নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_৪

নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_৪
নবনী_নীলা

শুভ্র থমথমে গলায় বললো,” কার কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছো তুমি?” হিয়া চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল। কি আজব মানুষ রে বাবা! এখন ওনার কাছ থেকে পারমিশন নিয়েও লাফাতে হবে? কিছু দিন পর বলবে শ্বাস নিতে হলেও ওনার পারমিশন নেওয়া লাগবে।

শুভ্র ভেবে পায় না কোনো প্রশ্ন করলে এই মেয়ে এভাবে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে কেনো? মেয়েটার কি মাথায় কোনো সমস্যা আছে? রাগ হচ্ছে কিন্তু রাগটা আজ আর শুভ্র প্রকাশ করলো না। রাগের মাথায় সে অনেক উল্টা পাল্টা কথা বলে ফেলে। শুভ্র চুপ চাপ এসে সামনের টুল টায় বসলো। তারপর স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” সমস্যাটা কোথায় তোমার? মাথায় না কানে?”

হিয়া চোখ বড় বড় করে বললো,” মানে?”
শুভ্র চোখ সরু করে বললো,” কিছু না। এই বইটা তুমি কোথা থেকে নিয়েছো?”

হিয়ার ইচ্ছে করছে লোকটার মাথায় কিছু একটা দিয়ে বাড়ি দে। প্রসঙ্গ ঘুরাচ্ছে এখন, কি বজ্জাত।

শুভ্র বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বললো,” কথা বলছো না কেনো? এই বুকসেলফে হাত দিয়েছ কেনো? অনুমতি ছাড়া আমার কোনো জিনিস ধরা আমার খুবই অপছন্দ।” বলেই কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকালো।

হিয়া ভীত হয়ে দাড়িয়ে আছে। শুভ্র বুঝতে পারলো সে আবারো রেগে গেছে তাই একটা নিশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল,” এই বুকশেলফের একটা বইয়েও হাত দিবে না। বুঝেছো কি বললাম?”

হিয়া স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে। হা বা না কিছুই বললো না। কারণ যেহেতু এই রূমে থাকবে আর সামনে এতো বই আর সে ছোয়া দিয়ে দেখবে না। কিভাবে সম্ভব? এই লোকটার হাত থেকে বাচতে কি হা বলে দিবে!হিয়া হা সূচক মাথা নাড়লো।

“হুম বুঝলেই ভালো। এবার বইটা যেখান থেকে নিয়েছো সেখানে রাখো।”,শুভ্র এখনও শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা এতো সহজে রাজি হলো কিভাবে? মনে তো হচ্ছে ভালোই যন্ত্রণা দিবে এই মেয়েটা।

হিয়া করুণ চোখে একবার বুক সেলফের দিকে তাকালো তারপর শুভ্রের বসে থাকা টুলটার দিকে । বইটা কিভাবে রাখবে সে? এতো উপরে তো নাগাল পাবে না সে। হিয়া বই হাতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। তারপর উপায় না পেয়ে বললো,” আপনি একটু উঠবেন?”

” কেনো?”, একটা ভ্রু তুলে বললো শুভ্র।

” আমি বইটা রাখবো।”, বলেই উপরের ঠোঁট কামড়াতে লাগলো হিয়া।

” কেনো? তুমি কি আমার কোলে উঠে তারপর বই রাখবে?”, প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো শুভ্র।

হিয়ার মুখ হা হয়ে গেছে। লোকটা কি বলে এসব? পাগল নাকি? হিয়া চমকিত কণ্ঠে বললো,” কি বলেছেন এসব আপনি? আমি তো টুলটা চাচ্ছিলাম।” বলেই হিয়া চোখ নামিয়ে ফেললো।

হিয়ার কথায় শুভ্র বুকশেলফটার দিকে তাকালো তারপর উঠে দাড়িয়ে হিয়ার হাত থেকে টান মেরে বইটা নিয়ে উপরের তাকে রাখতে রাখতে বললো,”টুল দিয়ে হবে না মই লাগবে তোমার। এইবার এই ঘর থেকে যাও।”

