#নয়নাভিরাম,পর্ব-9,10 last
♡আরশিয়া জান্নাত
09
“একটা কথা জিজ্ঞাসা করি দাদীজান?”
“কর”
“ধরো তুমি একজনকে অনেকদিন ধরে ভালোবাসো,আবার তোমারে অন্য একজন অনেকদিন ধরে ভালোবাসে। তোমারে যদি বলি এদের মধ্যে একজনকে বাছাই করো। তুমি কারে করবা?”
দাদীজান কিছুক্ষণ ভেবে বললো, যে আমারে ভালোবাসে তাঁরে যদি বাছাই করি তাইলে হয়তো আমি অনেক সুখ পামু, সে আমারে অনেক যত্নে আগলাইয়া রাখবো ভালোবাসা দিয়া। কিন্তু বুবুন মন যে বড় হারামী। এরে যতোই পোষ মানানোর চেষ্টা করো যারে একবার চাইবো তারে ছাড়া কারো পোষ মানতো না। আমি যারে বহুবছর ধইরা ভালোবাসতাছি যে যদি আমারে কাইট্টাও ফালায় তাও তাঁর জন্যই আমার মন কানবো। মাইয়ামানুষের একটা দোষ আছে, হেরা সবকিছু আবেগ দিয়া ভাবে। যারে মন থেইকা খাঁটি ভালোবাসে সে ছাড়া অন্য কারো আদর সোহাগও সহ্য করতে পারে না, সবকিছু বিষের মতো লাগে। বুঝতে পারতাছোস কিতা কইতাছি?
“হুম বুঝলাম। কিন্তু যদি ঐ মানুষটা ভালো না বাসে তোমার ভালোবাসা একতরফা হয় তখন?”
“একতরফা আর দুই তরফা কি? মাইনষে মরনের শেষ দিন পর্যন্ত আশা রাখে। এইডা তো একতরফা ভালোবাসা! এর বেলায় না কইলেও বিয়া হইবার আগ পর্যন্ত আশা রাখবোই। তারপর নসীবে নাই ভাইব্বা মাইনা লইবো। অনেকে তো এরপরও আশা রাখে”
“দাদীজান একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে খুব রাগ করবা?”
“জানি কি জিগাইবি। আমিই কইতাছি শোন, তোর দাদাজানে ঐ রেণুমালার ছবি আর চিঠি যত্ন কইরা রাখতো। হের জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভুলতে পারেনাই কইছে আমারে। আমারে কইলো নবীজি (সাঃ) তাঁর প্রথম বিবি খাদিজা (রাঃ) রে আজীবন মনে রাখছে, সবচেয়ে পেয়ারা বিবি তাইনের। আবার নবীজি (সাঃ) এটাও কইছে আয়েশা (রাঃ) রে সবচেয়ে ভালোবাসেন। আল্লাহর কাছে সবসময় ক্ষমা চাইয়া কইতো সব বিবিরে একরকম ভালোবাসতে হয় তবুও মন আয়েশা (রাঃ) রেই বেশি পছন্দ করে।
এহানে যদিও অনেক ফারাক আছে। কোথায় বিবি আর কোথায় প্রেমিকা (আল্লাহ মাফ করেন),এইডা খালি উদাহরণ দিছে মনের নিয়ম বুঝাইবার জন্য। এই মন যে একবারই একজনরেই ভালোবাসবো তা না। নতুনজনও অনেক গভীর ভালোবাসা হইতে পারে। রেণুমালারে ভালোবাসতো হের মানে এই না আমারে ভালোবাসেনা। সেতি হইছে অতীত আমি বর্তমান। মানুষ বর্তমানেই সুখি কি কস?”
“দাদাজান জানতো তুমি উনারে অনেক ভালোবাসো। এই ভালোবাসা দিয়েই উনারে বশ করছিলা।হেহে”
“ভালোবাসার মেলা শক্তিরে বুবুন। এই পৃথিবীতে এটাই একমাত্র অস্ত্র যা দিয়া খুন খারাবি ছাড়াই মানুষরে ঘায়েল করা যায়। এবার হাছা কইরা ক তো কারে ভালোবাসোছ? মিছা কবি না কইলাম আমি ঠিক জানি তোর মনে কেউ আছে!”
