নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_৩৮

#নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_৩৮
#নবনী_নীলা।

সকালের মিষ্টি রোদ চোখে এসে পড়তেই হিয়ার ঘুম ভাঙলো। আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই পেটের উপর কারোর বলিষ্ঠ হাতের বাধন অনুভব করলো সে। হিয়া নড়া চড়া করতেই কেউ যেনো তাকে আরো কাছে এনে হাতের বাধন শক্ত করলো। হিয়া আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুরাতেই শুভ্রের ঘুমন্ত মুখটা চোখে পড়লো তার। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। লোকটা ঘুমের মাঝে তাকে এইভাবে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে কেনো? সে কি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছে? হিয়া কিছুক্ষণ আগ্রহ নিয়ে শুভ্রের ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু শুভ্রের ঘুম ভাঙ্গার আগেই তাকে সরে যেতে হবে। হিয়া হাত বাড়িয়ে খুব সাবধানে শুভ্রের মাথার কাছ থেকে তার শার্ট টা নিলো। কোনো উপায় নেই তাকে এইটাই পড়তে হবে।

হিয়া খুব সাবধানে শুভ্রের বাঁধন থেকে বেরিয়ে এলো। তারপর গোসল সেরে শুভ্রের কাবাড থেকে মেরুন রঙের একটা শার্ট নিয়ে পরে ফেললো। কি এক যন্ত্রণা! তাকে কি শুভ্রের জামা কাপড় পড়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে? শুভ্রের এই লম্বা লম্বা ট্রাউজার গুলোও তো তার হবে না। তাও বেছে বেছে সে একটা ট্রাউজার নিলো। তাকে যে কি পরিমান হাস্যকর লাগছে সেটা সে আয়নায় সামনে দাড়িয়ে বুঝতে পেরেছে। হিয়া নিচের ঠোঁট উল্টে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে আছে সে। হিয়া ঠোঁট উল্টে ফিসফিসিয়ে বললো,” অসভ্য ডাক্তার।” বলেই ঠোঁট চেপে হাসলো।

হিয়া দরজা খুলে বের হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ইউভিকে খুঁজলো। হিয়া সিড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখলো ইউভি সোফায় বসে লেজ নাড়াচ্ছে। হিয়াকে দেখেই সে দৌড়ে এলো। হিয়া ইউভিকে কোলে তুলে আদর করতে লাগলো। সারারাত বেচারী একা একা ছিলো। হিয়া ইউভিকে কিচেনে নিয়ে গেলো। তারপর ইউভির খাবার বের করে বাটিতে নিয়ে ইউভিকে খেতে দিলো।

হিয়াকে এইবার নাস্তা বানাতে হবে কিন্তু তার আগে ডাক্তার সাহেবের ডিটক্স বানাতে হবে। হিয়া একটা বাটিতে শশা, লেবু, পুদিনা পাতা ইত্যাদি পাতলা স্লাইস করে কেটে পানি দিয়ে ভিজিয়ে ঢেকে একপাশে রেখে দিলো। তারপর নাস্তা বানিয়ে যেই কিচেন থেকে বেরিয়েছে সঙ্গে সঙ্গে কলিংবেল বেজে উঠলো। কে এসেছে এই সকালে? এই হাস্যকর রূপে এবার তাকে দরজা খুলতে হবে? হিয়া দরজা হালকা খুলে শুধু মুখটা বের করতেই দেখলো একজন পার্সেল হাতে দাড়িয়ে আছে।

লোকটা পার্সেল এগিয়ে দিতেই হিয়া হাত বাড়িয়ে নিয়ে সাইন করে সঙ্গে সঙ্গে দরজা আটকে দিলো। এই সাত সকালে আবার কিসের পার্সেল। কি ভারী বক্সরে বাবা! হিয়া বক্সটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে উপড়ে নিজের রুমে এলো। রুমে ঢুকে বক্সটা একপাশে রাখতেই দেখলো শুভ্র উঠে বসে আছে। চোখে মুখে ঘুম আর বিরক্তির ছাপ। হিয়া এগিয়ে এসে বলল,” একি আপনি কখন উঠেছেন?”

