নিরুদ্দেশ
পর্ব ২০
বিকেল থেকে তোতার মন ভারী। মন খারাপের কারণ জানে না সবুজ। কারণ যদি হয় বাপের বাড়ি যাওয়া তাহলে বড়ো দূর্ভোগে পড়তে হয় সবুজকে। শ্বশুরবাড়িতে সঠিক আপ্যায়ন করে না,সম্মান দেয় না, কেউ কথা বলে না -এমন কিন্তু নয়। ও বাড়ির সবাই সবুজকে খুব ভালোবাসে। তবুও তার যেতে ইচ্ছা করে না। শুধু শ্বশুরবাড়ি নয় তার কোনো আত্মীয় বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। তোতার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার শশুর বাড়ি গেছে। তাও বেশিদিন থাকেনি। ঠাকুরের কাছে প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে এল তোতা। তাকে কেমন একটা দেখাচ্ছে। সারাদিন ছটফট করা পাখিটা চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় বড়ো খারাপ লাগলো। তার মন ভালো থাকলে এতক্ষণে কম করে একশটা বাক্য ব্যয় করতো। এখন চুপচাপ গুম হয়ে বসে আছে। সবুজ তোতার বাহু ধরে কাছে টেনে আনলো। বলল,’খিদে পেয়েছে আপনার?’ তোতা মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বলল। সে সাধারণত মাথা নাড়িয়ে কিছু বলে না। মুখে সবকিছু বলে। একটু অবাক হলো সবুজ।
‘আপনার মন খারাপ কেন? বাপের বাড়ি যাবেন?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবো। আমায় এনে দেবেন?’
‘ঠিক আছে।’
‘কথা দিন এনে দেবেন।’
‘আচ্ছা বাবা কথা দিলাম এনে দিবো। এবার তো বলুন কি চাই?’
‘আমায় বিয়ার এনে দেবেন? অনেকদিন হলো খাইনি।’ সবুজ যেন আকাশ থেকে পড়লো। নিজের কানকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে রইল। তোতা জানে সবুজ এমন কথা শুনলে ভীষণভাবে আশ্চর্য হবে। তাই সে চুপ রইল। দীর্ঘ নীরবতা কাটিয়ে সবুজ বলল,’আপনি নেশা করেন?’
‘বিয়ার খেলে নেশা হয় না।’
‘কিন্তু ওটা নেশাজাতীয় দ্রব্য।’ তোতা কিছু বলল না। সবুজ বলল,’আপনি কবে থেকে নেশা করেন? আপনার বাবা জানেন?’
‘কলেজে পড়ার সময় বান্ধবীদের সঙ্গে মিশে একবার দুবার হতো। বাবা জানতে পারার পর খুব বকুনি দিয়েছিল। কিন্তু অভ্যাস ত্যাগ করতে পারিনি।’
‘আপনি খারাপ অভ্যাসে ডুবে আছেন।’
‘আমি মেয়ে মানুষ তাই খেতে পারি না বুঝি? ছেলেরা খেলে অসুবিধা হয় না?’
‘আমি ছেলে মেয়ের পার্থক্য করছি না। সবার ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক। আমি বন্ধুদেরও বারণ করেছি। আপনাকেও বারণ করব।’
‘আর আমি যদি বারণ না শুনি!’
‘বোঝাবো।’
‘আমি বুঝতে চাই না, রাজামশাই। আপনি এত ভালো মানুষ কেন? একটু দুষ্টুমি করুন না। যারা দুষ্টুমি করে তারা খুব বেশি মন্দ হয় না।’ তোতার কথা মন দিয়ে শুনল না। উঠে দাঁড়ালো। তোতা আবার একবার আদুরে কন্ঠে বায়না করল। সবুজকে বোঝালো। পৃথিবীতে বেশিরভাগ মানুষই সুরা পান করে। তাহলে সবাই খারাপ? আমরা যাদেরকে নিজেদের আদর্শ মনে করি যাদেরকে টিভির পর্দায় দেখলে আমাদের মন ভালো হয়ে যায় তারাও সুরা পান করে। রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ সবাই করেছেন। তাহলে সবাই খারাপ। তোতার এই যুক্তিগুলো কাজে লাগলো না। সবুজের মন যতক্ষণ না সায় দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো যুক্তি তার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। এতোকাল বন্ধুদের বারণ করেছে। তাদের বাড়িতে বলে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু আজ কি করবে? তোতার গার্জেন কে? সে নিজে। তোতাকে বাধা দিতে পারছে না। আবার সমর্থন করতেও পারছে না। মন আর মস্তিষ্কের লড়াই চলল। সে যদি তোতাকে বিয়ার খাওয়ার অনুমতি দেয় তাহলে বড়ো ভুল করবে। আবার যদি অনুমতি না দেয় তাহলেও ভুল করবে। তোতা খুব কষ্ট পাবে। তার বাকস্বাধীনতায় আঘাত করা হবে। কারোর বাক বাকস্বাধীনতায় আঘাত করাও তো অন্যায়। শেষ পর্যন্ত তোতাকে বিয়ার এনে দিল। কিন্তু খুশি হতে পারল না। মনের মধ্যে দ্বিধা যন্ত্রণায় স্তব্ধ হয়ে গেল।
রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সবুজ। কিছুক্ষণ পর তোতা এসে আলো নিভিয়ে পাশে শুয়ে পড়ল। দুজনের ঘুম কিছুতেই এল না। তোতা সবুজকে সব সময় জড়িয়ে ঘুমোয়। আজ একটু দূরে রয়েছে। সবুজ তা খেয়াল করে মৃদু স্বরে বলল,’আপনি দূরে রয়েছেন কেন? কাছে আসুন।’
‘আমি খুব খারাপ মেয়ে তাই না রাজামশাই!’
