#পাগল_প্রেমিকা
#অন্তিম_পর্ব
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
_______
সন্ধ্যার পর নাস্তার টেবিলে বসে অনেক ভেবে-চিন্তে মিসেস খান রিমনের বিয়ের প্রসঙ্গ তোলেন।
মেয়েকে পাশের চেয়ারে বসিয়ে জেলি দিয়ে পাউরুটি রুটি খাওয়াচ্ছিল মায়ের এমন কথা শুনে ভ্রুখানিক কুঞ্চিত করে তাকালো, তিনি আবারও বললেন, ‘ আমরা তোর ভালো চাই, যার যাওয়ার সে চলে গেছে বাবা তার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আর কত বছর বেঁচে থাকবি। সারাজীবন পরে আছে তোর এমন ভাবে একা তো আর থাকতে পারবি না। জীবনে বাঁচতে হলে একজন জীবনসঙ্গিনীর প্রয়োজন। আমি মা হয়ে তোকে এমন ভাবে দেখতে পারবো না। আমি মেয়ে দেখে নিয়েছি খুবই ভালো মেয়ে, রূপে ও গুনে সব দিক দিয়েই আমার পছন্দ হয়েছে তুই শুধু একবার, ‘
আর কিছু বলার আগে তাকে থামিয়ে দিয়ে রিমন তেজি কন্ঠে বলল, ‘ ও অলরেডি মেয়েও দেখে নিয়েছো আর আমাকে এসে এখন বলছো! শোনো মা, আমি আমার লাইফে বৃষ্টির জায়গা কাউকে দেবো না। ‘
বলে উঠে চলে যায়। আজ প্রায় মাস খানিক হতে চলল বৃষ্টি আসেনি তবে রোজ বৃষ্টিকে সরন করে ঘুমায় রিমন আজও তাই করেছে কিন্তু সে আসেনি। আজকে তাকে জড়িয়ে ধরতে অনেক ইচ্ছে করছে কিন্তু সে নিরূপায় কি করা উচিত তার, ভাবতে লাগল।
_______
রোজ সকালে বিকালে রাতে একই কথা শুনে রিমন বিরক্ত হয়ে উঠে সে মায়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। একবার মেয়েটার সাথে দেখা করবে।
অফিস টাইম শেষ হতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে, এক ক্যাফের এড্রেস এসএমএস করে পাঠিয়েছে মেয়ে নাকি সেখানেই অপেক্ষা করছে, তাই গন্তব্য রিমনকে সেখানেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে রিমন পেছনে সিটের সাথে হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রল করছে, ফোনে স্কিনে বৃষ্টির ছবি স্পষ্ট, গ্যালারী তে বৃষ্টির ছবি দেখছে, আর বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে,
কিমা
কিছুক্ষণ বাদ গাড়ি একটা দামি ক্যাফের সামনে পার্ক করে রিমন গাড়ি থেকে নেমে ক্যাফের ভেতর যায়। জোহরা নিঝুম নামে কাউকে খুঁজছে, এমন সময় পেছন থেকে মেয়েলি কন্ঠে বলল, ‘ এক্সকিউজ মি! আমিই জোহরা নিঝুম, আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। ‘
তারপর দু’জনে একটা টেবিলে গিয়ে বসল, ওয়েটার এসে দুইটা কোল্ড কফি দিয়ে যায়। রিমন নিচে ফোনের স্কিনে তাকিয়ে আছে, জোহরা নিঝুম সে প্রায় সবকিছুই জানে তার সম্পর্কে, এবং খুব ফ্রিলি কথা বলছে, রিমন কফি ছুঁয়েও দেখেনি।
নিঝুম রিমনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ আপনার তো কফি ফেভারিট তো নিচ্ছেন না কেনো? ‘
রিমন তার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, ‘ আমার ফেভারিট ছিল, পাঁচ বছর আগে, এখন অভ্যেস চেঞ্জ করেছি, তাছাড়া এমনটা তো নয়, এক সময় যা ফেভারিট ছিল সেটা সারাজীবন থাকতে হবে৷ ‘
নিঝুম বোকার মতো তাকিয়ে রইল কি এমন বলল যে এতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো। রিমন ফোনে কাউকে কল দেয় চেয়ার টেনে উঠতে গিয়ে নিঝুম কে উদ্দেশ্য বলে, ‘ আমার ইমার্জেন্সি কাজ পরে গেছে আমাকে যেতে হবে। ‘
