পুনম,পর্বঃ০৪,৫

পুনম,পর্বঃ০৪,৫
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৪

তারুণ কলেজ থেকে বের হয়ে দেখলো, একটা মেয়ে ছাতা দিয়ে একটা ছেলেকে মারছে।কি আশ্চর্য ঘটনা! ছেলেটাও পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে।একটা ছেলে হয়ে এই দৃশ্যটা দেখে ওর কেমন যেন লাগলো। দেখলো অনেকে দাঁড়িয়ে দেখছে আর মজা নিচ্ছে। তারুণ এগিয়ে গিয়ে দেখলো সাদা কলেজ ড্রেস পড়া একটি মেয়ে। চুলে দুটো বেণি করা তাও অগোছালো। কাঁধে কলেজ ব্যাগ আর হাতে ছাতা নিয়ে মেয়েটি ছেলেটাকে মারছে আর সমান তালে বকে যাচ্ছে। তারুণ ভিরের লোক দূর করে মেয়েটাকে থামিয়ে বললো,
——এই মেয়ে তুমি ওকে মারছো কেন? আর তুমিও বা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছো কেন?
সাদা কলেজ ড্রেস পড়া মেয়েটা আর কেও নয় লাবণ্য। লাবণ্য চিল্লিয়ে বললো,
—–মারবো না কেন? শালার কত বড় সাহস!আমার মেকাপ নিয়ে কথা বলে, এই লাবণ্যের মেকাপ নিয়ে কথা!
ও তো মার খাবে সাথে ওর চৌদ্দ গুষ্ঠি মার খাবে।চামচিকার নানা কোথাকার? বলে আবার একটা লাথি দিল লাবণ্য।
তারুণ আঁতকে উঠলো।কি সাংঘাতিক মেয়ে! নিজের বিস্ময় চেপে বললো,
—–মেকাপ নিয়ে কথা বলায় তুমি এভাবে মারবে?
—-লাবণ্যের কাছে লাবণ্যের মেকাপ হলো লাকি চার্ম। আর শুধু মেকাপের জন্য মারিনি এই চামচিকাকে।আমাকে বলে কিনা।আমি ফেল করা ছাত্রী, আমি মেকাপ ছাড়া আর কিছু পারি না।মেকাপ ছাড়া আমায় শয়তানের মত দেখায়। এরজন্য নাকি কেউ আমার সাথে রিলেশন করবে না তাই ওর সাথে রিলেশন করতে বলছে। শালা আমি কি তোর মত নকল টুকে পাস করি। আপনিই বলুন,মাত্র তিন সাবজেক্টে আমি নম্বর কম পেয়েছি তাই পাস করিনি তাই বলে আমি ফেল্টুস মার্কা মেয়ে? আর ও নড়বে কি একেবারে মেইন পয়েন্টে আগে মেরে কাবু করে ফেলেছি না।…..

তারুণের মুখ হা হয়ে গেছে এই সাংঘাতিক মেয়ের কথা শুনে, বলে কি এই মেয়ে? ওদের কথার মাঝখানে মার খাওয়া ছেলেটা উঠে চলে গেছে। লাবণ্য ছাতাটা মেলে ধরে তারুণকে প্রশ্ন করলো,
—-আচ্ছা আপনিই বলুন, আমি দেখতে কি অসুন্দর? আমাকে মেকাপে কি পেত্নির মত লাগে?

তারুণ ভারি দ্বিধায় পড়লো। সরাসরি কোন অচেনা মানুষকে এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে তা ওর ধারনার বাহিরে।তাছাড়া একটু আগে ছেলেটাকে যে মাইর মারলো তা ওর খাবার ইচ্ছে নেই কোন মন্তব্য করে।
লাবণ্য অবশ্য উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বললো,
—-আমার নয়াপু কি বলেন জানেন? বলে মেকাপ করাও একটা আর্ট।আর এটা সবাই পারে না।আর আমার নয়াপু কখনো ভুল বলে না। নয়াপু বলে, আমি হলাম মায়াবতী।আমি যখন মেকাপ করি তখন নাকি আমাকে দেবীদের রাণীর মত লাগে।