‘এমন বলছেন কেন?’
‘আপনি কোনো ভুল কাজ করেন না। আর আমি আপনাকে দিয়ে ভুল কাজ করাচ্ছি। আমি খুব খারাপ।’
‘আমি তো ভুল কিছু করিনি।’
‘আমি নেশা করছি আর আপনি আমায় সমর্থন করলেন। এ বুঝি ভুল নয়?’
‘ভুল তো।’
‘তাহলে সমর্থন করলেন কেন?’
‘কোনো ভুল যদি কারোর ক্ষতি না করে কাউকে খুশি করা যায় তাহলে ওই ভুলটাও সঠিক হয়ে যায়।’
‘জানেন তো রাজামশাই, আমাদের এই ত্রিভুবনে কেউই ভুল কাজ করে না। সবাই সঠিক মানুষ। খুন করার সময় খুনি ভাবে না সে ভুল কাজ করছে। সঠিক কাজ করছে ভেবে খুন করে। সে যদি ভাবে ভুল করছে তাহলে কখনোই খুন করতো না। আপনি যা করছেন তা আপনার কাছে সঠিক কিন্তু বহু মানুষের কাছে ভুল। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।’ সবুজ উত্তর করলো না। সবুজ উত্তর না দেওয়া তোতা বুঝে গেল তার কথাগুলো পছন্দ করেনি। তার যুক্তিতে একমত নয়। সে নিশ্চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর নিস্তব্ধতা কাটিয়ে সবুজ বলল,’আজ বুকে আসবেন না? দূরে দূরে থাকবেন বুঝি!’
‘নেশা করেছি তো। আপনার ভালো লাগবে না।’
‘আপনার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। কাছে আসুন।’ সবুজের বাক্য শেষ হতে না হতে তোতা স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মায়া ভরা কন্ঠে বলল,’দেখেছেন রাজামশাই, আপনি আমায় ভালোবাসতে শুরু করেছেন।’ সবুজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
‘আপনি খুশি না?’
‘খুব।’
‘নিন, এবার ঘুমিয়ে পড়ুন।’
‘আপনি খুব ভালো রাজামশাই। খুব ভালো।’
লেখকেরা শব্দের ভান্ডার তৈরি করে। তাদের মুখ থেকে সব সময় শব্দের ফুলঝুরি ঝরে পড়ে। কিন্তু একটা সময় তাদের জীবনেও স্তব্ধতা আসে। কিছুদিনের জন্য কলম স্তব্ধ হয়ে যায়। লিখতে ইচ্ছে করে কিন্তু পেরে ওঠে না। বেশ কয়েকটা মাস সবুজের এমনটা চলছে। লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিছু লিখতে পারছে না। যা লিখছে তা মনঃপূত হচ্ছে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। তবে কি সব শব্দ হারিয়ে ফেলেলো সে? আর লিখতে পারবে না। অনেক চেষ্টা করেও লেখায় সফল হতে পারল না। কথা কাহিনী হারিয়ে ফেলেছে। তাকে লিখতে হবে। ক’টা দিনে বেশ মুষড়ে পড়লো। একা থাকতে শুরু করলো। এই অবসরে তার ভাবনায় ছোটবেলার কথা মনে পরল। চার বছর নিরুদ্দেশ হয়ে পুরুলিয়া কাটিয়ে ছিল। সেখানকার অধিবাসীদের জীবনযাপন সম্পর্কে অবগত। তাদের নিয়ে কিছু লেখা যায়। সবুজ এই প্রথম কোনো উপন্যাস লিখতে দীর্ঘ সময় নিল। পূর্বে কোনো উপন্যাস লেখার সময় এত সময় নেয়নি। পুরুলিয়ায় সাধারণ মানুষদের কাহিনী এবং সরকারের বর্বরতা ফুটে উঠল তার কলমে। আবার একবার তার কলম গর্জে উঠল সরকারের বিরুদ্ধে। ফুটে উঠল পল্লী গ্রামের কোনো এক সুন্দর রাজার কথা। এই রাজার বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই কিন্তু লেখকের মনে সে-ই রাজা যেন রায়বাবু। উপন্যাস বেশ সাফল্য পেল। পুরুলিয়া বইমেলায় ডাক পড়লো সবুজের। রাজি হলো। চার বছরের স্বর্ণযুগ সেখানে লুকিয়ে আছে। ওখান থেকে ফিরে আসার পর আর কোনো ভাবে কোনো সম্পর্ক রাখেনি। চাইলে যোগাযোগ রাখতে পারতো। ইচ্ছে করে রাখেনি। সেখান থেকে যখন ফিরে এসেছিল তখন বয়স খুব বেশি হয়নি। তারপর জীবনের লড়াইয়ে নিবন্ধন হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিয়ে করেছে। সংসার হয়েছে। অনেকগুলো বছর অতিক্রম করে ফেলেছে।এত বছর পর যখন আবার একবার যাওয়ার সুযোগ পেল তখন ছাড়তে চাইল না। মন আনন্দে কলরব করে উঠলো। বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে এক অভিনব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলো। দৃশ্যটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। তোতা চিরুনি ডগায় সিঁদুর লাগিয়ে সিঁথিতে পরল। আজকাল এমন দৃশ্য খুব কম দেখা যায়। একটা লাল টিপ কপালে বসালো। সবুজ পাশে ঝপ করে বসে পড়ে হেসে ফেললো। মখমলে মুখের হাসি বেশ অপূর্ব লাগলো। হঠাৎ করে মানুষের উপস্থিতিতে তোতা চমকে উঠলো। সবুজকে দেখে সেও হেসে ফেললো। সবুজ বলল,’খুব সুন্দর লাগছে আপনাকে।’ লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল তোতা। সবুজ আবার বলল,’আজ আপনি আমার সঙ্গে যাবেন?’