বলে উঠে চলে গেলো, যাওয়ার আগে কফির বিল প্রে করে দিয়ে গেছে। নিঝুম টেবিলের উপর দুই হাতের কনুই রেখে একবার নিজের কফিতে চুমুক দিচ্ছে তো আরেকবার রিমনের কফিতে চুমুক দিচ্ছে। যা রিমন ছুঁয়ে দেখেনি। টাকা তো ঠিকই দিছে জিনিস কেনো ফেরত দেবো। তাই সে নিজের পেটেই চালান দিচ্ছে।
বাড়িতে এসে সবার আগে তিতিরের খোঁজ করে। হাতে এত এত চকোলেট, সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে আসছে তিতির মুখে ‘ বাবা ‘ ডাক স্পষ্ট, দূর থেকে এসে রিমনকে জড়িয়ে ধরে রিমন তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার হাতের সবগুলো চকলেট সে তিতির হাতে দেয়। সে খুশি হয়ে বলে, ‘ থ্যাংক ইউ বাবা ‘
রিমন তিতিরের গালে চুমু একে দিয়ে বলে, ‘ ওয়েলকাম মাই ডিয়ার প্রিন্সেস! ‘
রুমে আসার পর ফ্রেশ হয়ে বিছানার উপর বসে ল্যাপটপ স্ক্রল করছে, রুমের মধ্যে এসে কাঠকন্ঠে বলে, ‘ নিঝুমের সাথে দেখা করেছিলি? ‘
রিমন ল্যাপটপের উপরে চোখ রেখেই মাথা দুইবার উপর নিচ নাড়ায় মানে বোঝায় সে দেখা করেছিলো৷
ইচ্ছুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘ কেমন লাগল তোর ওকে? ‘
‘ বাঁচাল, অতিরিক্ত বকবক করে ‘
বলে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো, সে নিরাশ হয়ে বলল, ‘ বিয়ে তো করতেই হবে৷ ‘
‘ মা তুমি কি আমারে ফোর্স করছো? ‘
‘ হ্যাঁ করছি ‘
‘ করে লাভ নেই, আমি এখন আর বাচ্চা নই, এখন একটা বাচ্চার বাপ। ‘
বলতে বলতে তিতির বেলকনি থেকে ছুটে এসে রিমনের কোলে বসে আবারও মিষ্টি মধুর ডাক দিলো, ‘ বাবা ‘ বলে।
মেয়ের দুইগালে হাত রেখে কপালে চুমু একে দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল।
_____
নিঝুম সবাইকে বলেছে সে বিয়ের জন্য রাজি তার কোনো আপত্তি নেই, নিঝুম প্রায় দুই বছর ধরে রিমনকে চিনে কিন্তু রিমন তাকে চিনে না। যেদিন প্রথম দেখেছিলো সেদিন থেকেই তাকে ভালোলাগে তারপর থেকেই রিমনকে ফলো করতে লাগে ধীরে ধীরে ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণত হয়। এখনও সে তার মনের কথা জানায়নি তবে জানাতে চেয়েছিল সেদিন কফি শপে কিন্তু রিমন উঠে চলে যায়৷ একবছর পর জানতে পেরেছিল রিমন বিবাহিত ও তার একটা মেয়ে আছে তিনদিন পর্যন্ত রুমের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছিল, এক মাস পর জানতে পারে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে বউ মারা গেছে, তারপর থেকে আবারও শুরু করে ফলো করা। এমন ফলো করতে গিয়ে একদিন রিমনের মা’র কাছে হাতে নাতে ধরা খায়।
সে তার মনের অনূভুতি অজান্তেই রিমনের মা’র কাছে বলে ফেলে। পরিচয় জানার পর নিঝুম থুতুমুতু খেয়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়৷ নিজের ছেলের জন্য এমন মেয়েই খুজছিলেন তিনি যে তার সবটা জেনে তাকে আপন করবে এবং চলার পথের সঙ্গী হবে৷
_____
পরণে, সাদা শার্ট উপরে কালো ব্লেজার পরে কমিউনিটি সেন্টারে দাঁড়িয়ে আছে, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম, তার পরণে সাদা ও নীল এর মধ্যে গাউন।
সেন্টার ভর্তি লোকজন, সামনে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুল্লাহ বসে আছেন। রিমনের অস্তিত্ব ফিল হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার জীবন থেকে কিছু হারিয়ে যাচ্ছে খুবই দামি কিছু, ভাবছে কি হারিয়ে যাচ্ছে বলে তার মন এত অশান্ত হয়েছে কেনো? মনের মধ্যে উতালপাতাল ঢেউ কেনো বইছে?