তারুণ খেয়াল করলো মেয়েটা দেখতে শ্যামলা। সকালে মেকাপ করছিল তা এখন ফেটে ফেটে গেছে একটু আগে রোদে মারামারি করার জন্য। তার মায়াবতী মনে হলো না কিন্তু ভালো লাগলো বিশেষ করে মেয়েটির চিবুক আর চিকন ঠোঁট দুটির কারণে। তারুণ প্রশ্ন করলো,
—নয়াপু কে?

—–আরে আপনি নয়াপু কে চিনেন না,কি আজব! সে আমার চতুর্থ বোন।তার নাম পুনম। কিন্তু আমার দাদু বলতো সে হলো নয়া।আরে মুখের হা বন্ধ করুন। আমরা পাঁচ বোন।তো দাদু বলতো, বড় মেজো সেজো নয়া ছোট। তো সেখান থেকেই আমি ডাকি নয়াপু।জানেন? আমার নয়াপু একদম বোম্বে নায়িকাদের মত।হেব্বি দেখতে!

তারুণের মনে হলো লাবণ্যের নয়াপুকে চিনতে না পারা মহা অপরাধের কাজ।তারুণের মাথায় চক্কর দিতে শুরু করেছে, এই মেয়ে বেশি কথা বলা মেয়ে।অচেনা একটি ছেলের সাথে এভাবে বলছে যেন কতদিনের চেনা!
তারুণ এবার বললো,
—-লাবণ্য তুমি কি আমাকে চিনো?

এতক্ষণে লাবণ্যের খেয়াল হলো এবং বললো।, চিনিনা তবে চিনবো,
—আমি লাবণ্য। আপনি?
—আমি তারুণ।এই কলেজে পড়ি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।সায়েন্স গ্রুপ।
—-আরে ব্রো আমিও তো সেইম তবে আর্টস। তো কাল দেখা হবে ভালো থেকো। আমি দেরি করে ফিরলে আমার খারুস বাপ টেনশন করবে তারপর আবার আজ ক্লাস টেষ্টের রেজাল্ট দিছে,ফেল মারছি।আমার যে কি হবে? বেঁচে থাকলে কাল তোমায় ট্রিট দিবো। আসি…. বলে দুলতে দুলতে ছাতা মাথায় দিয়ে চলে গেলো।তারুণ বুঝতে পারলো না এই মেয়ে আদোও টেনসড কি না!
*************************
সালেহা বেগম খাটের উপর বসে পান বানাচ্ছেন আর ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছেন।স্বামীর হাতে পানের খিলি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—-আপনি একজন দয়া মায়াহীন পিতা।আমার মেজো মেয়েটা যাওয়ার সময় বললো, বাবা আসি।আপনি একবারও থাকতে বললেন না।

নিয়াজ উদ্দিন পান মুখে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তার মাঝে মাঝে মনে হয় মৃত শাশুড়ী মাকে কবর থেকে উঠিয়ে এনে জিজ্ঞেস করি,
— আপনি আমার সাথে এই অন্যায়টা কেন করলেন?আপনার এই বোকা মেয়েকে কেন আমার গলায় ঝুলালেন।
নিয়াজ উদ্দিনের এখনো মনে আছে তার বাসর রাতের কথা।বিয়ের আগে একবার নাম মাত্র দেখেছিলেন সালেহাকে।বাসর ঘরেই তাদের প্রথম কথা।নিয়াজ উদ্দিন যখন বাসর ঘরে ঢুকে, এই মহিলা না কোন সালাম না কোন কুশল প্রথম যে কথা বলেছিল তা হলো,
—চুমু দিলে সাবধানে দিবেন আপনার গোঁফে যেন আমি ব্যাথা না পাই!হনুমানের পশমের মত আপনার গোঁফ!

