#নিষ্প্রভ_প্রণয়
#পর্ব_১৮
লেখনীতেঃএকান্তিকা নাথ
বৃষ্টিতে ভেজার ফল রাতে রাতেই টের পেল নীরু।শরীর জ্বরে কাবু হয়ে আছে।জ্বরের উত্তাপে উত্তপ্ত বোধ হলো সর্বাঙ্গ।মাথা ভার অনুভব হলো।গলা ব্যাথায় গলা দিয়ে শব্দ বের হতে কষ্ট হলো ভীষণ। চোখজোড়াও সেই সাথে তাল মিলিয়ে জ্বলছে।কি যন্ত্রনা!ঘুমানোতো দূর চোখজোড়া বন্ধ করতেও পারছে না।নীরু মোবাইল হাতে নিল।আজকাল রাত হলে রঙ্গনকে কল দেওয়া হয় না।অনেক কষ্টে এই অভ্যাসটা তাকে ছাড়তে হচ্ছে।তবুও মাঝেমাঝে টলমলে আবেগ হৃদয়ে টইটুম্বুর হয়ে বার্তা পাঠায়, “একবার, একবার, একবার কল কর নীরু।”সেই টলমলে আবেগকে দামাচাপা দিয়ে চলতে হয় তাকে আজকাল।নীরু মোবাইলে রঙ্গনের নাম্বার খুঁজে পেল না।খুঁজে পাওয়ার কথাও নয়।সেই তো সব মুঁছে দিয়েছে।খাট থেকে উঠে বসেই ঘড়িতে চোখ বুলাল।মাঝরাত!ধুপধাপ পা ফেলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াল সে।মায়ের ঘরের দরজা হালকা ভিড়িয়ে রাখা।নীরু দরজা ঠেলে মায়ের ঘরে গেল।ঘুমন্ত মায়ের হাত ধরে কিয়ৎক্ষন চেয়ে থাকল।গলার অবস্থা খারাপ হওয়া স্বত্ত্বেও অস্ফুট স্বরে বলল,
” মা?শুনছো?এই মা?”
নীরুর মা সঙ্গে সঙ্গে না জাগলেও কিছুটা সময় পর ঘুমুঘুমু চোখে তাকাল।নীরুর উষ্ণ ছোঁয়া বুঝে উঠেই উঠে বসল।বলল,
” জ্বর নেমেছে?এইজন্যই বলি বৃষ্টিতে ভিজতে যাস না।কথা শুনিস আমার?”
নীরু মৃদু হাসল। বলল,
” আমার কি ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে মা।একটু মাথাটা টিপে দিবে?তুমি কি উঠে বসবে?তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমাই?”
নীরুর মা উঠে বসল।বলল,
” হ্যাঁ, আমার তো আর কাজকর্ম নেই।বৃষ্টিতে ভিজে এসে এখন রাতদুপুরে আমাকেই ঘুম পাড়ানোর দায়িত্ব নিতে হবে!”
নীরু মায়ের কোলে মাথা রেখে গুঁটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল।ঠোঁট উল্টে বলল,
” উহ!একটামাত্রই তো ছোট মেয়ে তোমার।ছোট মেয়ে হিসেবে এইটুকু আবদারও করতে পারবো না আমি?”
নীরুর মা কিছু বলল না।চুপচাপ মেয়ের মাথায় হাত বুলাল।নীরু আবারও বলল,
” মা?তুমি কি আজকাল আর আমায় বুঝতে পারো না?নাকি বুঝেও বুঝো না মা?আমার সুখ দুঃখ কোনকিছুই কি আজকাল তোমার দরজায় আর কড়া নাড়ে না মা?”
