পুনম,পর্বঃ২১,২২
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২১
পুনম কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।মনটা অকারণেই খারাপ!কিছু সময় থাকে যখন কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়।আজও সেরকম দিন।অথচ আজকে একটা শুভ দিন।ঈদের দিন!আজ মন ভালো থাকার কথা।অথচ….পুনমের মন কেমন করছে।
ছোটবেলায় ঈদের দিন মানেই ছিল সাজুগুজু, সালামি আর নতুন পোশাকের ঘ্রাণ!ছোটবেলার ঈদ আর বড়বেলার ঈদ কখনোই এক নয়! পুনমের কাছে মনে হয়, ছোটবেলার সুখ,খুশি বড়বেলায় এসে সংক্রীর্ণ হয়ে যায়। যা ছোটবেলার আনন্দ তা বড়বেলার আফসোস!
লাবণ্যের ছোটাছুটির আওয়াজ শুনতে পায় পুনম।এই মেয়েটা একমুহূর্ত শান্ত থাকতে পারে না।এত চন্ঞ্চল!রান্নার ঘ্রান আসছে…মা আর সেজ আপা রান্না করছে।লাবণ্য এসে রুমে প্রবেশ করে বলে,
—-এই নয়াপু ওঠো না…নয়াপু আমার সালামী দাও।
পুনম ডাকে সাড়া দেয় না।এই মেয়ে সকাল থেকে সবার কাছে এমন ভাবে সালামী চেয়ে আদায় করছে যে মনে হচ্ছে চাঁদাবাজি করছে।পাঁজির একসার! পুনম সাড়া দেয় না, চোখবুঁজে শুয়ে থাকে।
—–এই নয়াপু ওঠো না….আমার সালামী কই….সবাই দিয়েছে এমনকি মেজ দুলাভাইও দিয়েছে!…ও নয়াপু এমন মটকা মেরে শুয়ে আছো কেন?…..ঢঙ করো না….ওঠো তো….. নয়াপু…..
লাবণ্য কাঁথা ধরে টানতে থাকে আর সাথে কথার ফুলঝুরি।
—-জ্বালাস না লাবু। আমার কাছ থেকে পরে নিস…এখন যা।
—-বাকির নাম ফাঁকি! বাকির কাজ লাবণ্য করে না।তুমি উঠবে নাকি আমি কান্না করবো……নয়াপু, আমার সোনা আপি দাও না…ওঠো না.. আমায় সালামী দিয়ে তারপর তুমি ঘুমাও….
—-মাখন লাগাবি না বেয়াদব।তুই তো সালামই করিস নি তারপর আবার টাকা চাইছিস?কত বড় রাজাকার রে তুই?
—-বাবা বলেছে পা ধরে সালাম করতে নেই। তার বদলে আমি তোমায় একটা কিসসি দেই……বলে লাবণ্য ফট করে পুনমের গালে চুমু দেয়। পুনম হেসে দেয় লাবণ্যের কাজে।
—-যা.. মরিচা আর ইষ্টি মিষ্টিকে ডেকে নিয়ে আয় একসাথে সালামী দেই।
পুনমের একথা বলতে যতটুকু দেরি হয়েছে তার আগেই পর্দার আড়াল থেকে এই তিনজনের বের হয়ে আসতে ততটা সময় লাগেনি। তারমানে এরা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল…. ইষ্টি মিষ্টি সালামী নিয়ে বের হয়ে যায় আর লাবণ্য কপালে থেকে ঘাম মোছার ভান করে। উফফ!কত কষ্ট করে টাকা নিতে হলো। হাতে টাকা পেয়ে মরিচার চোখে পানি চলে আসে, এই মানুষ গুলা এত ভালো কেন?ওর এই একুশ বছরের জীবনে এতটা ভালোবাসা কারো কাছ থেকে পাইনি ও। ষোল বছরে বিয়ে তারপর বাচ্চা না হওয়া, সতীন, তালাক সব কিছুর সামনা হয়েছে কিন্তু এত ভালোবাসা পায়নি।সকালে খালুজান যখন পঞ্চাশ টাকার নোট ওকে সালামী দিয়ে বললো, লাবণ্যের মত মরিচাও তো ছোট তবে এ পাবে না কেন?তখন মরিচার বুকের মধ্যটা খুব পুড়েছে।ওর খালি ওর বাবাজানের মুখটা ভেসে উঠেছে!
