#নেকড়ে_মানব
#পর্ব:-০২
#আমিনা_আফরোজ
গ্রামবাসী আর জনাকয়েক পুলিশ সদস্য দিয়ে নিলয় ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে গভির অরন্যের দিকে। বেলা তখন একটা ছাড়িয়েছে। তবে এই গহিন অরন্যে তা বুঝার সাধ্য নেই। জঙ্গলটি এত বড় বড় গাছপালায় পূর্ন যে সূর্যের আলোক রশ্মির সামান্য তম অংশই পৌঁছাতে পারে এখানে তবে তা যৎসামান্য বলা যায়। নিলয় বুঝতে পারল এই নেকড়ে টিলার আন্ধাঘেরা জঙ্গলটির ঘনত্ব ও আয়তন দুটোই বেশি। প্রায় ঘন্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে খোঁজাখুঁজির পরও যখন আসিফ নামক অল্পবয়ষ্ক ছেলেটিকে খুঁজে পেলো না তখন অনেকটা গ্রামবাসীদের চাপে পড়েই রিক্ত হস্তে ফিরে আসতে হলো নিলয়দের।
আন্ধাঘেরা জঙ্গল থেকে ফিরে এসে খুব নিলয়রা একটা দেরি করে নি বড়কল গ্রামে। গ্রামটি থেকে মূল শহরে আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল ওদের। সময়ের ঘড়ি তখন পাঁচটার ঘরে ছুঁই ছুঁই করছে। পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে নিলয় সোজা ওর বাড়িতে চলে এলো। এই পাহাড়ি এলাকায় এই এক সুবিধা পেয়েছে নিলয়। যখন তখন নিজ খুশি মতো অফিস থেকে বাসায় আসতে পারে সে। এ নিয়ে অবশ্য উপর মহল থেকে কোন দিন কোন কথা শুনতে হয় নি ওকে। বাসায় ফিরেই নিলয় ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিল। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই বুঝতে পারল ভিষন ক্ষুধা পেয়েছে ওর। আর ক্ষুধা পাবে নাই বা কেন ? সেই কোন ভোরবেলা এতটুকু খেয়ে বেড়িয়ে ও। এতক্ষনে মনে হচ্ছে পেটের ভিতর রিতিমত ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে। নিলয় বিছানা থেকে ওঠে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে।
ছোট একটি কুঠরি সাইজের ঘরটিকে রান্নাঘর হিসেবে সাজিয়েছে নিলয়। রান্নাঘরটির একপাশে রয়েছে একটি গ্যাসের চুলা। গ্যাসের চুলাটির পাশেই রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। গ্যাসের চুলা থেকে হাত তিনেক দূরে বাম পাশে রয়েছে একটি আলমিরা। তবে তা মাঝারি আকৃতির। এর ভিতরেই খাবার রাখা ছাড়াও রান্নার ব্যবহার্য জিনিসপত্র রেখে দেয় ছোটাবুয়া। নিলয় আলমিরার পাল্লা খুলে দেখলো আলমিরার ভেতরে রাখা খাবারগুলো ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে। উৎকট এক গন্ধ ছড়াচ্ছে সেখান থেকে। নিলয় খাবারগুলো বের করে তাতে পানি ঢেলে রান্নাঘরের একপাশে রেখে দিল। আগামীকাল ছোটাবুয়া এসে সেগুলো ফেলে দিয়ে আসবে। খাবার নষ্ট হওয়ায় স্বাভাবিক। একে তো গরম তারপর খাবার গুলো সারাদিন বদ্ধ অবস্থায় ছিল। তাই এই ভ্যাপসা গরমে সব খাবার নষ্ট হয়ে গেছে। আজ হয়ত দুপুরে আসে নি বুয়াটা। এলেও হয়তো দরজায় তালা দেখে চলে গেছে। এই বিষয় নিয়ে আর মাথা ঘামানো না নিলয় । আপাতত খাবারের বন্দোবস্ত করতে হবে তাকে।
নিলয় তড়িঘড়ি করে ঘরে থাকা মুড়ি পানিতে ভিজিয়ে তা চিনি দিয়ে মাখিয়ে খেয়ে নিল। আপাতত এছাড়া আর ঘরে কোন খাবার নেই। তাছাড়া এখন বাহিরে গিয়ে খাবার কিনে আনার মতোও এনার্জি নেই ওর। খাবার খেয়ে পুনরায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে আজকের কেসটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। এই কেসটাই সত্যি কি কোন রহস্য লুকিয়ে আছে আপন মনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে ওঠল নিলয়। তবে উওর পেল না । সারা দিনের শ্রান্তিতে ভেঙ্গে আসছে নিলয়ের শরীর। তাই ক্লান্ত শরীরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে ও নিজেও জানে না। নিলয়ের ঘুম ভাঙল ওর ফোনের রিংটোনের শব্দে। ধরনীতে ততক্ষনে নেমে এসেছে নিকষ কালো অন্ধকার। মসজিদ থেকে শোনা যাচ্ছে আজানের ধ্বনি। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটি দেখে তড়াক গতিতে ওঠে বসল নিলয়। স্কিনে ডা: অজিত রায় দেখেই সকালের ঘটনাটা আবারো মনে পড়ল ওর। এতক্ষন তো সে ঘটনা ভূলেই বসেছিল ও। এত ভুলো মন যে কি করে হলো ওর তাই ভেবে পেল না নিলয়। নিলয় কলটা রিসিভ করে বলল,
