পুনম,পর্বঃ০২,০৩

পুনম,পর্বঃ০২,০৩
আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০২

পুনমের রিকশা যখন বাসার সামনে থামলো তখন দুটো ছায়ামূর্তি নড়ে উঠলো।একজন হলো নিয়াজ সাহেবের আর একজন হলো পুনমের সাথে যার নাড়ীর সম্পর্ক।পুনমের সেজো আপা পাবনী। এই পরিবারের সবচেয়ে চুপচাপ,শান্ত ও গম্ভীর মেয়েটা হলো পাবনী।এই মেয়েটা নিজেকে আড়ালে রাখতে সবসময় পছন্দ করে।নিয়াজ সাহেবের মত পাবনীও অপেক্ষা করছিল পুনমের।
পুনমকে বাসায় ঢুকতে দেখে পাবনী ছাদ থেকে নেমে যায়। সে এতক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়ে ছটফট করেছে বোনের জন্য আর নিয়াজ সাহেব বারান্দায়। কিন্তু তফাৎ হলো নিয়াজ সাহেবের অস্থিরতা দেখা গেলেও পাবনীর টা জানা অব্দি যায় না। এই পৃথিবীতে যারা শান্ত প্রকৃতির তাদের ভিতরের অশান্তিটা থাকে সবার আড়ালে!

পুনম বাজারের ব্যাগ নিয়ে সোজা রান্না ঘরে মায়ের কাছে চলে গেলো,
—–মা হাঁস ড্রেসিং করে এনেছি,তুমি শুধু কুটে ধুয়ে চুলায় বসালেই হবে।
সালেহা বেগম অত্যান্ত অসন্তোষ গলায় বলে উঠলো,
——হ্যারে, পুনু এটা হাঁস আনার কোন সময়? বলতো কখন রান্না করবো কখন জামাইদের খাওয়াবো? তারা নামাজ পড়ে এই এলো বলে।
পুনম শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
—–মা আমি বসে থাকিনি সারাদিন।আর এখন রান্না করতে না পারো কাল করবে।তোমাদের জামাইদের যদি এত তোমার হাতের রান্না খেতে মন চেয়েছে তবে তারা কেন কিনে আনে নি?
পুনমের বড় বোন রুমা এতক্ষণ তার বড় মেয়ে ইষ্টিকে খাবার খাওয়াচ্ছিলো টেবিলে বসে। এবার সে ফোঁস করে বলে উঠলো,
—–তোর কথার একি ছিরি পুনু। তারা জামাই মানুষ তারা শবে বরাতের দিনে বাজার আনলে বাবা ছোট হয়ে যাবে না।বল?তারা ভাববে না যে বাবার জামাই আদর করার মত সামর্থ নেই।
——শোন বড় আপা, মানুষ এত তুচ্ছ বিষয়ে ছোট হয়ে যায় না।আর আমার বাবা তো নয়ই।তারা আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা জেনেও যখন নির্লজ্জের মত বলতে পারে তবে কিনে কেন আনতে পারবে না?
——মা তোমার মেয়েকে বলে দাও আমরা রোজ রোজ আসি না। যে এত কথা শুনবো।তোমার বড় জামাই কিনা পুনমকে এত ভালোবাসে আর ও এভাবে বললো তাকে।
—-শোন বড় আপা, এইসব ভালোবাসার ধার পুনম ধারে না। আপা তোরা বড়লোক, তোর জামাই ব্যবসায়ী তাকে বলে দিস মাঝে মাঝে জামাই বাজার করলে আমরা তাতে ছোট হবো না বরং দুলাভাইয়ের আত্মা দেখে খুশিতে গদগদ হবো।
মুচকি হাসি দিয়ে বললো পুনম……।
পুনমের কথা শুনে ইষ্টি ফিক করে হেসে দেয়। মেয়ের হাসি দেখে রুমা চপাং করে চড় বসিয়ে দেয় মেয়েকে।মায়ের চর খেয়ে ইষ্টি আরো হাসতে থাকে….যেন তাকে চড় নয় আদর দেয়া হয়েছে।
পুনম ইষ্টিকে নিয়ে নিজের রুমে যেতে নিয়েও আবার থেমে পিছনে ফিরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,
——মা আমার ভাই বেঁচে নেই তার জন্য তোমার দুলাভাইদের প্রতি দূর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। তাই বলে নিজের ছেলে আর পরের ছেলের তফাৎ দেখবেনা।তোমার বোকামির কারণে বাবা কতটা কষ্ট পায় জানো? শোন মা জামাই জামাই হয়। আলালের ঘরের দুলাল দিয়ে তৈরী হয় দুলাভাই, যাদের এক সেকেন্ডের ভরসা নাই!

