#পাগল_প্রেমিকা
#পর্ব_৪৪,৪৫
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
৪৪
_________
কয়েকমাস পর,
আজ বৃষ্টির সাত মাসের সাধ দুই পরিবারের সকলে একত্র হয়েছে। খুবই ধুমধাম করে আয়োজন করা হয়েছে এলাকার অধিকাংশ মানুষই নিমন্ত্রিত কম বেশি অনেকেই চলে আসছে। বৃষ্টি কে নতুন লাল সুতি কাপড় পড়ানো হয়েছে। বাড়ির উঠানে সকল মুরব্বিরা বসে চালের সেঁওই বানাচ্ছে। তাদের প্রাচীনকালের মাননা, সেঁওই বানিয়ে রেখে দেওয়ার পর সেটা যদি ফাটে তাহলে মেয়ে হবে, আর যদি না ফাটে তাহলে ছেলে হবে৷ সবাই খুব আনন্দের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে। মাটির চুলা তৈরি করার জন্য কতগুলো ঈট এনে গোল করে রেখেছে তারপরে বড় বাতিলে সেঁওই রান্না বসিয়ে দিলো।
গরম গরম সেঁওই নিয়ে এক বড় ডিসের উপর ঢাললো পরে তা রুমের মধ্যে নিয়ে রেখে দিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সাধের অনুষ্ঠান শুরু হয়।
সব কিছুই ঠিকঠাক ভাবে সম্পূর্ণ হয় তবে সেঁওই যা
রান্না করে রেখেছিল। তা ডিসের মধ্যেই খুব খারাপ ভাবে ফাটল ধরেছে। সবাই একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ফট করে তাদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, ‘ এ আল্লাহ মাইয়া হইবো গো মাইয়া হুহ ‘
তার বলা কথা বৃষ্টির কান অবধি আসতে প্রতি উত্তরে বৃষ্টি মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ আপনি নিজেও তো মেয়ে তাহলে আমার মেয়ে হবে ভেবে তাকে তাচ্ছিল্য করলেন কেনো? আমার মেয়ে হবে না ছেলে হবে সেটা সম্পূর্ণ আমার আল্লাহর ইচ্ছা, আমার আল্লাহ খুশি হয়ে আমাকে যা দান করবে আমি তাতেই আলহামদুলিল্লাহ। আর আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলছি, আমার যদি সত্যি মেয়ে হয় তার নাম আমি রাখলাম ‘ তিতির ‘ আমার মেয়ের নাম তিতির। আর আমার মেয়েকে তাচ্ছিল্য করার কোনো অধিকার আপনাদের নেই। ‘
মহিলা মাথা নত করে কথাগুলো হজম করল৷
______
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গা থেকে গয়না গুলো খুলিতেছিল বৃষ্টি রিমন পেছন থেকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ তুমি জানো তোমাকে এখন কেমন লাগে? ‘
বৃষ্টি এক নজর রিমনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কেমন? ‘
সে বলল, ‘ গোল আলুর মতো ‘
বলে হাসতে হাসতে বিছানার উপর শুয়ে পরল। বৃষ্টি হাতে থাকা ভাড়ি একটা গহনা রিমনের দিকে ছুড়ে মেরে বলল, ‘ অসভ্য ‘
রিমন বিছানা থেকে উঠে গিয়ে বৃষ্টি কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। আর বলল, ‘ তোমাকে এখন আগের থেকেও বেশি কিউট লাগে একদম গুলুমুলু বউ একটা আমার। ‘
বৃষ্টি পেছনে ঘুরে রিমনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ I love you ‘
তবে রিমন শুনেও কোনো উত্তর দিলো না শুধু বৃষ্টির কপালে আলতো করে একটা চুমু একে দিলো।
বৃষ্টি মুখ ভাড়ি করে মুচকি হাসি দিলো।
