নিভৃতে_যতনে #Part_06,07

#নিভৃতে_যতনে
#Part_06,07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
06

খাটের এক কোনে তব্দা মেরে বসে আছি। শীতল চোখে সামনে তাকিয়ে আছি৷ আমাকে ঘিরে প্রায় আট-দশজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের পরিচয় তারা রোয়েনের কাজিন। রাহি,কুহু,ইশান হচ্ছে একদম আন্ডা-বাচ্চা টাইপ। জেরিন,ফাহিম হচ্ছে কিশোর-কিশোরী। নিহান,রেশমি,রাত হচ্ছে আমার বয়সী বা আমার চেয়ে হয়তো একটু বড়। নুরি,শুভ,নীলা এরা হচ্ছে রোয়েনের বয়সী বা তার চেয়ে বড়। নুরি আর নীলা আপু দুইজন বিবাহিত আর সেই আন্ডা-বাচ্চাগুলো তাদের দুইজন এরই। বাচ্চারা রুমের এক কোনে বসে খেলছে আর বাদ-বাকি সকলেই মিলে আড্ডার আসর জমিয়ে দিয়েছে। সকলেই এই সেই প্রশ্ন করে চলেছে। আমার কি পছন্দ না পছন্দ? হ্যানত্যান! এত প্রশ্নের ভীড়ে মাথাটা একদম ধরে এসেছে। কিন্তু তাও নিজেকে সংযত করে বসে আছি। এইদিকে কথায় কথায় নুরি আপু বলে উঠে,।

— বুঝলে সিয়াশা! তোমার ভাগ্যে এক রোবট জুটেছে।

আমি নুরি আপুর কথা শুনে কৌতহুল দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাই। পাশ থেকে শুভ ভাই বলে উঠে,

— শুধু কি রোবট বইন? ওই তো রোবটের চেয়েও অধম।

শুভ ভাইয়ার কথা শুনে বাকিরা হেসে উঠে। আমি এখনো গোলগাল চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দৃষ্টির মর্ম বুঝতে পেরে নীলা আপু হাসি মুখে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

— কি কিছু বুঝো নি?

আমি দুইপাশে মাথা দোলালাম। যার অর্থ আমি বুঝিনি। নুরি আপু বলে উঠে,

— ভাই আমাদের সেই ইন্ট্রোভার্ট। বলতে গেলে হাই লেভেলের ইন্ট্রোভার্ট। এর মুখ দিয়ে কথা বের করানো আর পাহাড় খুঁড়ে ইঁদুর খুঁজে বের করা একই কথা। সবসময় নীরব আর একা থাকতে ভালোবাসে। বলতে গেলে একঘেয়ে টাইপ।

নুরি আপুর কথার মাঝেই নীলা আপু বলে উঠে,

— এইভাবে ভাই আমার ভালোর ভালো। শান্ত-শিষ্ট। কিন্তু একবার রেগে গেলে কেয়ামত আনতে দেরি নেই। কথায় আছে না, ‘শান্ত-শিষ্ট মানুষদের কখনো রাগাতে নেই। নাহলে আজাব বয়ে যায়।’ রোয়েনের বেলায়ও কথাটা শতভাগ সত্য।

হঠাৎ নীলা আপুর কথার মাঝে শুভ ভাই ফোঁড়ন দিয়ে বলে,

— আসল কথা বলস না কেন তোরা? নাহলে ভাবী বুঝবে কিভাবে রোয়েন আসলে কোন উচ্চতর জাতের প্রাণী।

কথাটা বলে শুভ ভাইয়া আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— তো শুনেন ভাবী। আপনার অতি প্রিয় বরের কান্ড। সে বিয়ের কোন অনুষ্ঠান এই করতে রাজি ছিল না। বিয়েতে নাকি সোরগোল বেশি হয়, গেদারিং বেশি হয় তাই সে চায় না কোন প্রকার অনুষ্ঠান হোক৷ তার কথা অনুযায়ী সে যাবে, কবুল বলবে আর বউ নিয়ে চলে আসবে। এর মধ্যে এত হৈ-হুল্লোড়ের কি আছে? কিন্তু মামা-মামী কি আর তা মানে? একমাত্র এর ছেলের বিয়েতে নাকি কোন প্রকার অনুষ্ঠান করবে না তা কি মানা যায়? অবশেষে মামা-মামীর অতি জোড়াজুড়িতে সে রাজি হয়। মানে মানুষ কোন লেভেলের রস-কসহীন হলে এমন কথা বলে বলুন তো ভাবী?

