নিরুদ্দেশ পর্ব ২১

নিরুদ্দেশ
পর্ব ২১

‘তোতাপাখি,ও তোতাপাখি, কোথায় আপনি?’ সকাল সকাল বিরামহীন স্বামীর ডাক শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল তোতা। এ ভাবে কেউ ডাকে নাকি! তাকে আদর করে তোতাপাখি বলে। ঠিক আছে। তা বলে জোরে জোরে ডেকে সবাইকে শোনাবে! কেউ শুনতে পেলে কি যে ভাববে, কে জানে। ফুল তুলছিল সে। ফুল তোলা শেষ হয়নি। ছুটে পালিয়ে এল। ঠাকুর ঘরে ফুল রেখে স্বামীর কাছে এসে হাজির‌ হলো।
‘বালিকার মতো দৌড়াচ্ছেন কেন? পড়ে যাবেন তো।’
‘আপনি বালকের মতো চিৎকার করছিলেন কেন?’
‘আমি বালক!’ ভারী কন্ঠস্বরে বলল।
‘আমিও বালিকা নাকি! মুচকি হেসে জবাব দিল তোতা।
‘আপনি বড় ভারি মেয়ে।’
‘আপনি অল্প খান তাই হালকা। আমি বেশি খাই তাই ভারি।’
‘সকাল সকাল ঝগড়া শুরু করলেন!’
‘আপনি ওভাবে ডাকছিলেন কেন? জানেন, পুকুরঘাটে কতগুলো মহিলা ছিল। ওরা সম্ভবত শুনতে পেয়েছে। আমার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। ইস্! কি নাম তোতাপাখি! এ ভাবে স্ত্রীকে ডাকে নাকি! আপনার লজ্জা হচ্ছে না?’ লজ্জা মিশ্রিত হাসিতে তোতাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মুখের দিকে তাকালো। তবে কিছু বলল না। মনে মনে খুব হাসলো।
‘বলুন কি জন্য ডাক ছিলেন?’ সবুজ পুরনো বাদামি রংয়ের একটা জামা তার দিকে বাড়িয়ে বলল,’দেখুন না জামার কিছুটা অংশ ছিঁড়ে গেছে। একটু সেলাই করে দেবেন?’
‘সকাল সকাল সূচ সুতোর নাম নিতে হলো। জানেন না এতে অমঙ্গল হয়।’
‘ওসব কুসংস্কার। আমি বিশ্বাস করি না।’
‘আমি তো বিশ্বাস করি।’
‘আমি আপনাকে অবিশ্বাস করতে বলিনি।’
‘আপনার তো অনেক জামা রয়েছে সেগুলো পরতে পারেন। বাজার থেকে কিনে আনতে পারেন। তা না করে ছেঁড়াগুলো সেলাই করে পরতে হবে।’
‘একটুখানি ছিঁড়ে গেছে। আর দেখো জামাটা পুরো নতুন। ফেলে দিলে হয় নাকি!’ তোতা সূচ সুতো এনে সেলাই করতে শুরু করলো। সেলাই করতে করতে বলল,’আপনি না সত্যি একটা মানুষ। আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমিও আপনার মতো হয়ে যাচ্ছি। আমি যখন বাপের বাড়িতে থাকতাম তখন আমার অনেক জামা থাকলেও মনে হতো আমার কিছু নেই। আমার আরও চাই। আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমারও পুরনো জিনিসের প্রতি ভালোবাসা বেড়ে যাচ্ছে। একটা দুটো শাড়িতে হয়ে যাচ্ছে। আপনার কাছে জাদু আছে মশাই।’ সবুজ ঠোঁট টিপে হাসলো। জবাব দিল না। সেলাই শেষ হতেই জামাটা পরে নিল। তোতা হাসিমুখে বলল,’আপনি কোথাও বের হবেন?’
‘না।’
‘তাহলে সেলাই এর জন্য জোর করলেন কেন? পরে করলেও তো হতো।’
‘আমি এখন ঘুমাবো। আপনি ঘুমাবেন?’
‘এই তো ঘুম থেকে উঠলেন। আবার ঘুমাবেন?’
‘আপনিও ঘুমাবেন আসুন।’
‘অনেক কাজ আছে।’
‘পরে একসঙ্গে মিলেমিশে করে ফেলবো।’
তোতা খুব বেশি অবাক হয়নি। সবুজের এমন ব্যবহার প্রায়ই দেখা যায়। দুজনে বিছানায় শুয়ে পড়লো। বেশ অনেক্ষণ নিস্তব্ধতা। বিরামহীন স্তব্ধতা অতিক্রম করে তোতা বলল,’কিছু বলুন! এভাবে শুয়ে থাকবেন নাকি! কথা বলুন!’
‘ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘ঘুম থেকে উঠলাম আবার ঘুম!’
‘তাহলে কি করবেন?’
‘আপনার সঙ্গে গল্প করব।’
‘নিরবে গল্প করতে পারবেন?’
‘নিরবে আবার কী করে গল্প হয়!’
‘নিরবেও গল্প হয়, তোতাপাখি।’
‘আমায় শিখিয়ে দিন।’
‘আপনি চোখ বন্ধ করুন।’
‘করলাম।’
‘এবার আপনার যা ভালো লাগে তা অনুভব করুন। কল্পনা করুন। কল্পনায় গল্প করুন। ভালো লাগবে।’ তোতা চোখ বন্ধ করলো। সবুজ খেয়াল করল তোতা বন্ধ করার চোখে মিটিমিটি হাসছে। সে জোর করে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বেশিক্ষণ বন্ধ করে রাখতে পারল না। খিল খিল করে হেসে উঠলো।
‘কি হলো? হাসছেন কেন?’