______
সময়ের মতো সময় ঘনিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির যন্ত্রণা দিনদিন বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই শান্তি মিলে না। দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়েছে ডেলিভারির ও সময় চলে আসছে যে কোনো দিন ব্যথা উঠতে পারে। আজ রাতের ফ্লাইটে উঠেছে ডাক্তার নীল বাংলাদেশে এসে পৌঁছাতে প্রায় আরও ঘন্টা খানিক লাগবে৷ বৃষ্টি কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য আগে থেকে কাউকে বলেনি আজ যে বাংলাদেশে আসছে৷
রিমনও আজ এখনও বাড়ি ফিরেনি বৃষ্টির মনও আজ উদাসীনতায় ডুবে গেছে। মনের মধ্যে উতালপাতাল শুরু হয়েছে। মনের আঙ্গিনায় এক ভয় বাসা বেঁধেছে তবে ভয় টা কিসের তা অজানা। অনেকক্ষণ যাবৎ একা একা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছে করছে গান গাইতে, বৃষ্টির কেনো জানি এই গানটাই গাইতে ইচ্ছে করছে সে আপন মনে গান গাইতে শুরু করল, 🌸
মইরা গেলে কানবা ঠিকি
বাঁইচা থাকতে বুঝলা না,
হাতের ধন ঠেললা পায়ে আপন মানুষ খুঁজলা না,
আঙুল ধরে তাকাই দেখো
মায়া মায়া লাগবে গো,
চোখটা একটু বাঁকাই দেখো
কষ্ট মনে জাগবে গো,
হারাই গেলে সাধবা ঠিকি
এখন যারে বুঝলা না,
হাতের ধন ঠেললা পায়ে
আপন মানুষ খুঁজলা না,
কপালে হাত রাইখা দেখো
নিজের ভাগ্য পাইবা গো,
ঠোঁটের কাছে থাইকা দেখো
থাকতে আরও চাইবা গো,
একা একা হাসবা ঠিকি
আজ যে ভাষা বুঝলা না,
হাতের ধন ঠেললা পায়ে
আপন মানুষ খুঁজলা না,
মইরা গেলে কানবা ঠিকই
বাঁইচা থাকতে বুঝলা না. 🌸
রুমে আসছে অনেকক্ষণই হয়েছে বৃষ্টির গান শুনে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আজ গানের কন্ঠে অনেক কষ্ট ছিল। পেছন থেকে বলে উঠল, ‘ আজ হঠাৎ এই গানটা কেনো গাইলে? ‘
পেছনে ঘুরে রিমনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ তুমি কখন আসলে? ‘
‘ তুমি যখন গান শুরু করে ছিলে তখন আসছি। এখন বলো এই গানটাই কেনো গাইলে? ‘
‘ তুমি আমাকে ভালোবাসি শব্দ টা এখনও বলোনি তাই এই গানটাই গাইতে ইচ্ছে করল। বলো না ভালোবাসো, লাস্ট বার একবার একটিবার বলো না তুমিও আমাকে ভালোবাসো। আমি তোমার মুখে ভালোবাসি বৃষ্টি তোমাকে শব্দ টা শুনতে চাই। ‘
রিমন নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, বৃষ্টির চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ আজ বলার মুড নেই অন্য দিন বলব। ‘
বলে রুমে চলে আসল, রাগে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিলো। ইনসাল্ট করল নাকি অপমান কোনটা করল হুহ ভালোবাসি বলতে আবার মুড লাগে? আসলেই নষ্টা, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ রিমনকে উদ্ধার করল তারপর রুমে এসে পরল।
রাতে সকলে এক সাথে ডিনার করে যার যার রুমে চলে গেলো। বৃষ্টি এখন আর কোনো সাইডে কাত হয়ে শুতে পারে না তাকে সোজা হয়েই শুতে হয়। শুয়ে রয়েছে পাশ থেকে রিমন আজ সারাদিন অফিসে কি কি কাজ করল সব কিছুই ওর সাথে শেয়ার করছে৷ কান দিয়ে শুনছে তো আরেক কান দিয়ে বের করছে, শুনতে শুনতে একটা সময় ঘুমিয়ে গেছে। ঘুমিয়ে গেছে দেখে শরীরের উপর কাঁথা দিয়ে দেয় রুমের লাইট অফ করে নিজেও ঘুমিয়ে যায়।