“দাদীজান তোমাকে মিথ্যা বলবোনা, কিন্তু সে তো আমারে ভালোবাসে না। তাঁর আশা রাখা কি ঠিক?”
“তুই কইছোস কিছু তাঁরে? হে জানে তুই যে ভালোবাসোছ?”
“উহুঁ,,,”
“তো কেমনে বুঝলি ভালোবাসে না? অন্য কারো কথা কইছে?”
“ছিল একজন। তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে,, কিন্তু আমারে তো কিছু বলেনাই,”
“জিজ্ঞাসা কর মনের কথা কইয়া দেখ। মিটমাট কর হয় ইস পার নাহয় ওস পার। এহনের যুগের মাইয়া হইয়া মনের কথা কইতে ডরাস?”
“আমি বলতাম যে? মেয়েরা বলে নাকি পরে যদি নির্লজ্জ ভাবে?”
“ভাবলে ভাবুক! উল্টাডাও তো হইতে পারে। তোরা সবকিছুতে সমান অধিকার কস। এই বেলায় পিছাবি ক্যান? মনের কথা সবসময় পোলারাই আগে কইবো ক্যান? ”
“হুহ! তুমি বেশি মডার্ন হয়ে গেছ”
“না গো বুবু মডার্ন হইনাই, তোর দাদা মরবার পর বুঝছি জীবনডা খুব ছোডো। ভালোবাসার মানুষডার লগে যতোদিন বাঁচি মনের কথা বেশি কইরা কওন দরকার, বেশি কইরা ভালোবাসনের দরকার, দুনিয়ার কঠিন পরীক্ষার দিনে যদি ভালামতো সঙ্গ না দেই জান্নাতে সুখের সাথী কেমনে হমু? তহন তো এমনিতেই কোনো দুঃখই থাকতো না। তোর দাদাজানরে শরমে কোনোদিন কইতে পারিনাই তাইনেরে কত ভালোবাসি। এহন আফসোস হয়, লাগে আহাইরে একটু যদি কইতাম হয়তো খুব খুশি হইতো,,,,,,”
“দাদীজান তুমি দাদাজানের সত্যিকার অর্থেই জান্নাতের সাথী। দাদাজান তোমার মনের খবর ঠিক-ই জানতো, সেটা নিয়ে মন খারাপ করিও না।”
দাদীজান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোর মন যা কয় তাই হুনিস। তয় ফলাফল যাই আসুক মন শক্ত রাখবি। মনে রাখিস আল্লাহ যা করে ভালার জন্যই করে।
_____________
ফাহিমকে ব্যাপারটা খুলে বলাটাই বেটার মনে হলো। ও আমার কথা নিশ্চয়ই বুঝবে সেই প্রত্যাশায় আমি ওকে সবটা খুলে বললাম। আমি ঠিক করেছি আরশানকে মনের কথা বলবো, এতে যা হবার হবে। উনি যদি রাজী না হয় তবে আমি আর কাউকেই বিয়ে করবোনা। অন্য কারো স্পর্শ কল্পনা করারই শক্তি নেই সেখানে অন্য কারো ঘরণী হওয়া তো বহুদূর! যদিও আব্বু শুনলে খুব রাগারাগি করবেন হয়তো একসময় পরিবারের সবাই খুব জোর করবেন, তাই এর আগেই আমি চম্পট হবো। অন্য কারো কথা আপাতত আমি ভাবতেই পারছিনা,,,
ফাহিম সবটা শুনে বললো, সন্ন্যাসী হবার পণ ছাড়ো। কথা দিচ্ছি যতোদিন না তুমি চাইবে আমি কিছু বলবোনা, অপেক্ষা করবো। মিঃ আরশান যদি রিজেক্ট করে অপেক্ষা করার অধিকারটা অন্তত দিও! আর যদি উনি রাজী হয়ে যান আই প্রমিজ বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কোনো ফিলিংস এর কথা প্রকাশ করবোনা,আমার জন্য তুমি অন্তত বিপাকে পড়বেনা এই ভরসা রেখো। তবে আমি চাই তোমার মন না ভাঙুক, সে যেন এই অমূল্য রত্নটা হারিয়ে না বসে!