‘আপনাকে পাগল আর আমাকে বোকা মনে হচ্ছে। এ ভাবে কি হচ্ছে? আমার খুব হাসি পাচ্ছে, রাজামশাই।’ তোতা কিছুতেই হাসি থামালো না। অন্তহীনভাবে হেসে গেল। তার মুখের ললনা ভঙ্গি সবুজকে মুগ্ধ করল। এই মেয়ে বড় মায়াবতী। তার মায়ায় তাকে জড়িয়ে ফেলেছে।
‘এবার থামুন। অনেক হেসেছেন।’ তোতা থেমে গেলো ঠিকই তবে মুখ থেকে পুরোপুরি হাসি বিলীন হলো না। সবুজ তোতার পেটে হাত রাখল। চমকে উঠলো তোতা। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। কাঁপা কাঁপা উত্তেজনায় বলল,’কি হলো রাজামশাই?’
‘আপনি আবার চোখ বন্ধ করে কল্পনা করুন। ভালো লাগবে।’
‘আমি তাহলে হেসে হেসে মরে যাবো। আপনার সঙ্গে থাকতে থাকতে আমি বোকা হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে। আপনি পারেনও বটে।’
সবুজ আর কিছু বললা না তবে এবার সে নিজে থেকে চোখ বন্ধ করলো। মুখের হাসি লুকাতে পারলো না। তবে কিছুক্ষণ পর মুখের হাসি স্থির হয়ে গেল। স্থির চোখে কল্পনা করলো। তখনো সবুজের হাত তার পেটের উপর রয়েছে। হঠাৎ করে তার সারা শরীর শিরশির করে উঠল। সারা শরীর তাল পাতার মতো কেঁপে উঠল। তোতা হঠাৎ করে চমকে উঠে সবুজের বুকের তলায় আশ্রয় নিল। মুহুর্তের মধ্যে কি ঘটলো কিছুই বুঝতে পারলো না সবুজ। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তোতা বললো,’আমি কল্পনা করতে পারবো না। আমি নীরবতা চাই না। আমি আপনাকে সশরীরে চাই। আমি আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। আপনি হারিয়ে যাবেন না তো?’
‘হারাতে যাবো কেন? সব সময় আপনার সঙ্গে থাকবো।’
‘অন্য কারোর হয়ে যাবেন না তো কোনোদিন? আমি সহ্য করতে পারবো না কিন্তু।’
‘এত ভয় পাও কেন?’
‘ভয় হয় তাই ভয় পাই।’
তোতাকে আরও কাছে নিয়ে নিল। আদুরে কন্ঠে বলল,’ভয় পাবেন না। আপনাকে আমি কখনো ছেড়ে যাবো না। সবসময় কাছে রাখবো।’
বেশ নিস্তব্ধতা। তোতা গরম নিশ্বাস বারবার ছাড়ছে। সবুজ নিজের আবদ্ধ থেকে তোতাকে মুক্ত করল না। মেয়েটি এত ভয় পাচ্ছে কেন? মানুষের মধ্যে হারানোর ভয় এত তীব্র হওয়া ভালো নয়। মানুষ তো অথিতি। কখন চলে যাবে কেউ জানে না। সে চলে গেলে এই মেয়ের কী হবে? এক মুহূর্ত বাঁচতে পারবে না।
‘তোতাপাখি!’
‘হু।’
‘তোতা পাখি!’
‘শুনছি, বলুন।’
‘কিছু না।’
‘আমি ঘুমাবো রাজামশাই। আমায় ঘুম পাড়িয়ে দেবেন?’
‘এই না বললে আপনার এখন ঘুম পাবে না। আবার এখনই ঘুমাতে চাইছেন?’ তোতা কিছু বলল না। সবুজ অনুভব করল তোতা কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছে। তার কষ্টের কারণ কি? সে যে সারাদিন আর সবুজকে ছাড়বে না সেটা বুঝতে বাকি রইল না।মায়ের মতো সন্তানকে আগলে রাখতে হবে। একটা মেয়ে তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। তাকে ঠকানো কি ঠিক হচ্ছে? সবুজ তো তাকে ঠকাচ্ছে না। তবুও কেন এমন মনে হচ্ছে? সবুজ তোতাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। কিন্তু তা আবেগহীন শান্ত ধীর ভালোবাসা। মনে তৃপ্তি আনে। স্নিগ্ধতায় ভরে যায়, আনন্দ হয় কিন্তু শিরা-উপশিরায় রক্তের তান্ডব চলে না। আবেগহীন কন্ঠে সবুজ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’কাল বাইশে শ্রাবণ, মনে আছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কাল বাড়িতে ছোট একটা সাহিত্য সভা হবে। অনেক সাহিত্যিক,শিল্পী,গুনবান ব্যক্তিরা আসবেন। তাদের জন্য তো সব কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁরা কিন্তু দুপুরে আমাদের বাড়িতে খাবার খাবেন। সবকিছু পারবেন তো? বৌদিমণিকে না হয় ডেকে নেবেন। তাতে আপনার কাজ হালকা হবে।’ তোতা জোর করে স্বামীর বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল। বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে নিল। মুহূর্তের ঘটনায় হতভম্ব হল সবুজ।
‘কী হলো? এভাবে দূরে সরে গেলেন কেন?’