শুভ ভাইয়ার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে নীলা আপু বলে উঠে,

— হলুদের দিন কি করলো মনে নেই? বড়দের হলুদ ছোঁয়ানোর পর যখন আমাদের পালা এলো তখন সে উঠে রুমে চলে আসলো। আর দরজাও খিল মেরে রাখলো৷ বেয়াদব একটা!

নুরি আপু হেসে বলে,

— কারণ তোরা যে ওকে হলুদ আর রঙে ভূত বানানোর মাস্টার প্ল্যান করছিলি তা ও জেনে গিয়েছিল। তাই তো তোদের পালা আসতেই পালিয়েছে।

কথাটা বলেই নুরি আপু হু হু করে হেসে উঠে। নীলা আপু ও শুভ ভাই মুখ ভোতা করে একেক অপরের দিকে তাকায়৷ হঠাৎ শুভ ভাই একটু গম্ভীর হয়ে বলার চেষ্টা করে,

— এইখানে কে মীরজাফর গিরি করেছে তা বলে দে। তার গর্দান নিব আমি আজ।

কথাটা শুনার সাথে সাথে জেরিন দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে,

— শুভ ভাই! মীরজাফরের দিন শেষ ঘষেটি বেগমের বাংলাদেশ।

কথা বলেই জেরি৷ দাঁত কেলিয়ে এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তা দেখে শুভ চেঁচিয়ে বলে,

— রোয়েন ভাইয়ের চামচি! আমাদের গোপন কথা পাচার করিস, সাহস তো কম না। আজ তোকে পেয়ে নেই খবর আছে।

কথাটা বলতেই বলতে শুভ ভাই রুম থেকে বেরিয়ে যায় জেরিনের খোঁজে। আর তা দেখে বাকি সব হাসিটে গড়াগড়ি খায় এমন অবস্থা। আর এইদিকে আমি সবার কথা শুনে বিরবির করে বলে উঠি,

— ব্যাটা দেখি আস্ত নিরামিষও।

আমাকে বিরবির করতে দেখে নীলা আপু জিজ্ঞেস করে উঠে,

— কিছু বললে?

আমি তার কথায় ভড়কে গিয়ে আমতা আমতা করে বলি,

— না তো।

আমার কথার প্রত্যুত্তরে নীলা আপু কিছু বলবে এর আগেই রুমে আমার শ্বাশুড়ি মানে সালমা বেগম এসে হাজির হোন। রুমের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে তিনি সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,

— নতুন সদস্যকে পেয়ে বুঝি ছাড়তে ইচ্ছে করছে না? কিন্তু তাকেও তো একটু আরাম করতে দিতে হবে নাকি?

তার কথা শুনে নুরি আপু বলে উঠে,

— কথার তালে ভুলে গিয়েছিলাম চাচী। এই নীলা চল। ভাবী এখন যাই তুমি রেস্ট নাও। পরে আবার আসব নে।

আমি কিছু না বলে মিষ্টি এক হাসি হেসে মাথা দুলাই। নীলা আর নুরি আপু সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সকলে বেরিয়ে যেতেই সালমা বেগম আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার পাশে বসে বলে,

— ঠিক আছো তো মা? তোমার কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?

আমি মাথা নিচু করে বলি,

— জ্বী না আন্টি৷

সে আমার হাত তার কোলে নিয়ে বলে,

— আন্টি কি হ্যাঁ? মা বলে ডাকবা। সকালে ছাড় দিয়েছি বলে এখন দিব না কিন্তু।

আমি মাথা নিচু রেখেই ইতস্তত সুরে বলি,

— জ্বী আচ্ছা।

সে আমার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে ধরে বলে,

— আমাকে মা ডাকতে তোমার কোন সমস্যা আছে?

