নিভৃতে_যতনে #Part_04,05

#নিভৃতে_যতনে
#Part_04,05
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_04

— সবই বুঝলাম বাট বাচ্চাটা কার? ভূতের নাকি জ্বীনের? নাকি কোন ভ্যাম্পায়ারের?

কথাটা শুনার পর আমি হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে রইলাম। ঘটনাটা ক্রমে বুঝে উঠতে আমার বেশ বেগ পেতে হয়। অতঃপর বুঝতে পেরে আমি ফুঁসে উঠি। তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি,

— হোয়াট ডু ইউ মিন? মজা নিচ্ছেন আমার সাথে?

রোয়েন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে থাকা টাওয়ালটা গলায় ঝুলিয়ে নেয়। ট্রাউজাররের পকেটে হাত গুঁজে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— মজা আমি নিচ্ছি না তুমি?

প্রশ্নটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। একবার মনে হয়ে গেল,’ ধরা পড়ে গিয়েছি।’ কিন্তু তাও একটা চান্স নিব বলে ভঙ্গ ধরে রইলাম যে আমি তার কথার অর্থ বুঝিই নেই। চেহেরায় বিষ্ময়কর ভাবটা প্রদর্শিত করে বলি,

— মানে?

রোয়েন পুনরায় আমার দিকে একটু ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

— হোয়াট ডু ইউ থিং? যার সাথে আমার জীবন জুড়ে দেওয়া হবে তার কোন খোঁজখবরই আমি নিবো না? ইনফরমেশন কালেক্ট করবো না? লাইক সিরিয়াসলি! ডু আই লুক ষ্টুপিড?

কথাটা শুনে আমার চেহেরায় থমথম ভাবটা ফুটে উঠে। মনে মনে বলে উঠি, “অহ শিট! ধরা খেয়ে গেসি। ডেম ম্যান।” নিজেকে শ’খানেক বকা দিয়ে ক্ষান্ত হই আমি। অতঃপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে রুদ্ধ গলায় বলি,

— ষ্টুপিড এই তো। সবই যখন জানতেন বুঝতেন তাহলে বিয়েটা কেন করলেন? একটা মেয়ে যেহেতু বিয়েটা ভাঙ্গার জন্য এত বড় অপবাদ নিজের গায়ে লাগাচ্ছে তাহলে আপনার তো বুঝা উচিৎ সে বিয়েতে রাজী না। হুহ!

সে গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

— সো হোয়াট ক্যান আই ডু?

তার এমন কথা শুনে আমার ঠোঁট যুগলটি নিজ শক্তিতে হা হয়ে যায়। আমি গোলগোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে রই। আমার চোখ যেন আপনা-আপনি বলে উঠে, ‘মানে কি ভাই?’ পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বলি,

— হোয়াট ডু ইউ মিন বায় দ্যাট?

সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে,

— প্রবলেম তোমার ছিল আমার না। সো আই কুডেন্ট হ্যাল্প উইথ ইট।

কথাটা শুনে ক্রোধে আমার মাথা ফেটে যায়। আমি রুদ্ধদ্বার কন্ঠে বলে,

— তাই বলে বিয়ে করে নিবেন? একটা মেয়ের মর্জি আপনার কাছে মেটার করে না? মেয়েদের কি কোন বস্তু পাইসেন?

সে পুনরায় ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলে,

— তোমার মনে হয় না, তুমি একটু বেশি কথা বলো? সাচ আ হেডেক।

আমি রেগে গিয়ে বলি,

— একদম কথা ঘুরাবেন না। যা জিজ্ঞেস করেছি তার সোজাসাপটা উত্তর দিন। রাইট নাও আদার ওয়াইস।

সে তৃতীয় বারের মত আমার দিকে ঝুঁকে শীতল কন্ঠে বলে,

— আদার ওয়াইস হোয়াট?

