নিরুদ্দেশ
পর্ব ০৬
_________________
গত তিন বছর ধরে পশ্চিমবাংলার পশ্চিমের জেলা গুলোতে পর্যাপ্ত তুলনায় অনেক কম বৃষ্টি হয়ে আসছে। যার ফলে খরা সৃষ্টি হয়েছে। এবছর সে-ই খরা যেন মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। আষাঢ়ের মাঝামাঝি চলে আসার পরও বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা নেই। দুঃসহ গরমে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিঃশ্বাস ফেলার অবকাশ নেই। তীব্র জলের সংকট দেখা দিয়েছে। পানীয় জলের হাহাকার পড়েছে চতুর্দিকে। মানুষ বৃষ্টি চায়। আদিবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হচ্ছে। তিন বছর ধরে এখানে বৃষ্টি নেই। খরাপ্রবণ ঘোষণা করে মানুষকে সাহায্য করার জন্য কোনো চেষ্টা নেই সরকারের। এই স্থান যেন রাজ্যের বাইরে। পানীয় জলের অভাব সরকারকে ভাবিয়ে তুলেনি। অনুন্নত কুয়ো এবং অগভীর নলকূপ থেকে জল উঠা বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক গভীর নলকূপে আর্সেনিক ধরা পড়েছে। সাধারণ আদিবাসীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তারা অনেকবার জেলা এবং ব্লক দপ্তরে দরখাস্তের মাধ্যমে অভিযোগ জানিয়েছে। তাদের এমন করুণ অবস্থায় যেন দ্রুত হস্তগত করা হয়। অন্তত পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়। শিশু গর্ভবতী মহিলারা নানান রোগে খুব দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন। এই তো কয়েক মাস আগে মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য গ্রাম পরিদর্শন করে গেছেন। অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন। তারপর আর দেখা নেই। এখন শেষ ভরসা ঈশ্বর। ঈশ্বরের ভারসায় বসে আছে তারা। রায়বাবুর বাড়িতে দুটো কুয়ো রয়েছে। গ্রামের এমন পরিস্থিতিতে অর্চনা দুটো কুয়োই সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তাদের জলের অভাব অন্তর থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। তাতেই বাড়ির মধ্যে অনেক ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। সকাল থেকেই দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। মানুষদের মধ্যে হৈ-হুল্লোড় চলে। বাড়ির সদস্যরা অতিরিক্ত জল ব্যবহার করতে পারে না। সময় মতো জল পায় না। ফুরিয়ে যায়। সবাই কথা শোনাচ্ছে অর্চনাকে। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও নিজের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। সে মনে করে, সে কোনো অন্যায় কাজ করছে না। গ্রামের মানুষেরা সামান্য পানীয় জল পাচ্ছে না আর তারা অযথা অতিরিক্ত জল নষ্ট করবে -তা হয় না। বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা খুশি না হলেও রায়বাবু ভীষণ খুশি। তিনি জানতেন এই বাড়ির একমাত্র যোগ্য উত্তরাধিকারী তাঁর পুত্রবধূ। বলতে বলতে এক বছর হতে চলল অর্চনা এ বাড়ি সামলে আসছে। কত ধীর স্থির ভাবে সবকিছু বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজ করছে। পেছনে কাটি করা মানুষের অভাব নেই। সব সময় কেউ না কেউ লেগে রয়েছে। তাদেরকে সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে সবকিছু সামলে রেখেছে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। সমস্ত কিছুর উপরে সে সত্যকে সত্য রেখেছে। কোথাও মাথা নোয়ায়নি। তার মধ্যে কোনো খামখেয়ালি ভাব নেই। কাজ করার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেয়েছে সে।
সবুজের এত গরম সহ্য করার ক্ষমতা কখনও ছিল না। তাদের বাড়িতে যেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তিরিশ ডিগ্রি হতো এখানে গ্রীষ্মকালে প্রায় সময় চল্লিশ ডিগ্রীর উপরেই তাপমাত্রা থাকে। যা তার পক্ষে সহ্য করার সম্পূর্ণ অসম্ভব। খালি গায়ে বাড়ির উঠোনে উদাসীন ভাবে শূন্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখেমুখে অসংখ্য ভাবান্তর। এত গরমে ভালো লাগছে না। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। সেও চায় বৃষ্টি হোক। এ ভাবে তাকিয়ে থাকতেও বিরক্তবোধ করছে। তার উর্ধাঙ্গে নগ্ন শরীরে কারোর শীতল কোমল হাতের স্পর্শ মনকে আরও বিষাক্ত করে তুলল। এমন সময় আবার কে আসলো? ঘাড় ঘুরিয়ে কাজল দিদিকে দেখে মুখ থেকে আপনাআপনি হাসি বেরিয়ে আসলো। কাজল তার এই অবস্থা দেখে খুব হাসছে। মুখে হাত চেপে বেশ হাসলো। হাসির ছলে বলল,’এইভাবে বসে আছো কেন? খালি গায়ে থাকতে নেই। গায়ে জামা দাও। বাবা দেখতে পেলে বকুনি দেবেন।’
‘খুব গরম লাগছে তো।’
‘এমন গরমে অভ্যস্থ নও, তুমি?’