চোখ জোড়া খিচে বন্ধ করে নিলো৷ মাথায় চাপ দিয়ে মনে করার চেষ্টা করছে কি হারিয়ে যেতে চলেছে। সে কাল পর্যন্ত বৃষ্টিকে অনুভব করতে পারতো কিন্তু আজ থেকে সেটা পারছে না। মাথায় চাপ দিতে মনে পরল কাল রাতের স্বপ্ন, বৃষ্টি স্বপ্নে এসেছিল রিমনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে যায়। ‘ তুমি যদি অন্য কারো দিকে হাত বাড়াও তাহলে পরে হাজার চাইলেও আমাকে আর দেখতে পারবে না। ‘
বলেই রুমের মধ্য থেকে বৃষ্টি গায়েব হয়ে যায়, রিমন আচমকা চোখ মেলে তাকায়। রেজিস্ট্রারি খাতায় দু’জনকে সই করতে বলা হচ্ছে, রিমন ক্ষিপ্ত হয়ে খাতারা মাটিতে ছুড়ে ফেলে। নিঝুমের হাত ধরে টেনে সেন্টারের মাঝখানে নিয়ে যায়। সবার সামনে দাঁড়িয়ে করিয়ে চেচিয়ে বলে, ‘ আমার লাইফে শুধু একজন নারীরই স্থান রয়েছে আর তারই থাকবে। আমি ভালোবাসি শুধু তাকে, কেনো এসেছো তুমি আমাদের জীবনে টাকার লোভে আসছো কোটি কোটি টাকার মালিক বলে লোভ সামলাতে পারোনি৷ টাকা চাই তোমার কত টাকা চাও যত টাকা লাগবে এই চেকে এমাউন্ট বসিয়ে নিও তারপরেও বিদায় হও আমার লাইফ থেকে ‘
একটা চেক নিঝুমের মুখের উপর ছুঁড়ে ফেলে বলল, সবার সামনে এভাবে অপমানের কারণে দুই চোখ ভিজে যায় নিঝুমের, সে মাথা নত করে কাঁদছে, বিয়ে করবে না সে আগে বললেই পারতো এভাবে অপমান বা করলেই কি হতো না৷
দুই সপ্তাহ ধরে রিমনকে বাধ্য করেছে এই বিয়েটা করার জন্য সে মোটেও রাজি ছিল না। শুধু মায়ের জোরাজুরিতে রাজি হয়। তবে তার মনে হয়তো এটাই ছিল।
নিঝুমকে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধমক দিয়ে বলে, ‘ কথা কান দিয়ে যায়নি না শুনতে পাওনি দফা হয়ে যাও আমার সামনে থেকে। ‘
রিমনের দিকে এক নজর তাকিয়ে নিঝুম দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে আসে। মাঝরাস্তায় বসে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে।
সেন্টারে উপস্থিত সকলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মা কিছু বলতে আসলে রিমন হাত বাড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ এই নিয়ে কেউ আর একটা কথাও বলবে না ‘
হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সেন্টারের সকলে যার যার মতো চলে যায়৷ মিসেস খান উপলব্ধি করতে পারেন, ছেলে সত্যিই বড় হয়ে গেছে তাকে এইভাবে জোর করা তার ঠিক হয়নি৷ আজকের সব কিছুর জন্য সে নিজেকে দ্বায়ী করল৷ হাত ধরাধরি করে তাকে রিমি ও সোহান বাড়ি নিয়ে আসল৷
_____
পাঁচ বছর পর, আজ আবারও রিমন বারে ঢুকেছে। একের পর এক ড্রিংকস করেই চলেছে। রাত অনেক গভীর হয়েছে বার এখন বন্ধ করা হবে৷ রিমন হেলতে দুলতে বার থেকে বের হয়। মাতলামো করতে করতে সে হাঁটছে, পুরো শহর জু্ড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজমান। রাস্তায় কুকুর রিমনকে দেখে ঘাউ ঘাউ করছে, সে দিকে পাত্তা না দিয়ে হেঁটে চলছে সে, মুখে শুধু তার একটাই কথা, ‘ বৃষ্টি ভালোবাসি তোমাকে ‘
বলে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচে হাঁটু গেঁড়ে বসে পরল। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, ‘ বৃষ্টি ‘
মাথা নিচু করে অশ্রুপাত গোটাচ্ছে, এমন সময় সেই ঠান্ডা শীতল হাত নিজের কাঁধের উপর অনুভব করলো। মাথা তুলে পেছনে তাকিয়ে দেখল, বৃষ্টি অর্ধেক ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে তার এক চিলতে মিষ্টি হাসি। রিমন পুরোপুরি পেছনে ঘুরে বৃষ্টি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ ভালোবাসি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি, অতিরিক্ত ভালোবাসি, ‘