সারাদিন বাসায় না থাকার জন্য এখন পুনমের বাসায় থাকতে একটুও ভালো লাগে না। পুনম ঠিক করেছে আজকে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পুনমের গলার কাছটা জ্বলছে।পুনম নারকেল খেতে পারে না।কিন্তু সকালে মা জোর করে মলিদা খাওয়াইছে।মার মতে মলিদা ছাড়া আবার কিসের ঈদ? নারকেল দুধ আর চাল বেঁটে এই শরবত তৈরি হয়।যা পুনমের কাছে কুখাদ্য মনে হলেও মায়ের কাছে অমৃত! এখন কটা ভাত কচলে খেলে তবেই এই অসহ্য ঢেঁকুর আর জ্বলুনি কমবে। পুনম চুপচাপ হেটে গিয়ে খাবার টেবিলে বসে আগের দিনের রান্না করা ভাত বেড়ে খাওয়া শুরু করে। খেতে বসেই দেখতে পায় বাসার সব পুরুষ নামাজ পড়ে এসে সোফায় বসে কথা বলছে।তবে সুমন ভাইয়ের কথার দিকে কোন মনোযোগ নেই সে একমনে সেজ আপাকে দেখছে। আহাম্মক শুধু সারাজীবন দেখেই যাবে…. আর জামাল ভাই মেজ আপার পিছ পিছ ঘুরছে আর ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে কমলা শাড়ি পড়া মেজ আপার রুপের প্রশংসা করছে।মেজ আপা বিরক্তির ভান করে দুলাভাইকে বকছে কিন্তু মনে মনে মেজ আপা আদোও বিরক্ত কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে পুনমের।
**********************
রুমা ভারি কাতান শাড়ি পড়ে সেজেগুজে হারুনের সামনে চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়।হারুন একপলক রুমার দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে তাতে চুমুক দেয়। রুমার দিকে তার কোন মনোযোগ নেই।রুমার মেজাজ খারাপ হয়।হারুন বদলে গেছে….যে হারুনকে সে ভালোবাসতো সে হারুন এই ব্যক্তি নয়।আগে এই পুরুষের চোখে ছিল মুগ্ধতা কিন্তু এখন শুধুই বিরক্তি। রুমা রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে যায়। রুমার রাগ হারুনের মনে নাড়া না দিলেও জামিলা যে একটু আগে তাকে কল করে যেতে বলেছে তা ভেবেই সে পুলকিত হয়।চোখের সামনে ভেসে ওঠে জামিলার পাতলা ফিনফিনে নাইট ড্রেস পড়া অবয়ব! মেদহীন নগ্ন শরীর! ভেবেই রোমাঞ্চিত হয় পুরুষ স্বত্বা। রুমার স্থুলকায় শরীর হারুনকে প্রভাবিত করতে পারে না।এতটাদিন ওর শশুড় বাড়ি থাকার কারণই হলো জামিলা। নাহলে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুড়ায় তাদের কাছে পড়ে থাকবার লোক এই হারুন তালুকদার নয়।
পুনম যখন ঘুম থেকে জাগে তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতে শুরু করেছে। বড়সড় হাই তুলে এলোমেলো সজ্জায় ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করেই একটা বড়সড় ধাক্কা খায়! সোফায় শুকনো মুখে তানভীর বসে আছে।পুনম চোখ বন্ধ করে আবার মেলে।সেকি ভুল দেখছে।মরার মত ঘুমানোর জন্য কি সব উল্টা পাল্টা দেখছে…..তাই হবে হয়তে…তানভীর তাদের বাসায় আসবে কিভাব? বাবা গম্ভীর মুখে বসে আছে উল্টোদিকের সোফায় সাথে দুই দুলাভাইও উপস্থিত। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে পুনমের নজর আটকায় তানভীরের হাতের দিকে। সেকি!হাতের পাতায় ব্যান্ডেজ কেন?আর চোখও এত লাল কেন? কি হয়েছে?মানুষটাকে এত এলোমেলো কেন লাগছে? তার কি কোন কারণে মন খারাপ?
