পুনম,পর্বঃ৪০,স্পেশাল পর্ব

পুনম,পর্বঃ৪০,স্পেশাল পর্ব
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৪০

রেস্টুরেন্টের একটা সোফায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে তানভীর। পুরো শরীর এলিয়ে আরাম করে বসেছে।পুরো রেস্টুরেন্ট খালি।একটা কেয়ার টেকার আছে সে হয়তো ঘুমাচ্ছে। তানভীর ঠিক করেছে আজ রাত এখানেই কাটাবে।মা বুবু রাজু সবাই মিলে বিয়ের পিছনে পড়েছে।দুদিন বাসায় ফিরবে না মনোস্তাব করলো তানভীর!
মোবাইলের ওয়াল পেপারে নজর পড়তেই পুনমের হাসি মুখের একটা ছবি ভেসে ওঠে। পুনমকে যতদিন ও দেখেছে তারমধ্যে হাতে গোনা ক’বার হেসেছে মাত্র ।ছবিটা কক্সবাজার লাবণী বিচে বসে আড়ালে তুলেছিল তানভীর! মোবাইলটা রেখে তানভীর চোখ বন্ধ করে,চোখের তারায়ও পুনমের মুখটা ভেসে ওঠে। কতদিন হলো যেন? হ্যা একবছর! পুনমের হিসেবে হয়তো তিনবছর কিন্তু তানভীর পুনমের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্না করেছে একবছর। তানভীর দু-হাত দিয়ে নিজের গাল ঘসে,চুল পিছনে ঠেলে খামছে ধরে।
তিনবছর আগে যখন পুনম বলেছিল, আর মুখোমুখি হতে চায় না।তানভীর মেনে নিয়েছে কিন্তু অদৃশ্য ভাবে পুনমের হাত ধরেছিল সে।না হলে কি মাত্র দশদিনে কেউ বাড়ি বেঁচতে পারে?কত কাঠখড় পুড়িয়ে, চেনাশোনা লোক ধরিয়ে বাড়ির ক্রেতার ব্যবস্থা করে রাশেদ ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছে এরপর তো জামালের জন্য বেষ্ট ক্রিমিনাল লয়ার, সাক্ষী কতকিছুই না আড়াল থেকে করেছে তানভীর। তার পুনমিকে তো কখনো একা ছাড়েনি।যেদিন গুলো তে পুনমের পরিক্ষা হতো সেদিন গুলো আড়ালে থেকে দাঁড়িয়ে সাপোর্ট করতো,একমনে দোয়া করতো।