আমি একটু পিছিয়ে গিয়ে বলি,

— পিঠে সমস্যা আছে নাকি? বার বার মুখের উপর ঝুঁকে পড়েছেন কেন?

সে হঠাৎ কিঞ্চিৎ সোজা হালকা চেঁচিয়ে বলে,

— হোয়াট রাবিশ!

আমি ব্যঙ্গ করি বলি,

— হোয়াট রাবিশ! এমন এক ভাব করছেন যেন কিছু বুঝেন না। হুহ!

রোয়েন আমার দিকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আমার সামনে থেকে সরে যায়। বেলকনিতে গিয়ে নিজের টাওয়ালটা মেলে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলে,

— তুমি আমাকে আসল কারণটা বলো নি। যদি সত্যিটা বলতে তাহলে আমি বিনাবাক্যেই বিয়েতে ‘না’ করে দিতাম। ফ্রেংকলি স্পিকিং, মিথ্যা আমার সহ্য হয় না। আই জাস্ট হেট দিস থিং। যেহেতু মিথ্যা বলেছ সেহেতু এখন ভুগতো।

কথাটা শুনে আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে,

— এ কেমন বিচার?

সে আমার আয়নার মধ্য দিয়েই আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়৷ কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। নিজের চুল ঠিক করে সে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ট্রাউজারের পকেটে দুই হাত গুঁজে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে উঠে,

— আর কিছু বলার আছে? কিছু বলার থাকলে ঘুমাবো আমি এখন।

আমি তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলি,

— আমার জীবন নষ্ট করে বলছেন আপনি ঘুমাবেন?

সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

— বিয়ে করে যদি মনে করো তোমার জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাহলে সেটা তোমার প্রবলেম। এতে আমার কিছুই করার নেই বা বলার নেই ব্যতীত এই কথাটির, গুড লাক ফোর ইউর নষ্ট জীবন।

কথাটা বলে সে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। আর আমি রাগে ফোঁস ফোঁস করতে থাকি। অতঃপর নিজের মনকে বুঝাই, ‘এই খাটাশ ব্যাটার সাথে কথা বলে কোন লাভ নাই। এই ব্যাটা জন্মের ঘাড়ত্যাড়া। হুহ!’ কথাটা নিজেকে বলে নিজেকে স্থির করি। গমগম গলায় জিজ্ঞেস করে উঠি,

— আমি ঘুমাবো কোথায়?

সে আমার দিকে তার সেই বিখ্যাত ভ্রুকুঞ্চিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

— আমার জানা মতে সকল মানুষই খাটে ঘুমায়। এখন তুমি যদি মানুষ না হয়ে থাকো তাহলে সেটা আলাদা হিসাব।

আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,

— আ’ম সিরিয়াস!

সে বিছানার উপর বসে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে,

— যেখানে আমি ঘুমাচ্ছি সেখানেই ঘুমাবে৷ গল্প উপন্যাসের মত আমার রুমে তো আর নয়। যে রুমে সোফা থাকবে আর তুমি সেটা দখল করে বসবে। বাট ইয়েস, বারান্দা আছে। চাইলে ওইটা ট্রায় করতে পারো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। নাও চয়েজ ইজ ইউরস।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে বলি,

— লাইক সিরিয়াসলি?

সে মোবাইল বের করে কিছু একটা করতে করতে বলে,

— ইয়াহ!