শুভ্র ভ্রু কুঁচকে হাত ইশারায় হিয়াকে নিজের পাশে বসতে বললো। হিয়া বেশ চিন্তিত হয়ে পাশে এসে বসলো। ঘুম থেকে উঠেই এমন মেজাজ খারাপ কেনো শুভ্রের?
শুভ্র হিয়ার দিকে তাকিয়ে হিয়ার পা থেকে মাথা সম্পুর্ন দেখে বললো,” কখন উঠেছো তুমি?” হিয়া কানের পিছনে চুল গুঁজে বললো,” অনেক্ষন আগে। কিন্তু কেনো?”

শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” এরপর থেকে আর কখনো আমার আগে ঘুম থেকে উঠবে না।”, হিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতে যাবে শুভ্র হিয়াকে থামিয়ে বললো,” ঘুম ভেঙে গেলো। আমাকে ডেকে তুলবে কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠবে না।” বলে হিয়ার দিকে তাকালো। তারপর বললো,” কি বললাম বুঝতে পেরেছো?” হিয়া না সূচক মাথা নাড়ল। মানে কি এইসবের? বিছানা ছেড়ে উঠবে না তাহলে কি করবে? শুভ্রের অগোছালো কথার মানে সে কিছুই বুঝলো না।

শুভ্র সিরিয়াস হয়ে বললো,” সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর চোখ মেলতেই যেনো আমি তোমাকে দেখতে পাই। বুঝেছো?”

হিয়ার মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। শুভ্র কি অদ্ভূত তাই না?এই সুন্দর কথাটা একটু মিষ্টি করে বলা যেতো না বুঝি? সেই গম্ভীর মুখেই বলতে হবে তাকে। হিয়া ঠোঁট কামড়ে হাসি থামিয়ে বললো,” ঠিক আছে। সে পরে দেখা যাবে।” শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” অ্যাম সিরিয়াস।”

হিয়া চোখ পিট পিট করে তাকালো তারপর বললো,” সকাল সকাল এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেনো আমার সাথে?”

” আমার রাগের কারণটা তো তুমি নিজেই।”, আড় চোখে তাকিয়ে বললো। হিয়া ঠোঁট উল্টে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র বিছানা ছেড়ে উঠে যেতেই হিয়া শুভ্রের হাত টেনে ধরলো শুভ্র পিছনে তাকাতেই দেখলো হিয়া ছোট বাচ্চার মতন চেছারা করে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ঝুঁকে এসে হিয়ার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে হিয়ার দিকে তাকাতেই হিয়া ঠোঁট চেপে হাসলো। শুভ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,” যাও চেঞ্জ করে নাও।”

” মানে? চেঞ্জ করে কি পড়বো?”, বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো হিয়া। শুভ্র হিয়ার টেবিলে এনে রাখা বক্সটার দিকে ঈশারা করে বললো,” ওখানে আছে।”

হিয়া চমকে উঠে বললো,” সত্যি! এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছে? আমি তো ভেবেছিলাম সারাজীবন হয়তো আমাকে এই লম্বা শার্ট আর লম্বা প্যান্ট পরে কাটাতে হবে।” হিয়া এগিয়ে গিয়ে বক্সটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে গেলো। শুভ্র হালকা হেসে ফ্রেশ হতে গেলো।

হিয়া ড্রেস গুলো দেখে একটা সস্থির নিশ্বাস ফেললো। যাক এই শার্ট পরে থাকা, থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে। হিয়া একটা নীল রঙের কুর্তি আর সেলোয়ার পড়ে নিলো। তারপর আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখলো। আহ্ কি শান্তি লাগছে নিজেকে দেখে।

শুভ্র ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখলো হিয়া একগাল হাসি দিয়ে তার সামনে দাড়িয়ে আছে। হাসির কারণ কি তার দেওয়া এই ড্রেসগুলো। হিয়া হেসে উঠে বললো,” সুন্দর লাগছে না?”

