পুনম,পর্বঃ ৩৪,৩৫

পুনম,পর্বঃ ৩৪,৩৫
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ ৩৪

পুনম মূক হয়ে বসে আছে।চারপাশে এত আলো থাকা স্বত্বেও সবকিছু অন্ধকার লাগছে।হসপিটাল করিডোরের এক কোণের চেয়ারে বসে অনবরত নিজের এক পা দিয়ে আর এক পা খুঁটে যাচ্ছে! বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে!
গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে!
মাত্র পাঁচদিনেই পুনমের জীবন আমূল বদলে গেছে।নিদ্রাহীনতার জন্য চোখ মুখ বসে গেছে।চুল রুক্ষ। ঠোঁটের হাসি মুছে গেছে।বাতাসে ফিনাইলের গন্ধ!
পাশ থেকে একজন মহিলা বলে ওঠে,
” তোমাকে দেখতে অসুস্থ মনে হচ্ছে, তুমি কি ঠিক আছো?”
পুনম ফ্যালফ্যাল করে সেই মহিলার দিকে তাকায়।কি আশ্চর্য!একজন অপরিচিত মহিলার কপালে ওর জন্য চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে!মহিলা উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে। পুনমের বলতে মনে চাচ্ছে, ” আন্টি আমি ঠিক নেই।একদম ঠিক নেই।আমার প্রেশার ফল করেছে।মাথা ঘুরাচ্ছে! ” এত কথা মনে মনে বললেও মুখ ফুটে পুনমের একটি কথাও বলা হয় না।শুধু তাকিয়ে থাকে উদ্ভ্রান্তের মত।মহিলাটি কতক্ষণ জবাবের আশায় থেকে উঠে যায়।

পুনমের মনে আছে তার দাদু বলতো, ” শোন বু, বিপদ-এরা হইলো সাত ভাই!বিপদ যখন আসে তখন একা আসতে পারে না।তারা সাত ভাই একসাথে আসে! ”
পুনম তার দাদুর কথা শুনে হাসতো। আজ মনে হচ্ছে তার দাদু ঠিকই বলেছে।যখন কোন বিপদ আসে তখন একা আসে না সাথে আরো দু-চার বিপদ সঙ্গে নিয়ে আসে। নাহলে কি এতগুলো বিপদ হুট করে আসতে পারে? পারে না।
চিন্তায় চিন্তায় পুনমের মাথার রগ দপদপ করে। হাত পা ঠান্ডা আসে।এত গুলো টাকা কোথায় পাবে পুনম?কানে ভাসছে এখনো ডাক্তারের বুলি। ” দেখুন পুনম,কিডনি ফেইলিওর হয়েছে আপনার মায়ের।এই সমস্যাকে আমরা ডাক্তারের ভাষায় বলি রেনাল ইমার্জেন্সি।গুরুতর ক্রনিক কিডনি ডামেজে আক্রান্ত আপনার মা।এই সমস্যা ৭০/৮০ ভাগ ভাবে শরীরকে পুরোপুরি কাবু করার আগে বুঝা যায় না।উচ্চ রক্তচাপ,ডায়বেটিস জনিত সমস্যা, হাত পা ফোলা,বেশি বেশি ব্যথার ঔষধ সেবন,হুট করে অজ্ঞান হওয়া ইত্যাদি এই রোগের উপসর্গ!আপনার মায়ের একটা কিডনি পুরোপুরি ড্যামেজ আর একটির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।চিকিৎসা সময় মত না হলে জীবননাশের হুমকি আছে আপনার মায়ের।আর চিকিৎসাটাও কিন্তু ব্যয়বহুল!আমরা খুবই দুঃখিত! ”

পুনম কথাগুলো শুনে এতটাই অবাক হয়েছিল যে তাৎক্ষণিক কি অনুভূতি ব্যক্ত করবে ভেবে পেলো না।পুনমের হতবাক অবস্থা ভেঙে পুনরায় ডাক্তার বললেন, ” মিস পুনম, আপনাদের হাতে সময় খুব কম।তাই সিদ্ধান্তটা জলদি নিবেন আশাকরি।আপনার মায়ের পরিস্থিতি বিবেচনা করেই আমরা এতটা উদ্বিগ্ন! ”