বৃষ্টি ও রিমনের কানে কানে বলল, ‘ আমিও অতিরিক্ত ভালোবাসি তোমাকে। ‘
হাত ধরে উঠে দাড়ালো, দুজনে ভালোবাসার গল্প করতে করতে হাঁটতে শুরু করল রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের নিচ দিয়ে, রিমন বারবার মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলে বৃষ্টি তাকে ধরে ফেলছে। নিজের সম্পূর্ণ ভড় বৃষ্টির উপর দিয়ে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। একজন মানুষ আরেকজন ছায়ামূর্তি নিজেদের অপূর্ণ ভালোবাসার গল্প করতে করতে হেঁটে যাচ্ছে।
_____
সকালে ঘুম ভাঙ্গে তিতিরের ‘আব্বু ‘ ডাকে, হাত দিয়ে চোখ ঢোলে উঠে বসে৷ তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি হাসে। দু’জনে একসাথে ফ্রেশ হয়ে নতুন জামা পরিধান করে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। মিসেস খান রিমনের উদ্দেশ্য বলে, ‘ আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা, মা হয়ে শুধু তোর ভালো টুকুই চেয়েছিলাম। ‘
‘ ক্ষমা কেনো চাইছো মা? দোষ তোমার বা আমার নয় মা দোষ হচ্ছে পরিস্থিতির, আমি কখনো কাউকে আমার জীবনে চাই না মা, আমি বৃষ্টি কে ভালোবাসি আর তার সাথেই থাকতে চাই। ‘
ইতস্ততভাবে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল, ‘ বৃষ্টি তো বেঁচে নেই তাহলে তুই ওর সাথে বাঁচবি কি করে? ‘
শীতলাকন্ঠে রিমন প্রত্যত্তরে বলল, ‘ আমি বৃষ্টি কে তিতিরের দশ মাস বয়সের পর থেকেই দেখতে পাই মা। ‘
কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে যায় তিনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে রিমন শুরু থেকে সব পূর্ণ মাকে খোলে ও বুঝিয়ে বলেন। তার চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরে সত্যিই অনেক বেশি ভালোবাসে দু’জন দুজনকে শুধু উপরওয়ালা-ই ভালো জানেন কেনো তাদের ভালোবাসা অপূর্ণ রয়ে গেলো। কেনো বৃষ্টি কে তার কাছে টেনে নিলেন একমাত্র ‘ আল্লাহ মালুম ‘।
নাস্তা শেষে রিমন ও তিতির বাড়ি থেকে বের হয়। উদ্দেশ্য বৃষ্টির কবর জিয়ারত, গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দেয়। কবরস্থানে এসে গাড়ি থামিয়ে দুজনে বের হয়। তিতিরকে কবরস্থানের সামনে রেখে সে চলে যায় সেখানে,
কবরের পাশে বসে সবার আগে সালাম জানায়, ‘ আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর; ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওয়ালাকুম, আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আ-সার। ‘
সালাম দেওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ কেমন আছো? আজও কি ভয় পাচ্ছো? ভয় পেয়ো না আমিও তো আছি তোমারই হয়ে, এ জীবনে তোমার স্থান কাউকে দেবো না, আমি রিমন হাসানের বুকে শুধু বৃষ্টি নামটাই লিখা আছে লিখা থাকবে তোমার স্থান তোমারই থাকবে৷ কাল রাতের কথা মনে আছে বৃষ্টি কিন্তু আমাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বলেছিলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি আর সারাজীবন তোমাকে ভালোবাসবো, ভালোবাসলেই যে স্পর্শ করতে হবে তা কিন্তু নয়, আমি না হয় সারাজীবন তোমাকে দেখেই পাড় করে দেবো। তবে একটা সমস্যা হয়ে যাবো বুঝছো, সময়ের সাথে সাথে আমি তো বুড়ো হয়ে যাবো আর তুমি এখনের মতোই থাকবে কিউট তখন তো আমার একটু হিংসে হবে তাই না? আমার বউটা তখনও ইয়াং থাকবে অথচ আমি বুড়ো হয়ে যাবো। আচ্ছা বৃষ্টি তুমি তো বলেছিলে, ‘ অধিক আগ্রহে বসে অপেক্ষা করছি তোমার ‘ এই কথার মানে কি? আমি বুঝিনি, ওইতো দেখো আমাদের মেয়ে আমাদের দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে, জানো ও সব সময় শুধু তোমার কথাই জানতে চায়। অধিক ভালোবাসে তোমাকে। আচ্ছা এখন আমাকে যেতে হবে, আমি আবারও আসবো। ও একা একা হয়তো ভয় পাচ্ছে। ‘