নীরুর মা এবারও চুপ রইল।বেশ কিছুক্ষন পর কি বুঝে বলল,
” জানিস নীরু?একটা মেয়ে যখন প্রেমে পড়ে তখন তার আচরণে নতুন কিছু ধর্ম প্রকাশ পায়।মনমেজাজ ফুরফুরে থাকে।প্রেমের অনুভূতিতে কখনো কখনো মুখে লাজুকভাব ফুটে উঠে।কখনো বা আনমনে হাসে।আরো হরেক রকম বিচিত্র আচরণের সংযোগ ঘটে এই প্রেমানুভূতির কারণে।আর সেই বিচিত্র আচরণ গুলো সর্বপ্রথম কে খেয়াল করে জানিস? মেয়েটার সবচেয়ে কাছের বন্ধু!মেয়েটার মা।মেয়েটাকে সেই ছোটবেলা থেকে হাতে করে মানুষ করে তার মা।মেয়েটার প্রথম বন্ধু হয় তার মা।মেয়েটার প্রথম খেলার সঙ্গী হয় তার মা।মেয়েটার সারাদিনের সব ঘটনা চুপচাপ শুনেও তার মা।সেই মা বুঝি মেয়েটাকে বুঝবে না?বুঝে,সব বুঝে!মেয়েটার লাজুক মুখ, অন্যমনস্ক হয়ে হাসতে থাকা, ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়ানো দেখে একমুহুর্তেই বুঝে যায় তার মেয়ে প্রেমে পড়েছে।”
নীরু হালকা হাসল।বলল,
” তুমিও বুঝলে নাকি?”
” বুঝলাম।আমিও বুঝলাম আমার ছোট মেয়েটা প্রেমে পড়েছে।অন্যসব মায়ের মতো হয়তো চাইলে বাঁধা দিতে পারতাম।কিন্তু আমি বাঁধা দিলাম না। কেন দিলাম না তাও জানি না।তবে মনে হয়েছিল, এটা প্রেমের বয়স!এই বয়সে প্রেম এসে দরজায় কড়া নাড়বে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
নীরু আপসোসের সুরেই বলল,
” বাঁধা দিলেই বোধহয় ভালো হতো মা।তুমি কেন অন্য মায়েদের মতো হলে না? তাহলে আমায় বাঁধা দিতে, অনুভূতিটা এতদূর আসতেই পারত না।”
নীরুর মা মৃদু হাসল। ঝুঁকে নীরুর কপালে চুমু দিলেন।বললেন,
” আমি সবসময় ভাবতাম নিষাদ, নিলি আর নীরু এই তিনজনের মধ্যে নীরু মেয়েটাই সবচেয়ে ছোট, সবচেয়ে চঞ্চল, সবচেয়ে অবুঝ।কিন্তু আমি ভুল ছিলাম নীরু।নিলি আর নিষাদ একটু থেকে একটুতেই রাগ প্রকাশ করতে পারে, কষ্ট প্রকাশ করতে পারে,ঘৃণা প্রকাশ করতে পারে।কিন্তু তুই ওদের থেকে একদম ভিন্ন।আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে সেদিন রঙ্গনের সামনে কি সুন্দর হেসেখেলে সবটা মেনে নিলি।আমি সেদিন বুঝলাম, আমাদের ছোট নীরুটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।অনেকটা! ”
” উহ!আমাকে বড় বানাবে না একদম।আমি ছোটই আছি মা!”
” জানিস নীরু?রঙ্গন ছেলেটাকে আমি ভালো চোখে দেখতাম। পছন্দও করতাম। নিষাদের সাথে যখন থেকে ওর বন্ধুত্ব?তখন থেকেই আমি ছেলেটাকে অনেক ভালোবাসতাম।নিষাদের মতো করেই।কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় আমি ঐদিনের পর রঙ্গনকে আর পছন্দ করতে পারছি না।রঙ্গনের প্রতি আমার ভালোবাসাও আসছে না।বোধহয় প্রত্যেক মায়েরাই স্বার্থপর!আমিও স্বার্থপর!আমার সন্তানের সুখটাই আমার কাছে সবার আগে।আমার এখন রঙ্গন ছেলেটাকে বিরক্তিকর লাগে।মনে হয় ছেলেটা দোষী!আমার মেয়েটা এইটুকু জায়গাও করে উঠতে পারল না ছেলেটার মনে? আমার মেয়ের এত ভালোবাসার বিনিময়ে ছেলেটা কি এইটুকু ভালোবাসাও দিতে পারত না?”