‘কোথায়?’
‘বইমেলায়। চলুন না একবার আমার সঙ্গে। সবাই আমার স্ত্রীর কথা জানতে চায়। আমি কিছু বলতে পারি না। চলুন আমার সঙ্গে আমার ভালো লাগবে।’
‘আমার যাওয়াটা কি ভীষণ প্রয়োজন?’
‘আপনি কেন আমার কর্ম জীবন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন আমি জানি।’
‘কেন?’
‘আমার জীবনেও খারাপ দিন আসতে পারে। আসতে পারে নয় আসবে। তখন আমায় নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হবে। কিছু মানুষ আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিবারকেও তুলে আনবে। কিছু মানুষ আমার সাথে সাথে আমার স্ত্রী ছেলেমেয়েদেরও গালি দিতে দ্বিধাবোধ করবে না। সেজন্য আপনি আমার কর্ম জীবন থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন না!’
‘আপনি একটু বেশি আগে আগে ভাবেন। ভাবনা সবসময় এগিয়ে রাখেন কেন একটু পিছিয়ে রাখবেন তো। সবকিছু কি আপনার ভাবনার মতো হয়? আপনি যা ভাবছেন তা মোটেও নয়।’
‘তাহলে চলুন আমার সঙ্গে।’
‘ঠিক আছে। আজকে আমি আপনার সঙ্গে যাবো।’
‘মন থেকে রাজি হয়েছেন না?’
‘আচ্ছা মানুষ তো আপনি। রাজি হলেও প্রশ্ন না হলেও প্রশ্ন।’ সবুজ হেসে ফেললো।
যথাসময়ে বই মেলায় পৌঁছালো। নির্দিষ্ট স্টলে বসলো। পাশে তোতার জন্যও আসন রয়েছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেও বসলো। জায়গাটা প্রথমের দিকে অচেনা লাগছিল সবুজের। তবে কিছুক্ষণের পর তার মনে হলো এখানে পূর্বেও এসেছে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছে। এর আগে সে কাজল দিদির সাথে এই বই মেলায় এসেছে। সেদিন প্রিয় লেখকের বই কিনে ছিল। একটিবার প্রিয় লেখককে চোখের দেখার জন্য ছুটে এসেছিল। মন আনচান করছিল। প্রিয় লেখককে দেখার তাড়না কতটা সংবেদনশীল সে খুব ভালো করে জানে। আজ আবার এসেছে তবে বিভিন্নভাবে। জীবনের ভিন্নতা কত সুন্দর ভাবে বদলে গেছে। কঠোর অনুশীলনী তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। প্রতিদিনের তত্ত্বাবধান তাকে উজ্জ্বল করেছে। এখন অনেক মানুষের প্রিয় লেখক সে। তাকে দেখতে ভিড় জমেছে। দ্রুত বইতে অটোগ্রাফ দিতে শুরু করলো। বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকাতে অবকাশ পেল না। মাঝেমধ্যে সবুজ ঘুরে স্ত্রীকে দেখল। তোতা বেশ খুশি। চঞ্চল মনে বেশ কয়েকজন পাঠক-পাঠিকা সাথে কথা বলছে। কোনোরকম বিরক্ত কিংবা অস্বস্তি নেই। সে যে এমনি এমনি আসতে চাইছিল না তার বহিঃপ্রকাশ পেল। কাউকে জোর করে নিয়ে এলে তার মধ্যে অস্বস্তি ভাব থাকে। কোনো কিছু ভালো লাগে না। সন্তুষ্ট হতো না। সেখান থেকে বের হতে পারলে শান্তি। তোতার মধ্যে এ সব কিছুই নেই। সে আনন্দে আত্মহারা রয়েছে। মনে শান্তি খুঁজে পেয়েছে। একটু ভিড় কমতে সবুজ ফিসফিস করে তোতাকে বলল,’কেমন লাগছে আপনার?’