শুভ্র ঠোঁট উল্টে না সূচক মাথা নেড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র না বললো, তাহলে কি ভালো লাগেনি। কি খারাপ মুখের উপর না বলে দিলো। হিয়া ভ্রু কুঁচকে শুভ্রের দিকে এগিয়ে এলো তারপর বললো,” খুব বাজে লাগছে।” শুভ্র আবারো না সূচক মাথা নাড়লো।
হিয়া একটু চিন্তামুক্ত হয়ে বললো,” ও আচ্ছা। তাহলে মোটামুটি লাগছে?”

শুভ্র তৃতীয় বারের মতন না বলতেই হিয়া ক্ষেপে উঠে বললো,” হয়েছে হয়েছে,আমাকে তো আপনার ভালো লাগবেই না।”

শুভ্র হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের এগিয়ে এসে হিয়ার দুপাশে হাত রাখলো। কিন্তু হিয়া মুখ কালো করে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র একটু কাছে এসে ঝুঁকে আসতেই হিয়া একটা ঢোক গিললো। তারপর শুভ্র আস্তে আস্তে খুব কাছে চলে আসতেই হিয়া শুভ্রের হাতের নিচ দিয়ে ঝুকে বেড়িয়ে এলো।

শুভ্র সোজা দাড়িয়ে দুই হাত ভাজ করে বললো,” চলে গেলে কেনো? শুনে যেতে আমার তোমাকে ঠিক কিভাবে ভালো লাগে।”বলেই বাকা হাসি দিলো।

হিয়া আড় চোখে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে বললো,” থাক, হয়েছে। আপনাকে আর বলতে হবে না।” শুভ্র হিয়ার কাছে এগিয়ে আসতেই
হটাৎ হিয়ার কেনো জানি মনে হলো রহিমা খালার আওয়াজ শুনেছে সে। তাহলে কি সবাই ফিরে এসেছে? হিয়া চট জলদি রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সত্যিই তাই। বাবা মা সবাই ফিরে এসেছে। কিন্তু নীচে এসেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো হিয়ার। সঙ্গে রিমি নামক আপদটাও এসেছে।

রিমি এগিয়ে এসে হিয়াকে বললো,” বাহ্, তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে।”

হিয়া হাসার চেষ্টা করলো তারপর বললো,” তোমাকে দেখে ভালো লাগছে।” মনে মনে তো তার একদমই ভালো লাগছে না।

” আসলে আমি এতদিন এই বাড়িটাকে অনেক মিস করেছি। তাই ভাবলাম ইউএসে ফিরে যাওয়ার আগে সবার সাথে কিছুদিন থেকে যাই।”

হিয়া নিতান্ত অনিচ্ছায় হাসলো তারপর বললো,” অনেক ভালো করেছ। তোমাকে দেখে আমিও অনেক খুশি হয়েছি।” হিয়া কেনো যে একই কথা বার বার বলছে সে নিজেও জানে না।

শুভ্র নীচে নেমে এসে ওদের পাশে দাড়ালো। শুভ্রকে দেখে রিমি বললো,” কেমন আছো?” বলে এগিয়ে জড়িয়ে ধরতে যাবে হাত বাড়িয়ে দিতেই হিয়া এসে রিমিকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললো,” অনেক ভালো আছে।”

হিয়া হাসি দিয়ে পুরো বিষয়টাকে ঢাকা দিতেই অনবরত হেসে যাচ্ছে। রিমি হিয়ার কাণ্ডে প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে উঠে নিজেও হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। হিয়ার এমন কাণ্ডে শুভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে তো মারাত্মক হিংসুটে।

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here