#নেকড়ে_মানব,অন্তিম_পর্ব ( ১ম অংশ)
#আমিনা_আফরোজ
রাতের দ্বিপ্রহর, আকাশে তখন পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। বদ্ধ ভগ্ন ঘরে তখন আয়মান একা । সময় চলছে তার নিজ গতিতে । সময়ের সাথে সাথে আকাশের চাঁদখানাও হেলে পড়ছে পুবে পুবের আকাশে । হঠাৎ আয়মান এর পুরো শরীর ব্যথায় লাগলো। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে এক সময় লুটিয়ে পড়লো ধুলো জমে থাকা মেঝেতে। তারপর হাত -পা ছুড়তে লাগল শূন্যে। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ হাত-পা ছুড়ে হঠাৎ এক সময় স্থির হয়ে গেলো আয়মানের শরীর। ভগ্ন কুঠিরের ধুলো জমে থাকা মেঝেতে জানালার শিক গলে আছড়ে পড়ছে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো। চাঁদের সেই স্নিগ্ধ আলো আয়মানের শরীরে প্রবেশ করতেই চারপাশ ছেয়ে গেল গগন বিদারি আর্তনাদে।
ভগ্ন একটি কুটির সামনে এসে দাঁড়ালো নিলয়দের দল। দলের সবাই ঠিক থাকলেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না প্রফেসর সৌমিক চ্যাটার্জিকে। ঘন্টাখানেক আগের কথা , অজানা সেই অপার্থিব সুগন্ধে নিলয়দের দলের সবাই একে একে তদ্রাচ্ছন্ন হয়ে লুটিয়ে পড়ে অশ্বথ গাছের তলায়। সেইভাবেই কেটে যায় প্রায় ঘন্টাখানেকের বেশি। নিলয়দের যখন তন্দ্রা ভাঙ্গে তখন দেখে প্রফেসর উধাও। প্রফেসর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ্য করে নিভৃত। পরবর্তীতে নিলয়কে প্রফেসরের নিখোঁজ
হবার কথাটা জানাও। সাথে সাথেই দলের মধ্যে শুরু হলো চাঞ্চল্যতা। প্রফেসর নিখোঁজ হওয়ার শুরু
হলো হুলস্থুল কান্ড। অবশেষে নিলয় সবাইকে শান্ত করে জঙ্গলের সেই জায়গাটার অর্থাৎ সেই অশ্বথ গাছের আশেপাশে সমস্ত জায়গাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিন্তু প্রফেসরকে কোথাও খুঁজে পেল না ওরা। নিলয় ও নিভৃতের মনে হলো লোকটা যেন ভেলকিবাজির মত হাওয়াই মিশে গেছে। অগত্যা প্রফেসরকে ফেলেই নিলয়রা এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
ভগ্নপ্রায় কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করবে কিনা এ নিয়ে যখন সংশয়ে ছিল নিলয় ঠিক তখনই কুঠিরের ভেতর থেকে শুনতে পায় আর্তনাদের শব্দ। বড় করুন সেই সুর। মানব কন্ঠস্বর শুনে আর বিন্দুমাত্র সময় ব্যয় করেনি নিলয়রা। বন্দুক হাতে একে একে সবাই ঢুকে পড়ে কুটিরের ভেতরে। কুঠিরটা দেখেই মনে হয় বেশ পুরোনো এটি। কুঠিরটি ছিল মাটির তৈরী। তবে অনেকদিন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকবার দরুন কুঠির তার নিজস্ব শ্রী হারিয়েছে বহু আগে। কুঠিরের মাটির দেওয়ালে ইঁদুরেরা থাকবার জন্য বানিয়েছে বড় বড় সব গর্ত। জীর্ণ কুঠিটায় একটি মাত্র ঘর। ঘরের অবস্থাও জরাজীর্ণ। ঘরের ভাঙ্গা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল নিলয়,নিভৃত আর রমজান মিয়া। বাকিরা সবাই দোরগোড়ায় পাহারায় রইল। বলা তো যায় না হিংস্র নেকড়ের দল কোন দিক থেকে আক্রমন করে বসে ওদের।
মাঝারি আকারের ছোট ঘরটা আলো-আঁধারিতে পূর্ণ। ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই, এমনকি নেই কোন বিছানা। এত বছরের পুরনো বাড়িতে আসবাবপত্র না থাকাটাই স্বাভাবিক। ঘরের এক কোণে পড়ে রয়েছে একটি মাটির কলস। কলসের ঠিক পাশেই কলাপাতায় মোড়ানো রয়েছে কিছু পাহাড়ি ফল। এবার নিলয়দের দৃষ্টি গেল দখিনা জানালা বরাবর মাটির মেঝের দিকে। চাঁদের আলোয় ওরা দেখল সেখানে কেউ শুয়ে শূন্যে হাত-পা ছুটছে আর গগন বিদারী আর্তনাদ করছে। চাঁদের আলোয় লোকটার শরীর আবছা অবলোকন হলেও লোকটা মুখ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না নিলয়দের। তাই নিলয় ওর হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে আলো ফেলল সেদিকে। টর্চের তীব্র আলোক রশ্মি অজ্ঞাত ব্যক্তিটির মুখের ওপর পড়তেই অস্ফুট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো নিলয়ের মুখ থেকে। নিলয় মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
–“ডক্টর আয়মান।”
এরপর নিলয় দ্রুত ছুটে চলে গেল ডক্টর আয়মানের দিকে। নিলয়ের পিছু পিছু নিভৃতও ছুটলো সেদিকে। শুধু রমজান মিয়া নিয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই।
এদিকে নিলয়দের কাছে আসতে দেখে ইশারায় মাথা নাড়লেন ডক্টর আয়মান। কথা বলার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলেছেন তিনি । কোনমতে নিজের শক্তি প্রয়োগ করে শোয়া থেকে উঠে মেঝেতে উবু হয়ে বসলেন তিনি। ইতিমধ্যে নিলয়রা পৌঁছে গেছে ডক্টর আয়মানের কাছে। ডক্টর আয়মান দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা সহ্য করে বললেন,
–“আপনারা এখানে এসেছেন কেন? চলে যান এই মৃত্যুপুরী থেকে । তা না হলে সবাই মরবেন।”
নিলয় ডক্টর আয়মানকে উত্তেজিত হতে দেখে তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
–“আপনি ভয় পাবেন না । ঐ নেকড়েদের দল কিছুই করতে পারবে না আমাদের। ওদের শেষ করার অস্ত্র আছে আমাদের কাছে।”
নিলয়ের কথা শেষ না হতেই ডক্টর আয়মান উত্তেজিত কন্ঠে বলে ওঠলেন,
–” ওদেরকে শেষ করার মতো কোন অস্ত্র আদৌও আছে কি?”