এই সম্পর্কে তানভীর যদি এগিয়ে থাকে দশ পা তবে পুনম এগিয়েছে এক পা।তানভীর শুধু অপেক্ষায় আছে পুনমের বাকি ন’পা ফেলার।এবার পুনম এগোবে তার দিকে।সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে চিন্তা করে পুনমকে আসতে হবে তার কাছে পাছে সামনে কোন ঝড় হলে পুনম হাত ছেড়ে না দেয়।এই সম্পর্কের দায়িত্ব এবার পুনমের।তাই তো একবছর ধরে কোন খবরই রাখেনি পুনমের।পুনমকে সব পিছুটান ফেলে এবার এগোতে হবে।একা একা আর কত সম্পর্কের রশি টানবে?
ঠিক সেই মুহুর্তে মাহির কল আসে তানভীরের ফোনে।
—হ্যালো!
—কি করছো তানভী?
—বসে আছি।
—-বসে আছো নাকি পুনমকে ভাবছো?….চিকন স্বরে বলে মাহি।
—দুটোই!…হেসে উত্তর দেয় তানভীর।
—-জানো তো পুনম খুব লাকি।
—উহু…আমি খুব লাকি!…..বলে তানভীর আবার গালে ভাঁজ পড়া হাসি দেয়। ঠিক সেই মুহুর্তে তানভীরের হাসিমুখ মুছে গিয়ে চোখে মুখে বিস্ময় দেখা দেয়।গোলাপি সালওয়ার কামিজে জর্জেটের হলুদ ওড়না গলায় জড়ানো।এলোমেলো বেণী।হাতে অর্ধেক উঠে যাওয়া মেহেদি। চোখে মুখে এক আকাশ রাগ নিয়ে পুনম কাঁচের দরজা ঠেলে রেস্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করেছে।পিছনে পিছনে বল্টু উদ্ভ্রান্তের মত ছুঁটে আসছে।তানভীর আঁতকে উঠে! সেকি মেয়েটা এত রেগে আছে কেন? পুনম কিছুটা এগিয়ে আসতেই তানভীর লক্ষ্য করে পুনমের নাকে মুক্ত পাথরের ছোট নাকফুল জ্বল জ্বল করছে।উফ!নাকফুলে তার পুনমিকে যে এতটা মারাত্মক লাগবে তা আগে কেন বুঝেনি তানভীর। পুনম একদম সামনে এসে দাঁড়ায় তানভীরের।পুনম লক্ষ্য করে তানভীর আগের থেকে শুকিয়েছে কিন্তু তাতে আরো ছোট মনে হচ্ছে বয়স!গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি চোখে বিস্মিত চাহনি আর মেরুন শার্টে পুরাই আগুন লাগছে তানভীরকে।
ফোনের লাইনে এখনো মাহি বিদ্যমান তাই তানভীর বলে ওঠে, “রাখছি মাহি!”
রাখছি মাহি বলতে না যতটুকু দেরি হয়েছে তার আগেই পুনম দশাসই একটা ঘুসি বসিয়ে দেয় তানভীরের নাক বরাবর!তানভীর আউচ বলে দূরে সরে দাঁড়ায়। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আশ্চর্য! কি করেছি আমি?মারলে কেন?”
পুনম হিসহিসিয়ে বলে, “মেরেছি কেন এখন সে কৈফিয়ত দিতে হবে?”
বল্টু এসে পুনমকে আগলে ধরে।এই মেয়ে আজ ক্ষেপেছে।তানভীর নাক ঘষতে ঘষতে বলে, “বল্টু তোমার বন্ধু একটা পাগল!”
পুনম তানভীরের চোখের সামনে আঙুল নাচিয়ে বলে, “একদম মুখ সামলে মি.তানভীর। নিজেই দোষ করে আবার আমাকে পাগল বলা হচ্ছে। ”
তানভীর ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে।পুনম যে কোন কারণে রেগে বোম হয়ে আছে তা বুঝতে বাকি রইলো না। তাই খোঁচা মেরে বললো, ” তা তো আমাকে মুখ সামলে কথা বলতেই হবে জুনিয়র মেজিস্টেট সাহেবা।নাহলে দেখা গেলো দিন দুপুরে এসে আমার রেস্টুরেন্টে সিলগারা করে গেলেন।তখন এই অধমের কি হবে?”

এরপর তানভীর একটু এগিয়ে পুনমের রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে এক চোখ মেরে বলে উঠলো,”জানতাম না তো মধ্য রাতেও আপনাদের অভিযান চলে!নাকি এটা কোন বিশেষ অভিযান?এতটা বিশেষ মানুষ কবে হলাম জুনিয়র মেজিস্টেট সাহেবা? ”

তানভীরের বিশেষ ইঙ্গিতে পুনম পুরোই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। মারমুখী হয়ে আবার এগোতে নিলে বল্টু পিছন থেকে ঝাপটে ধরলো।তানভীর পুনমের এই নতুন আচরণে মিটমিটিয়ে হাসছে! তার ভালো লাগছে।পুনমের রাগ, শাসন সব ভালো লাগছে!প্রিয় মানুষের সবই ভালোলাগে?রাগ, অভিমান,হাসি, কান্না!সব!