পরদিন সকালে, ফজরের আজানের সময় ঘুম ভেঙে যায় নামাজ পড়ে কোরআন পাঠ করে কিচেনে চলে যায়৷ সবার জন্য নাস্তা বানানোর জন্য আজ অনেক ইচ্ছে করছে সবার জন্য খাবার বানাতে তাই রহিমার সাহায্য নিয়ে সবার জন্য সকালে ব্রেকফাস্ট বানালো। রিমনের জন্য কফি বানিয়ে কিচেন থেকে বের হলো। এক হাত দিয়ে কোমড় চেপে ধরেছে অন্য হাতে কফির মগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে।
এমন সময় হুট করে ব্যথা অনুভব করল। সামান্য ব্যথা মনে করে পাত্তা দেয়নি৷ এমন ব্যথা তো প্রায়ই হয় সেজন্য গুরুত্ব না দিয়ে আবারও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাবে চোখের পলকে ব্যাথা তীব্র হয়ে গেলো। এ ব্যথা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কফির মগ হাত থেকে ফেলে দিলো। ‘ রহিমা আপা আমাকে ধরেন ‘ বলে সিড়ির উপর চিৎকার দিয়ে বসে পরল। কিচেন থেকে বৃষ্টির ডাক শুনে ছুটে বের হলো রহিমা বৃষ্টিকে সিঁড়ি তে এমন ভাবে বসে থাকতে দেখে চিৎকার চেচামেচি দিয়ে বৃষ্টির কাছে এসে হাত শক্ত করে ধরল। চিৎকার শুনে বাকিদের ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভেঙে বৃষ্টিকে বিছানায় না পেয়ে বাহিরে ছুটে আসে৷ সবাই এসে দেখে সিঁড়ির উপর বসে ব্যথায় কুঁকড়াচ্ছে, ছুটে এসে রিমন বৃষ্টি কে কোলে তুলে নিলো৷ মা বলল, ‘ ওকে এখনই হাসপাতালে নিতে হবে। ‘
রিমন একা বৃষ্টিকে কোলে করে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছিল কারন বৃষ্টি এখন আর একা নয়, আর মেয়েদের এই সময় স্বাস্থ্য উন্নতি হয়। কোনো মতে বাড়ির বাহিরে এসে গাড়িতে নিয়ে উঠে, রিমনের অবস্থা এখন একটু জটিল গাড়ি চালাতে পারবে না বলে সোহান গাড়ি চালাচ্ছে।
ফজরের আজানের পরপরই ফ্লাইট বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছিল। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকেই হাসপাতালে আসে সবার সাথে দেখা করে বৃষ্টির সাথে দেখা করতে যাবে এই চিন্তা ভাবনা।
নিজের চেম্বারে বসে খুটিনাটি চেক করছিলেন।
আজও মিলি দরজা নক না করেই হুট করে চেম্বারে ঢুকে পরে এতে ডাক্তার নীল আগের মতো রিয়েক্ট করতে যাবে তার আগে মিলি তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, ‘ একদম চুপ কিছু বলবেন না। আমি খুবই তারাহুড়োর মধ্যে আছি তাই নক করতে ভুলে গেছি। এখন আপনি চলুন ওখানে একজনের লিভারপেইন উঠেছে। ‘
ভ্রু কুঞ্চিত করে রাগান্বিত স্বরে বলল, ‘ অন্য ডাক্তার কে বলো হাসপাতালে কি ডাক্তারের কম পরেছে নাকি? ‘
মিলি তেজি কন্ঠে বলল, ‘ ডাক্তার নীল পেসেন্ট উনি তো আপনার ফ্রেন্ড তাইতো আপনার কাছে আসলাম। ‘
ফ্রেন্ড শুনে মিলির দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ কোন ফ্রেন্ড? আমার মনে হয় না আমার ছেলে ফ্রেন্ডের লিভার পেইন হওয়া সম্ভব? ‘
মিলি বিরক্তি ঝেড়ে বলল, ‘ ছেলে কেন হতে যাবে সে তো মেয়ে কি জেনো নাম? ও হ্যাঁ মনে পরেছে বৃষ্টি ‘