আমি হাসিমুখে বললাম, তোর মতো মানুষ হয় না। যদিও অপেক্ষা করে লাভ হবেনা তবুও তোর জন্য এইটুকু ছাড় দিবো। তবে এরমধ্যে তোর যদি অন্য কাউকে পছন্দ হয় আমার কথা ভেবে আটকে যাস না যেন!
“হাহাহা। সে তুমি ভেবোনা”
______________
রোজ আরশানের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর অন্ধকার বেলকনীতে এক নজর দিয়ে বাসায় ফেরা আমার অভ্যাস।আজও তাঁর ব্যতিক্রম হয়নি, কিন্তু আজ তাঁর বেলকনীতে লাইট জ্বালানো দেখেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। আরশান ব্যাক করেছে ভাবতেই আমার হাঁটু কাঁপতে লাগলো। আমি কি করবো? একবার গিয়ে দেখে আসবো? নাকি ফোন করবো? সে তো আমায় নক করেনি দেশে ফিরেছে তাও তো বললোনা। আমি কি সেধে গিয়ে দেখে আসবো? যদি জিজ্ঞাসা করে হঠাৎ কেন এসেছি?
না না সেটা জিজ্ঞাসা করবেনা। আন্টির সাথে তো প্রায়ই দেখা করি। আজও নাহয় গেলাম এ আর বিশেষ কি? গেল সপ্তাহে আন্টির সাথে দেখা করলাম কই তিনিতো এ বিষয়ে কিছু বলেন নি,এমন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত হওয়া আমিটা না পারছিলাম গাড়িতে বসে বাসায় ফিরতে না পারছিলাম দু কদম হেঁটে গিয়ে আমার নয়নাভিরামকে এক পলক দেখতে। সে কি আগের মতোই আছে নাকি আরো সুন্দর হয়ে গেছে? দেখলে নিশ্চয়ই আগের মতোই চোখ জ্বালা করবে! আচ্ছা সে কি আমায় দেখে অবাক হবে ? এই যে আমি এখনো আগের মতোই আছি এক বিন্দুও বদলাই নি সে কি এতে খুশি হবে নাকি বলবে আপনি এখনো ম্যাচিওর হলেন না মিস মিমি?
আঙ্কেল গেইট থেকে বের হয়ে আমাকে দেখে বললেন,আরেহ মিমি যে! কেমন আছ?
“আস্সালামু আলাইকুম আঙ্কেল। ভালো আছি আপনি ভালো আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। বাসায় আসছিলেন নাকি? যাও যাও ভেতরে যাও, গতকাল রাতের ফ্লাইটে আরশান এসেছে। গিয়ে দেখা করো তোমাকে দেখলে খুশি হবে।”
“ওহ তিনি এসেছেন! তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“আমি হাঁটতে বেরিয়েছি। দিনে তো বের হতে পারিনা রাতে একটু চক্কর না দিলে শান্তি লাগে না।তুমি চলোতো মা ভেতরে গিয়ে বসো আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফেরত আসবো।”
আমি বোকার মতো আঙ্কেলের সাথে ভেতরে গেলাম।ইশ একটু আয়নাও দেখতে পারলাম না চেহারা টা ঠিকঠাক আছে তো!
আমাকে দেখেই আফরোজা আন্টি জড়িয়ে ধরে বললেন,ভালো দিনে এসেছিস মিমি। খোকা দেখ কে এসেছে!
আমি তাড়াতাড়ি সোফায় বসে ওড়না দিয়ে পা ঢাকলাম। এই হতচ্ছাড়া পা দুটো আমারে শান্তি দিলো না। তারপর সে এলো! তিন বছর দুই মাস পাঁচ দিন বিশ ঘন্টা পনেরো মিনিট এগারো সেকেন্ড পর তাঁর চেহারা আমি দেখলাম!
