#পাগল_প্রেমিকা
#পর্ব_46,47
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
৪৬
_______
সন্ধ্যা গনিয়ে এসেছে রিমন এখনও বৃষ্টির কবরের পাশে বসে। বৃষ্টির সাথে কথা বলছে, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে সোহান, অভ্র, নিলয়, কাব্য, অপূর্ব, নাহিদ, নাঈম আরও অনেকে রয়েছে তবে তারা কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। এত ভালো কেউ কাউকে কি করে বাসতে পারে? আর যদি ভালোবাসতোই আগে তাকে কেনো বলেনি। সোহান নিজের ভাইয়ের এমন করুণ দোষা আর সহ্য করতে পারছে না। তাই পায়ে হেটে রিমনের পাশে গিয়ে বসে কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা সরুপ বলল, ‘ কতক্ষণ এখানে বসে থাকবি ভাই? ‘
রিমন কবরের উপরে মাটিতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আমি চলে গেলে যে আমার বৃষ্টি ভয় পাবে! ‘
কথাটা শুনতেই সোহান রিমনের গলা জড়িয়ে ধরল, এতক্ষণ পর কারো কাঁধ পেয়ে রিমন কাঁধের উপর মাথা রেখে কেঁদে ফেলে। হারালে সবাই খুঁজে থাকতে কয় জনে মূল্য বুঝে? বাকিরাও এসে রিমনকে সাথে নিয়ে বাড়িতে চলে আসল। তাকে তার রুমে নিয়ে শুয়ে দিয়ে তারা পাশে বসে রয়েছে।
ভাবছেন তো কিভাবে নিয়ে আসল, শুনুন তবে সোহান যখন রিমনের গলা জড়িয়ে ধরে ছিল তখন ডাক্তার নীল পেছন থেকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করেন। তারপরেই ঘুমে তলিয়ে যায় । সবাই ধড়াধড়ি করে সেখান থেকে নিয়ে এসে রুমে শুইয়ে দেয়। মাঝ রাত পর্যন্ত এইরুমেই বাকিরা বসে থাকে, রাতে আর রিমন ঘুম থেকে উঠে না তাই বাকিরাও যেখানে সেখানে শুয়ে পরে।
চারদিন পর্যন্ত বৃষ্টির পরিবারের সবাই এখানেই থাকে চারদিনের আয়োজন সম্পূর্ণ করে চলে যায়। আজ চারদিন হয়ে গেছে রিমন তিতিরের দিকে ফিরেও তাকায়নি।
পঞ্চম দিনের দিন তিতিরকে নিয়ে রিমনের সামনে যায় রিমনের মা৷ রিমনকে সাধলো মেয়ের দিকে তাকাতে একটু কোলে নিয়ে আদর করতে কিন্তু রিমন তিতিরের মুখ পানে ফিরেও তাকায়নি । তিতিরের গালে একটা জন্ম তিল হয়েছে যেমন টা বৃষ্টির গালে ছিল। সেটার জন্য তিতির কে পুরোপুরি বৃষ্টির মতোই লাগে সেই চোখ সেই নাক। তবে রিমন বৃষ্টির মৃত্যুর জন্য দ্বায়ী তিতির কে করে।
মা জোর করে কোলে দিতে গেলে রিমন ছিটকে উঠে বলে, ‘ ভুলেও মা ওই মেয়েকে আমার সামনে আনবে না ওর জন্য আমি আমার বৃষ্টি কে হারিয়েছি আমি ওর চেহারা ও দেখতে চাইনা। ‘ বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়৷
রিমন এখন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে কারো নিষেধাজ্ঞার কোনো তোয়াক্কা করে না। নিজের মন মতো চলে সারাদিন রাত ক্লাবে গিয়ে নেশায় ডুবে থাকে। এতে নাকি সে শান্তি পায় বৃষ্টির মায়া থেকে বাহিরে থাকে। নেশা কেটে গেলেই রিমনকে বৃষ্টির স্মৃতি আঁকড়ে ধরে যা দুদণ্ড ও শান্তি দেয় না। বেশি কষ্ট হয় তখন যখন লাস্ট রাতে বৃষ্টির গাওয়া গানটার কথা মনে পরে। গানটা জেনো জীবন পেয়েছে গভীর রাতে কানের মধ্যে আপনা-আপনি চলতে থাকে। আরও মনে পরে হাসপাতালে হাত ধরে ভালোবাসি শুনতে চাওয়ার দৃশ্য যা রিমনকে মৃত্যুর মতো যন্ত্রণা দেয়। সে সব কিছু থেকেই মুক্ত থাকতে নেশায় ডুবে থাকা।
_____
১১ মাস পর,