‘ঘুমাবো। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।’ বেশ রেগে কথা বলল। তার রাগের কারণ বুঝতে বাকি রইল না সবুজের। তোতা বৌদিমণিকে পছন্দ করে না এমন নয়। পার্বতীর সন্তান একটু বড় হওয়ার পর এ বাড়িতে ফিরে এসেছে আবার। যতদিনে ফিরে এলো ততদিনে আর কিচ্ছু করার ছিল না। দুটো হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেছে ততদিনে। সংসারে সবাইকে এক করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল পার্বতী। সংসার নিয়ে আর নাক গলাতে চায় না। তার সন্তান হয়েছে। কথা বলার সঙ্গীর অভাব হবে না। তাকে নিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে। তোতার সাথে তার সম্পর্ক ভালো। দুজনে খুব কথা বলে। এ-বাড়ির রান্না ও-বাড়িতে যায় আবার ও-বাড়ির রান্না এ-বাড়িতেও আসে। তবে সবুজ বৌদিমণির সাথে খুব কথা বললে কিংবা বেশি মেলামেশা করলে রাগ করে। শুধু বৌদিমণি নয় সবুজ যে কোনো নারীর সাথে খুব বেশি মিশলে তোতা রেগে আগুন হয়ে যায়। অভিমানে কথা বলে না। সবুজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মনোক্ষুন্ন হয়েছে। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে ঠিকই তবে তোতার এমন ব্যবহারের সে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। এদিকে পার্বতীও ব্যাপারটি খেয়াল করেছে। তাই সেও আজকাল সবুজকে এড়িয়ে চলে। প্রয়োজনে কিংবা ভালো-মন্দ দু-একটা কথা ছাড়া কোনো কথা বলে না। এতোটুকু পর্যন্ত সহ্য করতে পারে এর বেশি সহ্য করতে পারে না তোতা। গত দু-দিন আগে তাদের বাড়িতে সাহিত্যসভায় নিয়ে সবুজ তোতার সঙ্গে আলোচনা করেছিল। সেদিন সবুজ পার্বতীর কথা বলে। কিন্তু তোতা জানায় সে একা সবকিছু সামলে নিতে পারবে। সবুজ আর কিছু বলেনি। মেনে নিয়েছিল। সবকিছু মেনে নেওয়ার পর আজ হঠাৎ করে আবার একই কথা বলায় রেগে গেছে সে।
পরের দিন সকালে সাহিত্য সভা শুরু হলো। অনেক ব্যক্তিবর্গ এসেছেন। সকলের সাথে ভাব বিনিময় করে একটা সভা শুরু হলো। কেউ আবৃত্তি করলেন, কেউ গান শোনালেন, কেউ গল্প পাঠ করলেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সভা বেশ জমে উঠল। সবুজ আর তোতা বেশ খুশি। সারাবাড়ি আনন্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। তোতা কিছু একটা কাজ করায় বাইরে বেরোতে পারল না। তাই সবুজ গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে অবাক হলো সংকেতকে দেখে। তার তো এই সময় ডিউটিতে থাকার কথা। ডিউটিতে না থেকে তার বাড়িতে কি করছে? নিশ্চয়ই কাজে যায়নি। ছুটি নিয়েছে। বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারতে চলে এসেছে। কিন্তু আজ তো আড্ডা দেওয়া যাবে না। বাড়িতে অনেক অতিথি রয়েছেন। তাদের ফেলে যেতে পারে না। সবকিছু জানার পর সংকেত নিশ্চয়ই জোর করবে না। তাকে কিছু বলতে না দিয়ে সংকেত বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করল। বাধা দিয়ে বলল,’কি দরকার বলো?’
‘আগে ভেতরে তো যেতে দাও।’
‘না, আজ নয়। আজ আমার অনেক কাজ আছে।’
‘তুমি চুপ করো তো। নতুন বৌঠান কই?’ বলেই হাঁক ছাড়লো,’নতুন বৌঠান, কোথায় তুমি! দেখো সবুজ আমায় ভেতরে আসতে দিচ্ছে না।’ ভেতরে গান বাজনার জন্য তোতার কাছে কোনো বার্তা পৌঁছালো না। সবুজ শান্ত কন্ঠে বলল,’দেখো, আজ আমায় কোনো কিছুতে জোর করো না। আমার অনেক কাজ আছে। আমাকে শেষ করতে দাও। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বিকেলে আমি নিজে তোমার বাড়ি যাব।’
‘তোমার কি হয়েছে বলো তো? এমন করছো কেন?’
‘কিছু হয়নি। অনেক দরকারি কাজ আছে।’ সংকেত শুনতে চাইল না। জোর করে ঢুকতে চাইলো। বাধা হয়ে দাঁড়ালো সবুজ।
‘আমায় ভেতরে যেতে দিচ্ছো না কেন?’
সবুজ কোনো জবাব না দিয়ে মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিল। বুঝে গেছে সংকেতকে আটকানো সম্ভব নয়। দরজা বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। সংকেত মুহূর্তের মধ্যে হতভম্ব হয়ে গেল। কী এমন ভেতরে রয়েছে, যার জন্য তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো না! তার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করতে পারল সবুজ? এই ছেলেটা তার ছোটবেলার বন্ধু সবুজ তো?