নীরু মায়ের কথা শুনে অবাক হলো না।মা সবসময়ই সবকিছুর আগে তাদের সুখকে বেঁছে নিয়েছে।সে মা সন্তানের সুখের কথা ভেবে রঙ্গনকেই দোষী ভাববে এটা যেন স্বাভাবিক মনে হলো তার।পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে বলল,
” উহ মা,এই পৃথিবীতে সবার তো সবার থেকে ভালোবাসা পাওয়া হয়ে উঠে না। একজনকে আমি ভালোবাসলাম, সেও যে আমায় ভালোবাসবে এমন কোন নিয়ম তো নেই কোথাও।কিংবা আমার মনে একজনের জায়গা আছে, তার মনেও আমার জন্য জায়গা থাকবে এমনও তো কোন নিয়ম নেই।ভালোবাসলেই যে ভালোবাসা পাব এমন কি কোন চুক্তি আছে?নেই।যদি এমন কোন নিয়ম অথবা চুক্তি থাকতই তবে পৃথিবীতে সবাই হতো চরিত্রহীন।এক নারীতে কিংবা এক পুরুষে আসক্ত পুরুষ তখন বিলুপ্ত হতো।ধরো তোমার আর বাবার প্রণয়ের পরও বাবাকে অন্য কোন নারী যদি ভালোবাসত, বাবারও কি উচিত হতো সে মহিলাকে একইভাবে ভালোবাসা?তাহলে যে বাবার চরিত্র শুদ্ধ হতো না।বাবার হৃদয়ে তখন শুধু তুমিই না, যারা যারা আমার বাবাকে প্রেমিকরূপে দেখত তারা সবাই বসবাস করত।ঠিক হতো কি?”
নীরুর মা বোধ হয় কল্পনাতেও তেমনটা ভাবতে পারলেন না।দ্রুত স্পষ্টকন্ঠে বলল,
” না!ঠিক হতো না।”
নীরু হাসল।ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা পেলে বোধহয় তারও এমন বিশ্বাস থাকত।যে বিশ্বাস নিয়ে কেউ এইটুকু নড়চড় করে প্রশ্ন ছুড়লে সেও বোধহয় আৎকে উঠত।এভাবেই স্পষ্ট কন্ঠে জবাব দিতে মরিয়া হয়ে উঠত।কিন্তু তার যে জবাব দেওয়ার মতো কোন কিছু নেই।একেবারে কিছুই না!সে শূণ্য!
.
সেতু বেশিক্ষন জেঁগে থাকতে পারল না।নিষাদের কাঁধে যেভাবে মাথাটা রাখা ছিল সেইভাবেই ঘুমে নিভুনিভু হয়ে আসল চোখজোড়া।কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমে তলিয়েও গেল।নিষাদ হতাশ হয়ে চাইল সেতুর দিকে।চন্দ্রবিলাশ?চন্দ্রবিলাশের চন্দ্রটাই রইল আকাশে। কিন্তু বিলাশ আর করা হলো না।নিষাদ হাত দিয়ে ডাকল সেতুকে।মৃদু স্বরে অভিমান ফলিয়ে বলল,
” সেতু?যাও, উঠে গিয়ে বিছানায় ঘুমাও।”
সেতু চোখ খুলল না।এখনও ঘুমে তলিয়ে আছে।নিষাদ আবারও হতাশ হলো।এইবার সেতুর মাথাটা নিজের কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়ে দূরত্ব রেখে বসল। সেতু সঙ্গে সঙ্গে ঘুমুঘুমু চোখে তাকাল।মাথাটা ঘুমে হেলে যেতে লাগলেও সোজা করল।সবটা বুঝে উঠে নিষাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” কি হলো?”