হিয়া রাগী চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। নিজে তালগাছ বলে কি সবাই তালগাছ হবে ওনার মতন। আবার চলেও যেতে বলছে। এবার কি সে ছাদে তাবু খাটিয়ে থাকবে। শুভ্র বইটা জায়গা মতন রেখে হিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটা এখনও যায় নি। শুভ্র বুকের কাছে হাত গুজে এগিয়ে এসে বললো,” কি বললাম শুনতে পাও নি? গেট আউট।”

হিয়া মুখ কালো করে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এমন পাজি লোক সে জীবনেও দেখেনি। ওনার থেকে তার মামী হাজার গুনে ভালো।
হিয়ার খুব ইচ্ছে করছে মামীকে ডেকে এনে আচ্ছা করে লোকটাকে একটা শিক্ষা দেয়। কানটা ধরে এমন মলা দিতো জীবনেও মুখ দিয়ে গেট আউট বের হতো না আর। এর জীবনে মামীর মতন কান মলা দেওয়ার কাউকে দরকার।

আচ্ছা লোকটা ভিতরে কি করবে? তাকে যে এভাবে বেড়িয়ে যেতে বললো। গোপন কিছু লুকিয়ে রেখেছে হয়তো এই রুমে। সে জন্যেই হয়তো বের করে দিয়েছে তাকে। কৌতূহল বশত হিয়া একবার উকি মারতেই শুভ্রের চোখে চোখ পড়লো। খেয়েছে ধরা, শুভ্র কিছু বলার আগেই হিয়া ছুটে নিচে নেমে এলো। লোকটাকে দেখলেই হিয়ার কেমন জানি একটা ভয় করে। ছোটো বেলায় স্কুলের প্রিন্সিপালকে দেখেও সে এইভাবে ছুটে পালাতো। প্রিন্সিপালটাও এর মতনই বদমেজাজি ছিলো। কে জানতো তখন যে তার কপালে এমন প্রিন্সিপাল টাইপ জামাই জুটবে, যে তাকে দেখলেই হুংকার দিয়ে উঠবে।।

শুভ্র প্রতিটা বই একটা একটা করে পরিষ্কার করলো। এই বইগুলো তার শখের বই। বুকশেলফটা নিজের রূমে নিয়ে গেলে ভালো হতো কিন্তু সেটা সম্ভব নয় দেওয়ালের সাথে জয়েন্ট করে শুভ্রের বাবা তাকে এইটা বানিয়ে দিয়েছেন। এই মেয়েটাকে সে একদম ভরসা করে না। বইগুলোর কি হাল করবে কে জানে।
শুভ্রের পরিষ্কার করা শেষ। আজ সে ভার্সিটি যাবে না।
শুভ্র কাজ শেষে ঘরটার দিকে তাকিয়ে দেখলো একবার। বেডের একপাশে একটা তোয়ালে পরে আছে। মেয়েটার ব্যাগটা মেঝের একপাশে চেইন খোলা অবস্থায় পরে আছে। কি অগোছালো অবস্থা এই রূমের! তার লাইব্রেরী রুমটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে।

শুভ্র পড়ার টেবিল থেকে নিজের দরকারি বইটা নেওয়ার সময়ে একটা ফোটোফ্রেম দেখলো টেবিলে। শুভ্র ছবিটা হাতে নিলো। হয়তো মেয়েটার ফ্যামিলি ফোটো।
কিন্তু এরা কোথায়? একটা ছোট ছেলেকেও দেখতে পেলো শুভ্র। ঝুকে যার গলা জড়িয়ে হিয়া দাড়িয়ে আছে। এই ছোটো ছেলেটি কি ভাই হয়? হিয়ার পিছনে দাড়িয়ে থাকা লোকটাকে শুভ্রের খুব চেনা চেনা লাগলো। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারলো না সে। এর মাঝে হিয়া রুমে এসে হাজির। প্রায় আধা ঘন্টা একবার উপরে আরেকবার সিড়ি বেয়ে নিচে উঠানামা করেছে সে। এখন আর পারছে না হাপিয়ে গেছে। শাশুড়িটাকে দেখলেও ভয় লাগে তাই আর রান্না ঘরে যায় নি।

হিয়া শুভ্রের হাতে ছবিটা দেখে ছুটে এসে ছবিটা শুভ্রের হাত থেকে নিয়ে নিলো। এই লোকের উপর কোনো ভরসা নেই ছুড়ে ফেলে দিতেও লোকটা দুবার ভাববে না। হিয়া ছবিসহ হাত দুটো পিছনে গুটিয়ে রেখে বললো,” আপনি ছবিটা ধরেছেন কেনো?”