নাম শুনে চলকে উঠল নীল বৃষ্টি প্রেগন্যান্ট কবে হলো আর ডেলিভারির সময়ও চলে আসল। তারাহুরো করে চেম্বার থেকে বের হলো। কেবিনের সামনে আসতে দেখল বৃষ্টির অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল ‘ ওকে এখনই আইসিইউ তে নিতে হবে। ‘
পেছনে ঘুরে দেখল নীল রিমন নীলের উদ্দেশ্য প্রশ্ন করল। ‘ তুমি কবে আসছো? ‘
‘ আজ ভোরেই আসছি, বেশি কথা বলার সময় নেই ওকে এখনই আইসিইউ তে নেওয়ার ব্যবস্থা করো। ‘
বৃষ্টি কে আইসিইউতে নিতে যাবে তখন, বৃষ্টি একহাত দিয়ে রিমনের হাত চেপে ধরে বলল, ‘ বলো না রাইটার বাবু তুমি আমাকে ভালোবাসো। লাস্ট বারের জন্য জানতে চাচ্ছি এখন না বললে আর কখনো জানতে চাইবো না৷ বলো না ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি তোমাকে তুমি প্লিজ বলো, ‘
রিমন বৃষ্টির উদ্দেশ্য কিছুই বলতে পারল না তার আগেই নার্স বৃষ্টিকে নিয়ে চলে গেলো।
এরই মধ্যে বৃষ্টির বাড়িতে কল দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছে গাড়ি দিয়ে আসলে রোডে জ্যামে পরতে পারে তাই তারা ট্রেনে করে আসছে।
ঘন্টা খানিক হয়ে গেছে কিন্তু এখনও কোনো খোঁজ খবর নেই। না আসছে ডাক্তার না আসছে নার্স৷ কিছুক্ষণ পর ডাক্তার নীল আইসিইউ থেকে বের হয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ বৃষ্টির অবস্থা খুবই সিরিয়াস বাচ্চা জরায়ুমুখের সামনে এসে রয়েছে তবে বাচ্চা উল্টো হয়ে আছে৷ যার ফলে ক্রিটিকাল অবস্থা। এখন আমরা সিজারও করতে পারবো না। সিজার করতে গেলে বাচ্চা বাঁচাতে পারবো না। আপনারা দোয়া করেন জেনো বাচ্চা নরমাল ডেলিভারিতে হয় ও সুস্থ ভাবে হয়। আর আমাদের ইমেডিয়েট A+ (Aপজিটিভ) এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। পেছনে থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল রক্ত লাগলে আমি দেবো আমার আর বৃষ্টির ব্লাড গ্রুপ সেম। দু’জন মেয়ে এদিকেই আসছে আর কথাটা বলছে।
ডাক্তার নীল তাদের পরিচয় জানতে চাইলে প্রথম মেয়েটা বলে, ‘ আমি অধরা ‘
দ্বিতীয় মেয়ে, ‘ আমি লাবণ্য! আমরা বৃষ্টির ক্লাসমেইট ও বেস্ট ফ্রেন্ড। আপনি আমার রক্ত নিন আমাদের ব্লাড সেইম। ‘
ডাক্তার নীল কিছুক্ষণ মণ থেকে লাবণ্য কে নিজের সাথে আইসিইউতে নিয়ে যাবে। রক্ত দেওয়া হয় এক ব্যাগ কিন্তু এখন পর্যন্ত বাচ্চার পজিশন ঠিক হয়নি। মাঝখানে নীল আবারও বের হয়েছিল। তখন রিমন নীলের হাত ধরে রিকুয়েষ্ট করে বলেছিল, ‘ আমার বউ বাচ্চা দু’জনকে সুস্থ করে দাও। ‘
ডাক্তার নীল, ‘ সমস্ত কিছু আল্লাহর ইচ্ছা আল্লাহ আল্লাহ ডাকুন আমরা চেষ্টা করছি। ‘
বলে চলে যায়, অবশেষে বাচ্চার পজিশন উল্টো তেই বাচ্চা প্রসব হয়। খুবই জোরে চিৎকার দিয়েছিল বৃষ্টি। একটা ফুটফুটে পরীর মতো কন্যা সন্তানের জন্ম হলো। বাচ্চার আকার আকৃতি সব সম্পূর্ণ বৃষ্টির মতো।বাচ্চা পূর্ণার কোলে দিয়ে বাহিরে পাঠিয়ে দিলেন।
দীর্ঘ ক্ষণ বাধ আইসিইউ থেকে ডাক্তার নীল বের হলো। পেছনে হুইলবেডে বৃষ্টি কে নিয়ে আসা হচ্ছে।
ডাক্তার নীল বললেন, বাচ্চার হয়তো খিদে পেয়েছে তাকে তোমার মার কাছে দাও
#চলবে?