নিষাদ বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।সেতুর দিকে একবারও ফিরে চাইল না।গমগমে সুরে বলল,
” কি হবে? কিছু হয়নি।যাও ঘুমাও।”
” মানে?”
নিষাদ শান্তস্বরেই ক্ষোভ মিশিয়ে বলল,
” কিছু না।যাও।”
সেতু ঘুমে নিভুনিভু চোখ মেলে ধরে রাখতে পারছে না।তবুও জোর করে মেলে রাখল।মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
” কি করেছি না বললে বুঝব কি করে?”
নিষাদ এবার উঠে দাঁড়াল।বলল,
” বললাম তো কিছু করোনি।ঘুমাও গিয়ে।এখানে এভাবে ঘুমালে পরে ঘাড়ব্যাথা হবে।”
সেতু কিয়ৎক্ষন ভাবল।কিছু বুঝে উঠেই অপরাধীর মতো বলে উঠল,
” আমার তো আপনার মতো না ঘুমানোর অভ্যাস নেই নিষাদ!সেই সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে শরীর ভেঙ্গে আসছে। ঘুম আসবে না?আমি চেষ্টা করেছি জেগে থাকার, কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছি।দোষটা আমার?আপনি কিন্তু শুধু শুধুই রাগ করলেন।”
নিষাদের এতক্ষনকার স্বল্প অভিমান আর রাগ মুহুর্তেই উবে গেল।মুখে হালকা হাসি ফুটল।ভ্রু উঁচিয়ে সেতুর দিকে না তাকিয়েই বলল,
” রাগ করব কেন?রাগ কি সবার উপর করা যায় নাকি?তুমি আমার প্রেমিকা হলে নাহয় কথা ছিল!প্রেম করতাম, রাগ করতাম, অভিমান করতাম।”
সেতু নিঃশব্দে হাসল।ঘুমুঘুমু চোখের ঘুম ছুটিয়ে সেও উঠে দাঁড়াল।বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে বলল,
” আমি আপনার প্রেমিকা না হলেও, আপনি বোধহয় আমার প্রেমিক।”
নিষাদ অবাক হওয়ার ভান করল।সেতুর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কী?ছিঃ ছিঃ!আমার বউ আছে,বাচ্চা আছে।এভাবে প্রেমিক উপাধি দিবে না দয়া করে! ”
” তাহলে বিনা কারণে রাগ টাগ করে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিচ্ছেন কেন,হুহ?”
” রাগ করলেই বা কি?তুমি কি রাগ ভাঙ্গাবে আমার?”
সেতু কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
” আপনার রাগ ভাঙ্গানোর উপায় তো জানা নেই।জানা থাকলে চেষ্টা করতাম।”
নিষাদ যেন সুযোগ পেল।মুখে চমৎকার বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে সেতুর দিকে ঝুঁকল।কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
” জানিয়ে দিই?”
” কি?”
” কিভাবে রাগ ভাঙ্গাবে?জানাব?”
সেতু সন্দেহী চোখে চাইল।নিষাদের মুখের বাঁকা হাসি দেখেই বুঝার চেষ্টা করল কিছু।কিয়ৎক্ষন চুপ থাকতেই নিষাদ আবারও ফিসফিসিয়ে বলল,
” তুমি যদি চাও তোমার ঠোঁটের চুম্বন দিয়ে রাগ ভাঙ্গাতে পারো।আমি কিছু মনে করব না।”
সেতু চোখ বড়বড় করল।মনে মনে যেন এমনকিছুই আন্দাজ করে উঠেছিল।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
” না, পারব না রাগ ভাঙ্গাতে।আপনি চাঁদ দেখুন, আমি গেলাম ঘুমোতে।”
কথাটা বলে সেতু দু পা বাড়াতেই হাতে টান পরল।নিষাদ সেভাবেই হাত চেপে ধরে সেতুর দিকে না তাকিয়ে মৃদু আওয়াজ তুলে বলল,
” চাঁদ সামনে না থাকলে চাঁদ দেখব কি করে?আশ্চর্য!”