বলে মোবাইল চালাতে চালাতে সে শুয়ে পরে। আর আমি হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে থাকি। বুঝে উঠার চেষ্টা করি, ‘একটা মানুষ কি পরিমাণ ঘাড়ত্যাড়া ওয়ালা হলে এমন হয়। সেই সাথে কি ভাব। দেখলেই গা জ্বলে যায়।’ কথাটা ভেবেই রাগ উঠে যায়। অতঃপর ভাবলাম, ‘ব্যাটা যেমনই হোক কিন্তু খারাপ না। খারাপ হলে এতক্ষণে নিজের আসল রুপ দেখিয়ে দিত। বাট তাই বলে এতও ভালো না। হুহ!’
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকি এখন কি করা যায়। বারান্দায় যাওয়া ইম্পসিবল। বারান্দায় গিয়ে ঘুমানোটা শুধু গল্প ও উপন্যাসেই সম্ভব রিয়েল লাইফে না। কিন্তু বিছানাতে ঘুমাতেও মন কেমন খচখচ করছে। বিব্রতবোধ করছি। এক বিছানায় অন্য এক পুরুষের সাথে শেয়ার করার কথাটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে৷ উফফ! কি অসহ্যকর এক পরিস্থিতি। কেন যে এই বিয়ে করতে হয় মানুষদের বুঝি না। নিজেই যখন নিজের সাথে এইসব নিয়ে আনমনে আজাইরা প্যাঁচাল পারছি তখন রোয়েন বলে উঠে,

— তুমি ঘুমাও কিংবা না ঘুমাও, লাইটটা অফ করে দাও। পরে ডীম লাইটটা অন করে দিও। ঘুমাবো আমি এখন।

কথাটা বলে সে পাশ ফিরে শুয়ে পরে। আমি মনে মনে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে লাইট অফ করে দিয়ে, ডীম লাইট অন করে দেই৷ বিরবির করে বলি, ‘ব্যাটা খাটাশ।’ অতঃপর নিজের সাথে বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধ করে বিছানার দিকে এগিয়ে যাই। বেশ দূরত্ব রেখে তার পাশে গিয়ে শুয়ে পরি আর মনে মনে বকতে থাকি, ‘ব্যাটা কিপটা। রুমে একটা সোফা রাখলো কি হইতো? টাকার আকাল পড়তো নাকি?’

#চলবে

#নিভৃতে_যতনে
#Part_05
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

নতুন সকাল,নতুন অধ্যায়। কথাটি আজ আমার জীবনের সাথে যেন খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। জীবনের গতিটাই যেন আজ বদলে গিয়েছে। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন জীবন। অথচ এই সকল নতুনের মাঝে এক পুরাতন আমি।

মিনিট পাঁচেক আগেই ঘুমটা ভেঙ্গেছে আমার। ঘুম ভাঙ্গবার পর কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিলাম। বুঝে উঠার চেষ্টা করছিলাম আমি আসলে কোথায়৷ অতঃপর পাশ ফিরে রোয়েনকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতেই চমকে উঠলাম। ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়ে এলো সব। মনে পরে গেল কালই আমার এই মানুষটির সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি এখন বিবাহিত। কথাটা মনে পড়তেই আনমনে সেই কথাগুলো ভেবে উঠি। কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেয়াল ঘড়িটা খুঁজতে থাকি। ডান দিকে দেয়ালে তাকাতে পেয়েও যাই। সময় এখন সাড়ে সাতটার একটু বেশি। আড়মোড়া ভেঙে নেমে পড়ি। লাগেজটার সামনে গিয়ে সেটা খুলি। ভাবতে থাকি কি পড়া যায়। নিয়ম অনুসারে আজ শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিন শাড়ি পড়তে হয়। কথাটা ভেবেই বিরক্তিতে নাক-মুখ কুঁচকে এলো আমার। এমন নয় যে আমি শাড়ি পড়তে পারি না। পারি! কিন্তু সমস্যা হলো শাড়ির সাথে আমার অনন্তকালের শত্রুতা। এই একটা জিনিসই পৃথিবীতে আছে যাকে নাকি আমি মনে প্রাণে ঘৃণা করি। এই চৌদ্দ প্যাঁচ আলা ত্যানা মানুষ যে কিভাবে এত সাচ্ছন্দ্যে পড়ে ঘুরে বেরায় আল্লাহ মালুম। নির্ঘাত এরা এলিয়েন। নাহলে এই ত্যানাটা পড়ে সারাদিন থাকা যায়? হুহ!
একবার ভাবলাম সেলোয়ার-কামিজই পড়বো। যে যা ইচ্ছা বলুক গা। সেলোয়ার-কামিজটা নিতে গিয়েও নিলাম না। শাড়ি উঠিয়ে নিলাম। কেন না শাড়িটা না পড়ার বিষয়টা যে কোথা থেকে কোন পর্যন্ত গড়াবে তা আমার জানা আছে। বিষয়টা আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আমার শ্বশুরবাড়ির সকলের মধ্য দিয়ে যাবে। ঝামেলা হবে। আর তা আমি আপাতত চাই না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষে শাড়িটাই বেঁছে নেই৷ ওয়াশরুমের দিকের যেতে যেতে ভাবি, ‘এইটা তো মাত্র শুরু। নিজের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সামনে আর কত কি যে করতে।’ কথাটা ভেবেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম।