নিজেই মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয় এই বোকা মহিলার সাথে সে এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলো।

তার মেজো মেয়ে ঝুমা শশুড় বাড়ি থাকে মাসের মধ্যে দশদিন আর বাপের বাড়ি বিশ দিন।দুদিন পর পর এই মেয়ে জামাই নিয়ে হাজির।ভালো কোম্পানির চাকরি দেখে বিয়ে দিয়েছিল মেজো মেয়েটার। আর তার জামাই দুদিন পর পর চাকরি ছেড়ে দিবে আর বউ নিয়ে ঘরে বসে থাকবে।তার নাকি চাকরি করতে ভালো লাগে না। সারাদিন মেয়েটার আঁচলে ঘুরবে আর মেয়েও পতিভক্ত কিছু বলে না জামাইকে চাকরি নিয়ে।তার মেয়েটা যেমন বোকা তেমন জামাইটা গাধা!বোকা আর গাধার সংসার!হুহ। শবে বরাতের আগে তারা এলো পাঁচদিন পর আজ গেলো।তাদের নাকি থাকতে বলবে।সে তো জানে দুদিন বাদেই তারা হাজির হলো বলে।
*************************

রাজু ড্রাইভিং করছে আর তানভীর স্যার তার পাশের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছে।তার স্যার একটু আগে বললো,
—–রাজু এখন তুমি সোজা পুনমের কাছে গিয়ে গাড়ি থামাবে।তার আগে গাড়ি থামালেই কঠিন শাস্তি!পুনমের দেখা পেলেই তবে আমায় ডাকবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?

রাজু বুঝতে পারছে না কি করবে?তার স্যার আজ পাঁচদিন পর বের হলো রুম থেকে।মূলত বলা যায় তাকে বের হতে দেয়া হয় নি।রাজু আজ ছয় বছর ধরে নামমাত্র তানভীর স্যারের পি এ।বড় স্যার মানে তানভীর স্যারের বাবা রাজুকে রেখেছে তানভীর স্যারের সকল খবর তাকে দেওয়ার জন্য।সারাদিন স্যার যা করে তা রাতে ঘুমানোর আগে বড় স্যারকে আপডেট দিতে হয়।রাজুর ভালো লাগে না।আগে তানভীর স্যার কখনো শাস্তি পায়নি,এই পুনমের জন্য একবছর যাবত শাস্তি পাচ্ছে। রাজুর বার বার মনে হয় মেয়ে মানে ঝামেলা।তার স্যার আগে কত নিয়ম মাফিক চলতো আজকাল তার স্যারের জীবনে সব উলোট পালোট। সেদিন পুনমকে ফুল দেওয়ার কারণে তানভীর শাস্তি হিসেবে পাঁচদিন ঘরবন্দী থেকেছে। তানভীর যখন ঘুমাচ্ছিলো তখন তার বাবা এসে ফোন নিয়ে যায় আর রুমের দরজা বাহির থেকে তালা দিয়ে রাখে।

রাজুর ভেবে অবাক লাগে তার স্যার এই পাঁচদিন কোন টু শব্দ করেনি।একবারও বলেনি দরজা খুলে দিতে। রাজু বার বার দরজার সামনে দিয়ে ঘুরে যেতো আর মনে মনে পুনমকে একশত ভাষায় একশত গালি দিত!