সেতু হতাশ হলো।নিষাদ এবারে ঘাড় ঘুরিয়ে একনজর তাকাল। বলল,
” তুমি ডাহা মিথ্যেবাদী সেতু!একটু আগে বললে আমি বোধহয় তোমার প্রেমিক!তোমার সেই কথার সাথে কাজের যে কিচ্ছু মিল নেই!কি ভীষণ মিথ্যেবাদী তুমি!”
সেতু করুণ চোখে চাইল নিষাদের দিকে।নিষাদ আবারও বলল,
” এভাবে তাকাবে না একদম!আমি অতো উদার নই।”
সেতু শান্তস্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,
” তো?কিভাবে তাকাব?”
নিষাদ অতি খুশি হয়ে উত্তর দিল,
” প্রেম প্রেম নজরে তাকাবে।ভালোবাসা-বাসির নজরে তাকাবে।”
সেতু নিষাদের অতি খুশি হয়ে দেওয়া উত্তরকে পাত্তা দিল না।বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকেই ক্লান্ত গলায় বলল,
” আমার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ান।”
” কেন?কি করবে তুমি? ”
সেতু ঠোঁটে ঠোঁট চাপল।বলল,
” যেটা বলছি করুন।”
নিষাদ এবার কিছু বলল না।ঠোঁট চওড়া করে হাসল।সেতুর সামনে ঝুঁকে দাঁড়াতেই সেতু বলল,
” এবার চোখ বন্ধ করুন দয়া করে।”
নিষাদ ফের প্রশ্ন ছুড়ল,
” কেন?”
” বলছি তাই।”
নিষাদ বাধ্য হয়ে চোখ বুঝল।সেতু আরেকটু এগিয়ে গেলো।কিয়ৎক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চাঁদের আলোয় নিষাদের মুখখানি দেখল।তার পরপরই নির্লজ্জ্বের মতো এক দুঃসাহসী কাজ করে বসল।নিজের মিহি ঠোঁট জোড়া নিষাদের চওড়া কপালে ছুঁয়ে দিল।তারপর আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়ানোর সাহস হলো না।লজ্জ্বায় কান গরম হলো।কপোল জোড় লালাভ বর্ণ ধারণ করল।বুকের ভেতর এমন অনুভব হলো যেন হাতুড়ে ফেটানোর শব্দ হচ্ছে।দ্রুত ধুপধাপ পা ফেলে সেই স্থান থেকে পালিয়ে গেল।নিষাদ চোখ খুলল তার ক্ষনিক পর।চোখের সামনে কাঙ্খিত মানুষটাকে না দেখলেও মুখে ফুটল বিস্তর হাসি।
.
তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত।নিষাদ বালিশে মাথা দিয়ে শুঁয়ে আছে।পেটের উপর ছোট নীর বসা।তার নরম হাত মুখের ভেতর।পরনের জামাটায় জায়গায় জায়গায় তরকারির দাগ।সেই তরকারির দাগ সমেত জামাটা সে কিছুতেই খুলবে না। খুলবে না মানে খুলবে না।সেতু অনেকক্ষন চেষ্টা করে অবশেষে হার মানল।নিষাদ হালকা হাসল সেই চিত্রবিচিত্র জামা পরিহিত নীরকে দেখে।পেটের উপর বসেই নীর হুটহাট বসা থেকে লাফ মেরে উঠে আবারও বসে পড়ছে।বার কয়েক পেটের উপর লাফ মারতেই নিষাদ ঠোঁট চাপল। দুই হাত দিয়ে নীরকে পেটের উপর থেকে নিয়ে উপর করে ধরল।দাঁত কেলিয়ে বলল,
” পেটের সব নাড়িনক্ষত্র ভর্তা হয়ে যাচ্ছে বাপ।লাফ মারিস না। সুন্দর করে বসে থাক। ”
নীর ভড়কে গেল।কিছু না বুঝেই বোধ হয় আলতো গলায় বলল,
” বা্ বা্ বা্ বা্ ”
নিষাদ আবারও হাসল।মৃদু গলায় বলল,
” তোমার সারা জামায় এমন তরকারি লাগিয়ে দিয়েছে কে ব্রো?তোমার বউ?হিসেব মতো তুমি তো বিয়ে করোনি তাহলে কি তুমি?এমন তরকারি ফরকারি লাগিয়ে ঘুরলে তো মেয়েরা তোমায় পছন্দ করবে না বাপ!”