আমি সাথে সাথে বলে উঠি,

— না! না! তেমন কিছু না।

— তাহলে মা বলে ডাকো।

আমি নিভু নিভু স্বরে বলি,

— মা!

সে স্মিত হেসে বলে,

— পরিবেশ নতুন, খাপ খাওয়াতে সময় লাগবেই৷ জানি বিষয়টা এতটা সহজ নয়৷ নতুন এক পরিবারে এসে, তাদের আপন করে নেওয়া,খাপ খায়িয়ে নেওয়া। কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবেই নাকি?

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা দুলিয়ে বলি,

— জ্বী।

সে আমার থুতনি থেকে হাত সরিয়ে বলে,

— আমার সাথে এতটা জড়তা নিয়ে কথা বলতে হবে না। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলো। হয়তো তোমার আমাকে মনে নেই, কিন্তু আমার যে আছে। সেই ছোট থেকে চিনি তোমায়।

আমি তার কথা শুনে মুখ চাই। কৌতহুল ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠি,

— আমাকে আপনি ছোট থেকে চিনেন?

— হ্যাঁ চিনি। তোমার ৩ বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা তোমাদের পাশের ফ্ল্যাটটাই ছিলাম। সেখানে থাকাকালীন এই তোমার পরিবারের সাথে আমাদের খুব ভালো সম্বন্ধে গড়ে উঠে। এমনকি মাঝে মধ্যে তোমায় আমি নিজের হাতে খায়িয়েও দিয়েছি।

— আমার মনে নেই।

কথাটা বলেই মাথা নিচু করে ফেললাম। সালমা বেগম হালকা হেসে বলে,

— আরেহ বোকা! এতে মন খারাপ করার কি আছে? অতটুকু বয়সে এইসব মনে থাকার কথা নাকি?

আমি কিছু না বলে চুপ করে রই। সে স্মিত হেসে বলে,

— দেখো মা! আমার যাওয়ার পরে যেহেতু তোমায় এই সংসার দেখতে হবে সেহেতু কিছু বিষয় সম্পর্কে তোমার আগ থেকে জেনে রাখা ভালো।

আমি তার কথা শুনে মুখ তুলে তাকিয়ে বলি,

— আপনার যাওয়ার পরে মানে?

— আমি আর তোমার শ্বশুর তো এইখানে থাকি না। দেশের বাড়িতে থাকি। তোমার শ্বশুর সেখানেই একটা স্কুলের হেডমাস্টার। তো সেই সুবাদে তার সাথে আমাকেও তার সাথে দেশের বাড়িটাতেই থাকতে হয়।

আমি তার দিকে গোলগাল চোখে তাকিয়ে বলি,

— তার মানে আমাকে এইখানে একাই থাকতে হবে?

সে হালকা হেসে বলে,

— একা কোথায়? রোয়েন আছে না। তার উপর একটা কাজের লোক আছে যে তিনবেলার খাবার রেঁধে দিয়ে যাবে আর সেই সাথে সব কাজও করে দিয়ে যাবে৷ চিন্তা নেই, আমিও মাঝে মধ্যে এসে বেড়িয়ে যাব।

আমি কিছু না বলে মাথা নুয়ে ফেলি৷ সে তা দেখে আবার বলতে শুরু করে,

— আমার ছেলেটা জানো বড্ড চাপা স্বভাবের। বলতে পারো অন্তর্মুখী। বেশি মানুষ পছন্দ করে না। সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না। নিজের মনের কথা কাউকে বলতে পারে না। একবারেই দরকার ছাড়া বেশি একটা কথাও বলে না। ওর মধ্যে ভাবান্তর জিনিসটা তেমন নেই। একটু কেমন যেনো ও। তাই ওকে ভুল বুঝো না তুমি। ছেলে আমার ছোট থেকেই মেধাবী। ছোট থেকেই পড়ালেখার প্রতি ওর যত আগ্রহ। আর এখন কাজ নিয়ে। কাজের উর্ধ্বে ওর জন্য কিছু নেই৷ কাজ একদিকে পুরো পৃথিবী একদিকে। বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?