গাড়ি থেমেছে অনেকক্ষণ, তানভীর গাড়ীতে বসে পার্কে বসা পুনমকে দেখছে।হালকা গোলাপি রঙের কু্র্তি সাদা ওড়না আর জিন্স পড়নে পুনমের।কোন সাজ নেই মুখে তারপরও কি অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রী।তানভীর জানে না এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে কিনা?তাদের মধ্যে কোন প্রেমও নেই।বরং পুনম সবসময় ওকে দেখলে কপাল কুঁচকে কথা বলে।বিরক্তির ভাব ধরে থাকে। তবুও তানভীরের অহেতুক ভালো লাগে পুনমকে।এই যে পুনম নামের মেয়েটির জন্য সে শাস্তি পাচ্ছে তাতেও তানভীর আনন্দ খুঁজে পায়।যেখানে পুনম নামটি জড়িত থাকে সেখানে তানভীরের বিরাজ করতে ভাল লাগে।পুনম যখন মাথা নত করে ঠোঁট চেপে হাসে ঠিক সে সময় তানভীরের মনে হয়,এই মাত্র গ্রীষ্মের খরা প্রান্তরে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি নেমেছে!
পুনমের কপালে জন্ম টিপ পড়ানো।বিধাতা পরম যত্নে পুনমের দুধে আলতা মুখে দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানে একটা কালো কুচকুচে তিল বসিয়ে দিয়েছে।দেখলেই মনে হয় টিপ পড়েছে।

রাজু চরম বিরক্ত, তার স্যার বিগত দশমিনিট যাবত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। না নামছে গাড়ি থেকে না কথা বলছে।শেষে না পেরে বলেই উঠলো,
—–স্যার নামবেন না?
তানভীর পুনমের দিকে তাকিয়েই বললো,
—–বুঝলে রাজু, তোমার পুনম ম্যাম হচ্ছে টোটাল কারেন্ট বক্স।তার কাছে গেলেই শকড লাগে।শরীর ঝিমঝিম করে।আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।তাই নিজেকে প্রস্তুত করছি।
রাজু বোকার মত হা করে করে তাকিয়ে রইলো স্যারের দিকে।তানভীর আবার বললো,
—–শোনো রাজু, সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে আপনি যখন পুনমকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন কি আপনার মুড ভালো ছিলো? না হলে এই মেয়েটা এত নিখুঁত হলো কেন?হোয়াই? হোয়াই?

রাজু কেঁদে দিলো এবার, তার স্যার এই পাঁচদিন বন্দি থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তারউপর আবার ঠিকমত খাওয়া দাওয়াও করেনি এতদিন।সে কি করবে ভেবে পেল না?
—-স্যার আপনার কি ক্ষুদা পেয়েছে?
তানভীরের মনে চাইলো পুনমকে সামনে বসিয়ে খাবার খেতে তাহলে যদি তার রুচি ফিরে আসে।এখন তা সম্ভব না। পুনম একটু আগে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য চলে গেছে।পুনম কোচিং এর পর আধাঘন্টা সময় পায় পরের টিউশনিতে যাওয়ার জন্য।পথের মাঝেই এই পার্কটা পড়ে, তাই সে এখানে কিছুক্ষণ বসে রেষ্ট নিয়ে পড়াতে যায়।
তানভীর আবার সিটে মাথা এলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-রাজু তুমি এত সহজে কিভাবে কাঁদো? আমি তো পারি না। রাজু আজ তো আমি পুনমির সঙ্গে কথা বলিনি তবে তোমার বড় স্যারকে কি বলবে? সে কি এখন পুনমিকে দেখার জন্য আমার চোখও বন্দি করবে?

রাজু মাথা নত করে আছে, তার স্যারের বিরুদ্ধে বলতে মনে চায় না কিন্তু সে অসহায় যার নুন খায় তার সাথে গাদ্দারি কি করে করবে?
তানভীর আবার বলে,
—- রাজু মন খারাপ করো না।এটা তোমার কাজ। তবে আমি তোমাকে ভীষন পছন্দ করি।এখন গাড়িটা বুবুর বাসার দিকে নিয়ে যাও। অনেকদিন তাকে দেখিনা!

রাজু গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো,কিন্তু তার প্রেসার লো হতে শুরু করেছে। বড় স্যার যখন জানতে পারবে তানভীর স্যার তার বোনের বাসায় গেছে তখন তার স্যারের আবার কি শাস্তি হবে?রাজু বিড় বিড় করে বলে, মেয়ে মানেই ঝামেলা!