নীর সাই দিল না এবার।উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল।নিষাদ আবারও আগের মতো পেটের উপর বসিয়ে দিল নীরকে।সেই মুহুর্তেই নীরু আসল।চোখ মুখ শুকনো দেখালেও মুখে হাসি বিদ্যমান।চুল এলোমেলো।জ্বরে জুবুথুবু শরীরটা নিয়ে এসেই বলল,
” তুমি ওকে কি বললে?প্রথমে ব্রো পরে বাপ?কি সম্বোধন!আর কিছু কি বাকি রেখেছো সম্বোধনের?”
কথাটা বলেই নীরু হাসিতে ফেঁটে পড়ল।নিষাদ মুখ কালো করল।জবাবে বলল,
” তোর মতো বিখ্যাত পেইন্টার অতোসব বুঝবে না।আমি একদিকে ওর বাপ,অন্যদিকে ওর বন্ধু!বুঝলি?সেতুকে অনেক আগে বলেছিলাম, নীর আমার থেকে একজন বন্ধুর মতোই ভালোবাসা পাবে, একজন বাবার মতোই আদর পাবে আর একজন শিক্ষকের মতোই শিক্ষা পাবে।তো?বাপ হয়ে ছেলেকে বাপ ডাকছি।বন্ধু হয়ে বন্ধুকে ব্রো, ভাই আরো হরেক রকম নামে ডাকব।তোর কি?দুই বন্ধুর মাঝে নাক গলাবি না নীরু।বন্ধুদের ভালোবাসা মানে আলাদা মানের ভালোবাসা!”
নীরু আবারও খিলখিলিয়ে হাসল।বলল,
” যে আলাদা মানের ভালোবাসা, তা তো দেখলামই।গাঁধাও তো তোমার নাকি কলিজার টুকরো বন্ধু। সেই বন্ধুর বিয়ে ঠিক হলো, অথচ তুমি ইনভাইট করার সময় জানতে পেরে যেন আকাশ থেকে পড়লে এমন ভাব করলে।নির্ঘাত গরু বেচারাকে গাঁধা তার বিয়ের কথা আগে জানায়নি। তাই না?”
নীরু কথাটা মজা করে বললেও নিষাদের মুখ চুপসে গেল।সত্যিই রঙ্গনের এরূপ ব্যবহার সে আশা করে নি।কিংবা হয়তো নীরু ওকে ভালোবাসে এইটা নিষাদও জানে দেখে বলেনি আগে।কে জানে!তবে সেইদিনের পর রঙ্গনের সাথে আর যোগাযোগ করেনি নিষাদ।কেন করেনি জানা নেই।তবে এইটুকু জানে, তার মন টানছে না।রঙ্গন কল দিলেও নিষাদ কল উঠায়নি।অদ্ভুতভাবে টের পেল তাদের বন্ধুত্ব আর আগের মতো নেই।বিস্তর দূরত্ব দুই বন্ধুর মাঝে।কবে, কখন, কোন ক্ষনে এই দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা যেন কেউই বুঝে উঠল না। কি সুন্দর বিনা বিজ্ঞপ্তিতে কয়েকদিনেই দুইজন বন্ধু আলাদা হয়ে গেল।অথচ কেউই জানে না এই আলাদা হওয়ার কথা!নিষাদ আনমনে তা ভাবল।নীরু কিয়ৎক্ষন নিষাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল মজা করতে গিয়ে ভুল প্রসঙ্গে কথা বলে ফেলেছে সে। কথা ঘুরানোর জন্যই আবারো বলে উঠল তড়িঘড়ি করে,
” তোমরা এখনো নীরের ড্রেস চেঞ্জ করাতে পারোনি?সেই দুপুরেই খাওয়ার সময় জামার এই অবস্থা করল। এখন তো রাত হলো!”