‘না।’
‘কি করবে বল তো! এবার একটু বেশি গরম পড়েছে। কয়দিন সহ্য করে নাও।’ একটা ঢোক গিলে আবার বলল,’বাইরে ঘুরতে যাবে?’
‘এই রোদে?’
‘সে-ই কখন থেকে মেঘ উঠে সূর্যের আলোকে শীতল করেছে। বাইরে তাকালে তো বোঝা যাচ্ছে। নিজে দেখো। তাছাড়া এখন তো বিকেল হয়ে গেছে। রোদের তেজ ততটা নেই।’
‘আচ্ছা আমি তৈরি হয়ে আসছি।’ সবুজ দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলো। মেঘের কথা শুনে মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। কতদিন হলো বৃষ্টি দেখেনি। বৃষ্টিতে ভেজেনি। এলাকাটা পান্ডববর্জিত হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি হলে আবার সবুজ হয়ে উঠবে। একজন প্রকৃতি প্রেমীর কাছে বৃষ্টি খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। সাধারণের মধ্যে অসাধারণ কিছু। নিজের ঘরে গিয়ে শরীরে জামা গলিয়ে একটা ভাবনায় ডুবে গেল। সে তো কখনো খালি গায়ে থাকে না। পূর্বে আরও অনেক গরম ছিল। আজ দুপুরে মেঘ করায় গরমের তীব্রতা একটু হলেও কম ছিল। অথচ আজ তাকে খালি গায়ে বসে থাকতে হলো। আর কেউ এসে কথা শোনালো। কথা শোনালো বলাটা ঠিক হবে কিনা জানা নেই তবে অভিযোগের আঙুল নিজের দিকে ছিল। সে কখনও খালি গায়ে থাকে না, নিজের বাড়িতে থাকাকালীনও ব্যাতিক্রম হয়নি অথচ এক বার থাকলো আর সেটা কারোর চোখে পড়ল। জীবনের ভুলও ঠিক তাই। জীবনে কোনো নির্দিষ্ট কাজে কখনও ভুল না করে একবার ভুল করলেও সেটা ভুল হিসেবে বিবেচিত হয়। আরও সতর্ক হয়ে চলতে হবে। মাথার ভাবনা গুলো উড়িয়ে আবার দ্রুত কাজলের কাছে ফিরে এলো। কাজল তাকে কাছে পেয়ে খুব খুশি। কাউকে না জানিয়ে দুজনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কিছুটা হাঁটার পর সবুজ একটা জিনিস খেয়াল করলো। সে কখনও কাজল দিদিকে বর্তমান যুগের পোশাক পরতে দেখেনি। এই পরিবারে এখনও মধ্যযুগের অনেক নিয়ম কানুন চললেও অনেক আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। সকলেই মোটামুটি ভাবে আধুনিক ভাবে জীবনযাপন করে। আধুনিক পোশাক-আশাক পরিধান করে। কিন্তু এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম কাজল। তাকে শাড়ি ছাড়া কখনো অন্য পোশাকে দেখা যায়নি। আবার রঙিন কালারফুল আধুনিক শাড়ি নয়। একদম মধ্যযুগের সাদামাটা শাড়ি। এই অভ্যাস সবুজের খুব পছন্দ। শাড়ি পরলে এমনিতেই মেয়েদের সুন্দর দেখায়। কাজলকে একটু বেশিই সুন্দর দেখায়। সে নির্লিপ্তি চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘বারন তো করিনি।’ কাজলের কথার ধাঁচ দেখে হেসে ফেলল সবুজ। বলল,’তুমি সবসময় শাড়ি পরো কেন? সবসময় শাড়ি তো বাড়ির বউয়েরা পরে,তাই না! কখনো সালোয়ার-কামিজ কিংবা অন্য কোনো পোশাকে দেখিনি তোমায়। তোমাদের বাড়ির কাউকে তো আর এমন দেখলাম না। তুমি সে-ই মধ্যযুগের মেয়েদের মতো থেকে গেছো।’
‘আমার আঠারো-উনিশ দশকের মেয়েদের খুব পছন্দ। ওদের ব্যক্তিত্বও আমার ভালো লাগে। আমার মনে হয় মধ্যযুগের অনেক কিছু মন্দ দিক থাকলেও সমাজের দিকটা অনেক আকর্ষণীয় ছিল। তখনকার সমাজের গ্রাম্য পরিবেশ ভালো ছিল। বাঙালিদের ঐতিহ্য বজায় ছিল। এখন আধুনিক যুগে তা লুপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমি মধ্যযুগের নারী থেকে গেছি। তাদের ধাঁচে আমি বড়ো হতে চাই। তাদের আমার ভালো লাগে।’
‘কেন,আধুনিক যুগের নারীদের তোমার পছন্দ না?’
‘পছন্দ নয় এমনটা নয়। আসলে, রঙিন সমাজ আর রঙিন মানুষ আমার খুব বেশি ভালো লাগে না। সাদা-কালোই আমার পছন্দ।’
‘জানি না বিশ্বাস করবে কিনা..’ সবুজের মুখের কথা তাড়াতাড়ি কেড়ে নিয়ে কাজল বলল,’বিশ্বাস না করে তো উপায় নেই। তুমি তো আবার মিথ্যা কথা বল না।’ বলেই ফিক করে হেসে ফেললো। শাড়ি পেঁচিয়ে কোমরের বিঁধল। তার কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বলল,’বলো,কি বলতে চাইছিলে?’