চলবে,
#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২২
তানভীর ঝোঁকের বসে পুনমদের বাসায় চলে এসে এখন অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে আছে।এতগুলো চোখের দৃষ্টি দেখে নিজেকে চিড়িয়াখানার বাঁদর মনে হচ্ছে।নিজেকে মনে মনে বকে যাচ্ছে।এখানে আসাটা একদম উচিত হয়নি।এখন এসে যখন পড়েছে আর কি করার?
হারুন তীক্ষ্ণ চোখে তানভীরকে পর্যবেক্ষণ করছে।দেখতে তো বড়লোকের ছেলে মনে হচ্ছে কিন্তু এর পুনমের সাথে কি সম্পর্ক?হারুন মনের কথা চেপে না রেখে দাম্ভিক কন্ঠে বলে,
—-তা মি.তানভীর আপনার পুনমের সাথে কি সম্পর্ক?
তানভীর প্রশ্ন শুনে উদ্ভ্রান্তের মত তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার কাছে ম্যাথম্যাটিক্সের কঠিন সূত্রের সমাধান জানতে চাওয়া হয়েছে।তানভীর ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে?আসলেই তো তার সাথে পুনমের কি সম্পর্ক?কোন সম্পর্ক কি আদোও গড়ে উঠেছে …কি বলবে? শুধু ভালোবাসলেই কি কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে? কি জানি?
—-কেমন সম্পর্ক বললে খুশি হবেন আপনি?
প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করায় অনেকটাই অবাক হয়ে যায় হারুন। হারুন কিছু বলতে চায় কিন্তু তার আগেই তানভীর বলে ওঠে নিয়াজ উদ্দিনের উদ্দেশ্যে,
—-আঙ্কেল আমি আগেই বলেছি আমার নাম তানভীর। পড়াশুনা শেষ করেছি আরো তিন বছর পূর্বে।আপাতত বেকার।বাবার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখলে অনেক কিছুর মালিক আমি আর যদি শুধু নিজেকে নিয়ে বলি তবে আমি পুরোপুরি শূন্য! তবে চেষ্টা আছে শূন্য থেকে কিছু করার। যদি বলেন এখানে কেন এসেছি? তার উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারবোনা। আর রইলো বাকি পুনমের সাথে আমার কি সম্পর্ক?এই প্রশ্নটির উত্তর আমি নিজেও খুঁজে বেরাচ্ছি….তবে আমরা দুজন দুজনের খুব পরিচিত।
নিয়াজ উদ্দিনের কেন জানি তানভীর ছেলেটাকে এক দেখায় ভীষণ পছন্দ হলো।মাথা ভর্তি স্ট্রেইট ঘন কালো চুল,ফর্সা গায়ের রঙ, ঘন পাপড়ির একজোড়া বড় শান্ত মায়াবী চোখ,গাল ভরা হালকা খোঁচানো দাড়ি,অসম্ভব মায়াবী মুখ যা সচারাচর ছেলেদের হয়না। আর লম্বা সুঠাম দেহের এক সুদর্শন পুরুষ যাকে এক দেখাতে সবার পছন্দ হবে।আর এখন কথার বাচন ভঙ্গি শুনে নিয়াজ উদ্দিনের বাকি টুকু পছন্দ হলো….তার পুনম যদি হয় অশান্ত স্রোত তবে এই ছেলে শক্ত বাঁধ!
নিয়াজ উদ্দিন তানভীরের কথার প্রেক্ষিতে কিছু বললো না। উল্টো প্রশ্ন করলো,
—-আপনার হাতে কি হয়েছে?ব্যান্ডেজ দেখতে পাচ্ছি।
—আমাকে তুমি করে বলবেন আঙ্কেল। আর গ্লাস মিররে আঘাত করার ফলে হাত কেটে গেছে।
জামাল হায় হায় করে উঠলো। বাবা অবশ্য কিছু বললো না।কেন আয়নায় আঘাত করলে? এটা ব্যক্তিগত বিষয়।যা জানতে চাওয়া মানে বিব্রত করা।তবে জামাল চিন্তিত কন্ঠে বললো,
—-ভালো করে ড্রেসিং করেছিলেন আপনি?এসব কাঁচ ভাঙা কিন্তু মারাত্মক হয়!