#পাগল_প্রেমিকা
#পর্ব_৪৫
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_______
‘ ওও, ওকে ওমন সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে কেনো রেখেছেন? ‘ তোতলিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল রিমন। কিছু সময় চুপ থেকে প্রত্যত্তরে বলল,
‘ বাচ্চার পজিশন উল্টো ছিল আমরা অনেক চেষ্টা করে বাচ্চা ডেলিভারি ঠিক মতো করতে পেরেছি। তবে ডেলিভারির সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়, যার জন্য আমরা ‘ আর কিছুই বলতে পারল না। মুখ থমথমে হয়ে গেলো গলার মধ্যেই কথা জেনো আটকে গেছে চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গাল বেয়ে পরল।
ডাক্তার নীল এর সামনে থেকে হেঁটে গিয়ে বেডের সামনে দাঁড়ালো নিজের হাতে মুখের উপর থেকে সাদা চাদর টা সরালো, কি সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছে বৃষ্টি। কোনো সাড়াশব্দ নেই কিছুক্ষণের জন্য পুরোপুরি রিমন থমকে গেলো হঠাৎ করে ‘ বৃষ্টি ‘ বলে চিৎকার দিয়ে। বৃষ্টির পিঠের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নিজের বুকের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। পাগলের মতো চিৎকার দিয়ে কাঁদছে, গালের উপর হাত রেখে আলতে চাপ দিয়ে ডাকছে আর বলছে, ‘ এই বৃষ্টি উঠো, বৃষ্টি কি হয়েছে বৃষ্টি চোখ কেনো খুলছো না। তুমি না বলেছিল চিরজীবনের জন্য আমার হয়ে থাকবে তাহলে এখন কেনো চুপ হয়ে আছো। বৃষ্টি ওই বৃষ্টি, মা ও মা বলো না বৃষ্টি কে উঠতে ও কেনো উঠছে আমার সাথে কথা কেনো বলছে না, আমার কলিজা উঠ না। তুই না শুনতে চেয়েছিলি আমি তোকে ভালোবাসি কি না। হ্যাঁ আমি তোকে ভালোবাসি খুব ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি এই বৃষ্টি এইবার তো উঠো৷
আমি ভালোবাসি বৃষ্টি তোমাকে তুমি কেনো ছেড়ে চলে গেলে আমাকে আমি বাঁচবো কি করে তোমাকে ছাড়া আমি যখন ভালোবাসি বলতাম না তখন তুমি শুনতে চাইতে আর আজ আমি যখন বলছি তখন তুমি শুনতে চাচ্ছো না। কিন্তু কেনো বৃষ্টি আমার জান আমার কলিজা উঠো না প্লিজ ওই উঠো না। আহহহহ আল্লাহ আমার বৃষ্টি কে কেনো কেড়ে নিলা আমার থেকে আমার বৃষ্টির প্রাণ ফিরিয়ে দাও আল্লাহ।
সোহান রিমনের কাঁধের উপর হাত রেখে শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘ চোয়াল শক্ত কর ভাই এভাবে ভেঙে পরিস না। ‘
রিমন সোহানের এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘ ভাই ওই ভাই বৃষ্ বৃষ্টি তো তোর সব কথাই শুনতো তাই না বল। তুই তুই ওকে ডাকলে ও নিশ্চয়ই উঠবে, ডাক না ভাই ওকে, ও কেনো এখানে এভাবে শুয়ে আছে। ওকে কেউ উঠতে বলছো না কেনো? রিমি এই রিমি তু.ই তুই বল না ওকে উঠতে তুই বললে ও নিশ্চয়ই উঠবে মা তুমি একবার বলো না ওকে উঠতে। ডাক্তার নীল তুমি তো বৃষ্টির বেস্ট ফ্রেন্ড বলো তুমি ওকে ডাকো না প্লিজ তোমরা সবাই এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেকা কান্না কেনো করছো? আমার বৃষ্টির কিছু হয়নি ও এখনই উঠে দেখো #writer_babu বলে ডাকবে। তোমরা প্লিজ কান্না বন্ধ করো। আমার বৃষ্টি এখনই উঠবে।