সেই গভীর কালো চোখ, ঝলমলে চুল, ঠোঁটে চিরচেনা হাসি। ব্ল্যাক টিশার্ট আর টাউজার পড়ে ঘরোয়াবেশে থাকা আমার নয়নাভিরাম, আমার চক্ষু শীতলকারী। আমার আরশান, হ্যাঁ আমার আরশান! চাপদাঁড়িটা রেখে না জানি কত বিদেশিনীকে ঘায়েল করেছে? ইশ এতো সুন্দর হবার দরকার ছিল তাঁর? এতোশত ভীড় টপকে তাঁর মন অবধি যাওয়ার সাধ্যি আছে আমার, হাহ!
“হেই মিস রুমাইসা কেমন আছেন? কত্তদিন পর দেখা!”
চোখে কিছু পড়েছে এমন ভাব করে চোখে টিস্যু চেপে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
“ভালো আছি। চোখে কি হয়েছে আপনার? কাজল লেপ্টে ফেললেন দেখি!”
“তেমন কিছু না কি যেন পড়লো বোধহয়”
“ওহ ! তারপর বলুন কি অবস্থা? বাসার সবাই ভালো আছে?”
“হুম ভালো ”
“আপনি এমন চুপচাপ যে?”
“না মানে অফিস থেকে ফিরেছি তো খুব টায়ার্ড। আচ্ছা আমি এখন যাই পরে দেখা হবে,”
আমি আন্টিকে না বলেই ওখান থেকে বেড়িয়ে এলাম। ওখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে হিচকি তুলে কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম নিশ্চিত। কত অভিমান অভিযোগ আছে তাঁর নামে সে কি জানে? তাঁর সামনে বসতেই চোখ ফেঁটে কান্না আসছিল উফফ ,ছিঃ মিমি এতো ছিচকাঁদুনে তুই Shame on u!
________________
আফরোজা নাস্তার ট্রে এনে বললেন,কি রে মিমি গেল কই?
আরশানের ধ্যান ভাঙতেই বললো,মা তুমি ঠিক বলেছিলে মিস রুমাইসা খুব অভিমানী! আমি তো বুঝতেই পারিনি তাঁকে। চোখের পানিতে গাল ভেসে যাচ্ছে অথচ অকপট মিথ্যে অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেল! আমি এই মেয়ের অভিমান ভাঙাবো কি করে মা?
“তুই এসে গেছিস না দেখবি সব অভিমান গলে যাবে। এবার আর দেরি না করে মেয়েটাকে আমার ঘরের বৌ করে আন দেখি। আর কত বছর অপেক্ষা করবো আমি?”
আরশান মনে মনে বললো, মিস রুমাইসা অনেক কষ্ট পেয়েছেন তাই না? আমি যোগাযোগ রাখিনি বলে অভিমান গলা অবধি জমে আছে। আমি কিন্তু ঠিকই আপনার খবর রেখেছি, আপনার স্মৃতিচারণ করে আর শ’ খানেক ছবি দেখে এতোটা দিন কত কষ্টে কাটিয়েছি জানেন? সেখানের সবাই জানে আরশানের একটা মিষ্টি রাজকন্যা আছে। যে তাঁর চোখে যাদুর কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছে। সেই চোখ অন্য কারো দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকাতে পারেনা। সেই চোখজোড়া কেবল রুমাইসাকেই দেখতে চায়। মনের মাঝে কেবল তাঁরই ছবি আঁকা, কানে কেবল তাঁর হাসি আর কথার ঝনঝনানির শব্দ।
এই পৃথিবীতে আর কারো সাধ্য আছে এই মনে আসীন হবার?
চলবে,,,,
#নয়নাভিরাম (পর্ব-১০)
♡আরশিয়া জান্নাত
“নীলা দোস্ত আমি না অনেক বড় একটা ভেজালে পড়েছি । উদ্ধার কর!”
“কি হয়েছে?”
“প্রমিজ কর হাসবি না ? আর মজা নিবি না,,,”
“প্রমিজ। বল এবার কি হয়েছে”
“ময়না বলতো ছেলেদের কিভাবে প্রপোজ করে? আই মিন কি কি বলতে হয় বা ইউনিক কোনো আইডিয়া দে কেমনে করলে রিজেক্ট করতে পারবে না?”