ফ্রেশ হয়ে এসে চুল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাওয়ালটা দিয়ে চুল মুচতে থাকলাম। নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে করতেই আয়নার মধ্য দিয়েই খাটের দিকে নজর যায়৷ রোয়েন চ্যাপ্টা হয়ে ঘুমাচ্ছে। চুলগুলো একটু লম্বা হওয়ায় কপালে এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে। আমি পিছন ঘুরে দাঁড়ালাম। ভালো ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। কেন না এর আগে আমার তাকে এতটা ভালো মত দেখা হয়নি। শ্যাম বর্ণ গায়ের ছেলেটির মুখশ্রী অতি সাধারণ। লম্বাটে মুখ, সরু নাক। ঠোঁটের রঙ একদম হালকা গোলাপি। গালে কোন দাঁড়ি নেই। দেহের গঠন মিডিয়াম। একদম মোটাও না আবার চিকনও না। দেখতে বেশ না হলেও খারাপ না। আমি এইবার ঘুরে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলি, “এত চেক আউট করার কি আছে? প্রেম করবি? এই খাটাশ ব্যাটা না চাইলেও তোর, চাইলেও তোর। একেই নিয়েই তোর কপাল পিটাতে হবে। সেকেন্ড কোন অপশন নাই। হুহ!”
কথাটা যখন ভাবছি তখন দরজায় কড়া আঘাত পড়ে। কেউ একজন অতি মিষ্টি সুরে বলে উঠে,

— ভাইয়া দরজা খুলো। সকাল হয়ে গিয়েছে। মামী ভাবীকে ডাকছে।

কথাটা আমার কর্ণপাত হতেই আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। দ্রুত বারান্দায় গিয়ে টাওয়ালটা মেলে দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে নিয়ে দরজার দিকে চলে যাই। দরজাটা খুলতেই ১৩-১৪ বয়সী একটি মেয়ের মিষ্টি চেহেরা ভেসে উঠে। আমি তার দিকে ছোট এক হাসি উপহার দিতেই সে চওড়া এক হাসি উপহার দেয়। মিষ্টি কন্ঠে বলে,

— ভাবী তুমি উঠে গিয়েছ?

আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ি। সে তা দেখে একটু হেসে বলে,

— তাহলে বেরিয়ে এসো। মামী ডাকছে। এসো আমার সাথে এসো।

কথাটা বলেই আমার হাত ধরে সে নিয়ে যেতে থাকে। স্বভাবে যতটুকু বুঝলাম সে নিতান্তই বাচ্চা টাইপের একটা মেয়ে। তেমন বুঝ-জ্ঞান এখনো হয়নি। যদি থাকতো নিশ্চয়ই এইভাবে হাত ধরে নতুন বউকে নিয়ে যেত না। অথবা এমন ও হতে পারে নতুন কাউকে পেয়ে তার মধ্যে এক্সাইটমেন্ট জিনিসটা বেশি কাজ করছে৷ সে যাই হোক! আমি আর এই বিষয়ের দিকে তেমন একটা পাত্তা না দিয়ে চুপচাপ এগুতে থাকি। ড্রয়িং রুমের দিকে আসতেই হঠাৎ বাজ গলায় কেউ ধমকে উঠে,

— জেরিন! এইটা কি ধরনের অসভ্যতা? বাড়ির নতুন বউকে কেউ এইভাবে টেনে নিয়ে আসে? আক্কেল-জ্ঞান নাই?