কথাগুলো চিন্তা করেই পুনম ফের দুচোখের পাতা বন্ধ করে।যেন কোন দুঃস্বপ্ন! কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন নয়! তার বোকা সোকা মা আজ হসপিটালের বেডে পড়ে আছে।যার দুনিয়াটা ছিল বেডরুম থেকে রান্না ঘর।তার অবস্থান আজ কোথায়?
এত এত দূর্ঘটনা মা নিতে পারে নি।হুট করে বাবার চাকরি চলে গেলো।এত বছরের চাকরি বাবার।রিটায়ার্ডের বাকি আর ক’মাস।তাকে কিনা বাড়তি অর্থ আত্মসাতের জন্য চাকরি থেকে বহিষ্কার করলো।যে মানুষটা চিরকাল সৎ ভাবে চলেছে।অর্থাভাবে কষ্ট করেছে।আজ কিনা তার এই দূর্গতি!বাবার চাকরি হারানোর সংবাদে মা পুরোপুরি ভাবে নিশ্চুপ হয়েগিয়েছিলো। আর তার পরের দিনেই মেজ দুলাভাইয়ের খুনের দায়ে জেলে যাবার সংবাদ!পুনমের পুরো পরিবারটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে গেছে।
জামাল ভাই বার বার বলছিল, আমি খুন করিনি ঝুমা! আমি খুন করিনি!
কারখানায় একটি লোকের সাথে কিছুদিন আগে একটা গেনজাম হয়েছিল মেজ দুলাভাইয়ের সাথে। আর সেই লোক ছুড়ি আঘাতে খুন হয়েছে।আর তার দায় সম্পূর্ণটা এসে পড়েছে মেজ দুলাভাইয়ের উপর। ঝুমা আপার অবস্থা শোচনীয়! মা এই সংবাদ শোনার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়লো।তাকে হসপিটালাইজ করার পর জানা গেলো মায়ের অবস্থা ভালো নয়।

******-*
সন্ধ্যা হয়ে গেছে পুনমের বাসায় ফিরা উচিত। কিন্তু ফিরতে মন চাইছে না।নিজের বাসায় নিজের দমবন্ধ লাগে।বাবার নির্বাক চাহনি, মেজ আপার স্বামীর জন্য আহাজারি,সেজ আপার কান্না এত সব কিছু ভালো লাগে না পুনমের।কোথাও কোন পালানোর জায়গা পেলে পুনম অবশ্যই এই অবস্থা থেকে পালিয়ে যেতো।বা এমন কোন গর্ত যদি পাওয়া যেত যেখানে লুকালে এতগুলো মানুষের শোচনীয় অবস্থা দেখতে হতো না।কিন্তু এমন স্থান নেই!কোথাও নেই!
সবাই কাঁদে পুনমের কাছে কিন্তু পুনম কাঁদবে কার কাছে গিয়ে?

*********-*
সুমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে হসপিটালে।পুনম দেখতে পায় সুমন ভাই কাঁদছে।কিন্তু কেন কাঁদছে? জানতে মন চাইলো না।জানতে চাওয়া মানে নতুন একটা দায়িত্ব টেনে ঘাড়ে তোলা।এত বোঝা বইবার ভার আর নেই!

সুমন সেই কতক্ষণ থেকে কেঁদেই যাচ্ছে পুনমের পাশে বসে।এ কেমন পুরুষ মানুষ?পুনম বিরক্তি নিয়ে বলে,
” সুমন ভাই কানের কাছে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদবেন না।কাঁদার হলে দূরে গিয়ে কাঁদুন। ”

সুমন আতংকিত স্বরে বলে, ” পুনম ভাইজান বিয়ে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে।ইষ্টি মিষ্টিকে রেখে ভাবিকে বাসা থেকে মেরে পাঠিয়ে দিয়েছে ভাইজান।ভাবি এখন তোমাদের বাসায়।তার অবস্থা ভালো নয়,সে পাগলের মত আচরণ করতাছে।”

পুনম ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বিপদের ষোলকলা কি পূর্ণ হলো নাকি আরো আছে? তারপর সুমনের উদ্দেশ্যে বলে,
” গাধার মত কথা কেন বলছেন সুমন ভাই।বিয়ে করে মেয়ে নিয়ে আসবে না তো কি একটা ছেলে নিয়ে আসবে?”