নীলা ভুত দেখার মতো চমকে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে রইলো। যেন আমি অবাস্তব কিছু বলে ফেলেছি।
“কিরে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকবি? বল না কিছু”
“এই মিমি তোর কি হয়েছে বল তো? কারে প্রপোজ করবি! তুই ঠিক আছিস তো?”
“ক্যান ! আমি প্রপোজ করতে পারিনা?”
“পারিস তবে,,”
“ঢং না করে বুদ্ধি দে,”
“আচ্ছা শোন,,,,,,,”
শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে আয়নার সামনে বসে নানা এঙ্গেল থেকে নিজেকে পরোখ করে দেখছি কোনো খুঁত আছে কিনা। চারটা বাজতে এখনো বিশ মিনিট বাকি। আরশান সাহেবকে টেক্সট করে বলে দিয়েছি মিট করতে। দরজা খুলে বের হবো তখনই দেখি দরজায় আঙ্কেল আন্টি আর আরশান দাঁড়িয়ে আছে। মিট করতে বলায় সে সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো? আয় হায়! আমি তো ভেন্যু টেক্সট করেছিলাম ধুরর,,
“এখন কি এখানেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন মিস রুমাইসা?”
“আল্লাহ না না না। আস্সালামু আলাইকুম আঙ্কেল আন্টি, আসুন আসুন ভেতরে আসুন।”
আঙ্কেল–কোথাও বের হচ্ছিলে নাকি? এসে বাঁধা দিয়ে ফেললাম?”
আমি–না মানে হ্যাঁ ঐ আচ্ছা আপনারা বসুন আমি সবাইকে ডাকছি
আন্টি–এতো অস্থির হচ্ছিস কেন? শান্ত হয়ে বস এখানে। ওগো দেখো আজকে মিমি কি সুন্দর লাগছে! শাড়িতে বেশ মানিয়েছে তাইনা?মাশাআল্লাহ।
আমি তো লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি, ইশ আজকেই এসব হতে হলো! বজ্জাত আরশান, এক্সপায়ার্ড সস, পচা ডিম একটা,,,ইচ্ছে করতেছে তাঁরে ময়দা থেরাপি দিতে, আমারে বলতে পারলো না একবার হুহ!
আম্মু– আস্সালামু আলাইকুম। আপনারা এতক্ষণে এসেছেন, আমি তো সেই কখন থেকে আপনাদের অপেক্ষা করছিলাম।
আমি অবাক হয়ে আম্মুকে বললাম, তুমি জানতে নাকি আন্টিরা আসবেন? কই আমাকে বলো নি তো?
আম্মু– তুই এই দুনিয়াতে থাকলে তো বললাম। সেই কখন থেকে তো আয়নার সামনেই বসে ছিলি। জানেন না আপা শাড়ি একটা বাছাই করতে কয়টার যে ভাঁজ খুলেছে ,পড়তে গেল আরো দুই ঘন্টা সাজের কথা,,,,,
শেষ করবার আগেই আম্মুর হাত ধরে বললাম,
আম্মাজান গো মুখে একটুতো লাগাম দাও। এইসব বলে দিতে হচ্ছে তোমার!
আমি আড় চোখে আরশানের দিকে চেয়ে দেখি তিনি অন্যদিকে ফিরে হাসছেন। ইয়া আল্লাহ!
আপু আর দুলাভাইকে হঠাৎ দেখে আরেক দফা অবাক হলাম। আপু এসে আমার কানেকানে বললো, বাব্বাহ নিজে নিজেই সেজেগুজে রেডি হয়ে আছিস? আমি তো ভাবলাম আজকে অন্তত আমার জন্য অপেক্ষা করবি।
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম, আজকের দিনে মানে? কি হয়েছে আজকে?
–হুহ ন্যাকা! একটু পরেই বুঝতে পারবি কি আজকে
আমি কিচেনে গিয়ে ভাবীকে বললাম, এই ভাবী ওনারা আজ কেন এসেছেন জানো? আপুও চলে আসলো দেখি রহস্য কি?
ভাবী মহাব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, অনেক দিন ননদীনিরে সহ্য করেছি,এবার তাঁকে বিদেয় করার পাঁয়তারা করছি।
আমি খুশিতে চেঁচিয়ে বললাম, আরশানের সঙ্গে আমার? সত্যি??