সবার সামনে গিয়ে গিয়ে সবার হাতে ধরে কথাগুলো বলে আবারও বৃষ্টির কাছে গিয়ে গালে হাত দিয়ে ডাকতেছে, ‘ এই বৃষ্টি আমার জানপাখি দেখো তোমার রাইটার বাবু তোমাকে ডাকছে প্লিজ উঠো লক্ষীটি প্লিজ উঠো একবার আমার নাম ধরো ডাকো প্লিজ এই উঠো।
বৃষ্টির কাঁধে হাত দিয়ে শরীর ঝাঁকাতে লাগল। বৃষ্টির চিবুকের উপর মাথা রেখে অশ্রুপাত করছে। এভাবে ভেঙে পরলে মানসিক আঘাত পেতে পারে। ডাক্তার নীল, পূর্ণা আর মিলির দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করল। তারা দুজন মাথা উপর নিচ করে সেখান থেকে চলে গেলো। এদিকে রিমনের কাঁদতে কাঁদতে হিচকিনি উঠে গেছে কেউ তাকে বৃষ্টির থেকে দূরে সরাতে পারছে না। এবং কান্না কোনো মতেই থামছে না৷ এদিকে নবজাতক শিশু খিদে তে কেঁদে উঠছে। এ কান্না যদি আজ তার মা শুনতে পেতো তাহলে কি তাকে এভাবে কাঁদতে দিতো নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে রেখে কান্না থামাতো কিন্তু আফসোস সে মা আজ নেই তার কান উব্ধি পৌঁছাচ্ছে না। সকলের চোখে পানি রিমনের কান্নাকাটি শুনে আশে পাশের কেবিন থেকো মানুষ জন ছুটে এসেছে। রিমনের কান্না দেখে তাদের চোখেও পানি জমেছে। পূর্ণা ইনজেকশন নীল এর হাতে এনে দিতে ডাক্তার নীল ইনজেকশন রিমনের বা হাতে পুশ করে দেয়। কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পরে সে। বৃষ্টির নিস্তেজ দেহ নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে আসে। আশেপাশে এলাকায় ছড়িয়ে পরে রিমন এর বউ বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে গত হয়েছে। আশেপাশের মানুষ সবাই আশে তাকে দেখতে। বৃষ্টি কে দেখে এক মহিলা বলল, ‘ ওইদিন মেয়ে হবে বলেছিলাম বলে আমাকে কত কথাই না শুনিয়েছিল আর আজ সেই মেয়েই গিলে খেলো তোমার বউ টাকে। ‘
এমন অবস্থায় নাতনি কে কোলে নিয়ে অশ্রুপাত গোটাচ্ছিলেন প্রতিবেশী হওয়ার তাগিদে কোথায় সান্ত্বনা দিবেন তা না উল্টো কটু কথা বলছেন৷ এই অবস্থায় তাদের কি বলবেন জানা নেই। কয়েক ঘন্টা আগে জন্ম নেওয়া নাতনিকে বুকের সাথে চেপে ধরে গত হওয়া বউমার শোকে আহত হয়ে পরেছেন৷ বাড়ির সামনে মানুষের ভিড় সবাইকে ঢেলে সামনে আসলেন বৃষ্টির পরিবার, এত কম বয়সে নিজেদের মেয়েকে হারিয়ে তাদেরও করুণ অবস্থা সবার উপস্থিতির পর বৃষ্টি কে শেষ গোসল করানোর জন্য নিয়ে যায়। গোসল শেষে মসজিদের খাটে শুইয়ে দেওয়া হয়। চার মাথায় চারজনে ধরে মসজিদের উদ্দেশ্য নিয়ে যায়। জানাজা শেষ করে কবরস্থানের উদ্দেশ্য নিয়ে যাওয়া হয়। পলকের মধ্যেই বৃষ্টি কে মাটির বিছানায় শুইয়ে মাটি চাপা দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরলে লাফ দিয়ে উঠে বসে। রুম থেকে দৌড়ে বাহির হয় বাড়ির সামনে মানুষের হড্ড ভীড় দুয়ারে উঠানে যে যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানে বসে কান্না জুড়ে দিয়েছে।