সুমন ফের কাঁদতে থাকে। তার পুনমের জন্য মায়া হচ্ছে। এতটুকুন একটা মেয়ে। কি করে এই কঠিন সমস্যা থেকে পার পাবে পুনম?
চোখের সামনে শক্ত মেয়েটাকে তিলে তিলে কষ্ট পেতে দেখে সুমনের মরে যেতে মনে চাইছে।সম্পত্তি গুলো যদি সুমন তাড়াতাড়ি পেতো তবে সব বিক্রি করে হলেও পুনম নামের মেয়েটার পাশে দাঁড়াতো।কিন্তু মামলা মোকদ্দমা কি এতই সহজ?আজ এই ডেট তো কাল এই ডেট!শালার নষ্ট দুনিয়া!

পুনম উঠে দাঁড়ায়। সুমনের উদ্দেশ্যে বলে, ” সুমন ভাই, আপনি একটু মায়ের কাছে থাকবেন।আমি একটু হেঁটে আসি।আমার দমবন্ধ লাগছে। ”
সুমন মাথা দুলিয়ে হ্যা জানায়।পুনম ক্লান্ত পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে পড়ে। আজ কিছুতেই বাসায় যাবে না পুনম।বড় আপার মুখোমুখি কি করে হবে?আর মেজ আপা যখন জানতে চাইবে, ” পুনু রে তোর দুলাভাইকে এনেছিস?” তখনই বা কি বলবে? বাবার নত মস্তিষ্কের সামনে কি করে দাঁড়াবে? ছোট্ট লাবণ্যের অসহায় মুখের দিকে কি করে তাকাবে?

পুনম ধীরপায়ে হাঁটতে থাকে।সবার সব কিছু হয় পুনমের কেন কিছু হয় না।কেন?

*********
সোডিয়াম আলোয় সারা ঢাকার শহর আবরিত।ফুটপাতের এক কোণায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে পুনম।তার চোখের দৃষ্টি ঘোলা!রুক্ষ চুলগুলো বাতাসে উড়ছে! সুন্দর মুখটিতে হাজারো দুশ্চিন্তার ছাপ।কি করে সামনের ঝড়টা অতিক্রম করবে?ভেবে পায়না পুনম।যে বাবা সবসময় সাহস দিতো।আজ সেও নিশ্চুপ! পুনমের আজ আবার মনে হচ্ছে, এই দুনিয়ায় টাকার কাছে সবই তুচ্ছ! টাকার বিনিময়ে প্রিয়জনকে ধরে রাখতে হয়! দিশেহারা পুনম রাতের অন্ধকারে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।খুবই করুণ শোনায় সেই কান্নার আওয়াজ! যে মেয়েটা কখনই কাঁদেনি আজ সেও কাঁদছে।প্রিয় মানুষগুলোর একটু ভালো থাকার আশায় কাঁদছে! তার বোকা মায়ের মত তারও আজ আবদার করতে মন চাইছে, “কেন ভাইটাকে বাচিয়ে রাখলে না আল্লাহ?”
পুনম ফের চিৎকার করে কাঁদে।এই পাঁচটা দিন বাসার প্রতিটা মানুষের সামনে শক্ত থাকা পুনম আজ ভেঙে পড়েছে।ভীষণ ভেঙে পড়েছে।
অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পাগল নিষ্পলক ভাবে পুনমের কান্না দেখছে।দেখছে ফুটফুটে একটি যুবতী মেয়ের কান্নার দৃশ্য!
পুনম বিড়বিড় করে বলে, ” মি.তানভীর আপনি কোথায়? আপনি কি আমার হাতটা একটু ধরবেন?আমার ভীষণ ভয় করছে!ভীষণ ভয়!”

পুনম যখন অবচেতন মনে তানভীরকে খুঁজছে তখন সে নিজের ব্যবসার কাজে ইন্ডিয়া। তানভীর জানতেই পারলো না, তার পুনমি কতটা কষ্ট নিয়ে তাকে ডাকছে!