পুনম বিড়বিড় করে কতগুলো গালি দিলো। হনুমান, কচ্ছপ, বিচ্ছু, লুচ্চা কোন গুলোই বাদ রাখলো না। তারপর সোজা পিছনে ঘুরে হনহনিয়ে হেঁটে বেঁড়িয়ে গেলো।তানভীর আবারও আশ্চর্য হলো।পুনমি তাকে লুচ্চা বললো কেন?লুচ্চামির আদৌও কিছু করেছে সে?

**********–

আজ হলুদ অনুষ্ঠান।কাল বাসায় যত মানুষ ছিল আজ তার দ্বিগুন।বিয়ে উপলক্ষে পুনম ছুটি নিয়েছিল তাই পুনম এই মানব অত্যাচার থেকে কোনমতেই বের হতে পারলো না।সকাল বাজে নয়টা।তাতেই মানুষ গিজগিজ করছে?এত মানুষ এলো কোথ থেকে পুনম ভেবে পেলো না।পুনম চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে সবার হট্টগোল দেখছে।পুনমের মনে হচ্ছে,এর থেকে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে পড়ালে ভালো হতো।বড় আপা এক কাপ দুধ চা দিয়ে গেলো।পুনম বরাবরের মত চুকচুক করে চা খাচ্ছে। পাশে বসে বাবা মুগ্ধ চোখ তাকিয়ে রইলো।চা খেতে খেতে পুনম লক্ষ্য করলো বাবা মা কথা বলছে না।কি ব্যপার? একটু খেয়াল করতেই দেখতে পেলো বাবা মা একজন আর একজনকে ভেংচি কাটছে। মারাত্মক ব্যপার!
এরপর ঝুমা আপার থেকে যা শুনলো তাতে পুনমের আক্কেল গুড়ুম! আজ ও কালকের জন্য বাবা মা দুজন দু’পক্ষ!মা সুমন ভাইয়ের মা হয়ে সব তদারকি করছে আর বাবা পাবনী আপার হয়ে সব তদারকি করছে।আর একটু পর পর একজন আর একজনের ভুল ধরছে।সর্বনাশ করেছে! আর মরিচা নাকি তাতে ঘি ঢেলে দেওয়ার কাজ ভালো মত করেছে।তারা এখন বেয়াই বেয়ান!তাই সকল দুষ্কর্ম করা যাবে বলে ধারনা দিয়েছে মরিচা।অলরেডি বাবার সব লুঙ্গিতে মা রঙ মেখে একটা বালতিতে চুবিয়ে রেখেছে।বাবা তার শোধ নিতে,মায়ের পানের ডালা সরিয়ে ফেলেছে। পুনমের এই প্রথম মনে হলো আয়োজন করে সেজ আপার বিয়ে হওয়াতে বরং ভালো হয়েছে…..

পুনম এই আয়োজনে চার চার লাগিয়ে দিলো।এপার্টমেন্টের সেক্রেটারিকে বলে পাশের খালি ফ্লাট টা চার দিনের জন্য বুকড করে ফেললো।এরপর ফোন নিয়ে একে একে সবাইকে কল করতে লাগলো।অনুষ্ঠান যখন হচ্ছে তখন ভালো মত হোক।তারিন আপার পরিবার,বল্টু,নাহিদ,শিমূল,শশী,বর্ষা,সাকিব,রিমি, আনোয়ার স্যার সবাইকে ইনভাইট করে ফেললো।
সুমন লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে বসে বসে হবু শশুর শাশুড়ীর রঙ্গ তামাশা উপভোগ করতে লাগলো।পাবনী আজ ভীষণ খুশি….এত আয়োজন তার বিয়ে উপলক্ষে ভাবতেই চোখে জল এসে যাচ্ছে। মা বাবা দুজন দু’ফ্লাটে অবস্থান নিল।মেজ আপা, পুনম ইষ্টি বাবার পক্ষে। বড় আপা আর লাবণ্য আর মিষ্টি মায়ের পক্ষে। মাঝখান থেকে মরিচা রেফারির দায়িত্ব নিল।
জামাল মুখ গোমড়া করে বসে আছে।সে বর্তমানে একটা মাত্র জামাই। সে কোন পক্ষে যাবে ভেবে পেল না।শশুর শাশুড়ীর দুজনের টানাটানিতে বাথরুমে ঘাপটি মেরে ছিল কতক্ষণ। তাতে বিশেষ সুবিধা হয়নি।তাকে টেনে হিচড়ে বেড় করেছে।কিছুক্ষণ পর জামাল শাশুড়ির দলে আর মুক্ত তার নানার দলে যোগ দিল।বাপ বেটা দুজনের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো।তারা একই দলের কেন হলো না সেই অভিযোগে মুখ ভারি করে রাখলো সারাদিন!