আজ ভরপেট ড্রিংকস করে সন্ধ্যাতেই বাড়ি ফিরে আসে, মা’য়ের রুমের সামনে দিয়েই নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল তখনই শুনতে পেলো দোলনায় শুয়ে তিতির ‘ ওয়া ওয়া, ‘ করে কাঁদছে কান্না শুনে থেমে যায় কিছুক্ষণ রুমের মধ্যে দুলতে থাকা দোলনার দিকে তাকিয়ে রইল। তখনই রুমের সামনে আসল রিমি, তিতির কে কাঁদতে শুনে ছুটে আসে রুমের সামনে রিমনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও সে ভেতরে গিয়ে কোলে তুলে নেয় তিতির কে। কান্না থামানোর জন্য কোলে নিয়ে হেলদোল করছে। পেছনে ঘুরে রিমনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস মেয়েটা কাদছে এসে কোলে নিতে পারিসনা। ‘ রিমন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।
______
রাত তখন গভীর সময়ের ঠিক আন্দাজ করা যাচ্ছে না। চারদিকে জুড়ে শুধু অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা হঠাৎ খুব জোড়ে বাতাস বইতে লাগল। বেলকনির দরজা খোলা জানালার বড় বড় থাই গুলো ও খোলা হয়তো লাগাতে ভুলে গেছে। এমন ভাবে বাতাস বইছে যে পুরো রুমে এসি চলছে এমন ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাতাসে জানালার পর্দা গুলো উড়ছে রিমনের তাতে কোনো হুশশ নেই। হটাৎ করে অনুভব করছে খুব ঠান্ডা একটা কিছু তার চুলে আলতো ভাবে হাত বুলাচ্ছে।
এত ঠান্ডা ও শীতল স্পর্শ যে সে আর ঘুমিয়ে থাকতে পারল না। টিপটিপ করে চোখ মেলে তাকালো, নিজের সামনে তাকে বসে থাকতে দেখে লাফিয়ে উঠে বসলো। চুলগুলো ছাড়া পরণে ওই আগুনে জ্বালিয়ে ফেলা সোনালী রঙের শাড়ি টা, রিমনের দিকে মোহিত নজরে তাকিয়ে আছে৷
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না রিমন মনে হচ্ছে সে কোনো ঘোরের মধ্যে রয়েছে জেনো স্বপ্ন দেখছে, অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, ‘ তুমি? ‘
রিমনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বলল, ‘ কেনো ভয় পাচ্ছো? ‘
রিমন তার দিকে তাকিয়ে দুইদিকে মাথা নাড়ালো, মানে সে ভয় পাচ্ছে না।
সামনে বসে থাকা সুদর্শনী রমণী হেঁসে বলল, ‘ ভয় পেয়ো না আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। আমি আজ তোমার কাছে এসেছি এক বিশেষ কারণে ‘
রিমন কোনো প্রত্যত্তর করল না। আঁখি জোড়া মেলে তাকিয়ে আছে তার এখনও মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে তাই কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে শাণিতকন্ঠে বলল, ‘ তুমি কি সত্যি এসেছো ‘
সে হালকা মৃদু হেঁসে মাথা উপর নিচ নাড়ালো।
রিমন তা দেখে বলল, ‘ আমি কি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি? ‘
মুহূর্তের মধ্যে হাসি বিলীন হয়ে গেলো। সে প্রত্যত্তরে জানালো, ‘ তুমি আমাকে এখনই স্পর্শ করতে পারবে না। সময় লাগবে বহুত ‘
কথাগুলো শুনে নিস্তব্ধ রয়ে গেলো রিমন। বিছানার উপর থেকে পা মেঝেতে নামিয়ে উঠে দাঁড়ালো, হেঁটে বেলকনিতে চলে আসল। গ্রিলের উপর হাত রেখে বলল, ‘ তুমি কি ভুলে গেছো রিমন এই বারান্দায় বসে তোমার কাঁধে মাথা রেখে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমাদের মেয়েকে নিয়ে অথচ আজ পর্যন্ত তুমি তার দিকে ফিরেও তাকাওনি, আমি চলে গিয়েছি কিন্তু আমি আবার তোমাদের জন্য ফিরে এসেছি। আমি সর্বক্ষণ তোমাদের কে দেখেছি কিন্তু তোমরা আমাকে দেখোনি। আমি তোমাদের ছুঁতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি।
আজ আমার মেয়ে কান্না করছিল আমি পাশে দাঁড়িয়ে থেকেও তাকে ছুঁতে পারিনি অথচ তুমি সেখানেই ছিলে কিন্তু আমার মেয়েকে ছুঁতে আসোনি।