পুনম পাগলের মত তানভীরের নাম ধরে ডাকছে আর কাঁদছে।যেন তানভীর তার পাশে দাঁড়ালেই সে জিতে যাবে এই দূর্বিষহ যুদ্ধ থেকে।কিন্তু পুনম জানে না,এ গল্পটা পুনমের!একান্ত নিজের!যাকে একাই লড়তে হবে কোন সঙ্গী ছাড়া!

***********
টুং টুং করে ফোন বাজছে।পুনম হ্যালো বলতেই শুনতে পায়, লাবণ্য কান্নামাখা কন্ঠে বলছে, ” নয়াপু জলদি আসো।মেজ আপা ব্যথায় ছটফট করছে।আমার ভীষণ ভয় করছে।”

পুনম ফোন রেখেই হন্তদন্ত পায়ে দৌড়াতে শুরু করে।পুনম রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। তার চুল, ওড়না বাতাসে উড়ছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে।পুনম দৌড়াচ্ছে আর বিড়বিড় করে হিসাব কষছে, ” কত টাকা আছে ? মেজ আপার ডেলিভারি হবে তো তাতে?”

চলবে,

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৫

ঝুমার ছেলে হয়েছে।নাদুসনুদুস একটা রাজপুত্র! ধবধবে ফর্সা শরীরের দেবশিশু যেন! পুনম সারা রাত বাচ্চা কোলে নিয়ে বসেছিল।আশ্চর্য হয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে দেখেছে।এতটুকুন একটা শিশু অথচ কি প্রশান্তিময় মুখ! এত দুঃখের মধ্যেও শিশুটির আগমন যেন এক পশলা সুখের মত! মেজ আপা নিজের ছেলের মুখ দেখেই প্রথম যে কথাটা বললো তা হলো, “দেখ পুনু একদম তোর দুলাভাইয়ের মত দেখতে! মানুষটা নিজের সন্তানকে একবার দেখতে পেলো না!পুনু তাকে এনে দে,তাকে এনে দে।”
পুনম তার উত্তরে কিছুই বলেনি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বোনের কান্নামাখা মুখ দেখেছে।তার এই আপার জগত হলো তার স্বামী!
ঝুমার ভাগ্য ভালো,বাচ্চাটি নরমাল ডেলিভারিতে হয়েছে।ছেলে হয়েছে শুনে মাকে আর হসপিটালে রাখা যায় নি।কান্নাকাটি করে একসার করেছে।শেষে সুমন ভাই রাতেই বাসায় নিয়ে এসেছে।মা পুচকুকে দেখেই বলে উঠলো, ” ওরে পুনম, আমার চাঁদ এসেছে ঘরে।তোর ভাইও এরকম চাঁদের মত হয়েছিলো।”
মা একরাতেই অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে তার নাতিকে দেখে।একটু পরপর কাঁদছে আর বাচ্চাটাকে চুমু দিচ্ছে। লাবণ্য তো মাকে বারবার বলছে, ” মা দেখো বাবু বড় হয়ে নায়ক হবে।যে সুন্দর দেখতে।তোমার এই নাতি হাজার মেয়ের ঘুম হারাম করবে!”
মরিচা সারাঘর ছুটাছুটি করছে আর একটু পরপর লেবুপাতা আর মরিচ পুরছে,পাছে পুচকুর কারো নজর লাগে!
একমাত্র বাবা তার নাতির মুখ দেখে কোন উচ্চ বাচ্চ করলো না,শুধু তপ্ত দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
বড় আপা ঘরের দোর আটকে বসে আছে।মধ্যরাত পর্যন্ত কান্নাকাটি করলেও শেষরাতের দিকে ঘুমিয়েছে।
ইষ্টি মিষ্টি তাদের একমাত্র ভাইকে দেখতে পেলো না।পুনম বড় দুলাভাইকে কল করলেও ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করলো না।

********
অনেকক্ষণ বসে গোসল করেছে পুনম। শরীরটা হালকা লাগছে।গোসলের পর যেন পেটের খুদাটা মাথাচার দিয়ে উঠেছে।ফ্যানের বাতাসে নিজের ভেজা চুল মেলে দিয়ে মি.তানভীরকে কল দিলো পুনম।কিন্তু বারবার ফোনটা বন্ধ বলছে।শেষে রাজুকে কল করলো।রাজু একবারই রিসিভ করলো।পুনম ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলো তানভীরের কথা।জানতে পারলো তানভীর ইন্ডিয়া গেছে।রাজু যায় নি।পুনমের সুক্ষ্ম অভিমান হলো।মানুষটা যাওয়ার সময় বলে গেলো না কেন?এই তার ভালোবাসা?