****************

বিকেল হতে না হতে সবাই এসে হাজির হলো।সব মেয়েদের অঙ্গে হলুদ পোশাক।যেন গাঁদা ফুলের সমারোহ! তারিন পুনমকে জড়িয়ে ধরে কতক্ষণ কাঁদলো,অভিযোগ করলো,পুনমের কাপড়ে নাক মুঁছলো।পরিশেষে রাশেদ ভাই অনেক বলে তাকে শান্ত করলো।এখন অবশ্য তারিন কাঁদছে না।সে এখন বড় আপার সাথে হলুদের প্রিপারেশন করছে। পুনমের মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো।শিমুল শশী এখনো ঝগড়া করছে।তবে বিষয় ভিন্ন। শশী সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। তাকে শান্তভাবে চলা ফেরা করতে বলাতে শশী ক্ষেপেছে।পুনমের অবাক লাগে, দুটিতে কলেজ লাইফে সারাজীবন ঝগড়া করে শেষে এসে বিয়ে করে নিল।
কিছুক্ষণ পর র্্যাবের উর্ধতন কর্মকর্তা শফিক ভাইয়ের কল পেয়ে পুনম টিভি ছেড়ে আয়েশ করে বসলো।সারা বাড়িতে হলুদের আয়োজন অথচ পুনম মনোযোগ সহকারে টিভি দেখছে।টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে,” সনামধন্য ব্যবসায়ী হায়দার হোসেনকে দুজন নারী সহ মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র সহ গ্রেফতার করেছে র্্যাব ও ডিবির লোকেরা”” টিভিতে দেখা যাচ্ছে হায়দার হোসেনের শরীরের কুঁচকানো শার্ট, ধূসর প্যান্ট আর এলোমেলো চুলে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আইনের লোকেরা।হায়দার হোসেনকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে পুরোপুরি মদ্যপ অবস্থায় আছে।পুনমের ভীষণ শান্তি লাগলো।যাকে বলে প্রার্থনার মত বিশেষ শান্তি।গত সাত মাস ধরে একটু একটু করে হায়দার হোসেনের বিপরীতে তথ্য কালেক্ট করেছে ও। গুপ্তচর লাগিয়ে ইনফরমেশন জেনেছে।বর্তমানে হায়দার হোসেনের যে পি এ সে পুনমের বন্ধু এবং একজন সাংবাদিক! খবরে আরো বলা হচ্ছে, ” এইমাত্র আমরা জানতে পারলাম,আশরাফ হোসেন যে হায়দার হোসেনের বড় ভাই তার মৃত্যুর পিছনেও হায়দার হোসেনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।এবং তার বিপরীতে সিরিয়াল রেপিস্টের অভিযোগ পাওয়া গেছে।”
পুনম হেসে উঠলো।জ্বলন্ত হাসি যাকে বলে।তারপর মোবাইল দিয়ে একটা টেক্সট পাঠালো,”শফিক ভাই অনেক ধন্যবাদ! এতটা সাহায্য করার জন্য। আর মেয়ে দুটোকে কিছু টাকা দিয়ে মুক্তির ব্যাসথা করে দিবেন ওরা পতিতা হতে পারে কিন্তু আজ ওরা সাহায্য না করলে কিছুই হত না।”