নিষাদ হতাশার সুরে বলল,
” পারলাম না রে, পারলাম না ড্রেস চেঞ্জ করাতে!তোর জ্বর ছেড়েছে?”
নীরু পা বাড়িয়ে নীরকে কোলে তুলল।তারপর আরাম করে বসে নীরের গায়ের জামাটা খুলল।নীর বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না এইবার।চুপচাপ বসে নীরুর দিকে তাকিয়ে রইল।নীরুও তাকিয়ে হাসল।তারপর আবারও আগের মতো নিষাদের পেটের উপর বসিয়ে দিল।কপাল চাপডে নিষাদের আগের কথাটাকে অনুসরন করে বলল,
“ছাড়ল না রে, ছাড়ল না আমায় জ্বর।মাথাটা আমার ভোতা হয়ে আছে এই জ্বর বাবাজীর কারণে!সব তোমার দোষ গরু।তুমি যদি আমায় লোভ না দেখাতে তাহলে তো আমিও বাইরে যেতাম না।বৃষ্টিতেও ভিজতাম না।”
নিষাদ গলা ঝেড়ে বলল,
” আমার দোষ?দোষ তো তোর।তোকে কি আমি একবারও বৃষ্টিতে ভিজতে বলছিলাম?বেয়াদব মেয়ে!”
নীরু ও রাগল।ঝাঝালো গলায় কিছু বলতে নিবে ঠিক তখনই সেতু আসল হাতে ঔষুধ নিয়ে।নীরুর দিকে তা এক হাতে এগিয়ে দিয়ে অন্য হাত রাখল নীরুর কপালে।শান্তস্বরে বলল,
” জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে নীরু।তুমি বিকালের ঔষুধ না খেয়ে এখনও দৌড়ে বেড়াচ্ছো?মা শুনলে কিন্তু মার দিবে।”
নীরু মুখ কুঁচকাল।বলল,
” মারলে মারুক সেতু দি।আমার আর এই দিন দুনিয়া ভালো লাগছে না বুঝলে।চিৎফটাং হয়ে ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে।”
সেতু প্রশ্ন করল,
” কেন?”
” আমার গলা ব্যাথা করছে, চিৎকার করে কথা বলতে পারছি না।আমার চিৎকার করে কথা বলতে না পারলে শান্তি লাগে না।সবসময় ফুরফুরে থাকা এই মাথাটা তখন থেকে ঝিমঝিম করতেছে!বলো, বাঁচার ইচ্ছে কি করে থাকবে?”
সেতু হালকা হাসল।পাশ থেকে পানি নিয়ে নীরুর দিকে ঔষুধ সমেত এগিয়ে দিয়ে বলল,
” ঔষুধটা খাও তাড়াতাড়ি।দেখবে চট করে গলা ব্যাথা, মাথা ব্যাথা সব উধাও!তারপর একটা ঘুম দিবে।ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব ফুরফুরে!”
নীরু হালকা হেসে বাধ্য মেয়ের মতো ঔষুধ খেয়ে নিল।তারপর ধুপধাপ পা ফেলে ঘুমানোর উদ্দেশ্যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল।সেতু আরেকটু এগিয়ে নীরকে কোলে তুলল।আরেকটা জামা নিয়ে নীরকে পরাতে গিয়েই অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,” আহ!”