রিমন তাদের সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ‘ আমার বৃষ্টি কোথায়? ‘
এক মহিলা বলল, ‘ তাকে তো জানাজার পর কবরস্থানে নিয়ে গিয়েছে। ‘
‘ নাহহ ‘ বলে এক চিৎকার দিয়ে বাড়ি থেকে হন্ন হয়ে ছুটে বের হয়। দৌড়াচ্ছে কবর দেওয়ার আগে সেখানে পৌছাতে হবে। কানের মধ্যে শুধু একটাই শব্দ ভাসিতেছে, গতকাল রাতে বৃষ্টির গাওয়া গান, ‘ মইরা গেলে কানবা ঠিকই বাঁইচা থাকতে বুঝলা না। ‘
দুই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে দৌঁড়ে কবরস্থানের কাছে আসল। এসে দেখে কবর দেওয়া সম্পূর্ণ মসজিদের ইমাম সাহেব ও কিছু মুসল্লী মোনাজাত করছেন। রিমন এক দৌড়ে ছুটে এসে বৃষ্টির কবরের উপর পরল। দুই হাতের মুঠির মধ্যে মাটি নিয়ে চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘ তোমরা কেনো আমার বৃষ্টি কে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো কেনো আমার বৃষ্টি কে আমার অগোচরে দাফন করেছো কেনো আমার বৃষ্টি কে আমার থেকে আলাদা করে দিয়েছো কেনো আমাকে শেষ বারের মতো দেখতেও দিলে না। আমার বৃষ্টি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আমি কেনো তাকে আটকাতে পারলাম না। আমার কাছে কতবার ভালোবাসি শব্দ টা শুনতে চেয়েছিল আমি তাকে ভালোবাসতাম তবে কেনো তাকে বলিনি। সে বলেছিল আজকেই শেষ আর কখনো শুনতে চাইবো না তবুও আমি তার কথার গুরুত্ব দেইনি। আমি বলিনি তাকে আমিও যে তাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। সে যদি হয় ভালোবাসায় #পাগল_প্রেমিকা তাহলে আমি তার ভালোবাসার #পাগল_প্রেমিক
বলে আবারও কান্নায় ভেঙে পরল৷ সবাই কবরস্থান থেকে চলে গেলো শুধু রিমন তার বৃষ্টিকে ছেড়ে যায়নি। কারণ বৃষ্টি বলেছিল তার অন্ধকারে থাকতে ভয় করে। আর আজ সেই বৃষ্টি অন্ধকার কবরে একা শুয়ে আছে, রিমন তার বৃষ্টি কে একা ছেড়ে কিছুতেই যাবে না। কবরের উপর উপুড় হয়ে মাটি যাপ্টে ধরে শুয়ে কেঁদেই যাচ্ছে আর বলল, ‘ জানপাখি শুনতে পাচ্ছো খুব বেশি ভালোবাসি তোমায়! ভয় করছে? ভয় পেয়ো না আমি তো আছি, আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না বৃষ্টি একটি বারও ভালোবাসি বলার সুযোগ দিলে না আমায়৷ ভেবেছিলাম আমাদের সন্তান কে কোলে নিয়ে তারপর তোমাদের দু’জন কে একসাথে বলবো ভালোবাসি৷ কিন্তু তুই আমার থেকেও বড় নিষ্ঠুর পাখি তুমি আমাকে সেই সুযোগ টুকুও দাওনি। 😭
আমি রিমন হাসান আজ এই খোলা আকাশের নিচে, কবরস্থানের সকল কবরবাসিদের সাক্ষী রেখে বলছি বৃষ্টি আমি তোমাকে ভালোবাসি তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার ডাক আমি তোমাকে ভালোবাসি। বৃষ্টি আমি ভালোবাসি তোমাকে!