মরিচা এসে টি টেবিলে নাস্তা রেখে যায়।তানভীর এক গ্লাস পানি নিয়ে তাতে ঠোঁট ছোঁয়ায়।ঠিক সেই মুহুর্তে এসে পুনম সামনে দাঁড়ায়।সদ্য ঘুম থেকে ওঠা পুনমের চোখে হাজারো বিস্ময় তখন!
*********************
পাবনী চায়ের পাত্র চুলায় বসিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পানিতে বলক হচ্ছে….. প্রচুর মাথা ধরেছে.….সকাল থেকে মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাজ করেছে।পাও ফুলে উঠেছে। পুনম দেখলে রাগ করবে কিন্তু ওরই বা কি করার আছে মা একা একা সব কাজ করবে….ঘরে চাল শেষ হয়ে আসছে।বাবাকে বলতে হবে।বাবার হাতে টাকা আছে তো? কাগজের নোটের এত মূল্য যে তার কাছে সম্পর্ক, ভালোবাসা, বিশ্বাস সব ফিকে হয়ে যায়! যার টাকা নাই তার কিছু নেই।
—–পাবনী আমায় এক কাপ চা দেয়া যাবে?
রান্নাঘরের দরজা কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চায় সুমন ভাই। পাবনী একপলক তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। সুমন একই ভাবে দাঁড়িয়ে পাবনীকে পর্যবেক্ষণ করে।মেয়েটা আগের থেকে শুকিয়ে গেছে নাকি?চোখের নিচে কালো দাগ কেন? রাতে ঘুমায় না….পায়ের ব্যাথা কি বেড়েছে? এত এত প্রশ্ন বুকে এসে জমাট বাঁধে কিন্তু তার উত্তর জানতে বড় দ্বিধা!
পাবনী কালো সালোয়ার কামিজ পড়ে আছে ফর্সা গায়ে তা খুব সুন্দর মানিয়েছে।সুমনের বলতে মনে চায়,” একটুও সাজো না কেন মেয়ে? ”
—-পাবনী?
—হুম!
—এককাপ চা পেতে পারি আমি?
—আপনি রুমে যান আমি মরিচার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
—মরিচাকে তো দেখলাম লাবণ্যের সাথে বের হলো।আমি এখানেই ওয়েট করি।
পাবনী জবাব দেয় না।সুমন খেয়াল করে পাবনী তার দিকে না তাকিয়ে কথা বলছে।কিন্তু কেন?
—-পাবনী তুমি চুড়ি পড়নি কেন?আমি এত শখ করে কিনলাম।।সবাই পড়লো শুধু তুমি বাদ গেলে….
—চুড়ি আমার পছন্দ নয় সুমন ভাই!
—-কিন্তু আমি তো জানি তোমার পছন্দ।
পাবনী এবার সুমনের দিকে তাকায়।সুমন থমকায়! কি নির্লিপ্ত দৃষ্টি! পাবনী ওভাবে তাকিয়েই প্রশ্ন করে,
—-আপনি কবে থেকে আমার পছন্দ জানা শুরু করেছেন সুমন ভাই?
—–না মানে আসলে…..
—-এখন থেকে কোন কিছু প্রয়োজন হলে লাবণ্য বা মরিচাকে বলবেন।
—-আমি কি কোন ভুল করেছি পাবনী? তুমি রেগে কথা বলছো কেন?
সুমনের কন্ঠে ব্যাথার আকুলতা!
—-সুমন ভাই আমি রাগ করতে জানি না।একটা সময় অবশ্য রাগ করতাম….আর ভুল আপনি করেন নি।ভুল আমার! ল্যাংড়া পা নিয়ে জন্মানো ভুল!বিরাট বড় ভুল!
—-পাবনী!
—সুমন ভাই একজন পঙ্গু মানুষকে করুনা করা যায় কিন্তু তাকে নিয়ে মন্দিরে বসিয়ে পূজা করা যায় না!জানেন তো সাধনার বস্তু নিখুঁত হতে হয়!
