নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_৩
নবনী_নীলা
“এইদিকে তাকাও, তোমাকেই বলছি।”, হিয়া ভ্রু কুঁচকে পিছনে তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। একটু শান্তিতে ঘুমাতে যাবে নাহ এই লোকটার সহ্য হচ্ছে না। হালকা মাথা উচু করে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো হিয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে চোখ নামিয়ে ফেললো। কি অবস্থা? এই লোকটার লজ্জা বলতে কি কিছুই নেই?
এইভাবে শার্ট ছাড়া বেড়িয়ে এসেছে। ঘরের মধ্যে তোয়ালে পরে ঘুরে বেড়ায় ভালো কথা তাই বলে রূমের বাহিরেও….! ভেবেই অসস্তি হচ্ছে হিয়ার।
শুভ্র কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে। অজানা কারণেই এই মেয়ের প্রতিটি কাজ শুভ্রের অসহ্য লাগছে। তাই তো নূপুরের সামান্য আওয়াজেও তার রাগ হচ্ছে। শুভ্র কথা না বাড়িয়ে বললো,” নেক্সট টাইম থেকে নূপুর পরে আমার ঘরের সামনে ঘুর ঘুর করবে না। আশা করি বুঝতে পেরেছো?”
শুভ্রের এমন অদ্ভূত কথা শুনে হিয়ার মুখ হা হয়ে গেলো। লোকটা কি পাগল নাকি? সত্যি সত্যি এবার হিয়ার রাগ লাগছে, রাগ সামলাতে না পেরে চোখ তুলে বললো,” মানে?”
শুভ্র নিজের রূমের দিকে যাচ্ছিল কিন্তু হিয়ার প্রশ্নে থেমে পিছনে ফিরলো। হিয়ার দিকে ঝুকে আসতেই হিয়ার ভয় লাগলো। নিচের ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে দাড়িয়ে রইলো নড়লো না সে। শুভ্র শক্ত গলায় বললো,” মানে বুঝতে পারছো না? তোমার কি মনে হয় নূপুর পড়ে ঘুর ঘুর করলে তুমি আমার অ্যাটেনশন পাবে?”
হিয়া হকচকিয়ে তাকালো, যথেষ্ট হয়েছেন। লোকটা প্রচন্ড বাড়াবাড়ি করছে এবার। এতো অপমান নিরবে সহ্য করার মেয়ে সে নয়। এই লোকটা এতক্ষণ শুধু ভদ্রতা দেখেছে।
” আমার কিছুই মনে হয় না। ঐসব আপনার মনের ভুল।”, প্রায় রেগে গিয়েই বললো হিয়া। যা হবে দেখা যাবে। অনেক বলেছে এই লোকটা।
প্রতি উত্তরে শুভ্র এমন কিছু শুনবে সেটা সে আশা করেনি। মেয়েটার সাহস দেখে সত্যি সে অবাক। এতে শুভ্রের মেজাজটা বিগড়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,” তুমি কি বলতে চাচ্ছো তুমি ইচ্ছে করে আমার ঘরে যাও নি। তারপর দরজা লাগিয়ে নিজের ড্রেস খোলার চেস্টা করোনি। তারপর এখন শব্দ করে আমার রুমের সামনে দিয়ে যাও নি। তোমার এইসবের পিছনের মতলব কি সেটা আমি বুঝিনা ভেবেছো। ওসব করে আমাকে হাত করা যাবে না। লাস্ট টাইম বলছি এসব বন্ধ করো।”
শুভ্রের কথাগুলো শুনে রাগে গজগজ করতে লাগলো হিয়া। অসভ্য, বেহায়া একটা লোক। মুখে কোনো লাগাম নেই। হিয়া রেগে উঠে বললো,” আচ্ছা? আমার তো ঠেকা পরেছে আপনাকে হাত করতে যাবো। অসভ্য লোক একটা। তাহলে তো আমিও বলতে পারি আমি রুমে ছিলাম জেনেও আপনি ইচ্ছে করে তোয়ালে পরে বেড়িয়ে এসেছেন। আর এখনও আপনি ইচ্ছে করেই শার্ট না গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে এসেছেন। আপনারও তো মতলব ভালো মনে হয় না।” গর গর করে বলেই জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো হিয়া। কিন্তু শুভ্রের অগ্নিমূর্তি দেখে ভয়ে চুপসে গেলো সে।
একটু বেশী বলে ফেললো নাকি?লোকটাকে রাগিয়ে দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? হিয়া দৌড়ে নিজের রূমের দিকে যাওয়ার আগেই শুভ্র হিয়ার হাত শক্ত করে ধরে সামনে এনে দাড় করালো।
এবার কি হবে? হিয়া ভয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। শুভ্র কড়া ধমকের সুরে বললো,” কি বললে তুমি? আবার বলো। খুব সাহস তাই না?….” বলেই হিয়ার হাতে জোড়ে চাপ দিলো। হিয়া ব্যাথায় শব্দ করে উঠলো।
” এবার কথা বলছো না কেনো? নেক্সট টাইম থেকে কিছু বলার আগে দশবার ভেবে বলবে। নাহলে কি …”, বাকিটা বলার আগেই মোহনা এসে হাজির হলো। হিয়ার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,” পাগল হয়ে গেছিস? শুভ্র, রূমে যা প্লীজ। কি ছেলেমানুষী এইগুলো।”
” আমি কোনো ছেলেমানুষী করছি না। ও কি বলেছে তুই জানিস?”, শুভ্রের কথায় হিয়া মোহনার পিছনে লুকিয়ে পড়লো। মোহনা একবার হিয়ার দিকে তাকালো মেয়েটা ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। তারপর রাগী গলায় শুভ্রকে প্রশ্ন করলো,” কি বলেছে?”