“পাজি মেয়ে একটু লজ্জাও নেই কিভাবে নাম ধরে বলতেছে!”
আমার তো লুঙ্গি ডান্স দিতে মন চাইতেছে (ওপস না না পরে সবাই আমারে পরীবানু কইবো)
____________
ছাদে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি আজকের দিনটার কথা। মাঝেমধ্যে ভাগ্য আমাদের বাকরুদ্ধ করে দেয় বটে! কোথায় আমি তাকে প্রপোজ করে চমকে দিতে চেয়েছিলাম, সে নিজেই আমায় চমকে দিলো। একদিকে যেমন আনন্দ হচ্ছিল তেমনই চোখ জ্বালা করছিল খুশিতে।
পছন্দের মানুষকে পারিবারিকভাবে পাওয়াটা আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। এই অনুভূতিটা কেমন তা বলে বোঝানোর ক্ষমতা নেই আমার।
আমার এই মিষ্টি প্রেমের গল্পটা তবে এক তরফা না!
—হ্যালো মিস রুমাইসা!
—হুম বলুন,
—আজ কি পুরো রাত ছাদে কাটিয়ে দেওয়ার প্ল্যানিং এ আছেন?
—আপনি জানলেন কি করে আমি ছাদে আছি?
—গুপ্তচর বলেছে,দেখুন অযথা এই শীতে ছাদে বসে থেকে অসুস্থ হলে কিন্তু খবর আছে। আমি কিন্তু কোনোভাবেই বিয়ের ডেট পেছাবো না।
—এহহ ঢং! এতোদিন তো দিব্যি একা ছিলেন এখন অপেক্ষা করতে ভয় কেন?
—অপেক্ষার কৌটা পূর্ণ হয়ে গেছে। এখন আর করতে পারবোনা। আচ্ছা শুনুন তো আপনি মিট করতে বলেছিলেন কেন তা তো বললেন না?
—কেন এমনিতে মিট করা যায়না ?
—তা যায় তবে এমন শাড়ি পড়ে সাজগোজ করে তো কখনো মিট করেন নি। কোনো বিশেষ কথা বলার ছিল নাকি?
—আরেহ না না না। বিশেষ কি কথা থাকবে,,,
—আমি তো ভাবলাম কেউ বুঝি আজ কাউকে মনের কথা বলতে যাচ্ছিলো,
—কি যে বলেন। মিমির যা বলার থাকে স্ট্রেটকার্ট বলে। কথা পেটে রাখার ক্ষমতা তাঁর খুব কম। ওরকম কিছু হলে ঠিকই বলে দিতাম।
—তাই বুঝি মিস রুমাইসা? এটা যদি সত্যি হতো তবে এতোদিন কি করে হজম করলেন? আমি তো সবসময় ভেবেছিলাম আপনি মনখোলা মানুষ, অথচ মনের আসল কথাটা বলতে পারলেন না?
–আপনি তো বলার সুযোগই দিলেন না জনাব! যতোবার বলার জন্য গেছি ততোবার পথ বন্ধ করেছেন। এই যে আজ সব ঠিকঠাক করলাম তখনো তো বলতে দিলেন না।
—এখন তো জিজ্ঞাসা করছি তাও তো বলছেন না। জানেন আমি শুনেছি একজন নাকি রোজ আমার বারান্দায় উঁকিঝুকি মারতো। চুপিসাড়ে আমাদের ফ্যামিলি অ্যালবাম থেকে আমার সব ছবি নিজের ফোনে টুকে নিতো। একদিন তো সাংঘাতিক কাজ করে বসেছে আমার রুম থেকে ব্লু টি শার্ট টা,,,,,
—আপনি এসব কি বলছেন। কার কথা বলছেন আমি তো কিছু বুঝতে পারছিনা।
—হাহাহাহা,, কার কথা বলছি সে অন্য একদিন বলবো। তবে সে কিন্তু যেনতেন চোর না বিরাট মাপের চোর। আমার সবচেয়ে দামি জিনিসটাই সে চুরি করেছে,,
—আপনি আমাকে চোর বললেন????