খালামণির কথা শুনে ইষ্টি আবার হাসতে থাকে……..

পুনম নিজের রুমে গিয়ে দেখে তার বিছানার উপর গোসলের জন্য কাপড়, তোয়ালে রাখা।বেট সাইড টেবিলে লেবুর শরবত রাখা।সারাদিনের এত কষ্টের পর এতটুকু যত্ন দেখে পুনমের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সেজো আপা তাকে কেন এত বুঝে? একসাথে মায়ের গর্ভে এক নাড়ীর বন্ধনে ছিল বলে, নাকি পুনমকে একটু বেশিই ভালোবাসে বলে?

আধা ঘন্টা পর পুনম যখন বাবার সাথে দেখা করতে গেল তখনও বাবাকে নামাজ পড়তে দেখে পুনম রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে তার মা পরম আনন্দে রাত সাড়ে দশটার সময় রান্না করছে।তার মা এমন একজন মানুষ যার গোটা জীবনটা কেটে গেলো রান্নাঘর আর নিজের এই পাঁচ রুমের ঘর দেখে।বাহিরের জগৎ তার কাছে অচেনা! এই বোকাসোকা মানুষটার জন্য পুনমের বড্ড মায়া হয়!

পুনম নিজের রুমে ফিরে এসে দেখে তার মেজো আপা ঝুমা বসে আছে তার খাটে।
—–আপা তুমি এখানে।দুলাভাই কই? কিছু বলবে?
ঝুমা মিষ্টি হেসে বলে ওঠে,
—–বুঝেছিস পুনম তোর দুলাভাইটা হচ্ছে একটা বিড়াল,বিড়াল যেমন সারাদিন ম্যাও ম্যাও করে। আর তোর দুলাভাই করে বউ বউ!তাকে ছেড়ে একমুহুর্ত কোথাও যেতে পারি না।
——আপা এটা তো আরো ভালো,দুলাভাই তোমায় চোখে হারায়।
—–আরে সে তো একটা পাগল,আজ কি বলেছে জানিস?
আমাকে নাকি কমলা রঙের শাড়িতে তার দেখতে ইচ্ছা করছে।বলতো এখন কমলা রঙের শাড়ি আমি কই পাবো?
তবে বলেছে আবার নতুন চাকরি হলে সবার আগে কমলা রঙের শাড়ি কিনে দিবে।
—-আপা আমি তোমায় কমলা রঙের শাড়ি কিনে দিবো, তুমি পড়ে দুলাভাইকে চমকে দিবে ঠিকাছে,আগে বলবে না কিন্তু।।
—-সত্যি তুই কিনে দিবি?আমি তো এখনই দেখতে পাচ্ছি তোর গাধা দুলাভাই আমার দিকে ড্যাব ড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে,আর আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি। হ্যা রে পুনম বাজারে কি লতি ওঠে? আমার না লতি চিংড়ী খেতে মন চাচ্ছে।
—–আপা আমি কাল দেখবো।
পুনম মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে তার মেজো আপার খুশি, এই মেয়েটার দিনের প্রথম কথা শুরু হয় তার স্বামীর নামে আর দিনের শেষ কথাও হয় তার স্বামীকে দিয়ে।
—-পুনু সোনা বলনা আমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে? তবে তোর দুলাভাই বলেছে আমাদের বংশে যেহুতো মেয়ের ধারা বেশি আমারও নাকি মেয়ে হবে। তোর কি মনে হয়?বড় আপারও তো দুই মেয়ে।
—–আপা তোমার তিনমাস চলছে এখনই এসব কথা কেন?
—–আমার কি মনে হয় জানিস? আমার রাজপুত্র হবে।
—–আপা আমি এখন ঘুমাবো,তুমি গিয়ে দুলাভাইকে হাঁসের গোসত আর রুটি পিঠা খাওয়াও।
ঝুমা ছুটে বেড়িয়ে গেলো। যেনো কত বড় কাজ সে ফেলে এসেছে।

