নিশি_রাতের_ডাক,পর্ব ১১,১২
সুমাইয়া_আক্তার
পর্ব ১১
যখন জ্ঞান ফেরে তখন ও আমি জয়দের বাড়িতে…আমার মাথার পাশে জয়ের মা চিন্তিত অবস্থায় বসে আছে…আমার জ্ঞান ফেরা দেখে জয়ের মা আমাকে দেখেই বলল,,,এই মাইয়া তোমার কারণে আমার পোলাডা মইরা গেছে…আমরা ভয়ে দিন রাত পার করতে আছি…এহন যদি তোমার মামা জানতে পারে তুমি আমগো বাড়িত আছো তাইলে আমগো রেও শেষ কইরা দিব…জয়ের বাপ এক কাজ করো তুমি ওরে ওর বাড়িত দিয়া আসো তো….
আমি বললাম,,চাচী আমি জয়ের কবর দেখব…কোথায় জয়ের কবর???
আইচ্ছা আসো দেখাইতেছি….
আমি জয়ের বাবার পিছু পিছু গেলাম…জয়ের কবর টা তালগাছ তলার নিচে…জয়ের নাকি ইচ্ছা ছিলো তার কবর যেন তালগাছ তলায় দেওয়া হয়….ওর ইচ্ছা পূরণ হয়েছে…
আমি জয়ের কবরে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম…কিভাবে পারলো মামা একটা নিরীহ ছেলেকে এভাবে মেরে ফেলতে???আমাকে প্রপোজ করেছিলো তাই বলে মেরে ফেলবে???
জয়ের বাবা আমাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে….মা আমাকে দেখেই চিল্লাতে শুরু করলো,,, কিরে এতোক্ষণ কই ছিলি??? ভাগ্য ভালো তোর বাবা জানেনা..জানলে আমার কি হতো জানিস???
আমি জয়ের বাবা কে বললাম,,,চাচা আপনি যান…আপনাকে কষ্ট দিলাম….জয়ের বাবা মাথা নিচু করে চলে গেলেন….
আমি মাকে প্রশ্ন ছুড়ে বললা,,,,মা জয় যে মারা গেছে আমাকে আগে বলোনি কেন???আর জয়কে মামার গুন্ডা পান্ডা রা মেরেছে তাও বলোনি কেন???
মা কিছু টা তোতলাতে তোতলাতে বললেন,,,আসলে তোর পড়া লেখায় ক্ষতি হবে তাই বলিনি…আর তোর মামা আমাকে বলতে বারণ করেছে….
আমি ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি….কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে রুমে চলে যাই….তারপর বারান্দায় গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি…মনে হলো পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে…
আমি বুঝতে পারছি জয় এসেছে…আমি জয়কে বললাম,,,জয় তুমি দেখা দেও প্লিজ…আমি জানি অদৃশ্য ছায়া টা তুমিই…প্লিজ দেখা দেও তুমি….
জয় আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে…আমি জয়কে জাপটে ধরি…ওকে ধরেই কান্না শুরু করি আমি….
জয় আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,,,আমার কি দোষ ছিলো বলতে পারো??? যখন তোমার মামা আমাকে তোমার থেকে দূরে সরে আসতে বলেছিলো তখন আমি তোমার সাথে কথা বলা দূরের কথা তাকাতাম ও না….যেদিন তুমি আমার পথ আটকিয়েছিলে সেদিন তোমার মামা আমার বাড়িতে এসে শাসিয়ে গেছে…আমি প্রতিবাদ করেছিলাম তাই আমাকে ছুরি মেরে দেয় পেটে…
আমাকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই আমি পথে মারা যাই….
জয়ের কথা শুনে অঝোরে চোখের পানি পড়ছে….জয় আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,,,কেঁদো না…এখন আমাদের কেউ দেখতে পাবেনা…আর আমার মরার ভয় ও নেই…এবার একটু হাসো!!আর তো বেশিদিন থাকবো না….প্রতিশোধ নেওয়া হলেই সারাজীবনের জন্য এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবো….