বলে পেছনে ফিরে তাকালো। আরও বলতে শুরু করল, ‘ আমি সব সময় তোমার আশে পাশেই আছি থাকবো মৃত্যুর পরও তোমাকে ছেড়ে যেতে পারিনি। তোমার যখনই আমার কথা মনে পরবে চোখ বন্ধ করে আমাকে সরণ করবে। আমি চলে আসবো তোমার সামনে। কিন্তু তার জন্য আমার মেয়েকে তোমার তার প্রাপ্প ভালোবাসা দিতে হবে। তাহলেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। ‘
রিমন বৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ যদি না আসো? ‘
‘ আমি আসবো! কিন্তু আমার কথা তুমি কাউকে বলতে পারবে না। আমি যে এসেছি তুমি আমাকে দেখতে পারো সে কথা কাউকে বলতে পারবে না। ‘
‘ আমি কাউকে বলবো না। ‘ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল।
বৃষ্টি খোলা আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ তোমার মনে পরে ওই রাতের কথা? ‘
রিমন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ কোন রাতের কথা? ‘
বৃষ্টি মৃদুস্বরে বলল, ‘ ভুলেই তো গেছো দেখছি। ওই রাতের কথা মনে পরে, যে রাতে তুমি একটা কালো শাড়ি আর একটা কালো পাঞ্জাবি কিনে এনেছিলে! শুধু আমার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য তুমি কালো শাড়িটা পরেছিলে আর আমি কালো পাঞ্জাবি টা পরেছিলাম। ‘
‘ হুম মনে আছে। ‘
‘ আমি সেদিনও জানতে চেয়েছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না কিন্তু তুমি কোনো প্রত্যত্তর করোনি। ‘
‘ বৃষ্টি আমি তোমাকে. ‘ রিমন বলতে যাবে তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বৃষ্টি বলল,
‘ থাক আর বলতে হবে না। শুধু কথা দাও আজকের পর থেকে তুমি আমার মেয়েকে অবহেলা করবে না। ‘
‘ আমি তোমাকে কথা দিলাম আজকের পর থেকে আমি আমাদের মেয়েকে বুকে করে আগলে রাখবো। ‘
দু’জনে রুমে চলে আসল, রিমনের চোখে ঘুম নেই সে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে,
বৃষ্টি বলল, ‘ তুমি শুয়ে পরো আমি গান গাইছি ঘুম চলে আসবে। ‘
রিমন বালিশে মাথা রাখলে বৃষ্টি গান ধরে, 🌸
এক জনে ছবি আঁকে এক মনে ও অমর
আরেকজনে বসে বসে রং মাখে ও অমর
সে ছবি খান নষ্ট করে কোন জনা কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা
মন জানো না 🌸
____
ভোরের এক চিলতে রোদ চোখে মুখে এসে পরতেই। হাতের কাছ থেকে বালিশ নিয়ে মুখের উপর চেপে ধরে কিন্তু ততক্ষণে তার ঘুম ভেঙে যায়, একবার ঘুম ভাঙলে দ্বিতীয় বার আর ঘুম আসে না। সে উঠে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে চলে গেলো। দীর্ঘক্ষণ শাওয়ার নিয়ে একটা সাদা টাওয়াল জরিয়ে বের হয়ে আসে অন্য একটা টাওয়াল হাতে নিয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে রুমের মধ্যে বড় আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো৷ এক মিনিট আয়নাতে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করল৷ এই কয়েক মাসে কতটা পরিবর্তন হয়েছে তার,। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর সে নিজের প্রতি যত্নশীল হতেই ভুলে গেছে,
পরক্ষণেই আয়নার সামনে থেকে সরে গিয়ে আলমারি থেকে নেভি ব্লু কালারের শার্ট আর কালো প্যান্ট বের করে পরল।
টাওয়াল ছুঁড়ে সোফার উপর ফেলে রুম থেকে বের হয়। ফোনে কারো সাথে কথা বলছে মা’য়ের রুমের সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। তখনই কানে ভেসে আসছে কারো মুখের মিষ্টি মধুর ডাক, ‘ বাব্বা বা বা বা বাব্বা বা বা ‘