চলবে,

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৫

পুনম শিমুদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চেপে অপেক্ষা করছে, দরজা খোলার ।পুনম খেয়াল করেছে মানুষ কোথাও দশ মিনিট অপেক্ষা করলে তার মধ্যে সময় দেখে অন্তত তিন চারবার।এই যেমন সে এখন দেখতেছে, তার হাতের চিকন সুরু কালো বেল্টের ঘড়িটাতে জানান দিচ্ছে এখন ছয়টা পাঁচ বাজে।
দরজা খুললো শিমুর আম্মু। এই মহিলা সহজ সরল টাইপ।খুবই আন্তরিক!শিমু এবার ক্লাস এইটে। যেমন মেধাবী তেমনি ভদ্র।এই মেয়েটাকে পড়াতে শিমুর কখনো ঝামেলা পোহাতে হয়না।তাই সারাদিনের ছোটাছুটির পর এতটুকু টাইম পুনম স্বস্তিতে পড়াতে যেমন পারে তেমন রেষ্টও হয় ওর। পুনম শিমুকে পড়াতে বসলে,পুনমের আম্মু এসে বলল,
—–স্যরি পুনম কাল তোমায় ইনফর্ম করতে পারি নি।হুট করে বোনকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসলো।তুমি এসে ফেরত গেছো, রাগ করনিতো বোন?
পুনম ছোট্ট করে উত্তর দিলো, —-না ভাবি।
—–তুমি ওকে পড়াও আমি তোমার জন্য চা নিয়ে আসি তোমার ক্লান্তি কেটে যাবে দেখো।

পুনম শিমুকে প্যারাগ্রাফ লিখতে দিয়ে টেবিলের উপর দুইহাত সোজা করে রেখে নিজের মাথা চেপে নিচু হয়ে বিড় বিড় করে বলতে লাগলো,ভাবি দেহের ক্লান্তি না হয় আপনার এক কাপ চায়ে দূর হবে কিন্তু মনের ক্লান্তি দূর করে এমন চা কোথায় পাবো আমি?

গতকাল যখন শিমুকে পড়াতে আসে দরজা খুলে শিমুর বাবা।গত তিন বছর যাবত এ বাসায় পড়ায় পুনম।কখনো এই পরিবারে অসংগত আচরণ দেখেনি ও।মাঝে মাঝে শিমুর বাবাকে বাসায় পায় যখন পুনম পড়াতে আসে। পুনম বাসায় ঢুকে জিজ্ঞেস করে জানতে পায় শিমুরা বাসায় নেই। তখন ও চলে যেতে নিলে শিমুর বাবা খুব ভদ্র সহকারে একটি চাকরির প্রস্তাব দেয় ওকে।তার অফিসে তার স্যারের জন্য একজন পি এ লাগবে। পুনম খুশি হলো। একটা চাকরির ওর দরকার খুব! পুনম যখন বললো,
—–রফিক ভাই আপনি বলেন কখন আমার কাগজ পত্র নিয়ে আপনার অফিসে যেতে হবে?
পুনম খেয়াল করে দেখলো রফিক ভাই মিনমিন করছে। বুঝতে পারলো কোন ঘাপলা আছে।পুনম চেক করলো তার পায়জামার রবাটের কাছে যে ছোট চেইন সিস্টেম পকেট আছে সেখানে পুনম ছোট্ট চাকু রাখে,সেটা আছে কিনা? পুনম সাবধানে চেইনটা খুলে রাখে, কোন এদিক ওদিক দেখলে জাষ্ট জায়গা মত চাকু বসিয়ে দেবে।
কিন্তু অনেকক্ষণ পড়ে রফিক ভাই বললো,
—-পুনম তোমার কোন কাগজপত্র নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে না।আমি তোমার ছবি দেখিয়েছি।তাদের তোমায় পছন্দ হয়েছে।তুমি হ্যা বললেই চাকরি কনফার্ম।