কথা বলার মূহুর্ত হারিয়ে যাওয়ায় পূর্বের কথার প্রতি কৌতুহল দ্রুত হারিয়ে ফেলল। একটু সময় নিয়ে বলল,’আসলে আমিও খানিকটা তোমার মতো। আমারও রঙিন জীবন ভালো লাগে না। আমারও মধ্যযুগের সাদা-কালো জীবন যাপন প্রিয়। আর আমার পরিবার পুরো ব্যতিক্রম। তাঁরা রঙিন জীবনযাপন ছাড়া কিছু বোঝে না। ওখানে আমি সুখ খুঁজে পাই কিন্তু শান্তি পাই না। নিজের বাড়িতে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।’
‘সব বুঝলাম,তা বলে তোমার বাড়ি ছাড়া একদম উচিত হয়নি।’
‘ঠিক করেছি কিনা জানি না। তবে ভুল করিনি।’
‘আমি ঠিক ভুলের কথা বলছি না। কিন্তু কি জানো, মানুষ যখন কোনো কিছুর পেছনে দৌড়ায় এবং নিজের শেষটুকু দিয়ে সে-ই পাওনা পূর্ণ করে। তখন সে-ই পূর্ণতাকে হারাতে চায় না। যেকোনো মূল্যে তাকে ধরে রাখতে চায়। আমি যতটুকু জেনেছি তুমি উঁচু বংশের ছেলে। তোমার বাবা নিশ্চয়ই চাইবেন না তোমার জন্য তোমাদের পরিবারের সম্মানহানি হোক। তোমাদের গৌরব মলিন হয়ে যাক। তোমার হারিয়ে যাওয়া খবর ইতিমধ্যে সকলে জেনে গেছে। নিশ্চয়ই অনেকে তোমাদের পরিবারের দিকে আঙুল তুলেছে। অবশ্যই অনেকে বলছে, তোমার বাবা-মা তোমায় মানুষ করতে পারেনি। তাঁরা সাকসেসফুল মানুষ ঠিকই তবে সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। এসব কথা তোমার বাবার আত্মসম্মান নষ্ট করেছে। এর ফলে তিনি তোমার বিরুদ্ধে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পিছুপা হবেন না।’ সবুজ কোনো জবাব দিল না। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। কাজল আবার বলল,’তোমার হয়তো এসব কথা শুনতে খারাপ লাগছে। কিন্তু বাস্তব এমন। তুমি নিজে যখন কঠোর পরিশ্রম করে কিছু পাবে সেটাকে হারাতে চাইবে না।’ সবুজের এইসব কথা একদমই ভালো লাগছে না -তার মুখের আকৃতি দেখে তা বোঝা যাচ্ছে। কাজল এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলল না। প্রসঙ্গ পাল্টালো। আর তাতে আগ্রহ প্রকাশ করল সবুজ। বেশ গরম ভাব রয়েছে। চতুর্দিকে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। বৃষ্টি হবে। তবে বিশ্বাস নেই। এর আগেও অনেকবার এমন মেঘের সঞ্চার ঘটেছে। কিন্তু ঝড়ো বাতাস ছাড়া বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটাও দেখা যায়নি। আশেপাশে গাছের পাতায় ধুলো চিপকে বসে রয়েছে। পাতাগুলো প্রকৃত বর্ণ হারিয়ে ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। বহু গাছ ন্যাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো পাতা ঝলসে রয়েছে। আশেপাশের মাঠে বড় বড় ফাটল ধরেছে। এখানকার মানুষ গুলো কিভাবে বেঁচে আছে তা সহজে বর্ণনা করা সম্ভব না। যুদ্ধাস্ত্র নেই অথচ যুদ্ধ করতে হবে। এবং সে-ই যুদ্ধে জিততেও হবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। একটা দমকা শীতল হাওয়ার পর গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়লো। যে বৃষ্টির উপস্থিতি টের করতে পারা গেল না। তারপর কালবৈশাখী ঝড়ের মতো বিশাল ঝড় উঠলো। বিদ্যুতের বারবার ঝলকানির সাথে সাথে মেঘ বীভৎসভাবে গর্জন করল। সবুজ ফিরে যেতে চাইলেও কাজল রাজি হলো না। এখানকার জলবায়ু সম্পর্কে অবগত সে। এই মেঘে বৃষ্টি হবে না নিশ্চিত। প্রচন্ড বাতাস বইল। গরম পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। হালকা শীত লাগলো। কাজলের চুলগুলো স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ালো। ঠোঁটে কোণায় হাসি ফুটে উঠেছে। পরনে নীল শাড়ি কোনো বাধা মানছে না। সমস্ত বাধা পেরিয়ে উড়ছে। বারবার শাড়ি আর চুল ঠিক করার চেষ্টা করছে কিন্তু বাতাসের গতি এতটা যে তা জুগিয়ে উঠতে পারছে না। সে সেদিকে বেশি মনোযোগীও হলো না। বাতাসের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। চোখেমুখে অদ্ভুত ধরনের খুশি লক্ষ করা গেল। সে আনন্দে কিশোরী হয়ে উঠেছে। পত্রপুষ্পে সজ্জিত থাকা নবকুসুম যৌবন উথলে পড়লো। ভুলে গেল সব কিছু। সবুজ কখনও কাজলকে এত খুশি দেখেনি। সে তো এত দিন নিজেকে পাগল প্রকৃতিপ্রেমী ভেবে এসেছে। কিন্তু তার চাইতে আরও বেশি পাগল প্রকৃতিপ্রেমি তো কাজল। আজ এমন মুহূর্ত তৈরি না হলে কখনও জানতে পারতো না কাজল আসলে কতটা প্রকৃতিপ্রেমী। কতটা ভালোবাসে বৃষ্টিকে! তার কাছে সব পরিস্কার হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলো কাজল