কান থেকে ফোন সরিয়ে রুমের মধ্যে তাকালো। বিছানার উপর হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাফাচ্ছে আর বাবা বাবা বলে ডাকছে, এখনও অনেক ছোটো তিতির তাই তার ডাক ততটা স্পষ্ট নয়। ফোনের অপরপাশের লোকের উদ্দেশ্য বলল, ‘ আমি আপনাকে কিছুক্ষণ পর কল বেক করছি। ‘
বলে কল কেটে দেয় ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রুমে মধ্যে আসল। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট তিতিরের মুখ পানে তাকিয়ে আছে, তিতির তার ছোটছোট আঁখি জোড়া দিয়ে রিমনের দিকে তাকালো গোলাপের পাপড়ির মতো লাল চিরল ঠোঁট বাঁকা করে বলছে, ‘ বাব বাব বাব বাববা ‘
আজ প্রথম তিতিরের এত কাছে এসেছে রিমন। নিজেকে সংযত করতে পারছে না। তিতির যে দেখতে এখন পুরো হুবহু বৃষ্টির মতো, মায়ের মতো হয়েছে, চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। তিতির হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে কোলে উঠবার জন্য, তিতির ছোট হলে কি হবে, সে হচ্ছে গুলুমুলু মাশাল্লাহ । রিমন হাত বাড়িয়ে তিতির কে কোলে তুলে নেয়। কিচেন থেকে খাবার গরম করে এদিকেই আসছে রিমি ও তার মা, তিতিরের জন্মের পর আজ প্রথম তার বাবার কোলে উঠেছে। তিতিরকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছে৷ তিতির এখন আবার অন্য নাম ধরে ডাকছে৷ তিতির বলল ‘ মা, মাম মাম মা ‘
এ ডাক রিমনের কান অব্দি পৌঁছালো। পরক্ষণেই তার কাল রাতের সব ঘটনা সিরিয়াল বাই সিরিয়াল মনে পরে গেলো। চোখ জেনো আর বাধা মানছে না। অশ্রু গড়িয়ে পরছে গাল বেয়ে। মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে বসে পরল।
রুমের সামনে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছে রিমি ও তার মা। তাদের চোখেও যে পানি টলমল করছে।
তিতিরকে নিজের সামনে এনে কপালে আলতে চুমু একে দিয়ে আবারও বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে।
পেছন থেকে কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে পেছনে ফিরে তাকালো৷ রিমি পেছনে থেকে রিমনকে জড়িয়ে ধরেছে। মা সামনে বসে রিমনের চুলে হাত রেখে কপালে চুমু একে দেয়।
বিছানার উপর বসে পায়ের উপর বালিশ রেখে তাতে তিতিরকে শুয়ে দিয়ে, চামচ দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। রিমন পাশে বসে তা দেখছে,
বা বা বাববা, করতে করতে নাকে মুখে খাবার তাউলায় উঠে যায় তিতিরের।
রিমন অস্ফুটস্বরে বলে উঠল, ‘ মা কিভাবে খাওয়াচ্ছো, তুমি পারবে না দাও আমাকে দাও। ‘
বলে তিতিরকে নিজের হাতের উপর শুয়ে রেখে একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছে। রিমি ও মা দু’জনে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে দু’জনের চোখেই জল। রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে এদৃশ্য দেখে আপনমনে হাসছে, সে তো এটাই চেয়েছিল। তাদের মেয়ে তার বাবার আদর ভালোবাসা যত্ন টুকু পাক। রিমনের রুমের ওই কোণায় চোখ পরতে দেখল বৃষ্টি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে তার এক চিলতে প্রাণোচ্ছল হাসি। রিমন তার দিকে তাকিয়ে মৃদুহাসি দিলো। সেও মুখে হাসি রেখে দুইবার চোখের পলক ফেলল। তারপর একপলকেই চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো।
#চলবে?