‘খুব সুন্দর। একটা সময় আমি আপনার অটোগ্রাফের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর আজ আপনার পাশে বসে রয়েছি। কত ভাগ্যবতী আমি।’
‘এভাবে নিজেকে ছোট ভাববেন না। নিজেকে ছোট ভাবা নিজের দুর্বলতা।’
‘আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। আমার খুব ভালো লাগছে। এবার থেকে আমি আর বারণ করব না। আপনার সঙ্গে যাবো।’ সবুজ হাসিমুখে কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই পরিচিত এক নারী কন্ঠ তার ভাব প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটালো; -সবুজবাবু আমায় অটোগ্রাফ দেবে না? সবুজ ঘুরে কাজলদিকে দেখে চমকে উঠলো। যেন সামনে অলৌকিক কিছু ঘটলো। ভয় আনন্দ কৌতুহল লাজুকতায় চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল,’কাজলদি।’ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পরল। পালকের মতো নিজেকে হালকা অনুভব করল।
‘তুমি আমায় চিনতে পেরেছো?’ এত ভিড়ের মধ্যে কাজলের মৃদু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল না সবুজ। হাসিমুখে তোতার কাঁধে হাত রেখে বলল,’এই সুন্দর রমণীটি আমার স্ত্রী।’ কাজল হেসে ফেললো। সঙ্গে তোতাও। পুরনো মানুষের সাথে অনেক দিনের পর দেখা হলে মানুষ সর্বপ্রথম কেমন আছে জিজ্ঞেস করে। নয়তো গতানুগতিক সৌন্দর্য বিনিময় করে। সবুজ প্রথমে নিজের স্ত্রীর পরিচয় দিচ্ছে। কাজল হাসতে হাসতে বলল,’তুমি এখনো বদলায়নি। এখনো সে-ই কিশোর সবুজ রয়েছো।’ কাজলের থেকে সবুজের দূরত্ব অনেকখানি। স্পষ্টভাবে সবকিছু শুনতে পেল না। সেখানে তোতাকে কিছুক্ষণ বসতে বলে বাইরে বেরিয়ে এলে। সবুজের এমন ব্যবহারে মোটেও মুগ্ধ করল না তোতা। এই সুন্দরী রমণীটি আমার স্ত্রী কথাটি শুনে যতটা খুশি হয়েছিল পরবর্তীতে সবুজের ব্যবহারে ঠিক ততটা দুঃখ পেলো। দুঃখ পাওয়ার সঠিক কারণ জানে না।
অনেক দিনের পর কাজল দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছে হাজারো কথা জমা আছে। বকবক করতে শুরু করলো। মাত্রাধিক কথা বলায় মুখের মধ্যে কিছুটা জড়োতা নেমে এলো। এরমধ্যে জানতে পারল তার বাড়ি ফিরে আসার কয়েক দিন পরে রায়বাবু পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। নীলা এখনো ফেরেনি। বৌদিমণির পুত্র সন্তান হয়েছে। বর্তমানে সে কিছুটা শান্ত। কাজল যথাযথ সবুজের প্রশ্নের উত্তর দিল। তারপর নিজে প্রশ্ন করল,’কেমন আছো তুমি?’ এত সময়ের পর হঠাৎ করে এমন প্রশ্নে একটু বিব্রত হল সবুজ।
‘দেখতেই পাচ্ছো তো কেমন আছি।’
‘বেশ আছো তাহলে! জানো সবুজ, আমি তোমার প্রতিটি বই পড়েছি। তোমার লেখা প্রতিটি লাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছি। নতুন কিছু খুঁজেছি। পেয়েছি। সারাদিন আমার পেছনে দৌঁড়ানো ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গেছে। ভাবতেই অবাক লাগে। তোমার যা জেদ ছিল তাতে আমি জানতাম তুমি একদিন উঁচু জায়গায় যাবে। তাই হয়েছে। আমি খুব খুশি সবুজ। আরও অনেক বড় জায়গায় যাও। আমার ভালোবাসা আর আশীর্বাদ তোমার সঙ্গে সবসময় রয়েছে।’ সবুজ চুপ করে মিটিমিটি হাসলো। কাজল আবার বলল,’তোমার কথা এখনো বাড়িতে সবাই বলে। সবাই বলে ছেলেটা মন্দ নয়। আজ কত বড় জায়গায় চলে গেছে তবুও তার মধ্যে কোনোরূপ অহংকার নেই। পুরো সাধারণ ঘরের ছেলে। বাবা যদি বেঁচে থাকতো তাহলে খুব খুশি হতো। তোমার সাফল্য দেখে যেতে পারল না। তুমি যখন বিয়ে করলে তখন আমাদের বাড়ির সকলেই জানতে পেরে খুশি হয়েছিল। ভাবছিলাম হয়তো আমরা আমন্ত্রিত হবো। আমরা সবাই আশাহত হয়েছিলাম কিন্তু কষ্ট পাইনি। কেউ রাগ করেনি তোমার উপর। আজও বাড়ির সকলে তোমায় খুব ভালোবাসে। স্ত্রীর সঙ্গে বেশ আছো তাই না?’
‘ভালোভাবে দিন কাটছে। তোতা খুব ভালো মেয়ে। আমাকে না হলে তার চলে না। সবসময় কাছে চাই। সেখানে যাবো সেখানে নিয়ে যেতে হবে। তা হলে কেঁদে ফেলবে। কত ছেলেমানুষি করে সে!’
‘তুমি তো সব কিছু জানো কাজলদি। আমি জেনেশুনে কখনো ভুল কাজ করতাম না। কিন্তু এখন দু-একটা ভুল কাজ করে ফেলি। ভুল কাজকে সমর্থন করি। ওর পছন্দের জিনিস গুলো আমার অপছন্দ হলেও ওর সহজ-সরল মুখের উপর না বলতে পারি না। তার খুশির জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। ও সত্যি সত্যিই অনেক ভালো মেয়ে। সহজ-সরল তবে খুব হিংসুটে।’
‘মেয়ে মানুষ তো হিংসুটেই হয়। ওরা কম ভালোবাসা সহ্য করতে পারে না। বাসতে হলে বেশি করে ভালোবাসো না হলে বাসার দরকার নেই।’
হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক দূরে চলে এসেছে। আর সামনে দিকে এগিয়ে গেল না। কাজল বলল,’তোমার আমাদের কথা মনে পড়তো?’ উত্তর না দিয়ে অনেকটা সময় চুপচাপ থাকতে দেখে কাজল হাসিমুখে বলল,’আমি মিথ্যা কথা বলি না। আর সত্যিটা জানলে তোমরা বিশ্বাস করবে না তাই আমি কিছু বলতে পারছি না,-এই কথা বলবে তো?’ নিজে বলে নিজেই হেসে উঠলো। সবুজও হাসলো। কাজলদি কত সুন্দর ভাবে তার মিষ্টি কথা গুলো মনে রেখেছে। এগুলো কেবল কাজলদির পক্ষেই সম্ভব। হাসি মাখা কন্ঠে বলল,’সত্যি কথা বলতে তোমাদের কথা আমার খুব মনে পড়ে। এখনো মনে পড়ে। গভীর রাতে কিংবা ভোরে, ব্যস্ত কিংবা অবসর যখন তখন তোমাদের কথা মনে পড়ে। চোখ দুটো ভিজে যায়। আমি ভুলে যাইনি তোমাদের। আজও তোমরা আমার খুব আপন। খুব ভালোবাসি তোমাদের।’
‘তাহলে যোগাযোগ রাখোনি কেন? তোমার জন্য তো আমাদের বাড়ির দরজা খোলা আছে। এসে ঘুরে যেতে পারতে।’
‘পিছুটান নিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে চাই না। আমি ওই চার বছরের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। ওই ক্ষণিকের মুহূর্তটা আমার কাছে অমরত্ব। ওটুকুই আমার জন্য অনেক। বেশি কিছু প্রয়োজন নেই।’
এতক্ষণে তোতা তাকে খুঁজতে খুঁজতে কাছে চলে এসেছে। সবুজ তোতার হাত ধরে হেসে বলল,’বলেছিলাম না তোতা আমাকে একমুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দেয় না আমাকে হারাতে চায় না। এক পলক দেখতে না পেয়ে দৌড়ে এসেছে।’ কাজল মাথা নেড়ে বলল,’তা দেখতেই পাচ্ছি। আজ আমাদের বাড়িতে থেকে যাও। বাড়ির সকলেই খুশি হবে। থেকে যাও না একটা দিন। সবাই তোমার অপেক্ষায় আছে।’ সবুজ রাজি হতে যাচ্ছিল তার আগেই তোতা বারন করে দিল। পরে কোনো দিন এসে থাকবে। এখন সম্ভব নয়। আরও দু-একটা কথা বলল। তবে প্রতিটা কথায় তোতা বুঝিয়ে দিল সে বিদায় নিতে চায়। তাই কাজল আর কথা বাড়ালো না। কাজলের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ব্যবহার করে সবুজকে সেখান থেকে নিয়ে চলে গেল। সবুজ বাধা দিল না। মনের অন্তঃকরণ ক্ষয়ে গেল। কাজল যে কষ্ট পেয়েছে তা বলার অপেক্ষায় থাকে না। কত কথা বাকি থেকে গেল। অনেক আশা করে কাজলদি এসেছিল। তাকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত হয়নি। আরও কয়েকটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে কথা বললে কি এমন হয়ে যেত? তার বইতে সামান্য অটোগ্রাফ দেওয়াও হলো না। তোতার এমন ব্যবহারের হতভম্ব হল সবুজ। সে ইচ্ছা করে করেছে। কিন্তু কেন এমন করলো? সবুজকে সন্দেহ করে, তাই! না, তোতা সবুজকে সন্দেহ করে না। সে নিজে মুখে বলেছে বলে শুধু নিশ্চিত হতে পারছে না। তার ব্যবহার দেখেও বুঝেছে তোতা তাকে সন্দেহ করে না। তবে এমন ব্যবহার কেন করল? সবুজকে হারানোর ভয়? সবুজের হাসিমাখা মুখটা স্তব্ধ হয়ে গেল। অনেককাল আগে একটা উপন্যাস পড়েছিল। সেখানে গল্পের নায়ক একটা পায়রা পুষে ছিল। রোজ তাকে খাবার দিতো। তার সাথে কথা বলতো। অনেক সময় কাটাতে। তারপর একদিন নায়ক বাড়িতে একটা বিড়াল নিয়ে আসে। তাকেও আদর-যত্ন করে বাড়িতে রাখে। দুজনকে খুব ভালোবাসতো। দুজনের সাথে কথা বলতো। একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখল বিড়ালটি পায়রাটিকে মেরে ফেলেছে। পায়রাটি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেদিন নায়ক কিছু বলতে পারেনি। নিশ্চুপ হয়ে যায়। পায়রাটি তার প্রিয় আবার বিড়ালটিও তার অপ্রিয় নয়। দুজনেই খুব কাছের। কাকে দোষ দেবে সে? বিড়ালটিকে কিছু বলেনি। শান্তভাবে গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। তবে মনে মনে বিড়ালের প্রতি তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সবুজেরও আজ তেমন কিছু হলো। আবার অটোগ্রাফ দিতে ব্যস্ত হয়ে পরলো সবুজ। কাজলকে আলাদাভাবে কিছুই দিতে পারল না। ভিড়ের মাঝখানে এসে দ্বিতীয়বারের অটোগ্রাফ নিয়ে গেল। সবুজের চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। বারবার ইচ্ছে করছিল তোতা যা করেছে তা ভুল কিন্তু তাকে বলতেই পারলো না। তাতে তোতা কষ্ট পাবে। সে তাকে কষ্ট দিতে চায় না। কাজলদির সাথে আর একটু কথা হলে মন শান্ত হয়ে যেত। আচ্ছা,সে কি বিয়ে করে নিয়েছে? তার কোলে নিশ্চয়ই সন্তান চলে এসেছে। সুখে শান্তিতে সংসার করছে। অথচ সে একদিন বলেছিল সে মা হতে চায় না। সংসার করতে চায় না। কারোর দায়িত্ব নিতে চায় না। কিন্তু সত্যি কি বিয়ে করেছে? তার সিঁথিতে সিঁদুর তো দেখতে পেল না। আজকাল কত মেয়ে তো সিঁদুর পরে না। কাজলদিও পরতে না পারে। নিজের ভাবনা কিছুতেই স্পষ্ট হলো না নিজের কাছে।