পুনম ঘুমানোর আগে লাবণ্যর সাথে দেখা করতে গেলো বাসায় আসার পর থেকে তার ছোট বোনের একবারও দেখা পেল না।
লাবণ্য ইষ্টির ছোট বোন মিষ্টির মেকাপ করছে এত রাতে। পুনম দরজায় নক করলো। ভিতর থেকে লাবণ্য বলে উঠলো, নয়াপু এখন ডিস্টার্ব করবে না তো আমি একটা মেকাপের ট্রায়াল দিচ্ছি। ভিষণ বিজি আমি তুমি পরে আসো। পুনম বেড়িয়ে গেলো।এখন হাজার বলেও লাবণ্যের মনোযোগ অন্য কোথাও সরাতে পারবে না, তার থেকে ঘুমানোই উত্তম।

***************———
নামাজ শেষে নিয়াজ উদ্দিন যখন পুনমের সাথে দেখা করতে এলো তখন পুনম ঘুমে বিভোর।নিয়াজ সাহেবের কষ্ট হয় তার এতটুকুন মেয়ে কত কষ্ট করে বাবার কষ্ট কমাবার জন্য! পুনম বাসায় ফিরে কখনোই বাবার সাথে আগে দেখা করে না।কারণ পুনম জানে বাবা তার ক্লান্ত মুখ দেখতে পারে না। তাই ফ্রেস হয়ে দেখা করতে যায়।

নিয়াজ সাহেব যখনই পুনমকে দেখে তখন তার মনে হয় আল্লাহ ভুলে তার ঘরে এমন রূপবতী আর গুনবতী একটা মেয়ে দিয়েছে। তার পাঁচ মেয়ের মধ্যে পুনম সব কিছুতে সেরা যেমন রুপ,তেমন পড়াশোনা, বিবেক বুদ্ধি,বাস্তব জ্ঞান। কি নেই তার পুনমের মধ্যে, কোন খুঁত সে পায় না। এই যে এবার মাস্টার্সে পড়ছে অন্যদিকে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকালে বের হয় বাসা থেকে তারপর নিজের ক্লাস করে দুটো টিউশনি করায় এরপর শিক্ষার আলো কোচিং সেন্টারে কোচিং ক্লাস করিয়ে আরো দুটি টিউশন করিয়ে বাসায় আসে। এত পরিশ্রমের পরও পুনমের বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল মুখে হাসি থাকে সবসময়।
তার প্রথম সন্তান ছিলো একটা ছেলে।তারপরে রুমার জন্ম হয়। এ্যাকসিডেন্টে ছেলেটা মারা যাওয়ার পর সবাই ভেঙে পড়েছিল।এরপর জন্ম হয় আর একটি মেয়ের। রুমার সাথে নাম মিলিয়ে তার নাম রাখেন ঝুমা। ছেলের আশায় পরবর্তী সন্তান নিলেও আবার মেয়ে হয়।তবে জমজ কন্যা সন্তান। এক ঘন্টা আগে জন্মগ্রহণ করে পাবনী,এরপর পুনম।পাবনীর জন্ম থেকেই এক পায়ে সমস্যা। সে খুড়িয়ে হাটে। জমজ হলে কি হবে তাদের না আছে চেহারায় মিল না আছে স্বভাবে।এরপর তার ছোট মেয়ে লাবন্যর জন্ম হয়।