— জ্বী পারছি।

সে আমার হাত আরেকটু চেপে ধরে বলে,

— তোমার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, আমি চাই তুমি আমার ছেলেটাকে দেখে রাখো। ওকে বুঝার চেষ্টা করো। ওর অর্ধাঙ্গিনী হয়ে সর্বদা ওর পাশে থাক। আগলে রাখো ওকে। বিপদে ওর পাশে দাঁড়াও। কি পারবে না?

আমি মাথা নেড়ে বলি,

— হ্যাঁ পারবো মা।

সে হেসে বলে,

— শাড়ি পড়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছে না? যাও চেঞ্জ করে নাও। আর কাউরো কোন কথা কানে নিবে না। মানুষের কাজই হলো বলা। এক কান দিয়ে শুনবে আরেক কান দিয়ে বের করবে। কেমন?

আমি পূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে সৌজন্য মূলক হাসি দেই৷ এই হাসির মধ্যে নেই কোন কৃত্রিমতা৷ আছে শুধু এক রাশ ভালবাসা আর শ্রদ্ধা।

___________________

রাতে খাবারের পর্ব চুকিয়ে রুমের ভিতরে আসতেই দেখি রোয়েন খাটের উপর বসে ল্যাপটপ চালাচ্ছে। আমি তার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডেসিং টেবিলের দিকে চলে যাই। চুলে বিনুনি করতে করত আজকের কথা ভাবতে থাকি।

আজ আমার আর রোয়েনের বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানে রোয়েনের পক্ষ থেকে সকলে উপস্থিত থাকলেও আমার পক্ষ থেকে শুধু ছিল মা,চাচা-চাচী,হৃদিপু আর কিছু কাজিনস। বাকি আর কেউ আসে নি। হয়তো আসার দরকার মনে করে নি। অবশ্য আমি নিজেও আশা রাখি নি যে এদের বাদে আর কেউ আসবে। আমার আপন বলতে হৃদিপু আর মায়েই। তো তারা যেহেতু এসেছে আমার কি আর কারোর দরকার আছে?
হৃদিপু এসেই আমায় জড়িয়ে ধরে। আবেগে প্রায় কেঁদে দেয় দেয় অবস্থা। মেয়েটা আমায় এত ভালবাসে যে বলার মত না। এইদিকে মা তো প্রায় কেঁদেই দিয়েছিল। কত কষ্টে যে থামিয়েছিলাম। পুরো অনুষ্ঠানেই মা ও হৃদিপু আমার আশেপাশেই থেকেছে। ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠান শেষ হতেই যখন চাচা আমায় আর রোয়েনকে যাওয়ার কথা বললো তখন আমার শ্বশুর বাবা কালকের কথা বললেন। আজ নাকি তাদের সকল আত্মীয় চলে যাবে তাই তাদের বিদায়ের সময় আমাদের থাকা প্রয়োজন। চাচাও এক কথায় মেনে গেলেন। সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন। আর এইদিকে শুধু উপহাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে নিলাম তাচ্ছিল্যের হাসি। হাসির আড়ালেই লুকিয়ে নিলাম নিজের কষ্ট গুলো। এই কষ্টগুলো যে দেখার কেউ নেই।

হঠাৎ রোনের কন্ঠ কানে আসতেই আমি নড়েচড়ে উঠিম আয়নার মধ্যে দিয়েই আড়চোখে রোয়েনের দিকে তাকাই। রোয়েন গম্ভীর গলায় বলে উঠে,

— কালকে সকাল ১০ টার মধ্যে রেডি থাকবে। ১০ টায় আমরা রওনা দিব।

কথাটা শুনে আমি ঘুরে দাঁড়াই। ছোট ছোট চোখ করে বলি,

— না গেলেও চলবে।

রোয়েন নিজের ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলে,

— তুমি থাকতে চাইলে থেক যেও। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— তা আপনার প্রবলেমটা আসলে কোথায় শুনি?

সে ভ্রু কুটি আরও কুঞ্চিত করে বলে,

— আমার প্রবলেম জেনে তোমার লাভ কি? সালুয়েশন বুক নাকি তুমি?