–” হ্যালো স্যার।”
–” হ্যালো নিলয় । কাম টু মাই ল্যাব অ্যাস সোন অ্যাস পসিবল।”
–” এনিথিং রং স্যার।”
–” ইয়াহ্।”
–” ওকে স্যার আই এম কামিং।”
ডাঃ অজিত রায় এর সাথে কথা শেষ করে ফ্রেশ হয়ে শার্ট গায়ে নিলয় বেরিয়ে পড়ল ল্যাবের উদ্দেশ্যে। তখন সময় সন্ধ্যার কাছাকাছি। পাহাড়ি এলাকায় ইতিমধ্যে নিরবতা নেমে এসেছে। চারিদিক শুনশান, নিস্তব্ধ। পুরো শহর ঝিমিয়ে পড়েছে।
ডাঃ অজিত রায় একজন ফরেন্সিক ডক্টর। অনেক দিন ধরেই এ পেশার সাথে যুক্ত আছেন তিনি। ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্ট এর একজন দক্ষ আর অভিজ্ঞ ডক্টর তিনি। এর আগে আরও তিন-চারটি কেস সলভ করতে নিলয়কে সাহায্য করেছিলেন তিনি। এজন্য নিলয়ের সাথে তার সম্পর্কটা মোটামুটি ভালোই বলা চলে।
প্রায় মিনিট পনেরো পর নিলয় এসে ডাঃ অজিত রায় এর ল্যাবে এসে পৌছিল। অজিত রায় তখনো ল্যাবে বসে কোন জিনিস নিয়ে রিসার্জ করছিলেন। নিলয়কে দেখে তিনি নিলয়কে নিয়ে তার কেবিনে এসে বসতে দিলেন। তারপর নিলয়কে সব কথা খুলে বললেন। এদিকে অজিত রায় এর কাছ থেকে যে তথ্য পেলো তাতে নিলয়ের কপালে বেশ খানিকটা কুঁচকে গেল। চিন্তার বলিরেখা ফুটে ওঠে ওর কপালে। অজিত রায় এর দেওয়া তথ্য যদি সত্যি হয় তবে এই খুন কোন মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর এমন কোন জন্তু বা প্রানীর কথা নিলয় শুধুমাত্র বিয়ের কাল্পনিক কাহিনীতেই শুনেছে সে। কিন্তু বাস্তবে এই জন্তুর অস্তিত্ব আছে কি না তা নিয়ে বেশ সন্দিহান সে। এই কেসটাতে বেশ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে। এই কেসটা যে তাকে বেশ খাটাবে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই আর। তবে ছোটবেলা থেকেই রহস্যের প্রতি আলাদা ঝোঁক রয়েছে নিলয়ের। রহস্য আর অ্যাডভেঞ্চার তার রক্তে নেশা ধরিয়ে দেয়।
রিপোর্টটা নিয়ে ডাঃ অজিত রায়ের কাছ থেকে বিদায় নিল নিলয়। আপাতত ওর গন্তব্য পুলিশ স্টেশন। নিজের কামরায় এসে রমজান মিয়াকে বাক দিলো ও। নিলয়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো মধ্যবয়ষ্ক রমজান মিয়া ।
–” স্যার আমারে ডাকতেছিলেন?”
–” হ্যা, একটা কাজ করেন তো আপনি?”
–” কি কাজ স্যার?”
–” আসিফের নামে একটা মিসিং ডায়রি লিখেন ।”
–” ঠিক আছে স্যার।”
রমজান মিয়া চলে যাওয়ার পর আবারও ফরেনসিক রিপোর্ট টা দেখতে লাগল নিলয় । আপাতত কিছুই মিলাতে পারছে না ও। আজ অনেক রাত করেই বাড়ি ফিরল সে। বাহির থেকে খেয়ে এসেছে নিলয় তাই রাতের খাবারের কোন চিন্তা করতে হলো না ওর।ফ্রেশ হয়ে এসে আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিল নিলয়। সাথে সাথে পাড়ি জমালো ঘুমের রাজ্যে। প্রতিদিনের মতো আজও ফজরের আজান কানে আসতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ওর । প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে নিলয় তবে বাকি ওয়াক্তগুলো মাঝে মাঝে ব্যস্ততার কারণে বাদ পড়ে যায় ওর। তবে চেষ্টা করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার। নামাজ পড়া শেষ করে আজ আর ঘুমাতে গেল না সে। একটু পরেই মিনুর মা আসবে তাই খাটে বসেই হালকা বিশ্রাম নিচ্ছি নিলয়।
নিলয়ের বাড়িতে ছুটা বুয়া হিসেবে যে কাজ করে তার নাম রাহেলা বেগম। সাত বছরের মেয়ে আছে তার । নাম তার মিনু। এজন্য সবাই তাকে মিনুর মা বলেই ডাকে। একটু পর দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ কানে এলো নিলয়ের। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দিল সে। দরজা খুলে দেখল তার আনুমানই ঠিক। দরজার ওপারে লাল সাদা প্রিন্টের ময়লা শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে বছর বাইশের এক তরুণী। নিলয়কে দেখে একটু স্মিত হেসে বলল,
–” কাইল এমন তাড়াহুড়া কইরা কোথায় গিয়েছিলেন সাহেব?”