সুমন স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকে।পাবনী চায়ের কাপ সামনে দিয়ে চলে যায়।পাবনী জানে সে অনেক কঠিন কথা বলে ফেলেছে। কিন্তু চারা গজানোর আগে বীজ নষ্ট করে দেয়াই উত্তম! পাবনী এতটা কঠিন কথা বলতো না।বড় আপা সেদিন যা বলেছে তাতেও পাবনীর কিছু যায় আসেনা। কিন্তু সুমন ভাই তার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে যা তার দৃষ্টিগোচড় এসেছে….
****************************
পুনমের গা গুলাচ্ছে।এই প্রথম সে তানভীরের সাথে তাদের গাড়িতে বসেছে।পুনম কেন জানি আজ সব এলোমেলো কাজ করছে।রাজু গাড়ি ড্রাইভ করছে আর বার বার আয়নায় পুনম তানভীরকে দেখছে।রাজু নিজেও হতভম্ব অবস্থায় আছে!
—রাজু ঠিক করে গাড়ি চালাও।এভাবে বার বার পিছনে দেখছো কেন?
পুনম তানভীরের গুরুগম্ভীর কন্ঠ শুনে চমকে ওঠে। কি আশ্চর্য! এই ছেলের আজ হয়েছে কি?
তানভীরকে বাসায় দেখেই পুনমের মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে গেছিলো।তারপর আর সে স্বাভাবিক চিন্তা করতে পারে নি। যখন নিজেকে একটু ধাতস্থ হয়ে জানতে চাইলো, এখানে কি করছেন আপনি?
তখন তানভীর উত্তরে কাতর কন্ঠে বলেছিল,—- তোমাকে খুব প্রয়োজন পুনম!প্লিজ… কাইন্ডলি আমার সাথে একটু বের হবে?
পুনম কি বলবে ওই মুহুর্তে ঠিক করতে পারছিল না।সোজা রুমে চলে এসেছিল। কি এমন প্রয়োজন থাকতে পারে? যে তানভীর ফোন না করে সোজা বাসায় চলে এসেছে…. জানার জন্য হলেও ওকে বের হতে হবে।চিন্তা হচ্ছিলো!আর বাসার সবার সামনে মুখের উপর বলতেও পারেনি আমি যাবো না। তাতে তানভীর ছোট হয়ে যেত।নিজের উপরই তখন মেজাজ খারাপ হচ্ছিল! এই ব্যক্তির প্রতি এত দরদ কিসের তার?
তখন বাবা রুমে এসে বলেছিল,
—-তুই ওভাবে বসে আছিস কেন?ছেলেটা তো ওয়েট করছে….
তখন পুনম কিছু বলতে পারে নি। যদি আজ না বের হতো তবে বড় আপা দুলাভাই অনেক পিন মেরে কথা বলতো। আর তা শুনে আমার মা চিন্তায় বিপি বাড়াতেন…..আসার আগে অবশ্য মাকে বলে এসেছে….মা বাসায় যেন কোন উল্টো পাল্টা কথা না বলে তোমার বড় মেয়ে….. মি.তানভীর শুধুই বন্ধু আমার।তাই তাকে ভরসা করতে পারি আমি।বের হচ্ছি…
পুনমের মেজাজ চূড়ান্ত রকমের খারাপ! এই ছেলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।আর তাকে কোথায়ই বা নিয়ে যাচ্ছে?জিজ্ঞেস করেছে দুবার কিছুই বলেনি।এখন মনে হচ্ছে আসাটাই ভুল হয়েছে।এই ছেলে কি হয় তার? যে বললেই চলে আসতে হবে….নিজেকে বিশ্রী গালি দিতে মনে চায়…..অসহ্য!
তার উপরে তার হাত ধরে আছে…উফফ!
তানভীর আজ ভীষণ চুপচাপ। গাড়িতে উঠেই সে পুনমের একটি হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে।পুনম কতক্ষণ হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। আর জোরে টান দিলে এই কচ্ছপ ব্যাথা পাবে।কি এক জ্বালা!তখন থেকে বাহিরে তাকিয়ে কি দেখছে? আল্লাহ মালুম….
