নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_১৪
নবনী_নীলা
শুভ্রের ঘুম ভেঙেছে খুব সকালে। হিয়ার রূমের একটা জানালা খোলা থাকায় ভোরের আলোয় রুমটা আলোকিত হয়ে গেছে। পাখিদের কিচিমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। প্রকৃতির ডাকে কখনই এমনভাবে সে জাগে নি। শুভ্র আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। তারপর নিজের বাম পাশে তাকাতেই দেখলো হিয়া গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। ছোট্ট বাচ্চাদের মতন গালের নীচে একটা হাত রেখে ঘুমাচ্ছে হিয়া।
শুভ্রের বাবা আসতে রাজি না হওয়ায় শুভ্রের মা তাকে জোড় করেছে। মোহনা এসেও হিয়াকে খুঁজেছে। কি অদ্ভূত কয়েক মাসেই মেয়েটা সবার এতো কাছের হয়ে গেলো। এই স্টুপিড মেয়েটার কি এমন ক্ষমতা যার জন্যে শুভ্রনীল আহমেদ এতদূর এসেছে। নাকি এই মেয়েটাকে জ্বালাতে তারও ভাললাগে। হয়তো!
শুভ্র দ্বিতীয়বারের মতো হিয়ার দিকে ফিরলো। হিয়া নড়ে চড়ে উঠে চোখ খুললো কিন্তু শুভ্র চোখ সরালো না, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
হিয়া চোখ খুলে শুভ্রকে নিজের সাথে এক বিছানায় দেখে চমকে উঠে দূরে সরতেই হুড়মুড়িয়ে চাদর সহ নীচে পড়ে গেলো। পড়েই আহ্ করে চিৎকার করে উঠলো। বিছানা থেকে পড়ে তার মাথায় এলো সে আর শুভ্র একই ঘরে ছিলো সারারাত। হিয়া কোমড় ধরে আর্তনাদ করে উঠলো।
হিয়ার এমন কান্ড দেখে শুভ্র ভ্রু কুঁচকে উঠে বসলো। এই মেয়েটা অতিরিক্ত পরিমাণে ছটফট করে। শুভ্র ভ্রূ ডলতে ডলতে বললো,” কোমড় কি ভেঙেছে? ভেঙে গেলেও কিন্তু স্ট্রেচারে করে ঢাকায় যেতে হবে।”
হিয়া রাগে কটমট করে শুভ্রের দিকে তাকালো তারপর বললো,” আপনি তো সেটাই চান। আমি কোমড় ভেঙে ঘরে বসে থাকি।”
” সে তোমার কোমড় ভাঙলেও তুমি ভাঙ্গা কোমড় নিয়ে লাফালাফি করবে। ঘরে বসে থাকার মেয়ে তো তুমি না।”, বলতে বলতে শুভ্র খাটের উপর থেকে উকি দিয়ে নিচে তাকালো। হিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে বসে আছে আর বির বির করে কি জানি বলছে। শুভ্রকে দেখে কটমট করে তাকালো। তারপর বললো,” তাকিয়ে তাকিয়ে কি মজা নিচ্ছেন?”
শুভ্র হিয়ার কথা সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বললো,” কতক্ষন বসে থাকবা নিচে?”