–” আছে বৈকি। এই দেখুন।”
কথাটা বলেই নিলয় ওর কাঁধে রাখা রাইফেলটা উঁচিয়ে ধরলো ডক্টর আয়মানের সামনে। ডক্টর আয়মান অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো রাইফেলের দিকে। তারপর মুচকি হেসে বললেন,
–” আপনারা কি পাগল হয়ে গেলেন মশাই। শেষমেষ সামান্য বন্দুক দিয়ে কিনা নেকড়েদের শেষ করতে বেরিয়েছেন আপনারা। আরে মশাই আপনারা কি জানেন কতটা হিংস্র হয় ঐ নেকড়েরা?”
ডক্টর আয়মানের প্রশ্নের প্রতিউত্তরে নিলয় কিছু বলতেই যাচ্ছি কিন্তু তার আগেই নিলয়রা ওদের ঠিক পেছন থেকেই শুনতে পেল এক হিসহিসে কন্ঠস্বর,
–” ওনারা তো আর নেকড়েরদের নৃশংস তান্ডব তোমার মতো সামনাসামনি দেখে নি। তবে এই নিয়ে আর আফসোস করো না তোমরা। তোমাদের এই মনোবাসনা পূর্ণ হবে আজ রাতেই। নিজের চোখে তোমরা আজ নেকড়েদের তান্ডব দেখবে।”
হিসহিসে কন্ঠস্বর শুনে নিলয় , নিভৃত দুজনেই পিছন ফিরে তাকালো। দেখল ওদের থেকে হাত দুয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা লোক ,তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দুইজন নেকড়ে মানব। নেকড়েদের মাঝে দাঁড়ানো লোকটা দেখতে হ্যাংলা-পাতলা। জরাজীর্ণ শুকনো শরীর। শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে অনেকটা। লোকটার মাথা ভর্তি চুল। হাতে পায়ের দৃশ্যমান জায়গাগুলো ঘন লোমে পূর্ণ। নিলয় ও নিভৃত এক মনে তাকিয়ে ছিল লোকটির দিকে হঠাৎ করে ওদের কাঁধের রাইফেল জোড়া হেঁচকা টানে কেড়ে নিলো নেকড়ে দুজন। রাইফেল হস্তত্যাগ হতেই স্তম্ভিত ফিরলো ওদের। আকশ্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলো ওরা। ডক্টর আয়মান কিন্তু হতবাক হন নি কারণ তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন এমন কিছু ঘটবে। কিন্তু বিশ্ময়ের ঘোর কাটতেই নিভৃত রেগে বলল,
–” কাপুরুষের মতো ছলনা করে আমাদের অস্ত্র কেড়ে না নিয়ে আমাদের সাথে মুখোমুখি লড়াই করো দেখি কে জিতে।”
নিভৃতের কথা শুনে হ্যাংলা পাতলা লোকটা এবার খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,
–” উপস তোমাদের বিরত্ব দেখে বড্ড ভয় পেয়ে গেছি আমি। তাই তোমাদের এখনি বন্দি করলাম আমি। এখন থেকে তোমরা আমার বন্দিনী। তবে ভয় নেই খুব বেশিক্ষণ বন্দি রাখবো না তোমাদের। ভরসা রাখো আমার ওপর।”
কথা শেষ হতেই রমজান মিয়াকেও নিলয়দের দিকে এগিয়ে দিয়ে নেকড়ে দুটোকে নিয়ে বেরিয়ে গেল লোকটা। লোকটা বেরিয়ে যেতেই দরজায় উঁকি দিল নিভৃত। দোরগড়ার ঠিক সামনেই পড়ে আছে বাকি পুলিশ সদস্যদের রক্তাক্ত মৃত দেহ। তাদের রক্তাক্ত দেহ দেখে নিভৃতের দুচোখ ভরে ওঠল নোনা পানিতে। দল জনের দলের মধ্যে এখন অব্দি বেঁচে আছে চারজন। সত্যিই কি চারজন বেঁচে আছে নাকি প্রফেসরকেও জীবন দিতে হয়েছে এই নিকৃষ্ট বর্বর নেকড়েদের হাতে? এই প্রশ্নের কোন উওর নেই নিলয়, নিভৃত কিংবা ডক্টর আয়মানের কাছে। রাত বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে চারজন মানুষের অস্থিরতা । মৃত্যু কি তবে সত্যিই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের সামনে? এই সুন্দর ধরনী ছেড়ে ওদের কি তবে চলে যাবার সময় এসেছে? তাহলে কি এই নেকড়েদের নিধন না করেই চলে যেতে হবে ওদের? ধরনীকে কি আর বাঁচাতে পারলো না ওরা?