—–আপনার সমস্যা কি প্লিজ আমাকে বলবেন?ওদিকে তাকিয়ে আছেন কেন?যদি ইগনোরই করবেন তবে আমাকে এনেছেন কেন?সোজা চলে গেলেন বাসায়, কেন? বাসার সবাই কি ভাবলো বলুন তো?আর কিসের প্রয়োজন আপনার আমাকে?মি.তানভীর… এদিকে ফিরুন বলছি….আমি কিন্তু এখন গাড়ি থেকে নেমে যাবো…..
তানভীর ফিরে তাকায় আর সাথে সাথেই পুনম স্তব্ধ হয়ে যায়।তানভীরের চোখ মুখ অসম্ভব লাল….কান্না আটকে রাখলে যেরকম চেহারা দেখায় সেরকম দেখতে লাগছে তানভীরকে। পুনম আহত হয়….মৃদু স্বরে বলে,কি হয়েছে আপনার?
তানভীর উত্তর দেয় না তবে আরো শক্ত করে ধরে পুনমের হাত!যেন বন্ধন আলগা হলেই পুনম চলে যাবে…..
পুনম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে বেশ বুঝেছে…তানভীর এখন কিছুই বলবেনা…..তাই হালছাড়া কন্ঠে বলে,
—ধীরে ধরুন,ব্যাথা পাবেন আপনি।আমি পালিয়ে যাচ্ছি না।
তারপর চোখবুঁজে সিটে মাথা হেলিয়ে দেয়……
*********************
তারিন ব্যস্তহাতে নাস্তা তৈরি করছে।চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করছে।রাশেদ তারিনের উজ্জ্বল মুখ দেখে প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলে।বড্ড ভালোবাসে এই মেয়েটিকে ও।আইনজীবি হয়েও এই বাড়িতে শুধু তারিনের আইন চলে।সংসারের দন্ডে দন্ডিত হতে রাশেদের মন্দ লাগে না!
—-ধীরে কাজ করো তারিন….এত তাড়াহুড়ো কেন করছো?তোমার ভাইতো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।
—-তুমি চুপ করো তো।মিতু কোথায়? ওকে দেখিয়েছো ওর মামিকে….
রাশেদ বিষম খায়! কিসব উল্টা পাল্টা কথা বলছে তারিন।
—-আস্তে কথা বলো। আর মামি কি?তানভীর কি বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে…যে বলছো মামি।
—-ঐ একই হলো। দেখেছো পুনমকে কত সুন্দর দেখতে।মাশাল্লাহ দুজনে রাজযোটক ।
—-আসলেই শালাবাবু জিতছে….মেয়েটা দেখতে বড়ই সুন্দর।
—-এই একদম বদনজর দেবে না।আমার ভাইয়ের জীবনে এতদিন পর খুশি এসেছে আমি চাইনা তাতে কারো নজর লাগুক। বুজেছো?
রাশেদ কপাল কুঁচকে তাকায়। সে কোথায় বদনজর দিল? প্রশংসাই তো করলো।তারিন ধমকে ওঠে,
—–এই খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছো কেন?একটা ট্রে হাতে নেও আমি আর একটা নিচ্ছি।
—-ভাইকে দেখে আমাকে যা তা বলা হচ্ছে না? মজা বুঝাবো পরে….
—–হ্যা হ্যা আমিও জানি তোমার দম কতটুকু? তো চাপা না ছেড়ে বরং আসো…..
রাশেদ ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে… বউ মানে জীবনটা তেজপাতা!
পুনম ভীষণ বিরক্ত! তানভীরের আক্কেল দেখে তব্দা মেরে গেছে।না বলে নিয়ে এসেছে বোনের বাসায়। আর বলার কথা আসছে কেন?ওকে এখানে আনবেই বা কেন?ভীষণ অস্বস্তি লাগছে।কি ভাবছে তানভীরের বোন? তবে তাকে দেখে খুবি আন্তরিক মনে হলো।দেখার সাথে সাথে কতক্ষণ জরিয়ে ধরে ছিল।মনে হচ্ছিল কত আপন মানুষ! তানভীর কে কোথাও দেখা গেলো না।সে এসেই ভিতরের রুমে চলে গিয়েছে যেন আনা পর্যন্তই তার দায়িত্ব!এই তার প্রয়োজন!