তার পাঁচ মেয়ে পাঁচ রকমের, কারো স্বভাবের সাথে কারো মিল নেই।তার বড় মেয়ে হিংসুটে ধরনের।যাকে বলে স্বার্থপর। বড় পরিবারের বউ হয়ে তো আর কাউকে গোনায়ই ধরে না।তবে তার নাতি দুটো অমায়িক।একজনের বয়স ১০ বছর,আর একজনের ৮ । তার মেজো মেয়ে তার মায়ের মত বোকা আর সরল স্বভাবের।যার পৃথিবীতে একটা কাজই হলো স্বামীকে নিয়ে কথা বলা,স্বামীর প্রাধান্য যার জীবনে অধিক। আর তার সেজো মেয়ে বড় গম্ভীর স্বভাবের।তাকে নিয়াজ সাহেব ঠিক বুঝে না।এই মেয়ের কোন কিছুর প্রতি আগ্রহ সে দেখে না। তিনি এড়িয়ে চলেন পাবনীকে সবসময়। আর তার পুনম বড় শক্ত মেয়ে, যে আবেগের থেকে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেয় বেশি। পুনম নামের অর্থ পূর্ণিমার রাত।তার পুনম তার ঘরের পূর্ণিমার আলো। কিন্তু পেলব, মিঠে আলো নয়।চোখ ঝলসানো আলো। আর তার ছোট কন্যা লাবণ্য। যে একনম্বরের দুষ্টু আর পড়াশোনায় ফেল্টুস মার্কা স্টুডেন্ট।

নিযাজ উদ্দিন বাটিতে করে নিয়ে আসা বাটা মেহেদী ঘুমন্ত পুনমের হাতে আস্তে আস্তে দিতে থাকেন।ছোট বেলায় মেয়েটা শবে বরাতে সব সময় গাছের মেহেদী বেটে হাতে দিত। নিয়াজ সাহেব এক হাত দেওয়ার পর যখন অন্য হাতে দিতে যাবে তখন পাবনী এসে পুনমের মেহেদী ভরা হাত ধরে আর তার বাবা পুনমের অন্য হাতে মেহেদী লাগাতে থাকে। পাবনী কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলে,
—–বাবা মা তোমায় খেতে ডাকে, ভাইয়ারা খেতে বসেছে।
—-তোমার বোকা মা তাদের খাওয়াক,আমি খাবো না। আমার মেয়েটা না খেয়ে ঘুমিয়েছে আর তারা হল্লা শুরু করেছে,হুহ্! পাবনী তুমি খেতে যাও।
—–বাবা আমি খাবো না,এখন আমি কিছুতেই খাবো না, আমি এখন ঘুমাবো।
পাবনী চট করে শুয়ে পড়ে।
মেহেদী দেয়ার পর নিয়াজ সাহেব পুনমের মাথায় হাত বুলাতে থাকেন,কিছুক্ষণ পর যখন তিনি দেখেন পাবনী ঘুমিয়ে পড়েছে তিনি তখন পাবনীর হাতেও পরম যত্নে মেহেদী লাগাতে শুরু করেন।
আজ রাতে সে শুধু তার এই দুই মেয়ের হাতে মেহেদী লাগানোর কাজে নিয়োজিত এক আনন্দিত বাবা!নিযাজ উদ্দিন বুঝতে পারে আজ তার ঘুমটা খুব ভালো হবে!

চলবে…..