সন্ধ্যা হতে বেশ খানিকটা বাকি। তবে চতুর্দিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। রিমঝিম করে বৃষ্টি পড়ছে। মাঝেমধ্যে মুষলধারে বৃষ্টিও হচ্ছে। বাড়ির একদম উঠোনে বসে রয়েছে সংকেত। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মাঝেমধ্যে ঝড়ো বাতাসে গায়ে বেশ কয়েকটা বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ছে। ঠান্ডায় গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। সেদিকে একদমই হুশ নেই তার। বেহুশের মতো বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার সংকোচনহীন মনে সন্দেহের বাসা বেঁধেছে। সকালবেলায় সবুজ এমনটা কেন করল? সবুজের সামনে নিজের আত্মসম্মান খুইয়েছে এ বিষয়ে ভয় পায় না সে। বন্ধুর কাছে আবার কিসের সম্মান? এটাই তো সকলে ভাবে। কিন্তু তারা তো এমন নয়। তারা তিনজন প্রত্যেককে যথেষ্ট সম্মান করে। অন্যের সামনে কিংবা নিজেদের সামনে তারা কখনো একে অপরকে ছোট কিংবা অসম্মানিত করে না। যারা বন্ধুদের সম্মান করে না তারা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। তারা সম্মান করতে পারছে না মানে অনেক সময় অন্যের সামনে অসম্মান করতেও দ্বিধাবোধ করবে না। যারা সম্মান দেয় না তারা প্রকৃত অর্থে প্রকৃত বন্ধু হয়ে ওঠে না। তারা হীন চোখে কখনো কাউকে দেখেনি। এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তারা কেউ কাউকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে না। সব জায়গায় সম্মান দিয়ে কথা বলে। কিন্তু আজ সবুজ কি করলো? সে অন্যায় করেছে। সে তো ভুল কাজ করে না। তাহলে আজকের ব্যবহারটি কি ভুল নয়? যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে সবুজ খুব শীঘ্রই তার বাড়িতে আসতে চলেছে। ঝড় বৃষ্টি তোয়াক্কা না করে সে আসবে। অনেকক্ষণ পর সংকেতের মনে হাসি ফুটে উঠল। সূর্যময়কে ফোন করলো তাদের বাড়িতে আসার জন্য। সে ঝড়কে ভয় করল না। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার জন্য রাজি হলো। তবে সংকেত সবুজকে ফোন করল না। তার দৃঢ় বিশ্বাস সবুজ নিজে থেকে আসবে। আশাহত হলো না। সন্ধ্যা হওয়ার কিছুটা পর ভিজে ভিজে সংকেতের বাড়িতে পৌঁছালো সবুজ। সংকেতকে দেখে মনে হলো তার ব্যবহারে মোটেও কষ্ট পায়নি। বেশ হাসিখুশি আছে। সকালের মূহুর্তের উত্তেজনা ভুলে গেছে।
‘পুরো ভিজে গেছো তো। ভেতরে এসো তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি করো।’ সবুজ ভেতরে প্রবেশ করলো। সংকেত স্ত্রীকে বলল গামছা আনার জন্য। গা মুছে খেয়াল করল জামাকাপড় পুরো ভিজে গেছে। সেগুলো পরে থাকা যাবে না। সংকেত তা বুঝতে পেরে নিজের জামাকাপড় এনে সবুজকে দিল। বন্ধুর জামা পরতে তার কোনো সংকোচন নেই। নিঃসংকোচনে তৃপ্তি মুখে পরে নিল। সে একটু পাতলা তাই খুব ঢিলে হলো। তাকে দেখে ফিক করে হেসে উঠলো তৃধা সঙ্গে সংকেতও। দু-একটা কথা বলে তারা বাইরে এসে বসলো। মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাই সূর্যময় আসতে দেরি করছে। সংকেত সবুজের মুখের পানে তাকালো। বলল,’যা বলতে এসেছো বলো। দেরি করছো কেন?’
‘কি বলবো?’
‘কি বলবে তা আমি জানি। তবে আমি তোমার মুখে শুনতে চাই।’
‘কষ্ট পাওনি?’
‘সে-ই মুহূর্তে পেয়েছিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়েছি। একই সঙ্গে থাকতে গেলে শুধু ভালো নয় কিছু খারাপ মুহূর্তও তৈরি হয়। কর্মজীবনে একটু তো মনোমালিন্য হবে। আমি খারাপ মুহূর্তগুলোকে মনে রাখতে চাই না। আমি ভুলে গেছি। আর তুমি যে ইচ্ছে করে করোনি তা আমি জানি।’
সবুজ সবকিছু পরিষ্কার করে বললো। ওই সময় সে সংকেতকে সব কিছু বলার জন্য তৈরি ছিল না। আর সে না শুনে কিছুতেই ফিরে আসতো না। তাই উত্তেজনাবশে করে ফেলেছে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো তারপর থেকে সবুজ আর সাহিত্য সভায় মন দিতে পারেনি। তার মন সংকেতের কাছে চলে এসেছিল। তারপর থেকে স্তব্ধ হয়ে যায়। বৈরাগী হয়ে পড়ে। সাহিত্য সভা থেকে উঠে আসার অবকাশও ছিল না। তাতে সৌন্দর্য নষ্ট হতো। তাই তো সব কিছু শেষ হওয়ার পর সর্বপ্রথম সংকেতের কাছে ছুটে এসেছে ক্ষমা চাইতে। সংকেত তাড়াহুড়ো করে বলল,’এভাবে ক্ষমা চাইবে না। আমার খারাপ লাগে। আমি অনেক আগে তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি।’
‘কেন করলে? আমি তো অন্যায় করেছি।’