কথাগুলো বলে রিমন কবরের উপরে হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় দুই হাত দিয়ে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিয়ে এক কদম সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলো। তখনই হঠাৎ বৃষ্টির কবরের উপর চিত হয়ে পরে গেলো। দূর থেকে তিতির রিমনকে পরতে দেখে চিৎকার দিয়ে দৌঁড়ে ছুটে আসছে।
রিমনের পাশে বসে তিতির কাঁদছে সাথে বারবার বাবা বলে ডাকছে কিন্তু রিমনের তাতে কোনো হেলদোল নেই।
পুরো একটা নিস্তেজ বডি পরছে। আত্মা টা বেড়িয়ে গেছে অনেক আগেই, প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে বাড়ির নাম্বারে ডায়াল করে৷ অপরপাশ থেকে কল রিসিভ করে হ্যালো বললে, তিতির বলে, ‘ দাদু বাবার কি জেনো হয়েছে বাবা কোনো কথা বলছে না হুট করে মা’র কবরের উপড়প পরে গেছে এখন আমি ডাকছি কিন্তু উঠছে না। আমার খুব ভয় করছে। ‘
কথাগুলো ঠিক করে বলতে অব্দি পারছিল না নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলে। নিজের নাতনির কাছ থেকে এমন কথা শুনে দুমড়ে মুচড়ে উঠল বুক, তার বুকের মধ্যে কামড় দিলো। ছেলের কিছু হয়নি তো?
বাকিদের কল দিয়ে জানিয়ে দিলো। সবাই একসাথে কবরস্থানের দিকেই আসছে। রিমনের বুকের উপর মাথা রেখে জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ বাবা ‘
বুকের উপর দুই হাত রেখে বারবার বাবা বাবা বলে চিৎকার করে ডাকছে।
খানিকক্ষণ বাদ তিতির অনুভব করল, তার দুইগালে দুই পাশ থেকে ঠোঁটের স্পর্শ পেলো। তার আর বুঝতে বাকি রইল না তার বাবা আর নেই। এই চুমু তার বাবা মা দু’জনে একসাথে দিয়েছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ‘ বাবা মা ‘ বলে চিৎকার দেয়। রিমনের শার্ট দুইহাত দিয়ে খামচে ধরে বুকের উপর মাথা গুঁজে কাঁদতে লাগে, ‘ আব্বু উঠো না আব্বু, তুমি ছাড়া আমি কিভাবে থাকবে। আমি কার বুকে ঘুমাবো আমাকে কে চকলেট কিনে এনে দেবে? আমাকে কে আদর করে প্রিন্সেস বলে ডাকবে? ও বাবা, উঠো না বাবা আমাকে কে আম্মুর গল্প শোনাবে আমাকে কে না খেলে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাইয়ে দিবে? ও বাবা বাবা গো উঠো না গো বাবা। আমাকে তোমরা কেনো একা ছেড়ে চলে গেলা। ও মা বাবাকে বলো না উঠতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিতে বলো না মা। ওই মা বাবা কে বলো না উঠতে, আমার বাবা গো উঠো না গো বাবা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা আমার ভয় করছে বাবা তুমি উঠে আমাকে কোলে নাও না বাবা, ও বাবা তোমার প্রিন্সেসের ভয় লাগছে বাবা গো। আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো না গো বাবা। আমার লক্ষী বাবা উঠো না গো ও আল্লাহ আমার বাবা কে উঠিয়ে দাও না গো আল্লাহ। আমি কার সাথে রাতে ঘুমাবো আমাকে বাবার মতো করে ভালোবাসবে আমাকে কে আগলে রাখবে। আমি যে আমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারবো না গো আল্লাহ। আমার বাবাকে উঠিয়ে দাও না গো আল্লাহ। তুমি এত নিষ্ঠুর কেনো আমার বাবা মাকে আমার থেকে কেনো কেড়ে নিলা? আমার আব্বুকে ফিরিয়ে দাও আল্লাহ।
আমার বাবা উঠো না বাবা। ওই বাবা উঠো না গো`!
•
•
•
•_______সমাপ্ত_______