আমি কি বলব ভেবে পাচ্ছিনা….হঠাৎ মা ডেকে বললেন,,,মা রে,,মাফ করে দিস আমাকে…আমি চাইনি তোর জীবনের কোন ক্ষতি হোক…..তোর মামা কে আমি ছাড়া আর কেউ ভালো জানে না…
আমাকেও একজন পছন্দ করতো…তোর মামা জানার পর সেই ছেলের এক হাত এক পা ভেঙে দিয়েছে…পরে তোর বাবার সাথেই আমাকে জোর পূর্বক বিয়ে দেয়…
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকি….জয় এখনো আমার পাশেই আছে…কিন্তু ওকে আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না…
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,,,চল খেয়ে নে…সেই সকাল থেকেই না খেয়ে আছিস..
জয় আমাকে ইশারায় বলল,,,যাও খেয়ে এসো…নাহয় শরীর খারাপ করবে তোমার…
আজ সারাদিন নবনীর সাথে কথা বলিনি…রুমে এসে দেখি নবনী বারান্দায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে…আমি পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরি…নবনী আমাকে ছাড়িয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বারান্দা থেকে রুমে চলে যায়….আমি বারান্দায় ই দাঁড়িয়ে আছি…
জয় এসে আমার হাতের উপর হাত দেখে বলল,,,আচ্ছা আমি বেচে থাকলে কত ভালো হতো বলো???
আমি জয়ের বুকে মাথা রেখে বললাম,,হু ভালো হতো…কিন্তু এখন অনেক খারাপ হলো…এখন তোমার প্রেমে পড়ে গেছি….তুমি চলে গেলে কিভাবে থাকবো আমি???
জয় মুচকি হেসে বলল,,,আমি আবার আসিব ফিরে…তুমি দেখে নিও….
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম….কি হয়ে গেলো ছোট্ট জীবনে…???মামার এরকম আচরণের কারণ বুঝতে পারছি না….
হঠাৎ নবনী এসে বলল,,,কার সাথে কথা বলো তুমি???নাকি তোমার সাথে জ্বীন আছে???
এই কথা বলেই ফিক করে হেসে দেয় নবনী….নবনী কে দেখে মনে হচ্ছে কত বছর যাবৎ যেন হাসেনা…
আমিও হেসে উঠলাম নবনীর সাথে…থাক হাসুক মেয়েটা… আমি নবনীকে বললাম,,,আচ্ছা মামা কি তোমার সাথে এমন কোন আচরণ করেছে যার কারণে তুমি কষ্ট পেয়েছো???
নবনী মুখ ঘুরিয়ে বলল,,,না তো ও তো আমাকে অনেক ভালোবাসে…তখনি সেই ছেলেটা মানে নবনীর ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিল সে আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে শুরু করে…আর নবনী ছেলেটা কে দেখেই ভাইয়া বলে ডাক দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিয়েছে….
যাক এবার বিশ্বাস করলাম ছেলেটা নবনীর ভাই….
(চলবে)
#নিশি_রাতের_ডাক
#পর্ব ১২
#সুমাইয়া_আক্তার
নবনী কেঁদে চলেছে এখনো…ওদের কান্না দেখে আমার চোখেও পানি চলে এসেছে…
তখনি ছেলে টা বলে উঠলো,,,আমি আশিক…এখন আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে…তোমার মামা গোপনে মাদক ব্যবসা করে…আর মেয়েদের পাচার করে…
ওহ ভাবছো কিভাবে আমি এসব জানতে পারলাম??? হু,বলছি…
আমি সেই হোস্টেল এর গনিতের শিক্ষক ছিলাম…গণিত ভালো করাতাম বিধায় ক্লাসের সব মেয়েরাই আমাকে পছন্দ করতো…কদিন তো ভালোই কাটালাম….
একদিন বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়…আমি বাইকে করে যাচ্ছিলাম…হঠাৎ কোন মেয়ের চিৎকার শুনতে পাই…আমি চিৎকার এর আওয়াজ কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য বাইক রাস্তার সাইডে দাড় করিয়ে দেখতে গেলাম…এখনো মেয়েটা চিৎকার করে যাচ্ছে…চিৎকার করে বলছে,,,,আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ…. আমার এত বড় ক্ষতি করবেন না…দয়া করেন একটু….