একটু পরই শফিক রিপ্লাই দিলো, “ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য ম্যাডাম।তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ছিল আমাদের চেক লিষ্টে কিন্তু শক্ত কোন প্রমাণ ছিল না।আপনি প্রমাণ যোগারের ব্যবস্থা না করলে রাঘব বোয়াল ধরতে পারতাম না।এবার দেখতে থাকেন ম্যাডাম এক বড়শিতে কত মাছ গাঁথে!”

পুনম টিভি থেকে চোখ সরাতেই দেখতে পেলো তারিন বিস্ফোরিত চোখে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।পুনমের এবার একটু খারাপ লাগলো।নিজ বাবার অপকর্ম দেখা কষ্টকর!কিন্তু তারিন পুনমকে অবাক করে দিয়ে বললো, “পুনম আমার শাড়িতে সেফটিপিন মারতে হবে।একা পারছি না।তুমি কি একটু সাহায্য করবে?”
পুনম মুহূর্তেই হেসে ফেললো।তারিনকে শাড়ি পড়াতে পড়াতে চিন্তা করলো একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে তার মেয়ে নিজ বাবার গ্রেফতারে কোন শোক পায় না!

********
হায়দার হোসেনের গ্রেফতারে তানভীর একটু চমকালো। কিন্তু কোন কষ্টের লেশমাত্র পেল না।মানুষটা নামেই বাবা ছিল কিন্তু কোনদিন বাবার ভূমিকা পালন করেনি।তানভীর ভেবেছিল বাসায় যাবে না কিন্তু এই সংবাদে কি হলো কে জানে তানভীর দুটো সিদ্ধান্ত নিলো।এক বাসায় যাবে এবং মায়ের জন্য বউমা আনবে।
তানভীর কলিং বেল বাজাতেই রাজু দরজা খুললো হাসিমুখে।তানভীরের একটু চিন্তা হলো।মা কি এখনো সংবাদ পায়নি নাকি?কিন্তু পরক্ষণেই তানভীর টের পেলো সারা ঘর বিরিয়ানির সুগন্ধে মোঁ মোঁ করছে।খাবার টেবিলে অন্তত সাত রকমের খাবার আইটেম।তার মধ্যে তানভীরের পছন্দ শুটকি দিয়ে বেগুন ভাজাও আছে।আজ কি কোন বিশেষ দিন?তানভীর ভেবে পেলো না। কিচেনে প্রবেশ করতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো তানভীর! মা সালাদ কাটতে কাটতে নজরুল সংগীত গাইছে….কত দিন পর গাইলো।মায়ের কন্ঠে নজরুল সংগীত এত ভালো লাগে কেন?
তানভীরকে দেখেই শায়লা হাসি মুখে বলল, ” খোকা হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে আয়।আজ অনেক আইটেম খাবারের। আর কোনটাতেই কোন গন্ডগোল পাবিনা তুই!গ্যারান্টি!”

“আজ কি কোন বিশেষ দিন মা?”

“খুব বিশেষ দিন!”….বলে ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো শায়লা বেগম।

************
হায়দার হোসেনের গ্রেফতারে কারো আক্ষেপ না হলেও একটা ছেলের চোখ ভিজে উঠলো।বুকের ভিতর আগুনের কুন্ডলী পাকালো।হাত পা কাঁপলো,বুক কাঁপলো!সুদূর লন্ডনে বসে তারুণ নামের ছেলেটা নিজ মনে বারবার বলতে লাগলো, ” কেন করতে গেলে বাবা এমনটা?তোমার কষ্টে আমার কেন কষ্ট হচ্ছে? তুমি তো আমাকে কখনো ছেলে বলেই মানো নি।তবে কিসের এত কষ্ট লাগছে? মুখফুটে একবার বলতে সব লিখে দিতাম আমি…. আজ তোমার সব থেকেও কেন শূন্য হলে?”