বাড়ি ফিরতে গভীর রাত হয়ে গেল। চারিদিকে শুনশান। রাস্তায় যানবাহন তো দূরের কথা কোনো মানুষই নেই। এত রাতে উবের কি পাওয়া যাবে? তেমন কোনো সুযোগ হল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটা ট্যাক্সির সাক্ষাৎ পেলো। যাকে পাওয়া গেল তার আবার অনেক শর্ত। সে এত রাতে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবে না। হাই রোডের শেষ সীমান্ত পর্যন্ত যাবে। তারপর গ্রামের রাস্তায় নিজেদেরকে একা যেতে হবে। রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। গ্রামের রাস্তায় না হয় হেঁটে চলে যাবে।
যথাসময়ে গ্রামের রাস্তার পৌঁছে গেল। অগত্য চার কিলোমিটারের রাস্তা হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। নির্জন রাতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। না, বন্য জন্তু-জানোয়ারে ভয় নেই। কিন্তু রাতে অসাধু মানুষ তো রয়েছে। অথচ সবুজের চোখে কোনোরকম ভয় ভ্রান্তি নেই। তোতার হাত শক্ত করে ধরে গল্প করতে করতে এগিয়ে গেল। গল্পের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাতে পারলো না সে। সবুজকে দেখে অবাক হলো। বিয়ের আগে সে একবার বাবার সাথে ভিড় বাসে উঠে ছিল। বাবার হাসিমাখা চোখ মুখ মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে যায়। মেয়েকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তা। কন্ডাক্টরকে বারবার বলছিল একটা সিটের ব্যবস্থা করে দিতে। মেয়ে মানুষ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? যখন তার সিটের ব্যবস্থা হয়ে গেল তখন মুহূর্তের মধ্যে বাবার মুখ থেকে অন্ধকার দূর হয়ে গেল। বাবা দাঁড়িয়ে রইল কিন্তু মনের মধ্যে আর কোনো দুশ্চিন্তা রইল না। বাবা তাহলে সন্তানের জন্য চিন্তা করছিল! কিন্তু না। তার আরও একমাস আগে তারা সপরিবারে মামার বাড়ি যাচ্ছিল। তখন বাসে মাত্র দুটো সিট পেয়েছিল। সেই সিটে তোতা আর মা বসেছিল। ভাই আর বাবা দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন কিন্তু বাবার মুখ তেমন একটা অন্ধকার হয়নি। দিব্যি দাঁড়িয়েছিল। ভাইও তো বাবার সন্তান। তাহলে ভাইয়ের জন্য কেন চিন্তা হচ্ছিল না? শুধুমাত্র সে ছেলে,তাই! অরিন্দম ছেলে তাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে আর তোতা মেয়ে তাই দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না! কিংবা তিরিশে আগস্টের কথা। হঠাৎ করে দুপুরে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। স্কুলের স্যারেরা ভেবেছিল ঝড় তাড়াতাড়ি থেমে যাবে। কিন্তু ছুটির পরও ঝড় থামেনি। তীব্র বেগে বাতাসের সাথে বৃষ্টি হতে থাকে। জোরে জোরে বাজ পড়ছিল। ক্রমশ সন্ধ্যা হয়ে আসছিল কিন্তু ঝড় কমার নামগন্ধ ছিল না। প্রধান শিক্ষক স্কুল ছুটি করার সাহস পাননি। ঝড়ের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না। চোখ মুখ কালো হয়ে যায়। বারবার তিনি বলছিলেন, এই ঝড়ের মধ্যে মেয়েরা কি করে বাড়ি ফিরবে? ঝড় তো কমার নাম ধরছে না। কিন্তু তোতা তো গার্লস স্কুলে পড়ে না। স্কুলে ছেলেরাও রয়েছে। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে খুব বেশি দুশ্চিন্তা করতে দেখা গিয়ে ছিল না। ঝড়কে তোয়াক্কা না করে কয়েকটা ছেলে যখন স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল তখন স্যারেরা তাদেরকে কিছু বলল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দুটো মেয়ে যখন ঝড়কে তোয়াক্কা না করে বেরোনোর চেষ্টা করল। তখন তাদেরকে চোখ রাঙিয়ে ডেকে এনেছিলেন। রুমের মধ্যে বসতে বলেছিলেন। ঝড় না কমা পর্যন্ত বেরোতে বারণ করছিলেন। ছেলেরা ঝড়কে অতিক্রম করে যেতে পারে,আর মেয়েরা পারে না? চোখের সামনে কিছু ঘটনা তোতাকে ভীতু করে রেখেছে। তার ধারণা, মেয়েরা অনেক কাজই পারে না। ট্যাক্সিতে বসে যখন ভেবেছিল এতটা নির্জন পথ হেঁটে হেঁটে যেতে হবে তখন ভয়ে বুকের রক্ত শুকিয়ে গেছিল। তার জন্য সবুজকে দুশ্চিন্তা করতে হবে। বিপদে পড়বে। সে যেন বিপদের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে বড় অসহায় লাগছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল সবুজ একটুও ভয় পায়নি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার সঙ্গে কোনো নারী রয়েছে। নারী থাকলে তো খুব দুশ্চিন্তা হওয়ার কথা। সবুজ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তার সঙ্গী কোনো পুরুষ মানুষ। কৌতুহলী তোতা নিজের কৌতুহল নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। বলল,’আপনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?’
‘দুশ্চিন্তা হবে কেন?’
‘আপনার পাশে একটা মেয়ে রয়েছে। নির্জন রাত! একাকী! দীর্ঘ পথ! আমায় নিয়ে আপনার ভয় হচ্ছে না?’