” সারাদিন বসে থাকবো। আপনার কোনো সমস্যা?”, মুখ বাকিয়ে বললো হিয়া।
” নাহ্, কোন সমস্যা নেই। বসে থাকো।”,বলেই শুভ্র উঠে পড়ল।
হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। এইটা মানুষ নাকি পাথর। কোনো মায়া দয়া কিছু নেই। সে যে পরে গেছে একবার জিজ্ঞেসও করলো না, ব্যাথা পেয়েছে কিনা? উল্টে বলে কিনা কোমড় ভাঙ্গলে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাবে। হিয়া আস্তে আস্তে উঠলো।তেমন বেশি ব্যাথা পায় নি সে। কিন্তু ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই এভাবেই খাট থেকে এর সে পড়েনি কখনো। লোকটার সাথে যে এক বিছানায় ঘুমিয়েছে সেটা তার মাথাতেই ছিলো না।
কি ভয়ানক একটা এক্সপিরিয়েন্স। যাক রাতটা ভালোয় ভালোয় কেটেছে। হিয়া বিছানা গুছিয়ে চট জলদি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। এই লোকটার আসে পাশে থাকা মানেই বিপদ।
এতো ভরে এর আগে কোনোদিন উঠেনি শুভ্র। হিয়ার রুমটা খুব সাজানো। পড়ার টেবিলে হিয়ার ফ্যামেলি ফটো। হিয়ার বাবার কথা শুভ্রের মনে আছে। এই ছবিতে স্পষ্ট তাকে সে চিনতে পারছে। শুভ্রের প্রথম সাইকেল চালানো তার কাছ থেকেই শেখা। তখন নয় দশ বছরের হবে হয়তো শুভ্রের। রফিক সাহেবের সাথে সেটাই তার প্রথম আর শেষ দেখা। এমন নির্মম মৃত্যু কেনো এই লোকটার বেলাই হলো।
শুভ্রের কাছে এবার সবটা পরিষ্কার। তার বাবার না বলা কথা গুলোও আজ তার জানা হয়ে গেলো। বাবার উপর রাগটাও তার অনেকটা কমে গেলো। রফিক সাহেব যে বাবার কতো কাছের সেটা সে জানে। বাবা তাকে সবটা বললে হয়তো পুরো ব্যাপারটা এতো বাজে হতো না। হটাৎ এক বিষণ্ণতায় তার মুখে ভরে এলো। শুভ্র ছবিটা আগের জায়গায় রেখে হাঁটতে বেড়িয়ে এলো।
শুভ্র ফিরে আসতেই হিয়ার মামার সাথে দেখা। তিনি ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। শুভ্রকে আসতে দেখে পত্রিকা নামিয়ে বললেন,” জগিংয়ে গিয়েছিলে নাকি?” বলেই হিয়াকে ডাকতে ডাকতে বললো,” এই হিয়া জামাইকে তোয়ালে দে।”
শুভ্র চলে যাওয়ায় হিয়া এই ফাঁকে নিজের রুমে ঢুকে ব্যাগটা গুছিয়ে নিচ্ছিলো।” জামাইকে তোয়ালে দে ” মামার মুখে কথাটা শুনেই রাগ লাগলো। এই হনুমাটাকে আবার তোয়ালে দিতে হবে কেনো? কি দরদ! একেবারে জামাই জামাই করে পাগল। সে চলে যাচ্ছে তাতে কারোর কিছু না। হিয়ার আবার ডাক পড়তেই হিয়া উচু গলায় বললো,” আসি….!” জামাই জামাই করে সবাই পাগল হয়ে গেছে।
হিয়া তোয়ালে হাতে মুখ কালো করে এগিয়ে এলো। শুভ্র সোফায় বসে ছিলো। হিয়া তোয়ালেটা এনে একেবারে শুভ্রের মুখের সামনে ধরলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তোয়ালেটার দিকে তাকালো। একদম মুখের সামনে এনেই ধরতে হবে মেয়েটার। শুভ্র তোয়ালে হাতে নিতেই হিয়া মামার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।
শুভ্র তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে মামাকে বললো,” আচ্ছা, হিয়ার বাবার কি হয়েছিলো। আমি শুধু দুসংবাদটা জানি এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।”