#পাগল_প্রেমিকা
#পর্ব_৪৭
#Sharmin_Akter_Borsha
________
সন্ধ্যার পরে তিতির হঠাৎ করেই কান্না শুরু করে দেয়। তাকে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল, রিমি ও তিতিরের দাদু ফোন করে রিমনকে তারাতাড়ি বাড়িতে আসতে বলে, কিন্তু তার যে অফিসের কাজের চাপ অতিরিক্ত, তারপরেও মেয়ের জন্য ধ্রুত সব কাজ শেষ করে অফিস থেকে বের হলো। তারপরও সব কাজ শেষ করতে করতে প্রায় রাত দশটার লাগাত বেজে যায়। ততক্ষণে তিতির ঘুমিয়ে পরে। তিতিরকে বিছানার উপর শুয়ে দিলে সে আপনা আপনি কাত হয়ে যায়। আর চোখের পলকেই সে ঘুমিয়ে যায়।
সকলেই খেয়ে ডাইনিং টেবিলের উপর রিমনের জন্য খাবার বেরে ডাকন দিয়ে ডেকে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরে। রিমনের কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় তাকে কাউকে ডাকতে হয়না। সে লক খুলে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই সামনে থেকে ‘ ভোহহ ‘ বলে চিৎকার দিলো। এমনিতেই বাড়ির সকল লাইট অফ করাছিল তারপরে ঘুটঘুটে অন্ধকার সেখানে হটাৎ কেউ সামনে এসে এভাবে ভয় দেখালে তো আত্মা বের হওয়ার অতিক্রম হয়৷ বুকের উপর হাত রেখে শাণিতকন্ঠে বলল, ‘ এটা কি ছিল? ‘
বৃষ্টি ফিক করে হেঁসে দেয়। এই অন্ধকারে তা দেখতে না পেলেও ঠিক শুনতে পাচ্ছে। তা রিমন বৃষ্টি কে দেখার জন্য লাইট অন করতে নিলে বৃষ্টি রিমনকে থামিয়ে বলে, ‘ লাইট জ্বালিও না, লাইটের পাওয়ার অনেক বেশি অন করলে আমাকে দেখতে পারবে না। ‘.
রিমন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ ছুঁতে তো পারবো ‘
বলে বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। দু’জনে হাত ধরে সিড়ি দিয়ে উপরে চলে যায়। মা’য়ের দরজার সামনে গিয়ে টোকা দিতে সে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। রিমন ভেতরে গিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। অতঃপর বলে, ‘ মা আমি তিতিরকে আমার রুমে নিয়ে যাই, আজ থেকে আমার মেয়ে আমার সাথেই থাকবে। ‘
মা প্রথমত দ্বিমত করেছিল কারণ এতটুকু বাচ্চা রাতে যদি উঠে ত্যক্ত করে অথবা তার উপরে যদি রিমন হুট করে হাত পা উঠিয়ে দেয় তখন তো হিতে বিপরীত হবে। তারপরও ছেলে চাইছে বলে নিয়ে যেতে বলে।
ঘুমন্ত তিতিরকে বিছানার উপর শুয়ে দেয়। মাথার কাছে বসে তিতিরকে মন ভরে দেখছে বৃষ্টি, ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসল রিমন। বৃষ্টি কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে টিটকারি মেরে বলল, ‘ সোনা বউ এইভাবে তাকিয়ে থেকো না, আমার মেয়ের নজর লেগে যাবে তো? ‘
বৃষ্টি রিমনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। প্রতিত্তোরে কিছু না বলে এক পাশে শুয়ে পরল। অন্য পাশে রিমন শুলো। তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ আমাদের মেয়ে। ‘
এবারও বৃষ্টি কোনো প্রতিত্তোর করল না। শুধু দু-চোখ দিয়ে অশ্রু ছেড়ে দিলো। এখানে রিমনের ও যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।