–” আর বলো না মিনুর মা , এখান থেকে বেশ দূরে নেকড়েটিলার শেষের প্রান্তে বড়কল গ্রামের এক লোক খুন হয়েছে গতকাল। সেখানেই গিয়েছিলাম। ”
নিলয়ের উত্তর শুনে আর কোন প্রশ্ন করে নি মিনুর মা। ঝটপট সে তার কাজে লেগে পরে। তাকে তো শুধু আর একবার কাজ করতে হয় না, বেশ কয়েকটি বাড়িতে কাজ করতে হয় তাকে । আর এই কাজের উপরই নির্ভর করে তাদের বাঁচা-মরা। এদিকে মিনুর মাকে কাজে লেগে পরতে দেখে নিলয় ওর ঘরে এসে ওর মা রাবেয়া বেগমকে কল দিলো । প্রায় বেশ কিছুদিন হলো নিলয়ের কথা হয় না তার সঙ্গে। পাহাড়ি এলাকায় এই এক ঝামেলা। যখন তখন ফোনের নেটওয়ার্ক গায়েব হয়ে যায় ।নিলয় ওর ফোনটা চার্জে বসিয়ে গোসল করতে গেল। এখানে পানির বড্ড সংকট। প্রায় দশেকের মাথায় গোসল শেষ করে ঘরে ফিরল সে। ফোনটা চার্জ থেকে পুনরায় ওর মা রাবেয়া বেগমকে কল দিল নিলয় কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি নেটওয়ার্কের প্রবলেম এর কারণে এখনো কথা বলতে পারলো না নিলয়। মাঝে মাঝে ওর মায়ের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছা হয় নিলয়ের কিন্তু পারে নাই ব্যস্ততম চাকরিটার কারণে।
নিলয়ের ছোটো থেকেই ইচ্ছে ছিল একজন সৎ পুলিশ অফিসার হবার। তার বাবাকে দেখে আরও দৃঢ় হয় তার ইচ্ছা শক্তি। তার মা রাবেয়া বেগম অবশ্য প্রথমে রাজি ছিলেন না ছেলের এমন ইচ্ছেতে। তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে তাদের সাথে থেকেই অন্য চাকরি করুক । তাদের যা সম্পদ আছে তা দিয়েই বাকি জীবনটা চলে যাবে তাদের। কিন্তু নিলয় রাজি হয় নি। সে তার মাকে রাজি করিয়েই ছেড়েছে।
পুরনো স্মৃতি থেকে বেরিয়ে এলো নিলয়। মিনুর মাকে নাস্তা দিতে বলল সে। আজ পুলিশ স্টেশনে তাড়াতাড়ি যেতে হবে তাকে। তারপর সেখান থেকে যাবে সে বরকল নামক গ্রামে। যেখানে এক মাকে আশ্বাস দিয়ে এসেছে সে । যে করে হোক ফিরিয়ে দেবে তার সন্তানকে। এসব ভাবনার মাঝেই নিলয় ওর ফোনের আওয়াজ পেল । এত সকাল সকালে আবার কে কল দিল নিলয়কে? আবার কোন খারাপ খবর অপেক্ষা করছে না তো তার জন্য ? ফোন এর কাছে গিয়ে দেখল রমজান মিয়া কল দিয়েছে থানা থেকে। নিলয় বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে কলটা রিসিভ করল। রমজান মিয়ার সাথে কথা শেষ করে চেয়ারে বসে পরলো সে। রমজান মিয়ার সাথে কথা শেষ করে জানতে পারলো, আজকেও একটি লাশ পাওয়া গেছে বরকল নামক গ্রামে। লাশটি নাকি অল্প বয়স্ক এক বালকের। নিলয় অনুমান করল লাশটি হয়তো আসিফের। হতাশ দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো নিলয়। একটি অসহায় মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিতে পারল না তার ছেলেকে। ব্যর্থতার গ্লানিতে ভোরে গেলো নিলয়ের বুক।
চলবে