পুনম এখন বসে আছে তারিনদের ড্রয়িং রুমে।সোফার অপর পাশে একটা পিচ্চি মেয়ে বসে আছে।যে গোলগোল চোখে তাকিয়ে পুনমকে দেখছে।পুনম নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে সাধারণ একটা সুতি শাড়ি পড়া।আজ ঈদের দিন আর একটু ভালো মত বের হওয়া উচিত ছিল।কিন্তু তখন তানভীর কে দেখে সব এলোমেলো হয়ে গেলো।
**********************
পুনম এখন বাসায় ফিরছে, একাই ফিরছে।তানভীর আসেনি।গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে হাতে একটা কাগজ দিয়ে বলেছে, সাবধানে যেও।
ছোট্ট একটা বাক্য কিন্তু কি যেন ছিল কথার মাঝে।পুনম শুনে কেঁপে উঠেছিল! পুনম জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল, আপনি যাবেন না?তা বলা হয় নি।তার আগেই রাজু গাড়ি চলাতে শুরু করেছে।
কাগজটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরেছে পুনম। কি আছে তাতে লেখা?
এতক্ষণ সময়টা ভালোই কেটেছে।প্রথমে অস্বস্তি লাগলেও তারিন আপা খুব আন্তরিক ভাবে কথা বলেছে।আর যখন জেনেছে রাশেদ ভাই আইনজীবী। তখন তাকে বলেছে তার কিছু জরুরি কাগজ দেখানোর দরকার ছিল।রাশেদ ভাই তখন হাসতে হাসতে বলেছিল,
—-তুমি হলে গিয়ে আমার শালাবাবুর বন্ধু, তোমার জন্য এই বান্দা সেবায় সবার আগে রাজি।তোমার সময় করে আমায় জানিও।
পুরোটা সময় ভালো কাটলেও তানভীর কে দেখতে পায়নি একবারো।শুধু যাওয়ার সময় দেখা পেয়েছিল।
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।গাড়িটাও ধীর গতিতে চলছে।পুনম কাগজটা মেলে ধরে।গাড়ির ভিতর মৃদু আলো। তাতেই পড়ার শুরু করে,
পুনমি,
ভাবছো তো কেন তোমাকে চিঠি দিলাম?আসলে ঠিকভাবে তোমার সামনে আমি কথা বলতে পারি না।আবার ঢং ভেবো না। এই পুনমি,জানো তো আজ আমার বুকের ভিতর টা ভীষণ পুড়েছে। ধাউ ধাউ করে না।তুষের আগুন চেনো সেরকম।নিভু নিভু!কিন্তু ভীষণ পুড়ছে।
পুনমি আমি খুবই ত্রুটিপূর্ণ একজন মানুষ।তুমি চাও তোমার পরিবার সাথে ভালো থাকা আর আমি ছোটবেলা থেকে এই পরিবার থেকে দূরে যেতে চাইতাম।কিন্তু তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর মনে হলো সমস্যা থেকে দূরে গেলে সমস্যা কমে না বরং বাড়ে।
এই পুনমি তোমার মনে আছে,আমাদের প্রথম দেখা। আমি রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লাম।রাজু ছিল গ্রামের বাড়ি।আমি একা অসুস্থ একটা মানুষ রাস্তায় অনর্গল বমি করতেছিলাম।কেউ আসলো না এগিয়ে। কিন্তু তুমি এলে।তুমি আমার হাত ধরে কি বলেছিলে মনে আছে?
কষ্ট হচ্ছে আপনার?কিছু হবেনা। আমি আছি তো!
ওই একটা শব্দ শুধু আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল,আমি আছি তো! এভাবে আমাকে কেউ বলেনি।বিশ্বাস করো পুনমি।এতটা সাহস আগে পায়নি!
ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আমার বাবা একজন মদ্যপ মানুষ। নিত্যনতুন মেয়ে মানুষ চাই তার বিছানায়। মা মানা করলে তাকে খুব মারতো।বুবু প্রতিবাদ করতো কিন্তু কাজ হতো না।একসময় মা চুপ হয়ে গেলেন।বুবু বারবার মাকে বলতো,চলে যেতে ওই লোকটাকে ছেড়ে। মা তা করতো না।আসলে এখন বুঝি মায়ের যাওয়ার কোন পথ ছিল।মা মানসিক রোগীর মত পড়ে থাকতো ঘরের এক কোনায়। বাবা তখন মেয়েদের বাসায় আনা শুরু করলো।মায়ের চুপ থাকা আমি মানতে পারলাম না তাই তার সাথে রাগ করে কথা বন্ধ করে দিলাম।একসময় বুবু নিজের রাস্তা দেখলো। আর আমি অসহায় হয়ে পড়লাম। ডিপ্রেশনে চলে গেলাম আমি।তখন আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম….নিজেকে শেষ করে দেবো এই ভুত মাথায় চাপলো।সাত আট বার আত্মহত্যার চেষ্টা করলাম কিন্তু প্রতিটি বার আমি হেরে যেতাম।
এরপর তুমি এলে… যেকোন মূল্যে আমার তোমাকে চাই এরকম অবস্থা আমার হলো।পুনমি আমাকে সাহস দেয়ার মত কেউ ছিল না, তুমি আমার শক্তিতে পরিনত হয়েছো।আমার ভালো থাকার জন্য হলেও আমার তোমাকে চাই পুনমি!পুনমি বাবা একজন খারাপ মানুষ কিন্তু আমি তার মত হবোনা কখনো।
পুনমি তোমাকে জানার পর আমার ভালো থাকতে মনে চায় খুব!তুমি আমি মা বুবু আর তারুণ।আমার আর কিছু চাইনা।আমি তোমাকে চাই, তবে তুমি যেদিন চাইবে আমি সেদিন তোমায় গ্রহণ করবো।শুধু তুমি পাশে থেকো,অক্সিজেনে পরিনত হয়েছো আমার তুমি!
চাইলে ছাড়তে পারবো না।
পুনমি তোমাকে যেমন চাই তেমন আমি এখন মাকে ঐ লোকটার থেকে মুক্তি করতে চাই।জানি এর জন্য অনেক ঝর ঝাপটা আমায় সইতে হবে।যতযাই হয়ে যাক পুনমি তুমি আমায় ভুল বুঝবে না।
ঐ পিশাচ লোকটা কাল মাকে আবার মেরেছে পুনমি।আমি তা আজ সকালে জানতে পেরেছি।বাবাকে মারতে গিয়েও মারতে পারেনি তাই হাত দিয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে আঘাত করেছি।নিজেকে কাপুরষ মনে হয়েছে। ঐ লোকটা তোমায় আঘাত করতে পারে ভেবে আজ সারাদিন আমি অস্থিরতায় ছিলাম।মায়ের আঘাত, তোমার চিন্তায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম তখন তোমাকে আমার পাশে দরকার ছিল। নাহলে দমবন্ধ হয়ে মরে যেতাম বোধহয়। তোমার একটু পাশে থাকা আমায় স্বস্তি দেয় পুনমি।
আমি জানি আমি তোমাকে আমার সাথে জরিয়ে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। কিন্তু পুনমি তুমি তো মায়ের মত নও। তোমার কিছু হলে মরে যাবো একদম পুনমি।তাই দূরে থাকো তবু আমার থেকো!
যেদিন মনে হবে আমার পৃথিবীতে তোমাকে নিরাপদে রাখা যায় সেদিন না হয় তুমি আমার হয়েও! ভালো থেকো।
পুনশ্চঃ ঐ লোকটা আমার জন্য তার বন্ধুর মেয়ে পছন্দ করেছে। যে তোমার মত নয়।তুমি যেমন আমায় দেখে বিরক্ত হও সে তার উল্টো আমার গায়ে ঢলে পড়তে চায়।কিসব জামা কাপড় পড়ে বাসায় আসে, আমি কিন্তু কখনো সেভাবে দেখিনি…বিশ্বাস… তোমার গলার থেকে একটু বেশি নিচে ঐ লাল তিলটার কসম পুনমি!
ইতি
নবাবপুত্র
চলবে,