‘আমরা যখন ভুল করি আর পরে যখন সে-ই ভুল বুঝতে পারি তখন অনুশোচনা করি। আর অনুশোচনা করেই ছেড়ে দিই। কিন্তু তুমি তো আলাদা। শুধু অনুশোচনা নয় ক্ষমা চাইতেও আসবে জানতাম। তাই আগে থেকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ওসব কথা বাদ দাও। কত সুন্দর ওয়েদার। গল্প করলে লাভ হবে।’ সবুজের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। বৃষ্টি কিছুটা কমার পর সূর্যময় তাদের সঙ্গে যোগ দিল। তারপর আবার বৃষ্টি শুরু হলো। বিদ্যুৎ চলে গেল। হ্যারিকেনের আলোয় তিন বন্ধু ফিরে গেল স্বর্ণযুগে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ আর ভেতরে বন্ধুত্বের গল্পগুজব মিলে এক বিরচিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তৃধা দরজার একটা পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে তাদেরদের আড্ডার নীরব দর্শক হলো। তাদের কথা শুনে একা একা হাসলো। আবার কিছুটা পর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কি অপূর্ব বন্ধুত্ব! কেউ কেউ প্রেমিক প্রেমিকার কিংবা প্রেমিকা প্রেমিকের মোহে ডুবে গেলে আর বেরোতে পারে না। একজনের মুগ্ধতায় আটকে গেলে নাকি আর বেরোনো সম্ভব নয়। কিন্তু তারা কি কখনো বন্ধুত্বের মোহময় ডুবেছে? বন্ধুত্বের মোহময়ে ডুবে গেলে সেখান থেকে বেরোনো সম্ভব নয়। এই সম্পর্ক বড়ো নরম তবে সহজে ভেঙে যায় না। দীর্ঘক্ষণ আড্ডা চলার পর সংকেত তৃধাকে চা বানানোর জন্য বলল। সূর্যময় বাঁধা দিয়ে বলল,’আজ আর বাড়িতে চা খেতে হবে না। চলো আমরা একবার স্কুলের দিকে যাই। মনে আছে স্কুলে পড়ার সময় দাদুর দোকানে রোজ মসলা মুড়ি খেতাম। চলো না একবার।’
‘এই দুর্যোগের রাতে অত দূর যাবে?’ সবুজ বলল।
‘কিছু হবে না। চল তো।’
তাদের কেউ আটকালো না। একটা ছাতার তলায় তিন জনে বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। তিন জনেই ভিজে গেল তবে কেউ দাঁড়ালো না। ফিরে পেলো শৈশব। হয়ে উঠলো বালক। রাস্তা জল জমা হয়ে আছে। নুড়ি বিছানো পথে জল লাল রঙ ধারন করছে। জল জামায় এসে লাগলো। কিন্তু সেগুলোকে তোয়াক্কা না করে কৌতুক করে করে এগিয়ে গেল। অন্ধকার রাত,বিদ্যুতের ঝলকানি, মেঘের গর্জন কোনো কিছুই পাত্তা পেলো না তাদের কাছে। অপূর্ব পরিবেশে অপূর্ব মেলবন্ধন। কিছুটা যাওয়ার পর সংকেত ছাতা বন্ধ করে দিল। তারা ভিজতে চায়। এই দুর্যোগকে ভয় করে না। ঘন নিস্তব্ধতার বুক চিরে তিন বন্ধুর কলরব ভেসে গেল দিগন্তের পর দিগন্ত। উত্তেজনায় তারা চিৎকার করে উঠল। তার খুব খুশি। বালকের মতো খুশি। সবুজ কিছুটা শান্ত হয়ে বলল,
‘চলো না বন্ধু যাই সাগর দেশে
নগ্ন পায়ে হাঁটি পথিকের বেশে।
ক্লান্ত হবো না ক্লান্ত হবো না
তোমরা আছো যে সাথে।’
তারা যখন দোকানের কাছে পৌঁছাল তখন দোকান দাদু দোকান বন্ধ করতে উঠেছে। তাদের দেখে বন্ধ করলো না। এই দুর্যোগের রাতে কারা আবার আসছে? টর্চের আলো ফেলে মুখগুলো বেশ চেনা চেনা লাগলো। সংকেত ভেতরে ঢুকে গিয়ে বলল,’আমাদের চিনতে পারছো?’
‘তোমাদের ভুলি কি করে? অনেকগুলো বছর এখানে আসোনি তবে মনে আছে সবাইকে। তা এত রাতে কি জন্য এলে?’
‘ইচ্ছা করলো। চা বানাতে পারবে?’
‘কেন পারব না? তোমরা ভেতরে বসো আমি এক্ষুণি বানিয়ে আনছি।’ দাদু হাসি মুখে চা বানাতে চলে গেল। তিনজনে ভেতরে গিয়ে বসলো। এখানে শুধুমাত্র স্কুলের সময় ভিড় জমে না। সন্ধ্যার সময়েও বেশ আড্ডা জমে। আশেপাশের শ্রমিক আর কৃষকেরা সারাদিনের ক্লান্তি উজাড় করতে এখানে এসে বিশ্রাম করে। চায়ের আড্ডা কিংবা তাসের আড্ডায় এলাকাটি মুখরিত হয়ে থাকে সবসময়। তবে আজ ঝড় হাওয়ায় কেউ আসেনি। তাই দাদু দোকান বন্ধ করে চলে যেতে চাইছিল।
কালো পলিথিন দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট কুটির মধ্যে জড়ো হয়ে বসল তারা। কত গল্প! কত আশা! কত আকাঙ্ক্ষা উপচে পড়ল। কথার শেষ নেই। ওদিকে মুষলধারে বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ আর মেঘের গর্জন তো রয়েছে। ঝড়ো বাতাস খুব শব্দ করছে। মনে হচ্ছে এই ছোট্ট কুঠিরের আয়ু কম। ভেঙে সব চুরমার করে দেবে। দূরে কাছে নিশাচর প্রাণীও স্তব্ধ হয়ে গেছে। ব্যাঙেরা ঘনঘন ডেকে চলেছে। কঠিন দুর্যোগ আরও ব্যাপকভাবে ঘনিয়ে আসছে। দূরে দাঁড়িয়ে দোকান দাদু তাদের দেখল। তাদের দেখে দাদুর রবি ঠাকুরের একটা কবিতা মনে পড়ল,”তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্না ঘরের চালে।” এই শালিক গুলো ঝগড়া করছে না। ভাব বিনিময় করছে। তাদের ভাব বিনিময় পাহাড়ের শক্ত পাথরকেও নরম করে দিতে পারে। পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য আর শান্তি যেন এখানে এসে থমকে গেছে। কি অপূর্ব মেলবন্ধন। দাদুকে ব্যাকুল হতে দেখে সংকেত প্রশ্ন করল,’কি হয়েছে দাদু? ভয় করছে?’
‘অবাক হচ্ছি।’
‘কেন?’
‘এই স্থানে আমার দোকান দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে। কত মানুষ আসে কত মানুষ ফিরে যায়। স্কুলের কত ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে ঘোরে। স্কুল থেকে বেরিয়ে গেলে তাদের আর দেখা যায় না। তবে সরস্বতী পূজোয় অনেককে দেখা যায়। কিন্তু কি জানো, তাদেরকে দেখে আমি অবাক হই। স্কুলে পড়ার সময় তারা যাদের সঙ্গে ঘুরতো কলেজ তারা একে অপরকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কেটে চলে যায়। যেন তারা একে অপরকে চেনে না। কেউ কেউ তো একে অপরের নামে বদনাম করে। অথচ তোমরা তিনজন!’
‘আমরা তিনজন কি?’