সম্মোধনটা শুনে বুঝতে পারলাম মেয়েটার নাম জেরিন। এইদিকে কথাটা শুনেই জেরিন আমার হাত ছেড়ে দেয় আর কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। গোলগাল চোখে সামনে তাকাই। তো আমিও জেরিনের সাথে সামনের দিকে তাকাই। সোফার উপর একজন মাঝবয়েসী মহিলা পায়ের উপর পা তুলে চায়ের পেয়ালা হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জেরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারই পাশে আরও কিছু মহিলা বসে বসে চা খাচ্ছে। জেরিন মাথা নিচু বলে উঠে,

— সরি মা। খেয়াল করি নি আসলে।

সোফায় বসে থাকা সে মহিলা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে একজন মহিলা বলে উঠে,

— আহা রেনু! মেয়েটা কেন বকছিস? বাচ্চা মানুষ।

রেনু বেগম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বলেন,

— বাচ্চা,বাচ্চা বলে তোমরাই কাড়ে উঠাচ্ছো। এমন করলে ও আদব কায়দা শিখবে কবে?

কথাটা বলে তিনি চুপ করে গেলেন। এরই মাঝে জেরিন কেটে পরে। জেরিন কেটে পড়তেই একজন মহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমার জানা মতে আমার শ্বাশুড়ি। আমার সামনে দাঁড়িতেই আমি সালাম দিয়ে উঠি। সে আমার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

— ঘুম ঠিক মত হয়েছে মা? নতুন পরিবেশে এসে সমস্যা হয়নি তো?

আমি না সূচক মাথা দুলাই। সে মুচকি হেসে বলে,

— এসো তোমায় সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।

কথাটা বলেই সে আমার হাত আলতো করে ধরে এগিয়ে নিয়ে যান। অতঃপর সকলের সামনে নিয়ে গিয়ে একেক করে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রেনু বেগম হচ্ছে তার ছোট ননদ আর তানিয়া বেগম হচ্ছে তার ননাশ। দিঘি বেগম হচ্ছে তার বড় জা। মারিয়া ও কুলসুম বেগম হচ্ছে তার ভাইয়ের বউ। মানে ভাবী। আমি সবাইকেই একেক করে সালাম দিলাম। অতঃপর তারা আমার সালামের উত্তর ফিরিয়ে দিয়ে তাদের মাঝে বসিয়ে দিলেন। এইটা সেটা জিজ্ঞেস করতে থাকলেন। এরই মাঝে মারিয়া বেগম জিজ্ঞেস করে উঠেন,

— তোমার গহনা-গাটি কই? পড়ো নাই কেন? জানো না নতুন বউদের সবসময় হাতে-গলায় গহনা পড়ে থাকতে হয়?

তার কথাটা শুনে সকলের আমার দিকে গোলগাল চোখে তাকায়। যার ফলে আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। কোন মতে বলে উঠি,

— গোসল করার সময় খুলে রেখেছিলাম। পরে আর পড়তে মনে ছিল না।

কুলসুম বেগম ঠেস মেরে বলে উঠে,

— এমা! এ কেমন কথা মনে ছিল না? এতটা মনভোলা হলে কিভাবে হবে? সংসারের হাল ধরবা কেমনে?