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা।
পর্বঃ০৩

রাজু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে তার তানভীর স্যারের রুমের দিকে।এখন ভোর পাঁচটা,এই টাইমে তার স্যারের কি এমন জরুরি কাজ আল্লাহ জানে? রাজু তানভীর স্যারের ফোন পেয়েই চলে এসেছে কোন রকমে। না দাঁত ব্রাশ করতে পেরেছে না সকালে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পেরেছে। এখন উভয়ের প্রয়োজনীতা অনুভব করছে।

ব্যলকোণের ডিভানে আধশোয়া হয়ে ভোরের আকাশ দেখছিল তানভীর। রাজুকে রুমে ঢুকতে দেখে বললো,
—– রাজু তুমি ভোর সাড়ে ছয়টার মধ্যে এই ঠিকানায় একটা ফুলের তোড়া পাঠাবে।সাথে এই চিরকুট টা।আর ফুলের তোড়াটা দেখার পর কি রিয়াকশন হয় তার? আমাকে মেসেজ করে সব আপডেট জানাবে।

রাজু স্টাচু হয়ে গেছে স্যারের কথা শুনে, শেষ পর্যন্ত কি তার স্যার পাগল হয়ে গেলো।এই সাত সকালে তাকে ডেকে ফুলের তোড়া পাঠাতে বলছে।এত সকালে ফুলের দোকান খোলা পাবে কিনা কে জানে? তানভীর আবার বললো,
—-রাজু প্রোপার টাইমে তুমি তোড়াটা পাঠাবে। আর অবশ্যই খেয়াল রাখবে যেন ফুল গুলো গোলাপ আর বেলি হয়।
রাজুকে একভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তানভীর আবার বললো,
—–কি হয়েছে রাজু?কথা বলছো না কেন?
রাজুর এখন কাঁদতে মন চাচ্ছে। কথা বললেই স্যার তার মুখের দুর্গন্ধ টের পাবে কেননা স্যার ডিভান থেকে উঠে রাজুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার উপর আবার পেটে চাপ বোধ করছে বাথরুমে যাওয়া এখন ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে, না হলে কেলেঙ্কারি বেধে যাবে। রাজুর সমস্যা আছে, ও এইসব বিষয় কখনো চেপে রাখতে পারেনা।মুখে হাত দিয়ে বললো,
—–ইয়েস স্যার আমি এখনই যাচ্ছি। টাইমের একটু হেরফের হলে তার জন্য এখনই স্যরি স্যার।… বলতে বলতে রাজু দৌড় লাগালো।
দরজার কাছে যেতেই রাজুকে আবার দাঁড়াতে বললো তানভীর।
—— আমার গাছের সবচেয়ে সুন্দর ফুল তুলে তোড়া করবে।আর আমার জন্য সবসময় এমন চাপের উপর থাকবেনা, আগে নিজের কাজ তারপর অন্যের কাজ। তোমাকে যে বেতন দেয় তার জন্য এভাবে চাপে থাকবে। ঠিকাছে? বলে…. তানভীর কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো এখন সে ঘুমাবে কেননা সারারাত সে জোছনা বিলাস করেছে।

রাজু আবার দৌড় দিলো তার হাতে দেড় ঘন্টা সময়, এর মধ্যে তাকে দাঁত ব্রাশ করতে হবে, না আগে বাথরুমে যেতে হবে,ফুল তুলে তোড়া করে জায়গা মত পৌঁছাতে হবে।হায়! হায়! বাথরুমেই তো তার আধাঘন্টা লাগে। রাজুর এই কথাটা বার বার মনে হয়, পি এ হওয়া সবচেয়ে কঠিন কাজ!