তখন লোকটা বলে উঠলো,,, এই চুপ একদম চুপ…তোকে আদর দিচ্ছি আমি….খুন তো করছিনা…বেশি কথা বললে তোকে আর তোর পরিবার কে শেষ করে দিবো….
মেয়েটা কেঁদে কেঁদে বলল,,,,আমার যা ক্ষতি করার করুন…আমার পরিবারের কোন ক্ষতি করবেন না প্লিজ….
এইতো এবার লাইনে এসেছো….
তারপর আমি যখন আওয়াজ দিলাম কে ওখানে??তখনি তোমার মামা ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে বলল,,,ও মাষ্টার মশাই আপনি???যাক ভালো হয়েছে..আপনিও চাইলে জয়েন করতে পারেন…
ছিঃ ছিঃ আপনি এতটা নিচু আর জঘন্য আগে জানা ছিলোনা…..নিজের ভাগ্নির বয়সের মেয়ের সাথে এসব করতে গায়ে বাধলো না???
এই যে মাষ্টার বেশি তেড়িবেড়ি করবা ভালো হইব না কিন্তু…
কি করবেন আপনি??দেখি কি করতে পারেন….?? এই আয়েশা চলো আমার সাথে…
আয়েশা ভয়ে গুটিশুটি হয়ে আমার সাথে চলে আসতেই তোমার মামা ধস্তাধস্তি শুরু করে…এক পর্যায়ে তোমার মামা আমার মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে…আর আমি সাথে সাথেই সেখানে পড়ে যাই…এরপর কি হয়েছে কিছুই জানিনা আমি….
তারপর দিন সকালে আমি নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি…তারপর শুনতে পারি আয়েশা আত্মহত্যা করেছে…কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনা যে আয়েশা আত্মহত্যা করেছে…আর ওকে মেরেছে তোমার মামা…নিজের দোষ ঢাকতে তোমার মামা একটা নিরীহ মেয়েকে খুন করে ফেলল….
আমি আর বসে থাকতে পারলাম না…হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম হোস্টেলে….হোস্টেলে তখন আয়েশার মৃত্যুর খবর নিয়ে তোলপাড় চলছে….তোমার মামা আমাকে দেখেই চোখে টিপ্পনি কেটে বলল,,,কেমন দিলাম????বেশি বাড়াবাড়ি করলে আপনাকেও উপরে পাঠিয়ে দিব….
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না….তোমার মামার সাথে হোস্টেলের শিক্ষক রহিম স্যার ও জড়িত ছিলো…কোন প্রমাণ না থাকায় আমি কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনাই তোমার মামার বিরুদ্ধে…
চলে এলাম বাসায়… এক সপ্তাহের মতো বাসায় ছিলাম…তবে মাঝে মধ্যে হোস্টেলে যেতাম…সবার খোজ খবর নিয়ে আসতাম…একদিন নবনী বায়না ধরলো যেন আমার হোস্টেল এ নিয়ে যাই ওকে…বাধ্য হয়ে নিয়ে গেলাম…আর তখনি তোমার মামার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে নবনীর উপর….আমি বুঝতে পেরে নবনী কে বাসায় নিয়ে আসি…. ভয়ে থাকতাম কখন কি হয়ে যায়???
এরপর হোস্টেলে একের পর এক খুন হতে থাকে…আমি তদন্ত করার জন্য খোজ খবর নিতে থাকলাম… সেদিন রাত 12টায় আমি হোস্টেলে যাই খবর তোমার মামার বিরুদ্ধে প্রমাণ নেওয়ার জন্য….
গিয়ে দেখি টিচার্স রুমে তোমার মামা আর রহিম স্যার কথা বলছে….আমি ওদের কিছু কথা আমার ফোনে রেকর্ড করি….
তারপরের দিন সকালে আমি সেই রেকর্ড তোমার মামা আর রহিম স্যার কে দেখাই…ওরা দুজনেই খুব ঘাবড়ে যায়….আমাকে বলতে থাকে,,,আচ্ছা শুনেন আমরা যে কাজ করি সেই কাজে আপনাকে 50% শেয়ার দিব…. এতে আপনার ও লাভ আমাদের ও লাভ….
আমি ওদের হুমকি দিয়ে আসি…পুলিশ কে দেখাবো সেই রেকর্ড….