******************
পুনমের পরিবারে যখন হলুদের আয়োজন হচ্ছে। তানভীরের বাসায় যখন মা ছেলের বিশাল খাবারের আয়োজন তখন জেলের আধো অন্ধকার ঘরটিতে হায়দার হোসেন শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন নিজের দিকে।নিজেকে তার অচেনা লাগছে!এই প্রথম তার মনে হলো তার সম্পদের জগতে তার কোন প্রিয়জন ছিল না।ঠিক তখনই বুকের ভিতর সুক্ষ একটা চিন চিন ব্যথা শুরু হলো আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটা মুখ!তিনি বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন, তারুণ! আমার তারুণ!

জানিনা কেমন হয়েছে?কোন ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সকলে।

চলবে,

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
#স্পেশাল পর্ব

পাবনীর হলুদ পর্ব শেষ হয়েছে দু’ঘন্টা হলো।এখন সবাই মটকা মেরে ঘুমাচ্ছে!বাহিরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে! ঝুম বৃষ্টি! পুনম নিজের ভারি পোশাক বদলে সাধারণ একটা পোশাক পড়ে।কড়া লিকারের দুধ চা বানিয়ে বারান্দায় এসে বসে।
যে দিনগুলোতে বৃষ্টি হয় সে দিন গুলোতে পুনম কিছুতেই ঘুমাতে পারেনা!মন, মস্তিষ্ক, চোখ সবকিছু অবাধ্য হয়ে ওঠে! একটা নাম তখন তারা বারবার জপে! তানভীর! তানভীর!
সেই বৃষ্টি ভেজা বিকেলটার কথা কি চাইলেও ভুলা যায়? শুভ্র পাঞ্জাবিতে যখন কাঙ্ক্ষিত পুরুষটা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল,তখন সবটা পুনমের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছিলো!যেন কোন ভয়ংকর স্বপ্ন! ঘুম ভাঙলেই নিজেকে আবিষ্কার করবে নিজের শক্ত পোক্ত বিছানায়!
কিন্তু পুনমের ঘুম ভাঙেনি কেননা গোটা ব্যপারটা অবাস্তব মনে হলেও স্বপ্ন ছিলনা কিছুতেই!
ঢাকা শহরে সেদিন ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল আর পুনমের মনেও!তানভীর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে।শুধু পুনমের হাত ধরা বাকি! সুঠাম দেহের আকর্ষণীয় তানভীর খুবই সহজ ভাবে ভালোবাসার আকুতি জানিয়েছিল পুনমের কাছে।তারপর তো ঘোরলাগা পুনমকে নিয়ে গিয়েছিল শাহবাগের এক কাজি অফিসে। চারদিকে তখন অজস্র বাতাস,বৃষ্টি!পুনমের হাতের ছাতা বাতাসের দাপটে পড়েছিল রাস্তায়! পুনম ঠকঠক করে কাঁপছিলো!বৃষ্টিতে নাকি ভয়ে? তা পুনম বুঝতে পারেনি!বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা পুনমকে ভিজিয়ে দিচ্ছিল!তিরতির করে কাঁপছিল! তানভীর এসে পুনমকে আগলে ধরে!পুরো রাস্তা জনশূন্য! তাই তানভীর নির্দ্বিধায় এসে পুনমকে কোলে তুলে নেয়! পুনম বড় বড় চোখ করে তাকালে তানভীর মাদকচোখে চেয়ে হেসে দেয়!পুনমের তখন নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়েছিল! পুনমের অস্থিরতা বুঝতে পেরেই তানভীর আরো শক্ত করে ধরে হাঁটা দেয়!ক ফুট দূরত্বে কাজি অফিস!
“আমাকে নামান মি.তানভীর! “…ছটফটিয়ে বলে পুনম!