*****
মেইন দরজায় কে যেন অনবরত কড়া নাড়ছে।থামার কোন লক্ষণ নেই। পুনম ঘাড় উঠিয়ে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো ছয়টা বাজে।এই সময় কে আসতে পারে?মানুষ বিরতি নিয়ে দরজায় নক করে। এখন যে কড়া নাড়ছে সে হয় ভিক্ষুক না হয় সুমন ভাই। আর এত সকালে ভিক্ষুক আসবে না। তাই পুনম ৯৯.৯% নিশ্চিত হয়ে বলতে পারে সুমন ভাই এসেছে। এই ব্যক্তির আর কিছু থাকুক আর না থাকুক অসীম ধৈর্য্য আছে।ওয়াশ রুমে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে।বিছানায় তাকিয়ে দেখে লাবন্য হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে তার মানে সেজো আপা ওয়াশরুমে। পুনম এলো চুলগুলো হাত খোপা করে বালিশের পাশ থেকে ওড়না উঠিয়ে গায়ে জরিয়ে রুম থেকে বের হলো।

দরজা ওপারে এলোমেলো চুলে মলিন চেহারায় সুমন ভাই দাঁড়িয়ে আছে। বার বার মাথার চুল গুলো পিছনে ঠেলছে আবার তা পুনরায় সামনে এসে পড়ছে।সুমন ভাই শ্যামলা রঙের উচ্চতায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। শরীর হালকা পাতলা গঠনের। আর একটু সাস্থ্য হলে মানাতো। ছোট ছোট চোখ গুলো হাসলে আরো ছোট হয়ে যায় তখন তাকে একদম বেবিদের মত নিষ্পাপ মনে হয়। সম্পর্কে বড় আপার চাচাতো দেবর।থাকে বড় আপাদের সাথেই।এখনো হাসি মুখে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে।
—-গুড মর্নিং পুনম। ঠোঁটে হাসি চোখে দ্বিধা নিয়ে বললো
সুমন।
—–কি করে গুড মনিং হবে বলুন তো সুমন ভাই?সকাল সকাল ঘুমের দুপুর বানিয়ে দিলেন।তা এত সকালে কোথা থেকে এলেন?
——ইয়ে পুনম, আসলে হয়েছি কি কাল একটা ইন্টারভিউ ছিল।ইন্টারভিউ শেষ হতে হতে রাত হয়ে গেলো। কোন গাড়ি পাচ্ছিলাম না ফেরার জন্য তাই আরকি।
—-আপনি তাহলে এখন এসেছেন কেন? রাতে কই ছিলেন?
সুমন ইতস্তত করে বললো,ইয়ে মানে বাহিরে।
পুনম অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। এই লোক কাল সারারাত তাদের বাসার সামনে থেকেছে অথচ বাসায় আসেনি।
—–এখন আসলেন কেন?
—-আসলে পুনম অত রাতে তোমাদের ডিস্টার্ব করতে চাইনি। আর বড় ভাইজান বা কি ভাববে,বল?আর এখন ভাবলাম যাওয়ার আগে একবার তোমাদের সাথে দেখা করে যাই।
এরপর কাচুমাচু করে বললো, এছাড়া আমার খুব খিদেও পেয়েছে। হাতে যা টাকা আছে তা দিয়ে হোটেলে খেলে আমি ফিরতে পারবো না।আমি কি ভিতরে আসবো?

পুনম দরজা থেকে সরে দাড়িয়ে বললো,সুমন ভাই আপনি হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি। আর এতক্ষণ যা বললেন তা সত্য হলেও সবচেয়ে বড় কথাটা আপনি লুকিয়ে গেছেন। আর জানেন তো সুমন ভাই, আমি আবার মিথ্যে আর লুকানো কথা খুব সহজে ধরে ফেলতে পারি।
এই শীতল ভোরেও সুমনের কপাল ঘেমে ওঠেছে কথাটি শুনে। পুনম কি জাদু জানে মনের কথা পড়ে ফেলবার?তাহলে তো সর্বনাশ!