কেন নিজের বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না! কেন কারোর প্রতি কোনো মায়া নেই? কেন সব সময় উদাস হয়ে থাকে? সে যে প্রকৃতিকে ভীষণ রকমের ভালোবাসে। প্রকৃতির জন্য সে নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিতে সক্ষম। এখন কাজলকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। তবে কাজলের ভাবনা সঠিক হল না। অল্প সময়ের মধ্যে ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি এলো। নিরাপদ আশ্রয়ে আশ্রয় নিতে চাইল সবুজ। কিন্তু কাজল নিজে গেল না তাকেও জেতে দিল না। দুজনে বৃষ্টিতে ভিজলো। সারা শরীর ভিজে যাওয়ায় কাজল চুলের খোপা খুলে দিল। মাথা নাড়িয়ে চুলগুলো ঘোরালো। চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ল। নিজেকে প্রেমিকা মনে করলো। দয়ালু মায়াবী প্রেমিকা। কিন্তু কার প্রেমিকা সে? প্রকৃতির প্রেমিকা না কোনো অজানা কিশোরের প্রেমিকা? সে দয়ালু প্রেমিকা। এত খুশি ধরে রাখতে পারল না। খুশিতে চোখ থেকে জল ঝরে পড়লো। নিজের মতো করে বাঁচার স্বপ্ন পেলো। এই দেশে খাতা-কলমে স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে উঠতে-বসতে আমারা পরাধীন। কারোর নিয়ন্ত্রণে আমাদের নিয়ন্ত্রিত হতে হয়। খুব কম মানুষই পারে নিজের মত করে বাঁচতে। এই বৃষ্টি তাকে নতুন করে জীবন দান করেছে। সবকিছু ভালো লাগছে। উদাস চোখে এক সময়ে সবুজকে খেয়াল করলো। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। বৃষ্টি উপভোগ করছে। কিন্তু তার মত খুব চঞ্চলা হয়ে পড়েনি। হঠাৎ করে তার শরৎচন্দ্রের একটা লাইন মনে পড়লো। শুধু শরৎচন্দ্র নয় অনেক লেখকের উপন্যাসে পড়ছে, নারীর রুপে বারবার পুরুষেরা মহিত হয়। কোনো পুরুষের সাধ্য নেই নারীর রূপের মায়া থেকে বেরিয়ে আসা। পুরুষের ক্ষমতা নেই এমন রূপকে পরিহাস করার। সে যে কয়েকটা মিনিটের জন্য হারিয়ে ফেলেছিল নিজেকে। নিজের উল্লাস নিজেকে কোন কুঞ্জবনে নিয়ে গেছিল নিজেও জানে না। ওই মুহুর্তে কি সবুজ মুগ্ধ হয়নি তার রূপে? নারীরাও তো চায় তার রূপে মুগ্ধ হোক পুরুষ। হঠাৎ করে নিজেকে ছোট মনে করলা। কত নিচু মানসিকতা তার। সবুজ তাকে দিদি বলে ডাকে। আর সে তাকেই তার রূপে মুগ্ধ করতে চাইছে। রূপে মুগ্ধ করা কি অন্যায়? তেমন তো অন্যায় দেখতে পাচ্ছে না কাজল। রুপ বলতে তো শুধু যৌবন বোঝায় না। কাজল সবুজের পাশে এসে দাঁড়াল। বৃষ্টির রেস বেশিক্ষণ বজায় রইল না। অল্পক্ষণ বর্ষা হয়ে থেমে গেল। যদিও আকাশ পরিষ্কার হলো না। মেঘে এখনও গাম্ভীর্য রয়েছে।
‘চলো, এবার বাড়ি ফেরা যাক।’ সবুজ ঘাড় ঘুরিয়ে কাজলদিকে দেখল। ভেজা অবস্থায় খোলা চুলে তাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। বাতাস স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় শাড়ি চুল কোনোটাই স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারছে না। শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। স্থির জড়বস্তুর মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। কি মৃন্ময়ী তার রূপ! সারা শরীর জুড়ে লাবণ্য ঝরে পড়ছে। সবুজ মৃদু হাসলো। তারপর দুইজন বাড়ির পথে হাঁটল। রাস্তা তেমন একটা কাদা হয়নি। লাল মাটিতে জল বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মাটি থেকে হালকা গরম উত্তাপ বেরোচ্ছে। শুষ্ক মাটি ভিজে গিয়ে হালকা নরম হয়েছে। এই সামান্য বৃষ্টি তেমন প্রভাব ফেলতে না পারলেও পরিবেশকে সুস্থ করেছে। গাছের পাতা থেকে ধুলা উড়ে গিয়ে সবুজ রং ধারণ করেছে। অনেকদিন পর বৃষ্টি হওয়া গাছগুলো সতেজ হয়ে উঠেছে। আকাশে বেশ কয়েকটা পাখিকে উড়তে দেখা গেল। তারাও বৃষ্টি পেয়ে আমোদে মেতে উঠেছে।অসংখ্য ছোট ছোট পোকা মাটি থেকে বেরিয়ে এসে দলবদ্ধভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের নিত্য যেকোনো প্রাকৃতি প্রেমিকে মুগ্ধ করবে। সবুজ মুগ্ধচোখে পরিবেশের লীলা দেখছিল। তার এই ভাবান্তরের ব্যাঘাত ঘটানো কাজল। সে এখনও বৃষ্টির সে-ই সামান্য মুহূর্ত ভুলতে পারেনি। এখনও সে কোনো এক অজানা কিশোরের প্রেমিকা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পারেনি। মিষ্টি কন্ঠে বলল,’সবুজ, তুমি কখনও কোনো নারীর রূপে মোহিত হয়েছো?’ এমন প্রশ্ন শুনে চমকে উঠল সবুজ। কাজলদি তো এমন কথা কখনও বলে না। আজ তার কি হলো?’