” সেটা ও ভালো বলতে পারবে। ওকেই জিজ্ঞেস কর।”, বলেই কড়া চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়েই নিজের রুমে ঢুকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। হিয়ার রাগটা যে দরজার উপর গিয়ে পড়লো ভালোই বুঝেছে সে।
মোহনা আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” কি বলছো তুমি?”
হিয়া নিচু স্বরে বললো,” আমি প্রথমে বলিনি উনি বলেছেন।”
” তা তোমার উনি প্রথমে কি বলেছে?”, ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মোহনা।
” উনি বলেছেন আমি নাকি ওনাকে হাত করতে ওনার ঘরের সামনে ঘুরঘুর করি।”, গাল ফুলিয়ে বললো হিয়া।
মোহনা কোমরে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,”আর তুমি কি বলেছো?”
হিয়া আমতা আমতা করে বললো,” আসলে রাগের মাথায় অসভ্য বলে ফেলেছি।”
মোহনা মাথায় হাত দিয়ে ফেললো,” সর্বনাশ, তোমরা দেখি আসতে না আসতেই যুদ্ধ শুরু করেছ। শোনো যতই হোক আমি কিন্তু আমার ভাইয়ের সাপোর্টে থাকবো। তোমার তো ভাগ্যে ভালো হাতটা ভেঙে দেয় নি। বাপরে,মহাশয়ের যা রাগ! যাও অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পরো। আর ভুলেও শুভ্রকে এইসব বলবে না কোনোদিন।”
হিয়া মাথা নাড়িয়ে নিজের রূমের চলে গেলো। বাবা গো কি ভয়ানক! আস্ত বনমানুষ একটা। এর থেকে দশ ফুট দুরত্ব বজায় রাখতে হবে। সুযোগ পেলেই হামলা করে বসে।
মোহনা দুবার দরজা টোকালো। তৃতীয় বারের সময়ে শুভ্র দরজা খুলে দিয়ে এসে নিজের খাটের এক পাশে বসলো। শুভ্র ছোটো বেলা থেকেই বড্ড অভিমানি। বাবার উপর এই ছেলের এখন প্রচুর অভিমান। এই সবের শিকার এখন মেয়েটা। যাকে দেখলেই শুভ্র ঝাড়ি মারছে। মোহনা শুভ্রের পাশে এসে বসলো। তারপর হালকা রসিকতা করে বললো,” তোর এতো রাগ কিসের ঐ পিচ্চিটার উপর?”