রাতে অনেকক্ষণ সবাই জেগে থাকার ফলে বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে।খাবার টেবিলে ওরা চারজন খাবার খেতে বসেছে। নিয়াজ উদ্দিন, পাবনী,সুমন ভাই আর পুনম। নিয়াজ সাহেবের সুমন ছেলেটাকে ভীষণ ভালো লাগে। ছেলেটা তার বড় জামাইর মত অহংকারী আর নাক উচু স্বভাবের নয়।দেখা হলেই কি সুন্দর সালাম দিয়ে আদবের সাথে কথা বলবে।আর তার বড় জামাই তার সাথে কথা বলে যেন সে নিজে তার কর্মচারী। পাবনী খাচ্ছে আর খাবার পরিবেশনও করছে।আর পুনম চুপচাপ খাচ্ছে। চালের রুটি বাসি হলে তার খুব পছন্দের। গোসের ঝোলের সাথে মেখে খুব আয়েশ করে খাচ্ছে। নিয়াজ সাহেবের দেখে খুব ভালো লাগছে।মেয়েটা কি আরাম করে খাচ্ছে। সে আর একটা রুটি ছিড়ে পুনমের প্লেটে দিলো। এরপর সুমনকে জিজ্ঞেস করলো,
——- তা বাবা তোমার ইন্টারভিউ কেমন হলো?
সুমন খেতে খেতে জবাব দিলো,
—– আংকেল ভালো হয়নি।যা জিজ্ঞেস করেছে তার উত্তর দিতে পারিনি।মার্কেটিং জবে ভুটানের,ইন্দোনেশিয়ার প্রধান মন্ত্রীর নামের কি প্রয়োজন? বুঝলাম না।
—–সুমন ভাই আমাদের মত বেকারদের জন্য টিউশনি হচ্ছে আশির্বাদ স্বরূপ। আপনি টিউশনি কেন করান না?খেতে খেতে জানতে চাইলো পুনম।
—-পুনম আমি মেধাবী বা এভারেজ ছাত্র নয়।আমি হলাম একেবারে নিম্নবর্গের মোটামুটি ছাত্র। জাস্ট লোক দেখানো পড়াশুনা ছোটবেলা থেকে বরাদ্দ ছিল আমার জন্য। এছাড়া আমি স্টুডেন্টদের বুঝাতে পারিনা। একমাসও টেকে না আমার টিউশনি।

—–বাবা শোনো, সবারই জীবনে এইম ইন লাইফ থাকে। সুমন ভাইয়ের এইম ইন লাইফ হলো বিয়ে করা।আমি নিশ্চিত সে চাকরী খুঁজে একমাত্র বিয়ে করার জন্য।
পুনমের কথা শুনে তার বাবা হেসে দিলেও সুমন বেশ বড় সড় বিষম খেলো। পাবনী ব্যস্ত হয়ে পানি এগিয়ে দিয়ে মাথায় আস্তে আস্তে চাপড় দিতে লাগলো। তাতে সুমন ভাইয়ের বিষম খাওয়া কমলো না বরং আরো বেড়ে গিয়ে খুক খুক করে কাশতে লাগলো।

পুনমের খাওয়া শেষ হতেই কলিং বেলে বেজে উঠলো।পুনম দরজা খুলতে যেতে যেতে সুমন ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
—–সুমন ভাই মেরুদণ্ডহীন মানুষ কোন কাজের না। মেরুদণ্ড সোজা করে চলতে শিখুন।দরকারে হলে রিকশা চালান তবুও গোলামী ছেড়ে দিন।
পুনম আজকে ক্লাস যাবে না একটা ইন্টারভিউ আছে। সেখানে কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম সুধায় কে জানে? ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে চলে গেলো।