পুনম হা করে তাকিয়ে কথা গুলো শুনলো। সার্টিফিকেট ছাড়া যে চেহারা দেখেই চাকরি হয় এযে কেমন চাকরি তা ওর বুঝা হয়ে গেছে। কিন্তু রফিক ভাই ওর ছবি পেলো কোথায়?
—ইয়ে পুনম আসলে ব্যাপারটা হলো কি তুমি তো পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হবে তাই তার সব কিছুই তোমার আন্ডারে থাকবে।আর তাছাড়া আজকালের দিনে এতো মানলে হয়,এরপর দেখবে উপরে ওঠার সিড়ি খুবই সহজ হবে তখন।
খুবই ভদ্রতার সহিত কথাগুলো বললো অভদ্র লোকটা।

পুনম উঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হেসে বললো, শুনুন রফিক ভাই আপনার ওয়াইফ কিছুদিন ধরে আমাকে বলছিল, তার বাসায় ভালো লাগে না,আপনি অফিসে চলে যান, আর শিমু স্কুলে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অল্প বলে চাকরিও করতে পারছেনা। আমি বরংচ এই অফারটা ভাবিকে দেই,তাকে বলি যে আজকাল শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না চাকরি নিতে ফর্সা আর ফিগার থাকলেই হয়।কি বলেন রফিক ভাই? আমাদের ভাবি তো আবার ঝাক্কাস সুন্দরী! আপনি আর সে একই অফিসে কাজ করলেন কারোই আর একা একা লাগলো না।ঠিকাছে?
পুনম হেসে হেসে কথা গুলো বললেও তার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ঝাঁজ বের হচ্ছিলো তখন।মনে মনে বিশ্রী গালি দিয়ে পুনম বের হয়ে আসে।

অন্যকেউ হলে এখানে পড়াতে আসতো না কিন্তু পুনম এসেছে।একে তো মাসের মাঝামাঝি টাইম তারউপর অন্য টিউশনি ঠিক করবে তারপর তো এটা ছাড়তে পারবে।আর চলে যেতে চাইলেও শিমুর আম্মুও ওকে যেতে দিবে না। পুনম ঠিক করেছে টিউশনির টাইমটা ঘুড়িয়ে নিবে অন্য টিউশনির থেকে আর একটু সাবধানে থাকলেই আর সমস্যা হবে না। এই টিউশনিটা থেকেই পুনম বেশি টাকা পায় তাই এই বদলোকের জন্য তো ছাড়বেই না। পুনম মনে করে এগুলো হলো বিষাক্ত পোকা যা প্রতিটি বাগানে থাকবেই তাই বলে কি কেউ বাগান করবে না।

পুনম দেখলো রফিক ভাই এসেছে, সে যে একটা ধাক্কা খেয়েছে পুনমকে দেখে তা নিশ্চিত।সে হয়তো ভেবেছিল পুনম আর আসবেনা। পুনম হেসে বললো, রফিক ভাই অল গুড?
এই কথাটা আগে রফিকের সাথে পুনমের দেখা হলে রফিক বলতো, পুনম অল গুড?
বের হওয়ার সময় পুনম দেখলো রফিক ভাই অনবরত কাশছে, কাশুক বেশি করে,ভালো মানুষের বেশে কতগুলো নোংরা পশু এগুলা!

রাস্তায় হাটতে হাটতে পুনমের মনে হলো মি.তানভীর কে একটা কল দিয়ে কথা বললে হয়তো ওর মন ভালো হবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, সে কি মন ভালো করার মেশিন? না তো। তবে তার সাথে কথা বললে মন ভালো হবে এই কথাটাই বা মাথায় আসলো কেন? আর মনে হওয়া কথা মনেই রাখতে হয়,সব ইচ্ছা মিটাতে নেই!