‘হঠাৎ! এমন প্রশ্ন?’
‘এমনি এমনি জানতে ইচ্ছে করলো।’
‘না।’
‘না! কেন? কত কবি বলে গেছেন নারী রূপে পুরুষরা বারবার মোহিত হয়। তাহলে কি তাঁরা মিথ্যা বলেছেন?’
‘কথাটা সমস্ত পুরুষের ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য নয়। নারী হোক বা পুরুষ কেউ একবার কারোর ব্যক্তিত্বে মোহিত হয়ে দেখুক। সে কোনো দিন আর সেখান থেকে বের হতে পারবে না। সে আর কোনোদিন তাকে তার থেকে মুক্ত করতে চাইবে না। সব কিছুর বিনিময়ে তাকে আগলে রাখবে। মৃত্যুকে অবজ্ঞা করতে দ্বিধা করবে না।’
‘তুমি বুঝি কারোর ব্যক্তিত্বে প্রেমে পড়েছিলে?’
‘না না, ব্যক্তিত্বে প্রেমে পড়া কিংবা ব্যক্তিত্বে মোহিত হওয়া অত সহজ নয়। সহজে তুমি ব্যক্তিত্বে প্রেমে পড়বে না। অসম্ভব!’ সবুজ খেয়াল করে দেখল কাজলদির মুখে সুন্দর একটা হাসি ফুটে উঠেছে। সে তার কথায় তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সবুজ নিজে খুশি হতে পারল না। কোথাও খটকা লাগলো। বড় বড় অনেক কথা বলে দিল কিন্তু সে-ই কথাগুলো নিজের ক্ষেত্রে কতটুকু গ্রহনযোগ্য তা বুঝে উঠতে পারল না। সাথীর প্রতি তার ভালোবাসাটা কি ব্যক্তিত্ব না রূপ? ব্যক্তিত্বটাই হবে, কিন্তু ব্যক্তিত্বে তো সহজে প্রেমে পড়া যায় না। তাহলে রূপ হবে! কিন্তু সে তো কারোর রূপে মোহিত হতে চায় না। কিন্তু সাথীকে দেখলেই হৃদয় উথালপাথাল করে উঠে। তাকে বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। ওই কিশোরীর দুষ্টু হাসি, চালচলনের ভঙ্গি, তার দুষ্টুমি, তার আবদার বারবার তাকে মুগ্ধ করে। সঠিক বুঝতে পারল না, সে তার ব্যক্তিত্বে প্রেমে পড়েছে না রূপের?
বাড়ির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছতেই নিজের ভাবনা গুলো ঝেড়ে ফেললো। কাজল মুখ গোমরা করে রেখেছে। বৃষ্টি আর হলো না। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। পশ্চিম আকাশে হালকা ঘোলাটে রোদ বেরিয়েছে। রোদের আভা তাদের চোখে মুখে পড়েছে। চকচক করছে মুখমণ্ডল। সবুজ একটু অবাক করে কাজলদিকে প্রশ্ন করল।
‘তুমি এত উদাসীন কেন?’