বৃষ্টিতে ভিজছিল তানভীরের চুল, ভ্রুু, চোখ, ঠোঁট! কি অসহ্য সুন্দর দৃশ্য! পুনম চোখ ফিরিয়ে নেয়।তানভীর পুনমকে কোলে নিয়ে মৃদু হাঁটতে হাঁটতে বলছিল, ” রিলাক্স পুনমি!এত ছটফট কেন করছো?আমি না নামালে নামতে পারবে বুঝি?”
পুনম শান্ত হয়ে যায়।তানভীর মৃদুস্বরে বলতে শুরু করে, “পুনমি,আজ তোমাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।কোনদিন এই সস্পর্কের বোঝা তোমার পায়ে বেড়ি বাঁধবে না।তবুও আমাকে ফিরিয়ে দিও না পুনমি! আমি প্রতিটা মুহুর্তে তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় করি!আমার দমবন্ধ হয়ে আসে!শ্বাস নিতে পারি না!মৃত্যু যন্ত্রণাও বুঝি এর চেয়ে সহজ!আমার বলতে দ্বিধা নেই,তুমি আমার এমন মূল্যাবান সম্পদ যা হারালে আমাকে দেউলিয়া হয়ে ঘুরতে হবে!এত বড় শাস্তি আমায় দিও না পুনমি!আমি কথা দিচ্ছি, কখনো তোমাকে এই সস্পর্কের অধিকার নিয়ে কিছু বলবো না।শুধু তোমার নামের পাশে আমার নামটা জুড়তে চাই,হোক না তা লোকচক্ষুর অন্তরালে!তবুও স্বস্তি। পুনমি,আমার পুনমি!আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি নিজেকে নিয়ে ভয় পাই,আমার কারণে না তোমাকে হারাতে হয় তাই এখানে নিয়ে আসা।আজ তোমাকে নিয়ে হয় আমি কাজি অফিসে যাবো নতুবা তোমার সাথে আমার এই শেষ দেখা!হয়তো পৃথিবীতে আমার কিছু নিঃশ্বাস ফেলা বাকি!”
পুনম সেদিন তানভীরের কথায় পুরোপুরি কেঁপে উঠেছিল। কি ভয়ংকর কথা! পুনম কি করবে ভেবে উঠার আগেই তানভীর তাকে নিয়ে কাজি অফিসের সেই ছোট্ট রুমটায় প্রবেশ করেছিল।দুজন অচেনা স্বাক্ষী, একজন কাজী আর সামনে রাখা নীল কাগজের ফাইল।পুনম স্তম্ভিতের মত বসে ছিল।মাথা পুরোপুরি ফাঁকা!হাত দুটো কাঁপছিল! গলা শুকিয়ে আসছিল!পুনম খুবই মৃদুস্বরে উচ্চারণ করেছিল, “আমার বাবা!”। তানভীর পরম ভরসায় হাতের উপর হাত রেখে পুনমকে আসস্থ করেছিল।পুনম শূন্য চোখে তাকিয়ে দেখলো তানভীর ঘচঘচ করে কাগজে সই করে কাগজটি হাসি মুখে বাড়িয়ে দিয়েছিল পুনমের দিকে।কি নির্মল সুন্দর হাসি!পুনমের কান্না পেলো।এখান থেকে চলে যাওয়া মানে তানভীরকে হারিয়ে ফেলা।আবার এই কাগজটিতে সই করা মানে…. নিজেকে শপে দেয়া!
সকল ভাবনার দোলাচলে থেকেই পুনম সই করে দিয়েছিল।বাহিরে তখন ঝুম বৃষ্টি আর তানভীরের চোখেও বৃষ্টি নেমেছিল।তানভীর পুনমের হাত চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল।কাজী অবাক চোখে তাকিয়ে ওদেরকে দেখছিল। এতদিন দেখে এসেছে মেয়েরা কাঁদে আজ সে একটা ছেলেকে কাঁদতে দেখে প্রচুর অবাকই হলেন।তানভীরের কান্না পুনমের বুকে সুক্ষ্ম ব্যথার আলোড়ন তুললো।ঠিক সেই মুহুর্তে পুনমের মনে হলো,ও ভুল করেনি!বরং এই মানুষটাকে আজ ফিরিয়ে দিলে বড় ভুল হয়ে যেতো!