দরজা খুলে দেখলো মি.তানভীরের তথাকথিত পি এ রাজু কে একটি ফুলের তোরা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । পুনমকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলো,
—- আপু ফুলের তোরা দেয়ার কথা ছিলো সাড়ে ছয়টার মধ্যে এখন বাজে ছয়টা সাতচল্লিশ এর জন্য আমি খুবই দুঃখিত।
পুনমের সাথে কেন সবসময় গাধাদের দেখা হয় পুনম জানে না।এত সকালে কেউ ফুলের তোড়া পাঠায়? রাজুকে খুবই বিরক্ত দেখাচ্ছে, ফুল আর চিরকুট পুনম না নেওয়া পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়তে পারছেনা। তার আবার প্রকৃতির ডাক পড়েছে।মনে হয় পেটে গন্ডগোল বেঁধেছে।কাল রাতে কি খেয়েছিল তা মনে করতে পারছেনা রাজু। খুবই বাজে অবস্থা!
—-ওয়াও, এতগুলো ফুল।নয়াপু এগুলো কে দিলো তোমায়? কি সুন্দর ঘ্রাণ বলে… লাবন্য ফুলগুলো রাজুর হাত থেকে নিয়ে নিলো। রাজুর এখন মরণ অবস্থা! কার জন্য আনলো আর কে নিলো? মেয়ে মানুষ মানেই ঝামেলা।কোন কমনসেন্স থাকে না এদের। রাজু চটজলদি লাবন্য এর হাত থেকে তোড়া নিয়ে পুনম কে উদ্দেশ্য করে বললো,
—-এগুলো আপনার আপু।
পুনম অবশ্য ফুলের তোড়া হাতে নিলনা।রাজুকে বললো লাবণ্যকে দিতে আর চিরকুটটা পুনম হাতে নিয়ে বললো,
—–লাবু এগুলো তোর।আর ইনি হলো ফুলের দোকানের কর্মচারী।আমি ফুল গুলো তোর জন্য আনিয়েছি,আজ তুই সন্ধ্যায় ফুল দিয়ে সেজে আমাদের সকলকে নিত্য পরিবেশন করে দেখাবি।
লাবণ্য খুশিতে ফুলের তোড়া নিয়ে দুলতে দুলতে ভিতরে চলে গেলো। রাজুর এখন কান্না পাচ্ছে। কোন সকালে কাঁটার গুতো খেয়ে কত কষ্ট করে ফুলের তোড়া যার জন্য বানালো সে একটু ছুঁয়েও দেখলো না।তার স্যারের গাছের এত সুন্দর ফুলও নষ্ট হলো আর সে নিজে ফুল বিক্রেতা হিসাবে ঘোষিত হলো। রাজু রাগে হন্তদন্ত হয়ে বেড় হয়ে গেলো সে আর এই আজব মেয়েটার সাথে কথা বলবে না।

পুনম চিরকুটটা তখন আর পড়লো না। সকাল নয়টায় যখন ইন্টারভিউ এর উদ্দেশ্য বের হয়ে রিকশায় উঠলো তখন চিরকুটটা পড়ল।

“পুনমি”
কাল আমি তোমায় একটা ভুল কথা বলেছি।আমার তোমায় বেয়াদব বলা উচিত হয় নি।তার জন্য আমি দুঃখীত।আমি দুঃখীত স্বরূপ ফুলের তোড়া তোমার জন্য পাঠালাম। তবে আমার বলা উচিত ছিল, পুনমি তুমি খুবই নিষ্ঠুর!
আর খুবই বুদ্ধিমতী। জানো তো, পৃথিবীতে সবথেকে বুদ্ধিমান বা বুদ্ধিমতীদের জীবনে সুখ থাকে কম।
সবচেয়ে সুখী হয় বোকারা।
এই পুনমি, তুমি একটু বোকা হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো?

বিঃদ্রঃ আমার বাবা আমাদের পরিবারে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি,সে নিজেকে সুখী মনে করলেও সে আদতে খুবই অসুখী মানুষ।

চিরকুটের অপর পৃষ্ঠায় ছোট্ট করে লেখা, “এই পুনমি, আজ কি আমাদের দেখা হবে?”

চিরকুটটা পড়া শেষে পুনমি আকাশের তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পুনম মনে মনে বললো,মি.তানভীর এতটুকু বুদ্ধিমতী না হলে এই সমাজে যে আমায় বাঁচতে দেবেনা!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here