তার কথায় আমি ফোঁস করে বলে উঠি,

— আমি সালুয়েশন বুক কি না জানি না বাট আপনি একটা অসহ্য।

সে ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বলে,

— আর তুমি একটা বুঁচি।

আমি ফোঁসফোঁস করতে করতে বলি,

— এই কি বললেন আপনি আমায়?

সে ল্যাপটপ সাইড টেবিলের উপর রেখে শুতে শুতে বলে,

— মিস বুঁচি! লাইট অফ করে দিও তো। ঘুমাবো আমি এখন।

বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। আর আমি রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকলাম। বিরবির করে বলে উঠলাম,

— ব্যাটা খাটাশ! এর শোধ যদি আমি না নিয়েছি তাহলে আমার নামও সিয়াশা না।

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

জৈষ্ঠ্য মাসের পনেরো তারিখ আজ। তপ্ত এক সকাল। গুমোট এক ভাব চারদিকে। এই তপ্ত গরমের মাঝেই আমি আর রোয়েন জ্যামে আটকে আছি আধাঘন্টা যাবৎ ধরে। সিগন্যালের জ্যাম নাকি কি-না তা আমার জানা নেই। একে তো গরম তার উপর জ্যাম। আমার তো প্রায় যায় যায় অবস্থা। রিকশায় আছি বিধায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের বিষাক্ত গ্যাস নাকে মুখে এসে বারি খাচ্ছে। তার উপর মাথার উপর তীক্ষ্ণ রোদের ছায়া। রোয়েনের কাছ থেকে দূরত্ব বুঝিয়ে রাখার জন্যই রিকশার হুটটা অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খোলা রাখতে হয়েছে। সব মিলিয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল। ভিতরটা আমার বার বার গুলিয়ে আসছে। কিন্তু কোন মতে নিজেকে সামলে রেখেছি। রোয়েনের অবস্থা বুঝার জন্য আমি আড়চোখে তার দিকে তাকাই। এক চিলতে রোদ এসে বারি খাচ্ছে তার মুখের উপর। ব্রাশ করার চুলের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে সোনালী আভা। কিন্তু সেদিকে কি তার ভাবান্তর আছে? সে তাই ভাবলেশহীন ভাবে বসে এক হাত দিয়ে মোবাইল স্ক্রোল করেই চলেছে। দেখে মনে হচ্ছে তার যেন গরমই লাগছে না। গরম বলতে এই পৃথিবীতে কিছুই নেই। অথচ গায়ের শার্ট ঘামে ভিজে একাকার। এই খাটাশ ব্যাটা যে কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানে। কিন্তু যত যাই হোক, মানুষ না।

আমি গরমে হাই-হুতাশ করতে করতে নিজেকে শ’খানেক বকা দিয়ে নেই। নিজেই নিজেকে বলি,

— ইউ ডাফার! কে বলেছিল মাত্তব্বোরি করতে? ভালোয় ভালোয় তো রোয়েন উবার বুক করছিল তুই মাঝে কাবাব ম্যায় হাড্ডি কেন হতে গেলি? রিকশার অতৃপ্ত আত্মা ভর করেছিল নাকি তোর উপর? যে রিকশা ছাড়া এক চুলও নড়তে রাজি হলি না তুই? এইবার গরমে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হো।

কথাটা ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। রোয়েনের কাছ থেকে আরেকটু সরে বসার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম৷ যাতে কোন ভাবেই তার শরীরের সাথে আমার স্পর্শ না লাগে। কিন্তু রিকশায় কি তা আদৌ সম্ভব? হঠাৎ রোয়েন বলে উঠে,

— গরমে বারবিকিউ হয়ে এইবার মন ভরেছে তো?