—হাহাহাহাহা মিস রুমাইসা আমি কি একবারও আপনার কথা বলেছি? আহারে ফেঁসে গেলেন বুঝি?
আমি ঝট করে ফোন কেটে দিলাম। এই ছেলেটা এমন সুন্দর কথা শিখেছে কবে, হুহ! কিভাবে কথার মারপ্যাঁচে ফাঁসিয়ে দিলো। তবে হাসিটা শুনতে বেশ লাগছিল। কি সুন্দর হাসে হায়য়ই!
।
“এ কি আপনি ওখানে উঠেছেন কেন! নীচে নামুন মিস রুমাইসা? ইয়া আল্লাহ আমি তো ভাবতেই পারিনি বাসরঘরে ঢুকে আপনার এই রূপ দেখবো!”
“আরেহ আরেহ এমন চেঁচাচ্ছেন কেন। পুরো বাড়ি মাথায় তুলবেন নাকি? দুই মিনিট ওয়েট।”
“কি হয়েছে বলবেন তো আমি হেল্প করছি,,”
বেলকনীর গ্রিল থেকে নেমে বললাম, এইটুকু কাজ মিমি একাই করতে পারে।
“কি করলেন ওখানে শুনি?”
“আপনি তো আজীব লোক। নিজের বেলকনীতে কবুতর বাচ্চা ফুটিয়েছে বলতেও পারেন না? বাচ্চাটা নীচে পড়ে গেছিল তাই আমি তুলে দিয়েছি। এদের মা গেল কই? চিন্তার বিষয় তো! আপনি আবার ধরে খেয়ে ফেলেন নি তো?”
“ধুরর আমি কবুতর খাই না। আমি কেন ধরতে যাবো?”
“সেটাও কথা আপনি যা ভীতু!”
“মিস রুমাইসা আমি মোটেও ভীতু না”
“ওহ হ্যালো আমি এখন মিস না মিসেস! ভুলে গেলেন নাকি?”
“ওহ হ্যাঁ আপনার তো বিয়ে হয়ে গেছে! নিন এবার কদমবুসি করেন আমি না আপনার বর?”
“সালামি কত দেবেন?”
“দোআ করে দিবো স্বামীসোহাগী হও আর শত সন্তানের জননী হও”
“এহহ এই দোআ চাই না আমার! এ তো দোআ না বদদোআ!”
“আমি কিন্তু মন থেকে এই দোআ করছি নিম্নে ফুটবল টিম তো হবেই। ন্যাশনাল টিমে আমার সন্তানেরা খেলবে!”
“আপনি দেখি আমার থেকে এডভান্স! এতোদিন তো বুঝিনি!!”
“আপনি তো অনেক কিছুই বোঝেননি, এখন থেকে বুঝবেন আরশান আহমেদ কতদিকে এডভান্স। খুব তো বলেছিলেন আমি একটুও রোমান্টিক না। Let’s see….”
আমি তাঁর হাতের নীচ দিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে বললাম, এমন রোমান্টিসিজম চাই না আমার। জানে বাঁচলে বরের নাম। আমি আজ আর বের হচ্ছি না,,,,,
বেশ খানিকক্ষণ সাড়াশব্দ না পেয়ে চুপিচুপি দরজা খুলে দেখি আরশান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি সেই সুযোগে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়তেই সে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, এবার পালাবেন কি করে মিসেস আরশান??
“না না মানি না এটা চিটিং। আপনি এক্টিং করে ধোঁকা দিয়েছেন হবে না হবে না”
তাঁর গরম নিঃশ্বাস মুখে পড়তেই আমি পরম আবেশে চোখ বুজে ফেললাম। সে আমার চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বললো, এই চোখজোড়া স্পর্শ করতে কতদিন মরিয়া হয়ে ছিলাম জানেন? এতো চোখের পানি ফেলেছেন আপনি, বেচারা দুটো আমার জন্য কত কষ্ট পেলো!