পাবনী পেপে ভর্তা দিয়ে একপ্লেট ভাত নিয়ে এসেছে। সাথে মরিচ পোড়া।পুনম প্লেটের দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তার মানে ঘরের বাজার শেষ হয়েছে।এতদিনের অশান্তিতে বাজার করা হয়নি।আর বাবাও থম মেরে সারাদিন রুমে শুয়ে থাকে তাকে কিছু বলে লাভ নেই।
পুনম শান্ত ভঙ্গিতে ভাত মেখে খাওয়া শুরু করে।পাবনীর বুকের ভিতর মোচর দিয়ে ওঠে।পুনমের জন্য তার কষ্ট হয়।এত কিছু মেয়েটা একা সামলাবে কি করে?
পাবনীকে চিন্তিত মুখে চেয়ে থাকতে দেখে পুনম বলে,
” এত কি চিন্তা করছো সেজ আপা? ”
“আমার বড় ভয় করছে পুনম।বাবা ভীষণ নিশ্চুপ হয়ে গেছে।তোর চিন্তা হচ্ছে না?”
“কাল পর্যন্ত খুব টেনশনে ছিলাম পরে ভাবলাম চিন্তা করে তো কোন লাভ নেই।যে বিপদ দিয়েছে সেই উদ্ধার করবে শুধু আমাকে লড়তে হবে। বুঝেছো আপা?”
” তোর মত সবাই কেন হয় না, বলতো? ”
পুনম চুপচাপ শুনলো পড়ে বললো,” আপা এইযে খাবার খাচ্ছি, খুদার তাড়নায়! কোন শান্তি নিয়ে না।দিনশেষে আমারও ভয় হয় কিন্তু তোমরা ভেঙে পড়লেও আমি ভেঙে পড়তে পারি না।আমি শুধু এতটুকু জানি আমাকে লড়ে বাঁচতে হবে নতুবা মরতে হবে কিন্তু ভেঙে পড়া যাবেনা!”

পাবনী পুনমের কথা শুনে কেঁদে দেয়।একটুকুন একটা মেয়ে। কি করে সবদিক সামলাবে?
“সেজ আপা শুধু শুধু কেঁদো না তো।টিউশনে যাওয়ার আগে বাজার দিয়ে যাবো,তা রান্না করে রেখো।এসব ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না।”
পাবনী হালকা পায়ে উঠে যায়। পুনম তাকিয়ে দেখে সেজ আপা বেশিই খুড়িয়ে হাঁটছে।তারমানে পায়ের ব্যথা বেড়েছে।পুনম দেখেও কিছু জিজ্ঞেস করলো না।

***********
তারুণ লন্ডন যাওয়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।কাগজপত্র ঠিক করছে।কোন ভার্সিটিতে পড়বে তার ডকুমেন্টস ঠিক করছে।সবকিছু মিলিয়ে ভীষণ ব্যস্ত!লাবণ্যের সাথে রাগ করে গত কয়েকদিন কথা বলেনি তারুণ।আজ মনে হচ্ছে দুষ্টু মেয়েটার সাথে রাগ করে লাভ নেই।রাগের কিছুই বোঝে না।এই যে এতদিন একটা কল করলো না তারুণ কই সে তো একটাবার খবর নেই নি।এই তার বন্ধুত্ব? মোবাইলে ঠিকই নাচানাচি করতে পারে অথচ…..
ঠিক সেই মুহুর্তে লাবণ্য মেসেজ করে, “তারু বেবি, আমি তৃতীয় বার খালামণি হয়েছি।খুব সুন্দর একটা রাজপুত্রের খালামাণি!আজ কিন্তু আমি অনেক প্লেট ফুচকা খাবো আর বিল তুই দিবি।রাজপুত্রের খালামণি হওয়ার ট্রিট!”
তারুণ মেসেজ পড়ে হেসে দেয়।লন্ডনে যাওয়ার পর এই মেয়েটাকে ও ভীষণ মিস করবে!
আর কাকে মিস করবে ভাবতেই মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে।অবাক হয় তারুণ!বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে সে আর বাবার সাথে সখ্যতাও বেশি অথচ মায়ের মুখটা কেন ভেসে উঠলো?তবে কি মাকে বেশি ভালোবাসে?মায়ের কথা ভাবতেই প্রচন্ড খারাপ লাগছে তারুণের অথচ বাবার জন্য একটুও খারাপ লাগছে না। কেন? তবে কি কোথাও কোন ভুল হলো?