‘উদাসীন! আমি! কোথায়? কী দেখে তোমার মনে হচ্ছে আমি উদাসীন?’ কাজল এমন ভাবে উত্তর দিলো যেন মনে হলো সে উদাসীন শব্দটির সঙ্গে অপরিচিত।
‘আমি অনেকবার খেয়াল করেছি তুমি সবকিছুতেই উদাসীন। আমার এই ব্যাপারে কথা বলা সঠিক কিনা জানি না তবুও বলছি। এই বাড়ির যদি কেউ যোগ্য উত্তরাধিকারী থেকে থাকে তাহলে তুমি। হ্যাঁ তুমিই! তবে রায়বাবু তোমাকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করলো কেন তা আমি বলতে পারব না। অবশ্য বৌদিমণি খারাপ নয়। সে যেভাবে সবকিছু সামলে নিয়েছে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়।’
‘আমার বাবার কোনো দোষ নেই। তিনি আগে থেকেই আমাকে সবকিছু বলেছিলেন। কিন্তু আমি দায়িত্ব নিতে চাইনি। দায়িত্ব নেওয়া অত সহজ নয়। আমার কাছে দায়িত্ব শব্দটার মানে লোভ নয়।’
‘দায়িত্ব শব্দটার মানে কোনোদিন লোভ ছিলও না।’
‘ছিল না ঠিকই। তবে মানুষ এখন দায়িত্ব শব্দের অর্থকে লোভ বানিয়ে ফেলেছে। দেখো না, আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতারা দায়িত্ব নিতে চায়। তারা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য হিংসা ছড়িয়ে দেয় মারামারি করে খুন করতেও পিছুপা হয় না।কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তো এত কিছুর প্রয়োজন হয় না। দায়িত্ব নিতে গেলে সৎ হতে হয়। আসলে বেশিরভাগ মানুষ দায়িত্বের জন্যে দৌড়ায় না, -দৌড়ায় লোভের জন্য। দায়িত্ব শব্দটা আসলে ভালবাসার উপর নির্ভরশীল। কাউকে ভালোবাসতে হলে আগে যেমন নিজেকে ভালোবাসতে হবে, দায়িত্বও ঠিক তেমন। কারোর দায়িত্ব নিতে গেলে আগে নিজের দায়িত্ব নিতে হবে। নিজের মন আর শরীরের দায়িত্ব নিতে হবে। আমি নিজের দায়িত্ব নিতে পারি না,অন্যের দায়িত্ব কি করে নেব? আসলে যারা দায়িত্বের অর্থ কে লোভ বানিয়ে ফেলেছে তারা প্রত্যেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ।’
‘তাহলে তুমি কি চাও?’
‘একটা ছোট্ট গ্রাম্য বাড়ি আর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। মশারী আর বিছানা থাকবে। পাশে অনেক বই থাকবে। বাড়ির সামনে তুলসী মন্দির। আর শূন্য একটা আকাশ একটা পাহাড় আর একটা সমুদ্র। আর কিছু না।’
বাড়ির একেবারে সামনে পৌঁছতে কাজল কথা থামিয়ে দিল। এ-দিক ও-দিক তাকিয়ে দেখল আশেপাশে কেউ আছে কিনা! কপাল চাপড়ালো। সে একটা সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে। এ বাড়ির মেয়েরা অনুমতি ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারে না। সে অনুমতি ছাড়া বেরিয়েছে আবার বৃষ্টিতে ভিজে ফিরেছে। অনেক কৈফত দিতে হবে। কথা ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে তা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে সবুজ রয়েছে। তাকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলানো যাবে না। বৃষ্টি হয়েছে বাড়ির সকলে নিশ্চয়ই বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। পিছনের দরজা দিয়ে প্রবেশের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। যা হওয়ার তাই হবে। সোজাসুজি সামনে দিয়ে প্রবেশ করল। বাড়ির উঠোনে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিলেন বর্ণালী দেবী। কাজল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল বাবা রয়েছে কিনা! নেই। তিনি অসুস্থ তাই ভেতরে রয়েছেন।
‘ইস, এভাবে ভিজেছিস কেন?’
‘ইচ্ছে করলো, তাই।’
‘এটা কোনো ইচ্ছে হলো?’ কাজল মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে উল্টে সবুজকে বলল,’তুমি ভেতরে চলে যাও। পোশাক বদলাও না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে।’ সবুজ কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। যাওয়া কি উচিত হবে? না, সে গেল না। দাঁড়িয়ে রইলো। ভুল সেও করেছে। কাউকে না জানিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। কাউকে না জানিয়ে বাইরে বেরোনোর অধিকার যদিও তার রয়েছে তবে এই ঝড়ের মধ্যে কাউকে না জানিয়ে যাওয়াটা অন্যায়। কাজল আবার বলল, ‘যাও।’ বড্ড জটিল ঝামেলায় পড়ল সে। একদিকে মনে হচ্ছে সে ভুল করেছে আবার অন্যদিকে মনে হচ্ছে তাদের পারিবারিক সমস্যার মধ্যে না থাকাই উচিত। শুধুমাত্র বৌদিমণির উত্তরের অপেক্ষায় রইল। সে অনুমতি দিলে আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তার অনুমতির আগেই বর্ণালী দেবী বললেন,’তুমি ভেতরে গিয়ে পোশাক বদলাও।’ সবুজ মাথা নাড়ালো। তিনি বয়স্ক মানুষ। তিনি যখন অনুমতি দিয়েছেন তাহলে অসুবিধা কোথায়? সে নির্বিধায় ভেতরে চলে গেল। বর্ণালী দেবী এবার মেয়েকে কড়া স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,’কাউকে কিছু জানানোর দরকার হলো না? একা একা বেরিয়ে গেলে। আমাদের বাড়ির নিয়মকানুন জানো না!লোকে কি বলবে? এত বড় একটা মেয়ে বৃষ্টিতে ধেই ধেই করে নেচে বেড়িয়েছে?’
‘মা ছেড়ে দাও না। সামান্য বৃষ্টিতে ভিজেছে। অন্যায় তো কিছু করেনি। তুমি এমন ভাবে শাসন করছো মনে হচ্ছে সে বড় কিছু ভুল করেছে।ও বড়ো হয়েছে ওকে নিজের মতো থাকতে দাও।’
‘দেখো বৌমা, তুমি সমস্ত কথায় নাক গলাবে না। বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব পেয়ে গেছো মানে ভাববে না আমিও তোমার কথা শুনে চলবো। এখনও আমরা বেঁচে আছি। আর আমরা বয়সে বড়। ওর বয়স অল্প নয়। বাইশে পা দিয়েছে আর এই বয়সে খোলামেলাভাবে বৃষ্টিতে ভেজা স্বাভাবিক নয়।’
‘আমি তো কোনো ভুল দেখতে পাচ্ছি না।মানুষ যত বড় হোক না কেন তার মধ্যে শিশু স্বভাবটা থেকে যায় আজীবন। দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় যদি বৃষ্টিতে সামান্য ভিজে থাকে তাহলে অসুবিধা কোথায়?’