‘তোমরা তিনজন সম্পূর্ণ আলাদা। একজন পুলিশ অফিসার একজন লেখক আর একজন জেলে। তিনটি পৃথক জগতের মানুষ অথচ তারা একসঙ্গে রয়েছে। কারোর একটু বেশি টাকা হয়েছে বলে গরিব বন্ধুটাকে দূরে ঠেলে দেয়নি আবার গরীব বন্ধুটা অভিমানে ধনী বন্ধুর থেকে দূরে সরে যায়নি। ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ ভুলে তোমরা একসঙ্গে রয়েছো। ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে সব কিছু এড়িয়ে যাও না। এটা বড়ো আশ্চর্যের সৃষ্টি। সবুজ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর থেকে তোমরা দুজনে আর আমার দোকানে আসোনি। ভাবছিলাম তোমাদের বন্ধুত্ব সেখানেই শেষ। আমি ভুল ছিলাম। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তাও তোমরা একসঙ্গে রয়েছো।ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে কিংবা সত্যি সত্যি ব্যস্ততার জন্য কেউ কারোর সঙ্গে থাকতে পারে না। অথচ তোমরা ব্যস্ততাকে পরোয়া না করে সবাই একসঙ্গে রয়েছো। দেখে ভালো লাগছে। মনে আছে তোমাদের প্রতিদিন এসে আমার দোকানে ঝাল মুড়ি খেতে। কত গল্প করতে তোমরা। বৃষ্টি ভেজা দিন, কিংবা গ্রীষ্মের দুপুর বা শীতের সকালের কথা মনে আছে তোমাদের? আমার সকলের মুখ হয়তো চেনা নেই। কিন্তু তোমাদের তো মনে আছে। ছোটবেলার দিনগুলো মনে পড়ে তোমাদের?’
‘জীবনে কাজ থাকবে স্বপ্ন থাকবে কিন্তু তার মাঝেও অবসর দরকার। যে মানুষ অবসর সময় খুঁজে বার করতে পারে না সে মানুষ কখনো সুখী হয় না। ওর জীবনে শান্তি থাকে না। জীবনে সবচেয়ে সুখ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস লুকিয়ে থাকে। আমাদের প্রত্যেককেই প্রত্যেক সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা উচিত। সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে সুখ থাকে। আজ মরে গেলে কাল দুই দিন। তোমার টাকা বাড়ি গাড়ি সম্মান সবকিছু পড়ে থাকবে তুমি না ফেরার দেশে চলে যাবে। তাই জীবনে যা মন চায় তাই করো।’ সংকেত সহজ-সরলভাবে জবাব দিল। দাদুর চোখে জল গড়িয়ে এলো। অন্ধকারের মধ্যে তার চোখের জল কেউ দেখতে পেলো না। কণ্ঠস্বর যে বসে গেছে তা বুঝতে পারল সবাই। হয়তো দাদুর মনে পড়ে গেছে ছোটবেলার কথা। দাদুরও এমন অনেক বন্ধু ছিল। সময়ের সমীকরণে আজ তারা কোথায় কেউ জানে না। হয়তো অনেকে চলে গেছে না ফেরার দেশে। আর কখনো দেখা হবে না। কোনো কথা হবে না।
তাদের গল্প চলতে রইল। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। যদি সারারাত এখানে থাকতে হয় তাতেও তাদের অসুবিধা নেই। তিনজন যেখানে একসঙ্গে আছে সেখানে ভয় নেই ভ্রান্তি নেই বেদনা নেই। নেই কোনো পিছুটান। একসঙ্গে প্রাণ দিতেও রাজি তিনজনে। কথার ফাঁকে সূর্যময় বলল,’আমরা জীবনে অর্ধেক তার সময় পার করে ফেলেছি। এরপর জীবন কেমন হবে জানি না। তবে একদিন সবাইকে মরতে হবে। আমার তিনজনের মধ্যে কে আগে পৃথিবীর ছাড়বো জানি না। কিন্তু ছাড়তে হবে। তখন বাকি দু’জনে কি কাঁদবে?’ দুজন স্তব্ধ হয়ে গেল। কোনো কথা বলল না। এমনটা তারা কখনো ভাবেনি। একদিন সত্যি সত্যি তাদেরকে পৃথিবী ছাড়তে হবে। সেদিন কি তারা বন্ধুকে ছেড়ে থাকতে পারবে? কষ্ট হবে না? দুঃখ পাবে না? বন্ধুর লাশ কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে যেতে হবে। এ যে বড়ো বেদনা! সহ্য করা কষ্টকর। সবুজ রিনিরিনি কন্ঠে বলল,’ওসব কথা বাদ দাও। ওইসব কথা ভাবলে জীবনে সুখ খুঁজে পাবে না। বর্তমানকে নিয়ে বাঁচি। আমাদের প্রত্যেককেই পৃথিবী ছাড়তে হবে। আর আমি চাইবো সেদিন যেন কেউ না কাঁদে। হাসি মুখে বিদায় জানাতে হবে। ঈশ্বর আমাদের পাঠিয়েছেন ঈশ্বর আবার আমাদের নিয়ে নেবেন। এটাই স্বাভাবিক। যতগুলো দিন দিয়েছেন সে-ই দিনগুলো আমরা আনন্দ করে হইহুল্লোড় করে কাটাবো। আর কি চাই? মৃত্যুর দিন যদি কেঁদে ফেলি তাহলে জীবনে তো অনেক অপূর্ণতা থেকে যাবে। মনে হবে জীবনে অনেক কিছু করতে পারিনি অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি সেজন্য কান্না করছি। না মৃত্যুর দিন কাঁদা যাবে না। মৃত্যুর দিন হাসতে হবে। হাসি মুখে বিদায় দিতে হবে। যেখানেই থাকি না কেন ভালো থাকবো। সবার কথা মনে করবো। আর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমরা কেউ নিরুদ্দেশ হবো না।’
আরও কিছুটা সময় কেটে গেল। তারপর সংকেত সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করল। সূর্যময় বাধা দিয়ে বলল,’সামনে সবুজ রয়েছে। সিগারেট ধরানো ঠিক হবে না।’ সংকেত হেসে বলল,’এখন আমাদের বাড়িতেও জানে আমরা নেশা করি। তাহলে আর ভয় কোথায়?’