” হোয়াট ননসেন্স? ওইটা পিচ্চি! আর ইউ কিডিং উইথ মি? চোখে কি ইদানিং অল্প দেখিস?”, বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বললো শুভ্র।
” নাহ্, আমার চোখ ঠিক আছে। তুই ভালো করে দেখিস ওর চেহারাটা কিউট বাচ্চাদের মতন।”, শুভ্র একটা ভ্রু তুলে তার বোনের দিকে তাকালো। “দেখ দিদি তোর এই রসিকতা বন্ধ কর। আর এতোই রসিকতা করার ইচ্ছে হলে নিজের বরকে ফোন দে। আমার মেজাজ খারাপ করিস না।”
” তুই বাবার রাগটা ঐ মেয়ের উপর দেখাচ্ছিস কেনো, বলতো? এতে তো ওর কোনো দোষ নেই।”,
“জানি না, আমার সব কিছু অসহ্য লাগছে।”, বলেই একটা নিঃশ্বাস ফেললো শুভ্র তারপর বললো,” বাবা একবার আমাকে এসে বলতে পারতো সমস্যার কথা। বুঝিয়ে বললে কি আমি বুঝতাম না। এখন তো মনে হচ্ছে আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কোনো মূল্যই নেই তার কাছে।”বলতে বলতে উঠে নিজের করিডোরে চলে গেলো।
মোহনা উঠে দাড়ালো, শুভ্রের একা থাকা প্রয়োজন। মোহনা জানে শুভ্রের রাগ কমানোর সাধ্য শুধু শুভ্রেরই আছে। অন্য কেউ শত চেষ্টা করেও ওর রাগ ভাঙ্গতে পারবে না।
✨
কয়েকদিন হলো হিয়া বেশ সাবধানেই থাকছে পা টিপে টিপে আসা যাওয়া করে শুভ্রের রূমের সামনে দিয়ে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই কিছুদিন শুভ্র হিয়াকে দেখে এড়িয়ে যায়। এতে হিয়া বেশ শান্তিতেই আছে।
হিয়া রুমের বিশাল বুকশেলফটার দিকে অনেক্ষন হলো মনোযোগ নিয়ে তাকিয়ে আছে। বেশির ভাগই সাইন্স ফিকশন আর রহস্যের বই। তার উপর দাত ভাঙ্গা সব ইংরেজি শব্দ। এসব হিয়ার ভালো লাগে না।
নিজ দেশেই তো কতো লেখক আছে। তাদের বই নেই কেনো এখানে। এতোই যখন রহস্য পছন্দ মিসির আলী সিরিজটাও তো রাখতে পারতো। বুকশেলফ টা একদম ইংরেজি সাহিত্য দিয়ে ভরা। হিয়া টুল টেনে উপর থেকে একটা বই নিলো। একদম উপরের দিকে ছিলো বইটা। বইটার কভারটা বেশ সুন্দর। যদিও ভিতরে দাত ভাঙ্গা ইংলিশ তাও পড়ার চেষ্টা করবে সে। হিয়া খাটে বসে বইটা দেখছিল।রবীউল সাহেব ঘরে এসে হিয়াকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,” আমি কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবো, পড়বি?”
হিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। সত্যি কি তাকে কলেজে ভর্তি করাবে? পড়ালেখার আশা তো সে অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। হিয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রবীউল সাহেব আবার প্রশ্ন করলো,” কি হলো বল? না বললে কিন্তু চলবে না। তোর মামার কাছ থেকে কাগজপত্র সব আনিয়ে নিচ্ছি।”
রবীউল সাহেবের কথায় হিয়ার ঠোটে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠলো। সত্যি সে পড়বে? বিশ্বাসই করতে পারছে না সে। হিয়ার হাসি দেখে রবীউল সাহেবও হেসে ফেললেন তারপর বললেন,” দাড়া, বেবস্থা করে আসি।”
রবীউল সাহেব চলে যাওয়ার সাথে সাথে হিয়া এক হাত দিয়ে নিজের গাল স্পর্শ করলো। সে কলেজে ভর্তি হবে! আবার পড়াশুনা করবে। ভাবতেই আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে তার।
লাফ দিলেও তো মুশকিল। পাশের রুম থেকে না তেড়ে আসে। যে তুমি লাফিয়েছ কেনো? তাও চুপচাপ একটা লাফ দিয়ে হাসতে হাসতে দরজার দিকে চোখ পড়তেই মুখের হাসি উধাও হয়ে গেলো তার। দরজার সামনে শুভ্র ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে আছে। এটা কি মানুষ নাকি ট্রেন, সেকেন্ডের মাঝে হাজির হয়ে গেছে। এবার যদি রুমটা থেকেও বের করে দেয়। হিয়া ভয়ে একটা ঢোক গিললো।
শুভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হিয়ার হাতের বইটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে এ ঘরে এসেছিলো নিজের বুকশেলফটা পরিষ্কার করতে। সপ্তাহে একদিন সে এ কাজ করে। নিজের কোনো কিছু সে কাউকে টাচ করতে দেয় না। আর এখন এই মেয়েটা এসে তার লাইব্রেরী রুমটা তো নিয়েছেই আবার বই গুলোর দিকে নজর দিচ্ছে। শুভ্র থমথমে গলায় বললো,” কার কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছো তুমি?”
হিয়া চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল। কি আজব মানুষ রে বাবা! এখন ওনার কাছ থেকে পারমিশন নিয়েও লাফাতে হবে? কিছু দিন পর বলবে শ্বাস নিতে হলেও ওনার পারমিশন নেওয়া লাগবে।
[ চলবে ]