তানভীর তার কথা রেখেছিল।কখনো পুনমের সামনে স্বামী হয়ে দাঁড়ায়নি।বরং প্রেমিকরুপেই তার আগমণ হত বারবার! পুনম মাঝে মাঝে অবাক হত!আবার ভাবতো মি.তানভীর কি ভুলে গেছে তারা বর বউ?
তানভীর শুধু নিশ্চয়তা চেয়েছিল।পুনম নামের মেয়েটা শুধু তার এতটুকু নিশ্চয়তা তার কাছে অনেক কিছু।তানভীর নিজের বাবাকে জানতো,তাই খুব গোপনে পুনম নামের মেয়েটাকে নিজের নামের সাথে জুড়ে দিয়েছিল!

আর পুনম, নিজের ক্যারিয়ার আর পরিবারকে একটু গুছিয়ে তানভীরের হাতটা পাকাপোক্ত ভাবে ধরতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই সবটা এলোমেলো হয়ে গেলো!পুনম নিজের পরিবারকে ভালোবাসে সবকিছুর উর্ধে!তাই ভয় পেলো,তাদের বিয়ের খবরটা জানাজানি হলে সব শেষ হয়ে যেতো।তাই মি.তানভীরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো নিজের থেকে কিন্তু মন থেকে কি সরাতে পেরেছিল? প্রতিটা মুহুর্ত শুধু তানভীর নামক পুরুষটিকে ভেবেইে কেটেছে! পুনম অপেক্ষা করতো কিন্তু তানভীর তার বাক্যে অটল,সে ফিরলো না!না কোন অধিকার বা না কোন প্রেমিক হয়ে!
পুনম অস্থির হয়ে প্রহর গুনতে।হয়তো হুট করে একদিন তানভীর তার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, “পুনমি থাকতে পারলাম না তোমায় ছেড়ে।যা শাস্তি তোমার পাশে থেকেই দাও!তবু আর দূরে থাকতে বলো না!”
কিন্তু তানভীর ফিরলো না।এই তিনটা বছর কেটে গেলো।পুনমের যখন প্রচন্ড অস্থির লাগতো দূর থেকেই দেখে আসতো মি.তানভীরকে।এরপর সারাটাদিন কাঁদতো!কিন্তু কাল সকল ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেলো।গোপনে তাকে বিয়ে করবে আর প্রকাশ্যে অন্য মেয়ের চোখের প্রশংসা!তা কখনো হবে না!
কাপের চা ঠান্ডা হয়েগেছে অনেকক্ষণ। বারান্দা গলে বৃষ্টি এসে পুনমকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। পুনম গুনগুন করে কেঁদে উঠলো। বুকের উপর চাপ বাড়ছে,কষ্ট হচ্ছ! এরপরই পুনম পাগলের মত হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।কান্নার শব্দে পাবনীর ঘুম ভেঙে গেলো।সে ছুটে এসে দেখলো পুনম উদ্ভ্রান্তের মত হাউমাউ করে কাঁদছে!পাবনী ভীষণ ভয় পেলো!দৌড়ে এসে পুনমকে জাপটে ধরলো!পাবনী শুনতে পেলো পুনম কাঁদছে আর বলতাছে,” আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সেজ আপা!ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! তাকে ফিরতে বল তুমি!তাকে ফিরতে বল আমার কাছে!”
পাবনী বোকার মত বোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কতক্ষণ। তার বুঝে আসলো না পুনম কাকে ফিরতে বলছে?পাবনী কি তাকে আদৌও চেনে?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here