আর মি.তানভীর ওরফে নবাবপুত্র সেই বা কেন আজ ওর সামনে আসলো না? চুপে চুপে দূর থেকে ওকে দেখেছে, নবাবপুত্র মনে করেছে আমি জানবো না।কত বড় গাধা এই লোক, সেকি জানে না নবাব চিহ্ন বহন করে যারা তারা যেখানেই যায় তার ছাপ থেকে যায় আশেপাশে!
ঠিক সেই মুহুর্তে পুনমের ফোন বেজে ওঠে।ছোট্ট বাটন সেটটিতে ভেসে ওঠে নবাবপুত্র লেখা নামটি। পুনম কল কেটে দেয় এ লোকের সাথে এখন আর কথা বলতে মন চাচ্ছে না।
পুনম হনহনিয়ে হাটা শুরু করে পরের টিউশনির জন্য, এটা সে নতুনে এ মাসে নিয়েছে।সামনে রোজা, ঈদ। কত খরচ! তার উপর বড় আপারা আছে।বড় আপারা সহজে আসে না, আর একবার আসলে আর এক দুইমাসের নিচে যায় না। পুনম টের পায় ব্যাগের ভিতর তার ফোনটি অনবরত বেজে যাচ্ছে। বাজুক,ধরবে না ও ।হয়ে যাক অদৃশ্য ধৈর্য্য পরিক্ষার খেলা! দেখি কে জিতে? নবাবপুত্র আপনি নাকি
যাকে আপনি পুনমি বলে ডাকেন সে?