‘ভয় নয় সম্মান। সবুজ পছন্দ করে না। আমার মনে হয় তার সামনে আমাদের নেশা করা উচিত হবে না। সে তার মনে যে ভাবনা পুষে রেখেছে তা কিন্তু অমূলক নয়। আমরা সে-ই ভাবনাকে অসম্মানিত করতে পারি না।’ সংকেত সিগারেট পকেটে ভরে নিল। সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল,’তুমি কি এখনো মনে করো এগুলো খাওয়া অন্যায়? এগুলো ভুল কাজ? তখন ছোট ছিলে না হয় ওইসব ভাবনা তোমার মাথায় ছিল এখনো কি আছে?’
‘অবশ্যই আছে। এগুলো সত্যি সত্যি অন্যায় কাজ।’
‘আমি যদি তোমার সামনে খাই তাহলে কি করবে?’
‘তোমায় খেতে দেব না। কিছুতেই দেবো না।’
‘সত্যি সবুজ, তুমি সবার থেকে আলাদা। আজকাল যখন কোনো খারাপ কাজ কিংবা অন্যায় কাজ করতে যাই তখনই তোমার মুখটা ভেসে ওঠে। আর নিজেকে সরিয়ে নিই। পারি না ভুল কাজ করতে।’
‘ঠিক বলেছো সংকেত। আমারও আজকাল তাই হয়। কোনো ভুল কাজ করতে গেলে প্রথমে সবুজের কথা মনে পড়ে। মনে হয় ভুল কাজ করে সবুজকে অপমান করছি। আমরা আজকাল খুব বেশি ভুল কাজ করতে পারি না।’ সবুজের মুকে প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল। এটাই যেন তার ভালো মানুষ হওয়ার সার্থকতা। এখানেই সে জিতে গেছে। কিন্তু সে নিজে যে কোথাও হেরে গেছে। বন্ধুরা অন্যায় করতে গেলে বাধা দেয়, কিন্তু তোতা! তাকে কেন বাধা দিতে পারে না? তোতাকে এর আগে অনেকবার বিয়ার কিনে দিয়েছে। ওই সময় মনে হয়েছে তোতা ভুল করছে। তাকে শুধরানোর কথা বলেছে কিন্তু পরে আবার তাকেই এনে দিয়েছে। তাহলে কি সে তোতার চাইতে বন্ধুদের বেশি ভালোবাসে? তাই তোতা খারাপ কাজ করলেও অনেক সময় তাকে সাপোর্ট করে কিন্তু বন্ধুদের পারে না। বন্ধুরদের খারাপ কোনো কাজ একদমই সহ্য করতে পারে না কিন্তু তোতার খারাপ কিছু করলে হয়তো কিছুটা সহ্য করতে পারে। না না এমনটা নয়। আসলে সে তোতার প্রতি ভীষণ দুর্বল। মুখের উপর না বলে দিলে তোতা কষ্ট পাবে। তার কষ্টটা নিতে পারে না সে। তাই তার অন্যায় কাজকে অনেক সময় সাপোর্ট করে। কিন্তু পরে বুঝিয়ে বলে সে যা করছে তা ভুল। অনেক বোঝায়। তোতা কখনো বুঝে আবার কখনো বোঝে না। না বুঝলে একই জিনিস পরে আবার করে। আর সবুজ সে-ই আবদার পূরণও করে।

দর্শকের আসনে বসে অনেক দর্শক ভাবে সে যদি মঞ্চে থাকতো তাহলে দারুন অভিনয় করতো। আর বর্তমানে যে অভিনয় করছে সে আদৌ পারছে না। মজার বিষয় হলো ওই দর্শককে মঞ্চে তুলে দিলে আদৌ কথা বলতে পারবে না। কোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে কোনো মানুষ অন্যায় করলে বহু মানুষ পেছনে কাঠি করে বলে ও ঠিক করছে না। আমি ওই জায়গায় থাকলে কখনো অন্যায় করতাম না। কিন্তু পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে ন্যায়-অন্যায়ের কথা ভুলে যায়। যে কাজে সুবিধা হবে ওই কাজটা করে। সেটা যদি অন্যায় হয় তাও করে। বর্তমানে সংকেতের অবস্থা তেমন। পুলিশ অফিসার হওয়ার আগে ভেবেছিল সে একজন অনেস্ট পুলিশ অফিসার হবে। কিন্তু কতটুকু পেরেছে? অনেক সময় মুখ বুঝে অন্যায় সহ্য করে নেয়। বিবেকে লাগে। অপরাধ বোধ জেগে ওঠে। কিন্তু কিছু করে উঠতে পারে না। নিজের এবং নিজের পরিবারের কথা ভেবে চুপ হয়ে যায়। শাসকের কথায় মাথা নোয়ায়। মাঝে মাঝে ভাবে তার জায়গায় যদি সবুজ থাকতো তাহলে কেমন হতো? সে কিছুতেই কোনো জায়গায় অন্যায় হতে দিত না। সহজে মাথা নোয়াতো না। যারা অন্যায় সহ্য করতে পারে না, যারা সব সময় সত্য পথে চলে তাদের জীবন অনেক কঠিন হয়। তাদের মতো ধৈর্যশীল এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। তাদের জীবনে একটাই লক্ষ্য তারা পরিবর্তন করবেই। হয় তারা সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিবর্তন করে দেবে নয়তো নিজে পরিবর্তন হয়ে যাবে। ভাগ্যিস পুলিশের লাইনে সবুজ আসেনি। না হলে সমাজের বিশাল একটা অংশ পরিবর্তন হয়ে যেতো। নয়তো সে নিজে পরিবর্তন হয়ে অন্যায়কে সাপোর্ট করতো। খাতা-কলমে একটা চরিত্রকে দিয়ে অনেক কিছু করানো যায় কিন্তু বাস্তবে সম্ভব নয়। বড়ো অস্বস্তিতে ভুগছে