‘ভিজুক তাতে আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা অন্যায়। ইচ্ছে করে চুল ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজাটা অন্যায়। আমার সব সন্তানদের কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি। এর মতো কেউ উচ্ছন্নে যায়নি। সবাই কথা শুনে চলে। কিন্তু কাজল কখনও শুনে না।’
‘ছেলেমেয়েদের যদি সত্যি মানুষের মতো মানুষ করেছেন তাহলে তোমার ছেলে রোজ রাতে জুয়া খেলতে যায় কেন?’ এবার তিনি মোক্ষম জবাব পেয়েছেন। মুখের উপর এত বড় কথা সহ্য করতে পারলেন না। চুপ হয়ে গেলেন। অন্ধকারে ছেয়ে গেল মুখশ্রী। হেসে ফেললো কাজল। এই ফাঁকে চুপিচুপি কেটে পড়লো। সবার আড়াল হতেই খুব হাসলো। কি নিয়ে সমস্যা শুরু হলো আর কোথায় শেষ হবে সেটা ভেবেই আবার একবার হাসলো। তবে মনে মনে বউদিমণির উপর খুব খুশি হলো। তার হয়ে কথা বলেছে বলে নয়, স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়নি -এই জন্য। সে-ই মধ্যযুগের কু-ভাবনা-চিন্তা যে তার মধ্যে নেই এটাই অনেক।
পোশাক বদলানোর পর ঘরের মধ্যে থাকতে আর ভালো লাগলো না সবুজের। বারান্দায় সকলে বসে গল্প করছে। সেখানে গিয়েও কাজ নেই। তারা সবাই নিজেদের পরিবার নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু সে কি নিয়ে কথা বলবে? বেশি হট্টগোলও তার অপছন্দ। সে সাথীর ঘরের দিকে গেল। ঠান্ডাতে বেশ জমিয়ে ঘুমোচ্ছে। তাকে ডেকে বিরক্ত করল না। সেখান থেকে ফিরে এসে সোজা কাজলের ঘরে গেল। বৃষ্টিতে ভিজেছে নিশ্চয়ই এখন আর সবার সাথে গল্প করতে চাইবে না। ঘরে থাকার কথা। আশাহত হলো না। হালকা অন্ধকার নেমেছে। বিকেলের সূর্য পশ্চিমে জানালা দিয়ে ঘরটিকে প্রখর ভাবে আলোকিত করে রেখেছে। বাইরে থেকে ডাকলো।
‘কাজলদি, কাজলদি,ও কাজলদি ভেতরে আসবো?’
‘এসো এসো। অনুমতি নেওয়ার কি আছে?’ সবুজ হালকা হেসে ভেতরে গেল। কাজল বৃষ্টিতে ভেজার পর আবার একবার স্নান করে বেশ সেজেছে। রায়বাবুর জন্মদিনে কালো রঙের যে শাড়িটা পরে ছিল ওই শাড়িটা আজ আবার পরেছে। তাকে নতুন শাড়ি পরেতে দেখে অবাক হল। সে বিছানার উপর উঠে বসল। তার দিকে তাকিয়ে বলল,’এত সেজেছো কেন?’
‘এমনি সেজেছি, ইচ্ছে করলো তাই।’ কাজল ইশারা করে সবুজকে পশ্চিমাকাশ দেখতে বলল।পশ্চিমে জানালা থেকে পশ্চিমাকাশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে। রক্তের মত লাল হয়ে গেছে। আকাশ যেন আজ বৈরাগীর পোশাক ধারণ করেছে। গোধূলি লগ্নে এমন দৃশ্য সত্যি মুগ্ধকর। প্রাণভরে সৌন্দর্য অনুভব করলো। হাসি কৌতুকে কাটিয়ে ফেললো আরও অনেকগুলো মিনিট। সবুজ ঝিমাতে লাগলো। তীব্র গরমে বেশ কয়েকদিন ঠিকমতো ঘুম হয়নি। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টিতে চোখে রাজ্যের ঘুম এসে চেপে বসেছে। মাথা কাজলের কোলে রেখে শুয়ে পড়ল তারপর পা মেলে ধরল। কাজল আশ্চর্য হল তবে তাকে তুলে দিলো না। তার মুখের দিকে তাকালো। নবীন ছোট নরম মুখখানা…। কত শান্ত! পবিত্র! তারও ভালো লাগলো। তার চোখ দুটো ভীষণ লাল হয়ে গেছে। ভয় করলো। তার জন্য সে বৃষ্টিতে ভিজেছে। জ্বর করবে না তো আবার! আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল,’ঘুম পাচ্ছে?’