আমি তার কথা শুনে কটমট দৃষ্টিতে তাকাই। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— মন আমার। সো সেটা ভরেছে কি-না সেটা নিয়ে আপনার এত ভাবতে হবে না।

সে ভাব নিয়ে বা হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলে,

— কাল পর্যন্ত জানতাম তুমি বুঁচি প্যাঁচি। আজ দেখছি তুমি মাথামোটা ও। নিজের পায়ে কোড়ল মারা কেউ তোমার থেকে শিখুক।

আমি তার কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— এট লিস্ট মানুষ আমার থেকে কিছু শিখতে তো পারবে, আপনার বেলায় তো তাও পারবে না। একটা খাটাশ মার্কা রোবট থেকে কি বাই আর শিখা যায়?

সে আমার কথা শুনে তার বিশ্ব বিখ্যাত ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে বলেন,

— ডু ইউ ইভেন নো, আমার আন্ডারে প্রায় দেড়শো জন কাজ করে?

আমি তার কথায় থমথম থেকে বলি,

— করতেই পারে,তো?

সে আমার কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করে চায় অতঃপর বিরবির করে বলে উঠে,

— ডাফার!

কথাটা আমি শুনেও না শুনার ভাণ করলাম। আমি আরেকটু চেপে বসতে যাব তখনই জ্যাম ছেড়ে দেয় আর রিকশাচালক একটান দেন। তাতে আমার ব্যালেন্স কিছুটা নড়বড় হয়ে যায় আর আমি পড়ে যেতে নেই। ঠিক এমন সময় রোয়েন আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আমাকে এক টান দিয়ে আমাকে তার সাথে মিশিয়ে নেন। সাথে সাথে আমি ভড়কে যাই। বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকাই। মূহুর্তেই সরে আসতে নিলেও সে আমায় ছাড়ে না। বরং আগের ন্যায় আমার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে বসে থাকে৷ আমি কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— এইটা কি ধরনের অসভ্যতা?

রোয়েন একবার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নত করে বলে,

— হসপিটালে ভর্তি হওয়ার এত ইচ্ছা থাকলে যখন আমি আশেপাশে থাকবো না তখন পূরণ করে নিও। এইসব দৌড়াদৌড়ির কাজ নিতান্তই অসহ্যকর।

আমি তার কথার মর্ম প্রথমে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রই। কথাটা বুঝতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। অতঃপর কথাটা বুঝতে পেরে আমি ফুঁসে উঠি। কাঠ কাঠ গলায় বলি,

— আমি কি বলেছি আপনাকে আমায় নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে? আমাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না আপনার। কিছু হলে একা একাই হসপিটাল চলে যেতে পারবো। হুহ!

সে ভাবলেশহীন ভাবেই বলে,

— ইউ আর নাও মাই রেসপনসেবলিটি। সো আমার সাথে থাকাকালীন তোমার দায়িত্ব আমারই। এর মধ্যে তোমার কিছু হলে এর দায়ভার আমাকেই পোহাতে হবে। আর যেটা আমি চাই না। গট ইট?

আমি কিছু না বলে কটমট দৃষ্টিতে তাকালাম। এর সাথে কথা বলাই বেকার।

______________________

বাসায় আসতে না আসতেই আমার সব কাজিনরা রোয়েনকে চেপে ধরে। আপ্যায়নে ভরে দেয়। সেই সাথে দুই একটা আন্ডা পিচ্চি ঝুলে পড়ে রোয়েনের গলায়। বড় ছোট সকলেই এই সেই জিজ্ঞেস করে চলেছে তাকে। আর সে খালি হু হা করে জবাব দিচ্ছে। মুখ একদম বাংলা প্যাঁচার মত করে আছে। ভাবসাব এমন যে, “ছেঁড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।” যেহেতু আমাকে নিয়ে কাউরো মাতামাতি নেই সেহেতু আমি দূর থেকে দাঁড়িয়ে রোয়েনের অবস্থা দেখছি আর মিটিমিটি হাসছি। বুঝতেই পারছি যে, সে না পারছে সইতে, না পারছে কিছু বলতে। জীবনে এই প্রথমবারের মত আমার কাজিনদের নিয়ে গর্ববোধ করতে ইচ্ছে করছে। মনে চাচ্ছে সবগুলোকে একটা বড়সড় পার্টি দেই। কত সুন্দর রোয়েনকে জ্বালিয়ে মারছে।আহা! কি শান্তি! শান্তি!