*********************
পাবনী ছাদের রেলিং এ হেলান দিয়ে রাতের আকাশ দেখছে, ও অনুভব করে ওর দু চোখ ভিজে উঠছে। পাবনী দেখতে সুন্দর তবে পুনমের মত ধারালো সৌন্দর্য তার নেই। পাবনী মাঝে মাঝে উপরওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে, একই মায়ের গর্ভে দুজনের বসবাস ছিল কিন্তু তাকেই কেন ত্রুটি নিয়ে জন্মাতে হলো? কিন্তু উপরওয়ালা জবাব দেয় না। পাবনীর সৌন্দর্য গুন সব ঢাকা পড়ে যায় একটি কথায়, পাবনীর পায়ে ত্রুটি আছে । ছোটবেলা থেকে সবাই ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে।ওকে কত সহজে সবাই লেংড়া বলে সম্বোধন করতো। সবাই দেখে ও চুপচাপ, গম্ভীর স্বভাবের কিন্তু কেউ কখনোই দেখতে পায়নি ও যখন ওর সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে খেলতে যেত তাড়া দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত।অন্যান্য বাচ্চাদের প্যারেন্টসরা তো বলেই ফেলতো খুব সুন্দর করে, পাবনী তুমি কাছে এসো না ওরা তোমাকে দেখলে ভয় পায়। কি সহজ কথা কিন্তু একটা বাচ্চার জন্য তা কতটা সহনশীল তা তারা বুঝতে চাইতো না। পাবনীর একটা পা অন্য পায়ের থেকে খাটো এবং কিছুটা বাঁকানো। তাই পাবনী খুঁড়িয়ে হাঁটতো। স্কুলে পড়ার সময় অনেকই বলতো আম্মুকে,
–ভাবি আপনার মেয়ে তো প্রতিবন্ধী। তাকে প্রতিবন্ধী স্কুলে দিলেই তো পারেন।
কি সহজ ভাবেই না তারা বলতো।অথচ শিশুদের মন কাঁচের পাত্রের মত হয়,অল্পতেই যা ভঙুর।ওকে ভিতর থেকে প্রতিবন্ধী করে দিতো মানুষ গুলো।নিজেদের আত্মীয় স্বজন কেউ বাদ থাকতো না।কেউ করুণা করত,কেউ তাচ্ছিল্য করতো, কেউ ঘৃণা করতো।অনেকে তো অপয়া বলতো।এত এত মানসিক আঘাত পাবনীকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে।পাবনী ছোট বেলা থেকে দেখেছে ওর আম্মুকে যখন সবাই ওর সম্পর্কে বলতো তখন ওর বোকা মা নিজের মুখ লুকাতো,মিন মিনিয়ে জবাব দিত তাদের। কখনো শক্ত গলায় তার মা বলেনি, —আমার মেয়ে ল্যাংড়া হোক খোঁড়া হোক সে আমার মেয়ে।আমি তাকে নিয়ে কি করবো তা আপনারা বলার কেউ না।
কিন্তু এই কাজ টা সবসময় পুনম করে এসেছে ছোটবেলা থেকে যেভাবে পারতো পাবনীকে সাহায্য করতো।ও তো ছোট ছিল তখন।একটু যখন বুঝতে শরু করলো তখন সবার কাছে বেয়াদব বলে পরিচিত হল পুনম।কেননা সে সেজো আপার হয়ে প্রতিবাদ করে কথা বলতো।
পাবনীর এখনো মনে আছে, তখন ওরা এইটে পড়ে। পুনম ওয়াশরুমে গেছিলো সেই সুযোগে ক্লাসের একটা দল ওকে নিয়ে অনেক উপহাস করছিল,পাবনীকে নিয়ে মজায় তারা এতটা ব্যস্ত ছিল তারা ওর কষ্ট কেউ দেখেনি বরং একজনে ওর অচল পায়ে স্যারের চেয়ার ফেলে দিয়েছিল। ছেলেটা বার বার চেয়ারটা পাবনীর পায়ের সামনে এনে একটু ফেলছিল আর ধরছিল ভয় দেখাবার জন্য ।অনেকবার পাবনী মানা করে, সরে যেতে চায় কিন্তু পারেনি। শেষে তো চেয়ারটা পায়ে পড়েই গেলো। পুনম এসে দেখে যখন তার সেজো আপা কান্না করছে আর সবাই দৌড়ে চলে যাচ্ছে। পাবনী যখন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কে মেরেছে সারা স্কুল মাঠ দৌড়ে সেই ছেলেকে ধরে একই চেয়ার দিয়ে সেই ছেলের পায়ে মেরেছে পুনম।
প্রিন্সিপাল রুমে নোটিশ দিল সব অভিবাকরা।সবার এক কথা পুনম বেয়াদব।পুরো স্কুলে গুন্জন, পুনম বখাটেদের মত একটা ছেলের পা ভেঙে দিয়েছে।
প্রিন্সিপাল যখন পুনমকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, পুনম প্রিন্সিপালের চোখের দিকে তাকিয়ে সাহসীর মত উত্তর দিলো,
— আমার বোনের ব্যাথা পায়ে যে আঘাত করেছে তার পা ভেঙে দিয়ে আমি কোন ভুল করিনি। বরং ও এখন আমার বোনের কষ্ট বুঝতে পারবে।
প্রিন্সিপাল স্যার অনেক্ক্ষণ পুনমের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে বলেছিল,যেহুতো সব অভিবাবক নোটিশ দিয়েছে তাই রুলস অনুযায়ী তোমাকে স্কুলে রাখা আমার সম্ভব নয়।তবে আমি এতটুকু তো বলতেই পারি, ওয়েল ডান ব্রেভো গার্ল!
এই হলো পুনম।সবাই ছি ছি করলো স্কুল থেকে বহিষ্কারের জন্য পুনমকে।শক্ত ভাবে উপস্থাপন হলো পুনম বেয়াদব। কিন্তু তাতে পুনমের কি। আমরা দুবোন যখন স্কুল থেকে টিসি নিয়ে বের হলাম বাবা তখন আমাদের আইসক্রিম কিনে খাওয়ালো,কাচ্চি খাওয়ালো।রিকশায় করে বাবার সাথে আমরা খুব ঘুরলাম।বাবার হাসি মুখ দেখে বুঝেছিলাম বাবা সেদিন খুব খুশি হয়েছিল!

পাবনীর এই জীবনে কষ্টের পরিমিতি অনেক বেশি,কিন্তু সকল কষ্টকে ছাপিয় যায় একটা প্রাপ্তি।পুনম! তার বোন। তার জীবনের বড় প্রাপ্তি। সকল তাচ্ছিল্যপূর্ণ অশ্রাব্য কথা ঢেকে যায় একটি ডাকে, সেজো আপা!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here