‘না তো, আমার মনে হচ্ছে না আমার ঘাড়ে কেউ চেপে রয়েছে। আমার পাশে আমার স্ত্রী, নিছক একটা মেয়ে রয়েছে, কোনো অবলা প্রাণী নেই যে দুশ্চিন্তা করব। আপনি কি নিজেকে অবলা ভাবেন?’ তোতা জবাব দিল না। মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। বাবা পৃথিবীতে অনেক আগে এসেছে। অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। স্কুলের শিক্ষকেরা অনেক বই পড়েছেন। অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। কিন্তু সবুজের এই ব্যবহারের কাছে তাঁরা কোথাও যেন ফিকে হয়ে গেল। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ পুরুষ মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন চারপাশ ঘুরে দেখে, তার সঙ্গে কে আছে? মানুষটি দেখতে চায় না -তার সাথে তার ছেলে না মেয়ে, স্ত্রী না বান্ধবী, বাবা না মা রয়েছে। সে দেখতে চায় তার সাথে পুরুষ না নারী রয়েছে। যদি পুরুষ থাকে তাহলে ভাবে তার সত্তর শতাংশ বিপদ কেটে গেছে। আর সঙ্গে যদি নারী থাকে তাহলে তো আর দুশ্চিন্তার অভাব হয় না। মাথায় যেন মোটা চাল বস্তা কেউ চাপিয়ে দেয়। সেটা নামাতে পারলেই শান্তি। পুরুষ মানুষ রাতে বাস মিস করার পর সঙ্গে পুরুষ সঙ্গী থাকলে ভাবে ঘুরেফিরে রাতটা ঠিক কাটিয়ে দেবে। কিন্তু সঙ্গে মেয়ে থাকলেই দুশ্চিন্তা করে। কিন্তু কেন? সে মেয়ে বলে! সে পারবে না,ঘুরেফিরে রাতটা ঠিক মতো কাটিয়ে দিতে? সে মেয়ে ঠিকই তবে দুশ্চিন্তার কারণ নয়। পুরুষকে যেমন নিছক পুরুষ ভাবা হয় তেমনই মেয়েকেও নিছক মেয়ে ভাবা উচিত। মেয়েকে অবলা ভাবলে হবে না।
ময়ূর খুব হাসতে পারে। কথা বলতে পারে না। তবে কয়েক দিন হল মুখে অস্পষ্ট ভাবে ‘বাবা’ শব্দটি উচ্চারণ করছে। সাধারণত শিশুরা ‘মা’ বলে কথা বলতে শেখে। আর ময়ূর ব্যতিক্রম। সে প্রথমে বাবা বলতে শিখেছে। তাতে লতার খুব অভিমান হয়েছে। সে কষ্ট পায়। আর এটা দেখে ময়ূর খুব হাসে। মাকে মুখ কালো করতে দেখলেই সে হেসে ওঠে। লতার রাগ আরও বেড়ে যায়। ছেলেকে রেখে দূরে সরে যায়। তখনই কেঁদে অস্থির হয়ে ওঠে ময়ূর। ঝামেলা সামলাতে হয় সূর্যময়কে। লতাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ছেলের কাছে নিয়ে আসে। ও ছোট। কিছু জানে না বোঝে না। যেটাতে আনন্দ পায় সেটাই করে। এর জন্য তার উপর রাগ করা ঠিক নয়। সে অবোধ নির্বোধ অসহায় শিশু। লতার মন ভালো হলে ছেলের কাছে ফিরে আসে। ছেলেকে কোলে নেয়। দুধ খাওয়ায়। ময়ূরের পেট আর মন ভরে গেলে আবার হাসতে শুরু করে। আর মার কাছে থাকতে চায় না। বাবার কাছে চলে যায়। তখন আর রাগ করে না লতা। দুপুরে বাবা-মা, ছেলে একইসঙ্গে খেতে বসেছিলো। মা আর ছেলের খাবারের ধৈর্য নেই। বারবার চঞ্চল হয়ে পড়ছে। সূর্যময় তাড়াতাড়ি খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। বিকেলে আবার কাজে যেতে হবে। দুপুরে একটু বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। একটুখানি চোখ বন্ধ হয়েছিল আর তখনই লতার জোরালো কন্ঠস্বর শোনা গেল। সে চিৎকার করে বলছে,’ছেলে গেছে। ওকে দেখো।’ তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে উঠে পরলো। বিছানা থেকে নামতে হলো না। হামাগুড়ি দিয়ে ময়ূর সেখানে পৌঁছে গেছে। পালঙ্কের পা ধরে ওঠার চেষ্টা করছে। সূর্যময় হাসিমুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল,’খোকা আসবে?’ লাফিয়ে উঠলো সে। হাসল। মুখে অস্পষ্ট ভাবে ‘বা’ ‘বা’ বলল। সকালে বাবা বলছিল এখন আর বলতে পারছে না। সূর্যময় ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে ময়ূর বাবার কোলে চলে এলো। তার মুখে কত হাসি। হাসি লেপ্টে রয়েছে। কিছুতেই কমছে না। সে তাড়াতাড়ি বাবার বুকের উপর উঠে পরল। তারপর তার মুখ নিয়ে বাবার মুখে দাড়িতে কপালে ঘষে দিল। বাবা আর ছেলে মিলে খুব হাসলো। কেউ থামাতে পারল না। দীর্ঘ সময় একই ঘটনা ঘটল। সমস্ত কাজ সেরে লতা শাড়িতে মুখ মুছতে মুছতে ঘরের মধ্যে এলো। হাতে কাজল রয়েছে। পালঙ্কে এসে বসলো। মাকে দেখতে পেয়ে ময়ূর খুব হাসলো। সূর্যময় লতার দিকে তাকিয়ে বলল,’দেখেছো লতা তোমার ছেলে খুব দুষ্টু হয়েছে। ঘুমোতে দিল না কিছুতেই।’
‘তুমি নিজেই ওকে দুষ্টু বানিয়েছো।’
‘আমি!’ লতা উত্তর না দিয়ে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল,’বাবু কাছে এসো। টিপ লাগিয়ে দিই। সোনা বাবু আমার।’ ময়ূর কিছুতে মার কাছে যাবে না। বাবাকে জাপ্টে ধরল। সূর্যময় হেসে উঠলো।
‘খোকা মার কাছে যাও। মা ডাকছে তো।’ ময়ূর মুখ তুলে হেসে ফেললো। মার কাছে গেল না। তবে দ্বিতীয়বার লতা ময়ূরের দিকে হাত বাড়াতে মায়ের কোলে চলে এলো। লতা কাপালে কাজল লাগিয়ে দিল। আর অবশিষ্ট যা হাতে রইল তার নিজের শাঁখাতে লাগালো। তারপর কাজলের ওপর পাউডার দিল। কাজল লাগানো শেষ হতেই ময়ূর আমার বাবার কাছে ফিরে এলো। বাবার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে নিজের মতো কি সব শব্দ করে গেল। ঘটনাটি লক্ষ করে লতা খুব মজা পেলো। একপাশে কাজল আর পাউডার রেখে তাদের পাশে শুয়ে পড়লো। সূর্যময় বলল,’এভাবে কাজল লাগাও কেন তোমরা?’