হঠাৎ আমার দিকে রোয়েনের নজর পড়তে সে ইশারায় আমায় কিছু বলে। আমি প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝি সে আমাকে এইখান থেকে উদ্ধার করতে বলছে। কথা বুঝার সাথে সাথে আমার মুখে পৈচাশিক হাসি ফুটে উঠে৷ আমি মনে মনে বলি,

— আমাকে বুঁচি বলা হয়েছিল না কাল। এইবার বুঝবেন ঠ্যালা।

কথাটা ভেবেই আমি মুখ ঘুরিয়ে গুনগুন করতে করতে হৃদিপুর রুমে দিকে চলে গেলাম। ছেড়ে দিলাম তাকে আমার কাজিনদের কাছে। কেন না আমি চিনি আমার কাজিনদের। তারা একবার কারো পিছে পড়লে তার অবস্থা নাজেহাল করে ছাড়ে। যেমন এখন রোয়েনের করবে৷ আহা! বাতাসটা এত স্নিগ্ধ কেন?
হৃদিপুর রুমের সামনে আসতেই হৃদিপু দৌড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে। আপ্লূত সুরে বলে,

— সিয়া তুই এসেছিস?

আমি দুষ্টুমির সুরে বলি,

— না আমার অতৃপ্ত আত্মা এসেছে। ভাওওও!

হৃদিপু আমায় ছেড়ে দিয়ে কানে হাতে দিয়ে বলে,

— ইউ খবিশ! কানের পোকার নাড়িভুঁড়িও মেরে দিলি।

আমি কিছু না বলে হু হু করে হেসে উঠি। হৃদিপু আর কিছু না বলে আমায় টেনে তার রুমে নিয়ে যায়। এরপর জুড়ে দেয় দুনিয়ার গল্প। একসময় গল্পের মাঝেই হৃদিপু গম্ভীর হয়ে যায়। মিহিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে উঠে,

— সিয়া একটা কথা বলি?

— হ্যাঁ বলো। না করেছে কে?

— উফফ মজা না।

আমি এইবার নড়েচড়ে বসে বলি,

— ওকে। বলো!

— তুই কি বিয়েটা মেনে নিয়েছিস সিয়া?

কথাটা শুনেই আমি চুপ হয়ে যাই। কোন উত্তর দেই না। হৃদিপু কিছুক্ষণ আমার উত্তরের আশায় আমার মুখ পানে চেয়ে থাকে। কিন্তু কোন উত্তর না পেয়ে বলে,

— দেখ! যেভাবেই হোক বিয়েটা হয়ে গিয়েছে। হোক সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত। হয়েছে তো? তার উপর যতটুকু তোর থেকে শুনলাম, না তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন খারাপ আর না ভাইয়া। তাই বলছি কি লাইফটাকে একটা চান্স দে। নিজের সবটা দিয়ে তাদের ভালবেসেই দেখ না। আশা করি এইবার নিরাশ হবি না। তোর প্রাপ্যটা এইবার তুই পাবি।

আমি হৃদিপুর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলি,

— আমার ভিতরে আর বাকি আছেটা কি?

হৃদিপু আমার হাত তার কোলে নিয়ে বলে,

— এখনো অনেক কিছু আছে বুঝলি। অনেক কিছু জানার আছে,বুঝার আছে। তাই বলছি এই বিয়েটা মেনে নে। সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দে।

আমি কিছু না বলে চুপ করে থাকি। হৃদিপু আবার বলে,

— কিছু তো বল?

— ভালো লাগছে না এই বিষয়টা। বাদ দাও তো।

— কিন্তু..

আমি হৃদিপুর কথার মাঝে ফোঁড়ন দিয়ে বলি,

— তুমি থাক আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে আসি। চলে যাই নিজের রুমে। মাথা ভিতরটা কেমন এলোমেলো লাগছে। অসহ্য লাগছে সব। শাওয়ার নেওয়ার দরকার। আমি কার্বাড থেকে এক সেট জামা নিয়ে ঢুকে পড়ি ওয়াশরুমে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here