আমি কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকি। ইচ্ছে তো করছে দুই একটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু আমার সেটা করতে হয়নি কেন আমার জায়গায় আমার শ্বাশুড়িই কথাটা কাটিয়ে দেন,

— ভাবী মনে নাই থাকতে পারে। নতুন পরিবেশ, নতুন জায়গায়। এইভাবেই তো ঘাবড়িয়ে আছে ও। খেয়াল করি নি হয়তো এতটা।

মারিয়া বেগম ভেঙচি দিয়ে বলে,

— বাড়ির বউরে এত ছুট দিতে নাই। নাইলে পরে মাথায় চড়ে বসে।

কথাটা শুনে রেনু বেগম বলে উঠে,

— বউ যার তাকেই না হয় বুঝতে দিন। সে ছুট দিবে কি না। খামাকা অন্যের বিষয়ে নাক ঢুকিয়ে তো লাভ নেই।

রেনু বেগমের কথাটা শুনে মারিয়া বেগম ফুঁসে উঠে। সেই সাথে কুলসুম বেগমও। তারা আর কিছু না বললেও ফোঁস ফোঁস ঠিকই করতে থাকে। একসময় উঠে চলে যান রান্নাঘরের দিকে। তানিয়া বেগম বলে উঠে,

— রেনু তুই একটু বেশি কথা বলিস।

দিঘি বেগম বলে উঠে,

— খারাপ কিছু বলে নি আপা। ঠিকই তো বলেছে।

তানিয়া বেগম বলেন,

— তাও কথাটা এইভাবে বলা ঠিক হয়নি।

রেনু বেগম ভাবলেশহীন ভাবেই বলেন,

— দুনিয়ায় নিজে টিকতে হলে অন্যের মুখের উপর বলা শিখতে হয় বড় আপা।

ঘটনাটা ক্রমে অন্যদিকে যেতে দেখে আমার শ্বাশুড়ি বলে উঠে,

— আচ্ছা থাক না বিষয়টা। এই কথাটা আর টেনে লাভ নেই। এইভাবেও নাস্তার সময় হয়ে গিয়েছে। নাস্তা সাজানো দরকার।

সবাই আর কিছু না বলে একে করে উঠে পরে। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বসিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। অতঃপর এক কাপ কফি নিয়ে ফিরে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

— যাও মা! কফিটা রোয়েনকে দিয়ে এসো আর নাস্তার জন্য বেরিয়ে আসতে বইলো।

আমি মাথা নিচু করে মাথা দুলাই। সে আমার দিকে মুচকি হেসে বলে,

— কিছু মনে নিও না। আমার ভাইয়ের বউগুলো একটু এমনই। একটু সহ্য করো। কালকের অনুষ্ঠানের পরই তারা চলে যাবে।

আমি চট করে বলে উঠি,

— না! না! আন্টি কোন সমস্যা নেই। আমি কিছু মনে করি নি।

সে মুচকি হেসে আমার হাতে কফির কাপটা ধরিয়ে চলে যায়। আর আমি চুপচাপ উঠে চলে যাই রুমে। রুমে এসে দেখি বিছানা খালি। চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম একবার। না কোথাও রোয়েন নেই। আমি বেড সাইড টেবিলে কফির কাপটা রেখে পিছনে ঘুরতেই দেখি ওয়াশরুম থেকে রোয়েন বের হচ্ছে। তাকে দেখেই আমি থম মেরে দাঁড়িয়ে যাই। সে আমাকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। একবার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত আমায় দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে টাওয়াল দিয়ে নিজের চুল মুচতে মুচতে আয়নার সামনে চলে যায়। আর আমি তার দিকে তাকিয়ে ভয়ানক এক বকা দিয়ে মনে মনে বলি, “ভাব দেখলে বাঁচি না। এমন ভাবে মুখ ঘুরালো যেন আমার দিকে তাকিয়ে মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। ব্যাটা খাটাশ একটা।”
কথাটা ভেবেই মুখ-চোখ কুঁচকে নিলাম। এই মানুষটাকে আমার বিন্দু মাত্র সহ্য হয় না। আমি।দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠি,