সংকেত। সব সময় চেষ্টা করে ভালো কিছু করতে। শাসকের জ্বালায় তা আর হয় না। বারান্দায় দোলনায় বসে বাস্তব জীবনের ভাবনায় ডুবে ছিল সংকেত। তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো কারোর গুন গুন গানের শব্দ। কান খাড়া করে শুনল। ঘরের ভেতর কেউ নাচছে আর মুখে গুনগুন করে গান গাইছে। ঘরে তো তৃধা একা রয়েছে। তাহলে কে নাচছে? তৃধা! ধীর পায়ে উঠে গেল। ভেতরের ঘরে দরজা ঘোলা। আড়ালে থেকে তার নৃত্য লক্ষ করল। সে যেভাবে নাচছে তাতে কেউ বলতে পারবে না সে সদ্য নাচ শিখেছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তৃধা নাচতে পারে! তাকে তো কখনো বলেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে স্ত্রীর নাচ দেখল। বেশ ভালো নাচতে পারে। আপন মনে পা হাত কোমর দুলিয়ে নাচছে। দারুণভাবে হাতে বিভিন্ন রকমের ভঙ্গি তুলে ধরছে। অপূর্ব লাগছে তাকে। তার চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল। খুশি খুশি লাগছে। কিছুক্ষণ পর তৃধা সংকেতকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল। লজ্জায় আড়াল হয়ে গেল। সংকেত হাসিমুখে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। স্ত্রীর কাছে গেল। পেছন থেকে হাতটা ধরে বলল,’তুমি নাচতে পারো?’
কোনোরকম মুখ তুলে বললো,’পারি।’
‘এতদিন আমাকে বলনি কেন?’
‘তুমিও তো জানতে চাওনি।’
‘আমি যা জানতে চাইবো তাই বলবে। নিজে থেকে কিছু বলবে না!’
‘নিজে থেকে তখনই বলতে ইচ্ছে করে যখন তুমি কিছু না কিছু জানতে চাও। তুমি তো আমার থেকে কিছুই জানতে চাও না।’
সংকেত উত্তর করলো না। কিছুক্ষণ পর তৃধা বলল,’আজ নয় আমি অনেকদিন থেকে নাচতে পারি। স্কুলে যখন অনুষ্ঠান হতো তখন আমি নামতাম।’
‘কিন্তু তুমিতো ততটা ভালো নাচতে পারো না। যদি ছোটবেলা থেকে নাচের অভ্যাস থাকতো তাহলে আজকে অনেক ভালো নাচতে পারতে। ভালো নাচতে পারো কিন্তু অতটা ভালো নয়।’ চরম সত্যি কথা বলেছে সংকেত। কিন্তু চরম সত্যি কথাতে তৃধার মন খারাপ হলো না। সে হয়তো খারাপ নাচে। প্রিয় মানুষের কাছে ভালো প্রসংসা অর্জন করতে চাইছিল। কিন্তু না। সে তার দুর্বলতা ধরে দিল। সংকেত যা দিয়েছে তাই ভালো। মানুষটা তো তাকে বোঝার চেষ্টা করে না। তার ভালোলাগা খারাপ লাগা গুলো জানার চেষ্টা করে না। আর শুধুমাত্র নাচের প্রশংসা করলেই বা কি হবে? তৃধা একটু অভিমান সুরে বলল,’কত মানুষ আছে লিখতে পারে না। তবুও তারা খাতার পর খাতা লিখে ভরিয়ে ফেলে। কত মানুষ আছে গান গাইতে পারে না। তবুও বেসুরো কন্ঠে গুন গুন করে গান গেয়ে যায়। আমিও নাচতে পারি না তবুও নাচি। কেন জানো? কারণ আমাদের ওইসব করতে ভালো লাগে। যা ভালোলাগে তা করতে অসুবিধা কোথায়? মানুষ তা নিয়ে খিল্লি করলে খারাপ লাগে। কিন্তু ওটা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। তারপর আর তাদের কথায় গুরুত্ব দিই না। সবাইকে গুরুত্ব দিলে নিজে আর কখন বাঁচবো?’
‘রাগ করছো?’
‘রাগ করবো কেন? মিথ্যা প্রশংসা অর্জন করার চেয়ে সত্য কথা শোনা অনেক ভালো। তাছাড়া আমার আর আজকাল রাগ হয় না?’
‘কেন হয় না?’
‘এমনি এমনি হয় না।’
‘তুমিও দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছ। তোমার কথার মানে বুঝি না।’
‘বুঝতে পারবে,বুঝতে পারবে, একটু সময় লাগবে।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমায় আর একটা নাচ দেখাও!’
‘না।’
‘কেন?’
‘আমি শুধুমাত্র নিজের খুশির জন্য নাচি কাউকে দেখানোর জন্য নয়।’
‘আমাকেও দেখাবে না!’
‘তোমাকে দেখাতে পারি। তবে এখন নয়। যখন আমার ইচ্ছে করবে তখন।’
‘তোমার ইচ্ছেটাই ইচ্ছে। আমার কোনো ইচ্ছে নেই বুঝি!’ তৃধা হাসলো। তাচ্ছিল্য করে হাসলো।
সংকেত বলল,’হাসছো কেন?’ তৃধা জবাব দিল না। কোমরে শাড়ি গুঁজে রবীন্দ্র সংগীত মুখে গাইতে গাইতে নাচলো। সংকেত খেয়াল করে দেখল তৃধার পূর্বে হাসিমাখা মুখ বিলীন হয়ে গেছে। সুন্দর করে নাচলো ঠিকই তবে খুশি হতে পারল না। তাকে যেন জোর করে নাচানো হলো।

পর্ব ২২ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here