সেদিন ই বিকেলে তোমার মামা আমাদের বাসায় এসে হাজির হয়….আমি তাকে দেখেই বুঝে যাই সে কেন এসেছে???আমার হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,,,এবার কি করবেন মাষ্টার মশাই???নবনী কে আমি বিয়ে করব আশা করছি আপনার কোন আপত্তি নেই???
আমি জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠি,,,এই যে আপনার এই গুন্ডাগিরি আপনার হোস্টেলে দেখান…. আমার বাসায় না…এটা ভদ্রলোকের বাসা…
তোমার মামা হাসতে হাসতে আমার সামনে মোবাইল ধরে…. মোবাইলে আমার ভালোবাসার মানুষ নিশিতা কে দেখাচ্ছে….তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,,,এইবার কিন্তু ইনি আমার মাছের টোপ হবে….ভেবে দেখেন কি করবেন????
নিশিতা আমার হবু বউ…বাবা মায়ের পছন্দে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়….কিন্তু উনি কিভাবে নিশিতার খোজ পেলেন আমি জানিনা….
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি…কি করব বুঝে উঠতে পারছি না….সেই সময় ই নিশিতা আমাদের বাসায় আসে…আমি নিশিতা কে দেখেই চমকে উঠি…
তোমার মামা নিশিতা কে দেখেই ওর কাছে গিয়ে গালে স্পর্শ করে…আমি তখনি তোমার মামার গালে ঠাস করে চড় দিয়ে বসি….
একদিকে আমার বোন একদিকে আমার ভালোবাসার মানুষ… কি করব আমি???পরে ভেবেচিন্তে রাজি হলাম তার প্রস্তাবে…কিন্তু কিছুই করার ছিল না আমার….
তোমার মামা চলে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেছে,,,আমি যেন রেকর্ডিং টা ডিলেট করে দেই….আমি আর কোন জবাব দিলাম না….ভাবতে লাগলাম কিভাবে কি করব???
হুম এবার আমাকে যা করার করতে হবে…আমি নিশিতা কে নিয়ে বেরিয়ে যাই…ওকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে তারপর থানায় যাবো….
যাওয়ার পথেই কয়েকজন লোক আমাদের পথ আটকায়…আমাকে দুইজন ছেলে আটকে ধরে রেখেছে…আর নিশিতা কে দুইজন ছেলে টেনে ধরে রেখেছে…..
আমার পিছন দিকে তোমার মামা পিস্তল ঠেকিয়ে বলছে,,,আমি জানতাম আপনি কিছু একটা ঝামেলা করবেন…তাই আমি আগে থেকেই সতর্ক ছিলাম…. এবার তো আর আপনাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা…মরতে হবে আপনাকে….
আমি চিৎকার দিয়ে বলি,,,আমাকে যা করার করেন কিন্তু নিশিতা কে ছেড়ে দেন….
তিনি হো হো করে হেসে বললেন,,,এবার যা করার আপনার সামনেই করব…এই বলে তিনি নিশিতার কাছে যেতে লাগলেন…নিশিতার কাছে গিয়েই ওর গায়ের শাড়ি এক টানে খুলে ফেলল….আমার চোখের সামনেই আমার নিশিতা কে!!!!!
আমার কিচ্ছু করার ছিলোনা…. তারপর নিশিতার পেটে একটা গুলি করে…একটা গুলিতেই আমার নিশিতা মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে….এরপর আমাকে গুলি করা হয়…. এই যে আমার কপালে…..আমি বেচে ছিলাম অনেকক্ষণ… আমি ধীরে ধীরে নিশিতার কাছে যাই…আমার নিশিতা আজ সাদা শাড়ি পড়েছিল…সেই সাদা শাড়ি এখন রক্তে লাল হয়ে আছে….কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে আমার নিশিতা কে….আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে… নিশিতা কে ছোয়ার আগেই জন্য আমার মৃত্যু হয়…..
আশিক ভাইয়া কান্না করতে করতে মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে…..আমার চোখ দিয়েও অঝোরে পানি পড়ছে….আমার মামা এমন নিচু মনের মানুষ আমার জানা ছিলো না…..
(চলবে)