_____
ভোরের মিষ্টি আলো তিতিরের মুখ পানে পরছে, সে বারবার নড়েচড়ে উঠছে, কিছুক্ষণের মধ্যে সে পুরোপুরি ঘুম থেকে উঠে যায়। নিজে হাপুড় দিয়ে একা একাই উঠে বসে রিমনের চোখে মুখে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে, চোখের উপর খোঁচা দিচ্ছে নাকের ভেতর দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছে, লাফ দিয়ে উঠে বসে দেখে মা মেয়ে দুজন হাসছে। তিতিরকে কোলে নিয়ে বিছানা থেকে নিচে নেমে পরে। রিমন তিতিরকে কোলে নিয়ে ঝাঁকুনি দিচ্ছে, মুখের উপরে দাঁত উঠেছে সে দাঁত দু’টো বের করে খিলখিল করে হাসছে। বৃষ্টি রিমনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিতির জেনো ওর মা’কে দেখতে পায়। এক হাত বাড়িয়ে দেয় সে বৃষ্টির দিকে কোলে তো নিতে পারবে না। তবে আঙুল ছুতে তো পারবে। সে তিতিরের আঙুল স্পর্শ করতে তিতির আবারও খিলখিল করে হেঁসে ফেলে একবার বৃষ্টির দিকে তো আরেকবার রিমনের দিকে তাকাচ্ছে, রিমন ও বৃষ্টি তিতিরের কান্ড দেখে ফিক করে হেঁসে ফেলে। এতে তিতির ও সাই দিয়ে শব্দ করে হাসে।
সকাল হয়েছে তিতিরকে খাওয়ানোরও সময় হয়ে গেছে। মা এসে দরজায় কড়া নাড়ছে, দরজা খুলে দিলে সে তিতিরকে তার রুমে নিয়ে চলে যায়।
রিমন তিতিরকে দিয়ে পেছনে ঘুরতে বৃষ্টিকে দেখতে পায়না বলে জোর করে হাসার চেষ্টা করে তবুও চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।
_____
দেখতে দেখতে প্রায় চারটা বছর গেটে যায়। এর মাঝে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। সবাই অতীত পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায় তবে শুধু একজনই সেই অতীত আগড়ে ধরেই বেঁচে আছে, এই চার বছরে বৃষ্টি তেমন আর রিমনের সাথে দেখা করতে আসেনি। মাঝে মধ্যে রিমন বৃষ্টিকে অতি স্বরং করলে এসেছে, তবে বেশিক্ষণ থাকেনি। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর রিমন বৃষ্টিকে এতটাই ভালোবেসে যে সেখানে অন্য কারো কোনো জায়গা নেই। বৃষ্টির পর আজ পর্যন্ত রিমন তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছে, মেয়ে বলতে অজ্ঞান রিমন। এই চারবছরে সে অনেক উন্নতি করেছে, এখন আর সে অন্য কারো অফিসে জব করে না। তার এখন নিজেরই দুইটা অফিস হয়েছে, নিজেরই এখন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি হয়েছে, বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নেই, মেইড স্টাফ আছে তারা বাদে আপন বলতে একমাত্র মা আর তিতির রয়েছে তবে মাঝেমধ্যে বৃষ্টি আসে রিমনের একা কৃত্তের সঙ্গী হতে। সপ্তাহে একদিন রিমন বৃষ্টির কবর জিয়ারত করতে যায় সাথে তিতিরকেও নিয়ে যায় সে এখন বুঝতে পারে সবই, সে জানে তার মা এই পৃথিবীতে নেই, তাকে জন্ম দিতে গিয়েই তার মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন।
কবর জিয়ারত সম্পূর্ণ হলে কবরের পাশে বসে, এক সপ্তাহের কিচ্ছা কাহিনী বলা শুরু করে। যাওয়ার আগে নিয়ম করে বুকের বা পাশের দিকটায় ব্লেজারের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা লাল গোলাপ বের করে, ফুল টাতে নিজের ঠোঁটের আলতো পরশ একে দিয়ে কবরের উপর রাখে আর বলে, ‘ খুব ভালোবাসি আমার প্রিয় দর্শিনী তোমাকে ‘
মেয়ের হাত ধরে সেখান থেকে চলতে শুরু করে। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেও রিমনের প্রতিটি কথায় বৃষ্টির নাম উচ্চারিত হয়।
______
একটা ইয়াং ছেলে তো আর সারাজীবন একা থাকতে পারবে না। তাকেও তো তার সংসার নতুন করে বাঁধতে হবে। এই নিয়ে আলোচনা করছিলেন তখনই রিমন সহ তিতির বাড়িতে প্রবেশ করল তাদের দেখে বাকি সবাই চুপ হয়ে যায়।
সন্ধ্যা সকলে একসাথে
চলবে