কথাটা জিজ্ঞেস করতেই হিয়ার মামার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” কি আর বলবো? সব আল্লাহর ইচ্ছা। যতটুকু শুনেছি গভীর রাতে চালক নাকি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে সরু রাস্তায়। তারপর বাস উল্টে খাদে পড়ে যায়। তারপর না হয় নাই বা বললাম। হিয়ার বাবা আইসিইউতে ছিলেন দুই দিন।”, এতটুকু বলেই চোখ ভিজে এলো তার।তিনি চুপ করে থেকে নিজেকে সামলে বললেন,
” আকাশ আর আমার বোন ওরা তো শেষ চেষ্টাও আমাকে করতে দেয় নি। আর আমি অনেক চেষ্টা করেছি দুলাভাইকে বাঁচানোর কিন্তু পারিনি।” এতটুকু বলেই তিনি কেদে ফেললেন।
শুভ্র উঠে এসে মামাকে ধরলো। তিনি চোখের পানি মুছে বললেন,” আমি ঠিক আছি।” শুভ্র মামাকে ধরে তার পাশে বসলো।
” হিয়াকে আল্লাহ বাঁচাইয়া রাখসে কিন্তু ওর বাম পায়ে বিশাল এক ক্ষতি হয়ে গেছে। অপারেশন করাতে এখন শুধু হাঁটতে পারে। কয়মাস যে মেয়েটা বিছানায় বসে ছিল, চুপ করে শুধু কানতো। কথাও বলতো না ঠিক করে। ডাক্তার ওকে দৌড়াতে বারণ করছে। হিয়ার অপারেশনের টাকা জোগাড় করতে মেয়ের বিয়ের জন্যে জমানো সব টাকা খরচ করে ফেলায়, তোমার মামীও কম কথা শোনায় নি মেয়েটাকে। সে মহিলাও দুশ্চিন্তায় এমন করতো।”, মামার কথার মাঝেই শুভ্র মামার হাত ধরে বললো,” আপনি চিন্তা করবেন না।আপনার মেয়ের বিয়ের সব ব্যাবস্থা আমি করবো।”
” তোমার বাবাও এক কথা বলছে। তাই তোমার মামী শান্ত আছে। কিন্তু হিয়ার জন্য আমার বড়ো চিন্তা হয়। আমার মেয়ের জন্যে তো আমি আছি।ওর তো কেউ নেই।”,মাথা নিচু করে বললেন তিনি।
” আমরা সবাই আছি।”, শুভ্রের মুখে এমন কথা শুনে মামা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। ছেলেটাকে প্রথমে সে যেমনটা ভেবেছিল ছেলেটা আসলে তেমন না।
✨ শুভ্র নাস্তার টেবিলে বসতেই মেসেজের আওয়াজ হলো তার ফোন থেকে। শুভ্র ফোনটা বের করে হাতে নিলো। প্রভার ম্যাসেজ এসেছে। শুভ্র ম্যাসেজ দেখার আগেই হটাৎ হিয়ার মামী এসে শুভ্রের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়ে বললেন,
” খাবার সময় ফোন টিপা ভালো না। খাবার খাওয়া একটা সওয়াবের কাজ।”
শুভ্রের মুখটা দেখার মতন হয়েছে। মামীর এমন আচরণে সে হতভম্ভ। হিয়া পাশেই বসে ছিল। শুভ্রের চোখ মুখের অবস্থা দেখে সে ঠোঁট চেপে হাসছে। মামী যে কি জিনিস লোকটা এইবার টের পাবে। মামী খাবারের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,” তোমার নাকি ঢেঁড়স পছন্দ অনেক। তাই ঢেঁড়স করেছি, সবজিও নাকি খাও। সবজিও রান্না করেছি আমি।………….” মামী ক্রমাগত কথা বলতেই থাকলেন।
শুভ্রের রীতিমতন মাথা ধরে গেছে। আর ঢেঁড়স? এইটা কবে তার প্রিয় হলো। অদ্ভূত! চট জলদি নাস্তা করে সে উঠে পড়ল। তারপর নিজের ফোন নিতে ফিরে এসে দেখে হিয়া পুরো ঢেঁড়সের বাটিটা সামনে নিয়ে বসে আছে। আচ্ছা এই বার সে বুঝেছে ঢেঁড়স তার প্রিয় কথাটা হিয়ার মামী কেনো বলেছে। বাঁদরটা নিজের পছন্দ তার উপর চালিয়ে দিয়েছে। শুভ্র চলে যেতেই হিয়ার মামী আবার আসলো। তারপর শুভ্রকে বললো,” আমি এতো কষ্ট করলাম তুমি তো একবার খেয়েও দেখলে না।”