‘হ্যাঁ।’ অকারনে কাজলের হাসি পেল। কেন হাসি পাচ্ছে বুঝতে পারলো না। আবার সবুজের দিকে তাকালো। বলল,’নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। কেউ বিরক্ত করবে না।’ সবুজের কাছ থেকে কোনো জবাব আসলো না। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে ঘুমিয়ে পড়েছে। মানুষ এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে পারে সে কখনও কল্পনা করতে পারেনি। ঘুমন্ত অবস্থায় কিশোরকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। দ্বিধা সংকোচ হিংসা মনের মধ্যে নেই। পবিত্রতায় ভরা। তার ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই সে মাথায় হাত বুলানো বন্ধ করল না। গায়ে চাদর দিয়ে দিল। দিদির কোল পেয়ে গভীর ঘুমিয়ে জড়িয়ে পড়লো দ্রুত।সে অনুমান করলো, সবুজ ছোটবেলা থেকে আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। মায়ের স্নেহ ভালোবাসা পায়নি। তাই তার মধ্যে একা থাকার প্রবণতা খুব বেশি। বড্ড একঘেঁয়ে হয়ে উঠেছে।আর এই বাড়িতে এসে সে আদর-যত্ন ভালোবাসা সব কিছু পেয়েছে। তাই এই বাড়ি ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।হয়তো রক্তের সম্পর্ক নেই তবুও এই বাড়ির কেউই তাকে হীন চোখে দেখে না। সকলেই তার গুণের কারণে ভালোবাসে। বড্ড ভালোবাসে। সামান্য আদুরে কোল পেতেই সে খুশি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাজল হাসলো। নিজের মতো করে একটা মানুষ পেয়েছে। নিজের সাথে কত মিল। ভালো লাগলো। মুগ্ধ হল।তবে বেশিক্ষন সেখানে থাকতে পারল না। বারান্দায় সবাই বসে গল্প করছে। সেখানে যেতে ইচ্ছা করলো। আবার সবুজকে ডেকে তুলতে ইচ্ছে করলো না। ঘুমিয়ে থাকুক তার ঘরে। বিরক্ত করে লাভ নেই। মাথার বালিশ গুঁজে দিয়ে সবার কাছে ফিরে এল।
কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো মনে নেই। তবে অনেকক্ষণ। ঘুম ভাঙার পর দেখল চারিদিকে অন্ধকার। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘুমের পূর্বের মুহূর্ত মনে পরল। সবটা মনে পড়তে একা একা হেসে ফেললো। ঘরের মধ্যে কাউকে না দেখে বাইরে বেরিয়ে গেল। রাত হয়েছে। চারিদিকে ঘন অন্ধকার। বেশ কয়েকটি ল্যাম্প জ্বালানো হয়েছে। বিদ্যুৎ নেই। কিছুক্ষণ পর সে জানতে পারল আজকে আর বিদ্যুৎ আসবে না। ঝড়ে কোথাও গাছ পড়ে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। বিদ্যুৎহীন পুরো রাত্রি কখনও কাটায়নি। নতুন একটা পরিবেশের অপেক্ষায় রইল। ঘরের মধ্যে একা একা বসে বুঝতে পারল বিদ্যুৎহীন রাত্রি বড্ড মায়াবী। বিদ্যুৎহীন রাত্রি এত সুন্দর হয় আগে জানতো না। চারিদিকে ঘন নির্জনতা। নির্জনতার মধ্যে মাঝে মাঝে ঝাঁকিয়ে বৃষ্টি সময়কে অপরূপ করে তুলেছে। নিজের কিছু কাজ শেষ করার পর সাথীর ঘরে গেল সে। ল্যাম্পের আলোয় পড়াশোনা করছে।পাশে গিয়ে বসতেও কোনো কৌতুহল দেখালো না সাথী। মনে হয় রেগে আছে।
‘রাগ করেছো?’ সাথী বই থেকে মুখ তুলে তাড়াতাড়ি উত্তর দিল,’না তো।’
‘কিন্তু মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে রাগ করে আছো।’
‘মুখ দেখে তো অনেক কিছুই মনে হয়। সব কি সত্যি হয়?’
‘এ বাবা, তুমি এত বুড়ির মতো কথা বলছো কেন?’
‘তুমি আজকে মেজদির সঙ্গে বিকেলে ঘুরতে গিয়েছিলে?’ অবাক হলো সবুজ। সাথী কি করে জানলো? নিশ্চয়ই এই বিষয়ে বাড়িতে আলোচনা হয়েছে।
‘হ্যাঁ, গিয়েছিলাম তো।’
‘আমায় নিয়ে গেলে না কেন?’
‘তখন তো তুমি ঘুমাচ্ছিলে।’
‘বা রে,ডেকে তুলতে পারলে না? একা একা চলে গেলে।’ সবুজের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল সাথী। বইতে আবার মনোযোগী হয়ে পড়লো। বালিকা অভিমান করেছে। অভিমান ভাঙ্গাতে হবে।তবে তার মাথায় অন্য একটা ভাবনা এল। তাদের বাইরে বেরোনো নিয়ে একটা বড় গন্ডগোল হয়েছে। না হলে পরিবারের…. সাথীর কাছে এত দ্রুত পৌঁছোবে না।কাজলও কখনও কিছু বলতে চাইবে না।কি হয়েছে জানতে হবে। তার জন্য কাজল আবার কোনো শাস্তি পাবে না তো? ভয় করলো সবুজের।
পর্ব ০৭ আসছে।।