‘কাজল লাগালে ছেলের উপর কেউ নজর দেবে না।’
‘আমাকেও লাগিয়ে দাও। আমার উপরও তো কেউ নজর দিতে পারে।’
‘শখ কত! বুড়ো বয়সে শখ জেগেছে।’ মুখ পেঁচিয়ে বললো লতা।
‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি?’
‘তা নয়তো কি? চুল পেকে গেছে। আয়নায় মুখটা দেখো বুঝতে পারবে।’
‘চুল পেকে গেলে বুড়ো হয়ে যায় নাকি!’ লতা হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,’এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছ কেন? এমনি এমনি বলছি।’ লতা অনেকটা কাছে চলে এল।
‘আর কত কাছে আসবে? খোকা ঘুমিয়ে গেছে। উঠে পড়বে তো।’
‘হ্যাঁ, এখন তো সবকিছু খোকা। আমি কেউ না। আমি পরের ঘরের মেয়ে। যাও তুমি খোকাকে নিয়ে থাকো। আমি চললাম।’ অভিমানে লতা দূরে সরে গিয়ে মুখ বিপরীত দিকে ফিরিয়ে নিল। সূর্যময় ময়ূরকে একটু সরিয়ে লতার কাছে চলে এলো। তার কোমরের উপর হাত রেখে বলল,’তাকাও আমার দিকে।’ লতা কিছুতেই তাকালো না। সূর্যময় আবার একই কথা বলল। গ্রাহ্য করল না লতা।
‘তাকাবে না তো! ঠিক আছে। আমি কাজে চলে গেলাম।’ মুহুর্তের মধ্যে লতা মুখ ফিরিয়ে নিল। বুঝতে পেরেছিল সূর্যময় ছেলেকে সরিয়ে তার কাছে চলে এসেছে। কিন্তু এতটা যে কাছে চলে এসছে তা বুঝতে পারেনি। নাকের সঙ্গে নাকের সংঘর্ষ হয়ে গেল। বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মুখে হাসি ফুটে উঠল। চোখ দুটো ছল ছল করছে। সূর্যময় লতাকে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে নিল। ভারাট কন্ঠে বলল,’কি হয়েছে তোমার?’
‘তুমি আর আসো না কেন আমার কাছে? সবসময় খোকা খোকা আর খোকা। আমি পর হয়ে গেছি না!আমায় আর ভালোবাসো না!’
‘খুব ভালোবাসি তো।’ বলেই কপালে চুম্বন করল। লতা লাজুক কন্ঠে বলল,’এই বুঝি শুরু হল তোমার দুষ্টুমি।’ সূর্যময় হেসে ফেললো। লতা আবার বলল,’তুমি খুব চিন্তা করো না?’
‘না তো।’
‘তাহলে তোমার মাথায় চুল উঠে যাচ্ছে কেন?’
‘বয়স হচ্ছে তো তাই।’
‘কত আর বয়স হয়েছে? তুমি খুব চিন্তা করো তাই তোমার এমন অবস্থা হয়েছে।’ একটু থেমে বলল,’এত চিন্তা করো কেন? কিসের অভাব তোমার? টাকা পয়সা! ওগুলো বাদ দাও না। তোমার বাবা-মা রয়েছে আমি রয়েছি আমাদের ময়ূর আছে। আর কি চাই তোমার?’
‘আর সবুজ আর সংকেতকে।’ লতা হেসে বলল,’ওরাও তো সঙ্গে আছে। তাহলে চিন্তা কিসের?’
‘চিন্তা নেই তো।’
‘বেশি চিন্তা করো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে বলতো? আমি কাকে নিয়ে থাকবো?’
‘আমার কিছু হবে না। আমার কিছু হতে পারে না। তুমিও তো নিজের খেয়াল রাখো না। দেখেছো তোমার অবস্থা কী হয়েছে। কতদিন তুমি মাথায় শ্যাম্পু করনি? শাড়িও আজকাল ঠিকঠাক পরো না। যেমন তেমন ভাবে জড়িয়ে ফেলো। আগের মতো সাজুগুজু করো না।’
‘ছেলেকে সারাদিন সামলাতে হয়। নিজেকে আর কখন দেখবো?’
‘নিজেকে বেশি নয় একটু তো দেখো। নিজের জন্য কিছু ভাবো। শুধু সংসার সংসার করলে হবে না।’ বেশ নিস্তব্ধতা। কেউ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর সূর্যময় বলল,’সময় হয়ে গেছে। কাজে যেতে হবে। পান সাজিয়ে দাও।’
‘আসছি।’ লতা স্বামীর বন্ধন ছেড়ে উঠে গেল। পান সাজালো।
পর্ব ২১ আসছে।।