নিষাদ সন্দেহী চোখে তাকাল।দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ল,
” তোমার হাত কাঁ’টল কিভাবে?”
সেতুর টনক নড়ল।কাঁটা হাতটা নীরু কিংবা শ্বাশুড়ী কারোরই নজরে পড়ে নি এতক্ষন।কিংবা পরলেও জিজ্ঞেস করে নি কেউ।তাই এর জন্য জবাব ও দিতে হয়নি।সেতু পাশ ফিরে নিষাদের দিকে তাকাতেই দেখল নিষাদ কাঁ’টা হাতের দিকেই তাকিয়ে আছে।সে বিকালেই কেঁটে গিয়েছিল হাতটা।নীরের সাথে নীরু আর নিষাদের সম্পর্কটার বেশ ভালো পরিণতি হলেও নিষাদের মা কিংবা বড়বোনের সাথে এখনও তেমন কোন পরিণতি চোখে পড়েনি।নীরু অসুস্থ হওয়ায় আজ বিকালে রান্না করার সময় নীরকে আর নীরুর কাছে রাখার জন্য বলতে পারল না সেতু।শ্বাশুড়িকেও আগ বাড়িয়ে বলা গেল না সংকোচে।নীরকে নিয়েই তড়িঘড়ি করে রান্না ঘরে তরকারি কাঁটতে গিয়ে হাত কেঁটে গেছে বেশ খানিকটা।রক্ত ও বের হয়েছে বেশ।পরে অবশ্য ঔষুধ লাগানোতে ঠিক হয়েছে।সেতু হালকা মাথা নাড়িয়ে বলল,
” রান্না করেছেন কখনো?রান্না করতে গেলে হাত কাঁটে এমন।”
” হাত কাঁ’টে সেটা আমিও জানি।দেখে মনে হচ্ছে তোমার হাতটা বেশিই কেঁটেছে।”
সেতু মৃদু আওয়াজে বলল,
” ঔষুধ লাগিয়ে নিয়েছি তো।সেরে যাবে।”
” না,ঔষুধ লাগানো হয়নি।আমি ঔষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।বসো।”
সেতু নাকোচ করল সেই প্রস্তাব।বলল,
” হবে না কেন ঔষুধ লাগানো?আমার ঔষুধ লাগানো, ব্যান্ডেজ করা,ঔষুধ খাওয়া সবকিছুরই অভ্যাস আছে নিষাদ।যাদের যত্ন করার কেউ থাকে না তারা সবসময়ই তাদের নিজেদের যত্ন করতে পারে।মা মা’রা যাওয়ার পর থেকেই আমার সেই অভ্যাস আছে।তাই এই অভ্যাসটার পরিবর্তন না করলেই খুশি হবো।আজ আপনি যত্ন দেখালেন, কাল না দেখালে?তাই নিজের যত্ন নিজেকেই সবসময় করতে হয় বুঝলেন?”
নিষাদ তাকিয়ে থাকল সেতুর দিকে।বলল,
” আমি তোমার যত্ন সবসময় করব না এমন মনে হলো কেন?”
” জানি না।আমি এত ভালোবাসা, এত সুখ, এত যত্ন মেনে নিতে পারি না।ভয় হয় আমার অতি সুখে।”
নিষাদ ঠোট গোল করে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল।কিছু বলল না আর।শুধু তাকিয়ে রইল।
#চলবে….
[ কাল দিতে না পারার জন্য অতি দুঃখিত।সকালেই অনলাইনে এসেছিলাম, নয়তো কালরাতেই জানিয়ে দিতাম গল্প না দেওয়ার কথাটা।আজ আরো একটা পর্ব দিব।যায় হোক, কেমন হয়েছে?অতিবেশি একঘেয়েমি লাগছে?এর জন্য আসলেই আবারও দুঃখিত ]