হিয়ার এমন প্রশ্নে শুভ্র ভ্রু কুচকে তাকালো। শুভ্র টেবিলের দিকে ঈশারা করে বললো,”এটা আমার টেবিল। আর তুমি…..!”

বাকিটা বলে শেষ করার আগেই হিয়া ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,” জানি রুম আপনার, বুকশেলফ, টেবিল, খাট, ল্যাম্প সব আপনারা। তাহলে আমি কি করবো? বলুন। ছাদে উঠে তাবু খাটিয়ে থাকবো?”

“নাহ্, গাছে থাকতে পারো। এমনিতেও বাদররা তো গাছেই থাকে।”, হিয়ার মুখের উপর কথাটা বলেই শুভ্র বেড়িয়ে গেলো।

কত বড় সাহস! তাকে বাদর বললো আর নিজে কি বনমানুষ কোথাগার। ইচ্ছে তো করছে এনাকে বাঁদর দিয়ে পিটাই। বাঁদর যখন মাথায় উঠে নাচবে,তখন বুঝবে বাঁদর কি জিনিস। রাগে ফুলতে ফুলতে দরজা লাগিয়ে দিলো হিয়া।

✨ আজকে হিয়ার কলেজে প্রথমদিন। রাতের বেলায় রবীউল সাহেব কলেজ ড্রেস, বই,ব্যাগ সব দিয়ে গেছেন। হিয়ার ছোট্ট বেলার কথা মনে পড়ে গেলো। তখনও ঠিক সে এতোটাই খুশী ছিলো। স্কুলের প্রথম দিনের সেই অনুভূতিটা আবার অনুভব করছে সে। হিয়া সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলো। ক্লাস শুরু সাড়ে আটটায়।
সাড়ে সাতটায় হিয়া রেডি হয়ে নীচে নামলো।
রবীউল সাহেব ডাইনিং টেবিলের মাঝখানের চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। রান্নাঘরে রহিমা খালা আর সাহারা খাতুন।

হিয়া চুপচাপ এসে রবীউল সাহেবের পাশের চেয়ারটায় বসলো। ওনার কাছে বসলে নিজেকে নিরাপদ মনে হয়।সামনে আবার রাগী শাশুড়িটাও আছে।

রবীউল সাহেব হিয়াকে দেখে পত্রিকাটা মুখের সামনে থেকে নামিয়ে বললেন,” বাহ্ তুই তো দেখি খুবই পাঞ্চুআল। ঠিক টাইমে রেডি হয়ে নীচে নেমেছিস। কিগো নাস্তা দেও আমাদের?”, বলেই রান্নাঘরের দিকে তাকালেন তিনি।
সাহারা খাতুন সরল কণ্ঠে বললেন,” হুম দিচ্ছি।” আহ্ কি মিষ্টি আওয়াজ ওনার। অথচ ছেলের মতন মুখটা সবসময় ভার করে রাখেন। রহিমা খালা নাস্তা এনে সামনে রাখলেন।

” শুন, আমি সব কিছু বেবস্থা করেছি। আজ তোর সাথে যেতে পারলে ভালো হতো কিন্তু অফিসে কাজের চাপ। ড্রাইভার দিয়ে আসবে আবার তোকে নিয়েও আসবে।” হিয়া রবীউল সাহেবের প্রতিটি আদেশের সাথে হা সূচক মাথা নাড়লো। এর মাঝে ডান দিকে তাকাতেই হিয়া দেখলো শুভ্র একদম ঘেমে একাকার হয়ে নীচে নামছে। একি অবস্থা! ওনার ঘরের এসি কি নষ্ট ছিলো?