শুভ্র অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো। তারপর মামী হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” তুই পুরো বাটি নিয়ে বসেছিস কেনো? দে জামাইকে একটু খাইয়ে দে।” বলেই তিনি সামনে গেলো।
মামির কথা শুনে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকালো। মামির কথায় হিয়াকে লজ্জা দিতেই শুভ্র ঝুকে এসে বললো,” দেও। খেয়ে বলি কেমন হয়েছে।”
হিয়া হা করে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। মামীর হাতের ঢেঁড়স হিয়ার অনেক পছন্দ। মামী শুভ্রের প্রিয় খাবার জানতে চেয়েছিল, শুভ্রও বাসায় ছিল না। তাই হিয়ার যেটা খেতে ইচ্ছে করেছিল সে সেটা বলে দিয়েছে। এমন ভেজালে পড়তে হবে কে জানতো।
হিয়া বাটিটা শুভ্রের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” নিজে নিয়ে খান।”
” পারবো না। আমার নামে মিথ্যে কথা ছড়িয়েছ এর ফল তো তোমাকে ভুগতেই হবে। খাইয়ে দেও।” বলেই হিয়ার মামীর দিকে ঈশারা করলো। হিয়া মুখ কালো করে শুভ্রের দিকে তাকালো। পাগল হয়ে গেছে, সবাই পাগল হয়েগেছে। লোকটাকে আবার খাইয়ে দিতে হবে। কেনো? হাত আছে কেনো? সাজিয়ে রাখার জন্যে? দূর থেকে মামী তাকিয়ে আছে।
অসহ্য লাগছে, হিয়া কথা বাড়ালো না চামচে করে এক গাল খাইয়ে দিতেই শুভ্রের চোখে চোখ পড়ল। হিয়ার বুকের ভিতরটা ধুক ধুক শুরু হয়েছে হিয়া সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। শুভ্র যেতে যেতে মামীকে বললো,” দারুন হয়েছে।”
হিয়ার ইচ্ছে করছে ঢেঁড়সটা লোকটার মাথায় ঢেলে দেয়। ইচ্ছে করে এমন করলো। বদমাইস ডাক্তার।
✨ হিয়া গাড়িতে উঠার সময় শুভ্রকে ড্রাইভিং সীটে দেখে হা করে রইলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো,
” ড্রাইভার কাকু কোথায়? আপনি একা এসেছেন? আমাকে আপনার সাথে একা একা সাড়া রাস্তা যেতে হবে?”
শুভ্র নিজের চশমাটা পরিষ্কার করছিলো। হিয়ার কথায় সে উত্তর দিলো না। চশমা পড়ে সামনে তাকিয়ে বললো,” কচটেপ আছে?”
উত্তর না পেয়ে হিয়া গাড়িতে উঠে বসছিলো। শুভ্রের এমন প্রশ্নে হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” কেনো? আপনার চশমা ভেঙে গেছে?”
শুভ্র আড় চোখে হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো।”
হিয়া রেগে বললো,” আরে আমার কাছে কচটেপ আসবে কোথা থেকে? আমি কি স্টেশনারি দোকান ব্যাগে নিয়ে ঘুরি?”
” এক কাজ করো। তোমার রুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে কচটেপ নিয়ে নিজের মুখে লাগিয়ে তারপর আসো।”, গম্ভীর মুখে বললো শুভ্র।
হিয়া রেগে গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার জন্যে সিট বেল্ট খুলতে নিতেই শুভ্র গাড়ী স্টার্ট দিলো। হিয়া কড়া গলায় বললো,” গাড়ি থামান। আমি আপনার সাথে যাবো না, আমি একা একা ট্রেনে করে যেতে পারবো।”,হিয়ার কথার মাঝেই শুভ্র ইয়ারপড কানে দিয়ে এক দৃষ্টিতে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। হিয়া মুখ গোমড়া করে বসে বসে শুভ্রকে মনে মনে বকা দিতে লাগলো।
[ চলবে ]