— আন্টি আপনার জন্য কফি পাঠিয়েছে আর বলেছে নাস্তার জন্যও ডেকেছেন আপনাকে।

সে আয়নার মধ্য দিয়েই আমার দিকে একনজর তাকিয়ে আপন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বারান্দায় গিয়ে টাওয়ালটা মেলে দিয়ে সে রুমে ফেরত আসে। অতঃপর আমাকে ক্রস করে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে কফির কাপটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার এমন খাপছাড়া ভাব দেখে আমার মুখ রীতিমতো হা হয়ে যাওয়ার অতিক্রম। মনে মনে বিরক্তি প্রকাশ করে বিরবির করে আমি বলে উঠি,”স্বাদে কি খাটাশ বলি?আস্ত খাটাশ একটা।”

__________________

নাস্তার টেবিলে বসে আছি সকলে। টেবিলে আমি,রোয়েন, রেনু বেগম,তানিয়া বেগম, আমার শ্বশুর আর শ্বাশুড়ি বসে আছেন। বাকিরা নাকি ইতিমধ্যে খেয়ে উঠেছে। এখন বাকি আছে ছোটরা। তারা আপাতত পাশের ফ্ল্যাটটায় আছে৷ তাদের জন্য নাস্তা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষ বেশি হওয়ায় সকলের নাকি এই ফ্ল্যাটে জায়গায় হয়নি। পাশের ফ্ল্যাট খালি থাকায় রোয়েন নাকি বাড়ির মালিকের সাথে কথা বলে এক সপ্তাহের জন্য সেটা ভাড়া নিয়েছে। যাতে বাকি মেহমানরা সেখানে থাকতে পারে।
আমি চুপচাপ খাবার খাচ্ছি। এমন সময় আমার শ্বশুর মানে তৌসিফ সাহেব বলে উঠেন,

— মা তোমার এইখানে সমস্যা হচ্ছে না তো?

‘মা’ সম্মোধনটা শুনে আমি কিছুক্ষণের জন্য থমকে যাই। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রই তৌসিফ সাহেবের দিকে। অতঃপর ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি ঝুলিয়ে বলি,

— জ্বী না আঙ্কেল। আমার এইখানে কোন সমস্যা হচ্ছে না।

— কোন সমস্যা হলে কিন্তু আমায় বা রোয়েনের মাকে বলবে। কিছু যদি দরকার হয় তাহলে তা বলতে লজ্জা পাবে না।

আমি মাথা নিচু করে বলি,

— জ্বী।

কথাটা বলে আমি আড়চোখে রোয়েনের দিকে তাকাই। সে নিচের দিকে তাকিয়ে আপন মনে খেয়েই চলেছে। তার মধ্যে যেন কোন ভাবান্তর নেই। মনে মনে ভাবী, “রোবট নাকি? মানুষ এতক্ষণ কথা না বলে বাঁচে কেমনে ভাই?হাও?” কথাটা ভেবে আমি নিজেও খাওয়ায় মন দেই। হঠাৎ রোয়েন বলে উঠে,

— মা আমার একটু কাজ আছে আমার বেরুতে হবে।

আমার শ্বাশুড়ি সালমা বেগম ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলে,

— আজকে আবার কিসের কাজ শুনি? তুই না এখন ছুটিতে আছিস?

রোয়েন ও ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে বলে,

— ছুটিতে আছি বলে যে কাজ পড়তে পারে না? এইটা কোথায় লিখা আছে?

সালমা বেগম একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলেন,

— মানে তুই আজ বের হয়েই মানবি?

সে নিজের নাস্তা শেষ করে ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠে,

— ইয়াহ!

কথাটা বলেই সে উঠে রুমে চলে যায়। আর আমি সেইদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেই। ব্যাটা আসলেই ঘাড়ত্যাড়া।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here