শুভ্র নীচে নামার সময় হিয়ার সাথে চোখাচোখি হলো। হিয়া খাওয়া বাদ দিয়ে হা করে তাকিয়ে আছে। শুভ্র নীচে নেমে ডাইনিং টেবিলের উপর একটা বাটি ভর্তি পানি আর তার উপর শশা, লেবু, লেটুস পাতা আরো কি কি স্লাইস করে রাখা। পানিতে সেগুলো ভাসমান অবস্থায় আছে। দেখতে তো সুন্দর লাগছে কিন্তু শুভ্র সেই বাটি থেকে স্লাইস গুলো বাদে পানি টুকু গ্লাসে ঢেলে এক চুমুকে খেয়ে নিলো।
হিয়া রীতিমতন নাক মুখ কুচকে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভেবেছিল এই বাটিটা টেবিল সাজানোর জন্য এভাবে রাখা হয়েছে। আর এই লোকটা এসে এগুলো খেয়ে নিলো। একদম পারফেক্ট একটা নাম দিয়েছে সে বনমানুষ।

রহিমা খালা নাস্তা এনে শুভ্রের সামনে রাখতেই শুভ্র বললো,” খালা প্রতিদিন কি বলা লাগবে আমার নাস্তা রূমে পাঠানোর জন্যে।” বলেই বিরক্তি নিয়ে শুভ্র সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।

যবে থেকে হিয়া এসেছে সে কোনোদিন শুভ্রকে সবার সাথে খেতে বসতে দেখেনি। কিন্তু কেনো? সে এসেছে বলে? হিয়া একবার সাহারা খাতুনের দিকে তাকালো। হটাৎ চিন্তার চাপ পরেছে ওনার চেহারায়। হয়তো শুভ্রের এমন আচরণ তার খারাপ লাগছে। লাগারই কথা,সব মায়েরই খারাপ লাগাবে। হিয়া এইভাবে কখনো ভাবেনি। সত্যিই কি তার জন্যে শুভ্র সবার সাথে বসে খায় না? ভাবতেই তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

খাবার শেষে হিয়া রহিমা খালাকে জিজ্ঞেস করলো,” আচ্ছা উনি এভাবে ঘেমে একাকার হয়ে নীচে এলেন কেনো?”

” দৌড়াইয়া আসছে।”,

” উনি রূমের ভিতরে দৌড়ায়?”, অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সে।

” হ,ঐযে মেশিন আছে একটা ঐটাতে দৌড়ায়।”,

” ও আচ্ছা! আর এই বাসি পানিগুলো খেলো কেনো?”, এই প্রশ্নে রহিমা খালা ভ্রু কুচকে তাকালেন তারপর বললেন,” বাসি পানি না, ওইটা কী জানি কয়? ডিটক না জানি কি? কঠিন নাম অনেক। ঐটা খাইলে বলে অনেক ভালা।”

হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” ডিটক? এইটা আবার কেমন নাম।”

হটাৎ পাশ থেকে শাশুড়ি এসে বললো,” ডিটক না ডিটক্স।” হটাৎ শাশুড়ির এমন আওয়াজে হিয়া আতকে উঠলো। এরা মা ছেলে দেখছি এক রকম হুট হাট কোথা থেকে অশরীরী আত্তার মতন এসে হাজির হয়। সাহারা খাতুন হাতে থাকা বক্সটা হিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,” এতে তোমার টিফিন আছে। পুরোটা শেষ করবে। খাবার অপচয় আমার একদম পছন্দ নয়।”

হিয়া হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে বক্সটা নিলো। বাহ্ শুধু আচরণ নয় এদের কথার ধরনও দেখি এক। কি আশ্চর্য!

এরপর তিনি রহিমা খালাকে বললেন,” পানির বোতলটা ওর ব্যাগে ভরে দিয়েছো।”

রহিমা খালা জিভ বের করে মাথায় হাত দিলেন, তিনি ভুলে গেছেন। সাহারা খাতুন গম্ভীর গলায় বললেন,” এক্ষুনি যাও।”

” যাইতাছি আম্মা।”, বলেই তিনি দিলেন এক দৌড়।

হিয়া বক্স হাতে দাড়িয়ে আছে। শাশুড়িটাকে একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। ধন্যবাদ কি দেওয়া যায়?

[ চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here