*********
পুনম অনেকক্ষণ থানায় বসে থাকার পর মেজ দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করার অনুমতি পেলো।মানুষটাকে দেখেই পুনমের ভীষণ খারাপ লাগলো আর পুচকুর মুখটা ভেসে উঠলো।জামাল একয়দিনেই অনেক শুকিয়ে গেছে।চোখমুখ কেমন বসে গেছে।পুনমকে দেখেই জামাল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।বারবার বলতে লাগলো, ” আমি কাউকে মারি নি পুনম,আমি কাউকে মারিনি।”
পুনম অনেকবলে তাকে শান্ত করলো।পরক্ষণেই আবার ঝুমা ঝুমা বলে কেঁদে উঠলো।পুনম মোবাইলে তোলা পুচকুর ছবি দেখালো।জামাল সেই ছবি দেখে আবার কতক্ষন কাঁদলো।ছবিতে হাত বুলালো,চুমু দিলো।শেষে বললো,” পুনম বাবুর গা থেকে কি নেফতানির গন্ধ আসে? ঝুমা তো সারাদিন তার গন্ধ শুঁকতো!”
কি অদ্ভুত প্রশ্ন!পুনম মাথা নাড়িয়ে না বললো।জামাল আবার কাঁদলো।তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করলো।পুনম তাকে কি স্বান্তনা দিবে ভেবে পেলো না।খুনের দায়ে জেলে গেলে কি এত সহজে ছাড়ানো যায়? তারউপর তো এ দেশে সত্য মামলার থেকে মিথ্যে মামলায় শাস্তি হয় বেশি! পুনম একরাশ চিন্তা নিয়ে থানা থেকে বের হলো।অবশ্য আসার আগে জামাল বলে দিলো তার ছেলের নাম রাখতে মুক্ত!পুনম তাকে আসস্ত করে এসেছে পুনম যেকোন উপায়েই তাকে ছাড়াবে।কিন্তু আদৌ সেই উপায়টা পুনমের জানা নেই!

***********
রাতে বাসায় ফিরবার আগে পুনমের নম্বরে একটা কল এলো।আনএক্সপেক্টেড কল যাকে বলে।তানভীরের বাবা কল করেছে তাকে।পুনম ভীষণ আশ্চর্য হলো।এই লোক তার কাছে কি চায় আবার?
পুনম কল রিসিভ করলো না।পরক্ষণেই একটা মেসেজ এলো সে নম্বর থেকে। ” অফারটা কিন্তু এখনো আছে।আই এম ওয়েটিং ফর ইউ!”
মেসেজটা পড়ে পুনমের কাছে সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো।রাগমিশ্রিত ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো।একটা মানুষ কতটা জঘন্য হলে এরকম কিছু করতে পারে।কোন অজানা কারণে তানভীরের উপরও রাগ হলো।সকালে যে মন তানভীরের চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল এখন সেই মন তানভীরের উপর বিষিয়ে উঠলো।বারবার মনে হতে লাগলো, এই ছেলেটা তার জীবনে না এলে আজ এরকম কিছুই হতো না!
তানভীরের চৌদ্দ গুষ্টিকে বিশ্রী সব গালি দিতে মন চাইলো! পুনমের সমস্ত স্বত্বটা বিষিয়ে উঠলো!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here