তারপর গালে হাত ছুঁইয়ে বললো, আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি রুমাইসা, আপনাকে পাওয়ার পর মনে হলো যাকে ভালোবাসা বলে দীর্ঘদিন আমি আগলে রেখেছিলাম সেটা আসলে ভালোবাসাই ছিল না। আপনার মতো করে কেউ আমায় ভালোবাসতেই পারতো না। আপনিই আমার সুখ দুঃখের সাথী হবার যোগ্য। যে আমার সবটা জেনে দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, আমায় অকারণেই ভালোবেসেছেন। আপনার মতো কাউকে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া আমার ভাগ্য! আল্লাহ বোধহয় আপনাকে আমার জন্য সৃষ্টি করেছিলেন বলেই নিপুণ আমার জীবন থেকে সরে গিয়েছিল। ভাগ্যিস সে আমায় ছেড়ে গেছিল নাহয় আমিতো আপনার খোঁজ পেতাম না!
“উহু অকারণে ভালোবাসিনি তো। চোখ জুড়াতে ভালোবেসেছি। আমার নয়নাভিরাম যে আপনি তাই ভালোবেসেছি। এখন এতোশতো গুণগান করে আমায় অতো উপরে তুলবেন না। আমি খুব সাধারণ একজন,আর ভালোবাসার ক্ষেত্রে খুব স্বার্থপর হুহ! আজ তাঁর নাম ধরেছেন এটাই শেষবার। এরপর কিন্তু আমি এই নাম শুনবোনা। আপনার মনের এক বিন্দু জায়গাতেও অন্য কোনো মেয়ে থাকতে পারবেনা, এই আমি বলে দিলাম”
সে তাঁর সেই ভুবনভোলানো হাসি হাসতে লাগলো, আমি আস্তে করে বললাম, এভাবে হাসবেন না প্লিজ। আমার অনিয়ন্ত্রিত হৃদকম্পনের শব্দ শুনে ফেলবেন তো!
“আমি তো সব শুনতে চাই রুমাইসা। আপনার মনের সবটা পড়তে চাই, জানতে চাই। এখনও বলবেন না ভালোবাসি?”
“Seni Seviyorum!”
“মানে?”
“বলেছি যা বলার। এখন খুঁজে বের করুন আমি ঘুমাই। গুড নাইট”
আরশান চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে রইলো। আর আমি ঘুমের দেশে হারিয়ে গেলাম। ইশ জীবনটা আজ স্বপ্নের মতোই সুন্দর!
_______
পরিশিষ্টঃ আম্মু আম্মু! তুমি আমার পেন্সিল বক্সটা ভেঙে ফেলেছ? তোমাকে নিয়ে আমি কি যে করি?
বাবা বাবা দেখো আম্মু আবার আমার জিনিস ভেঙে ফেলেছে।
আমি শাশুড়ি আম্মুর পেছনে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি কিছু করি নি তোমার বাবাই ভেঙেছে। মা দেখেছেন এই ঘরে কিছু ভাঙলেই আমার উপর দোষ আসে। আমি আর এই বাড়িতে থাকবোনা।
আরশান এসে বললো, কাউকে কোথাও যেতে দেওয়া হবেনা। আরজু বাবাই তোমাকে আরেকটা বক্স কিনে দেবো কেমন? মায়ের উপর এভাবে রাগ করেনা সোনা।
আরজু, বাবাই তোমার কথা তো ছাড়োই। আদর করে করে আম্মুকে একদম মাথায় চড়িয়েছ।
আমি—দেখেছো মা তোমার নাতনি কি ভাবে কথা বললো?
মা হেসে বললো, বাপের উপর গেছে তো সবকিছুতে বেশি যত্নশীল।
আমি গাল ফুলিয়ে রুমে চলে গেলাম। হুহ আমি যেন অযত্নশীল? কথা বলবো না আর কারো সঙ্গে।সে আমার পেটে হয়েছে নাকি আমি তার পেটে হু?
আরজু এসে আমার গালে পাপ্পি দিয়ে বললো, রাগ করেনা আম্মু, এখনো এমন দুষ্টুমি করলে চলে? যাও আর বকবোনা এবার তো হাসো না হয় কিন্তু কাতুকুতু দেবো।
আমি ফিক করে হেসে বললাম, রাগ করবোনা তবে একটা প্রমিজ করো কিছু বলবেনা?
–কোন বিষয়ে?
–আমি না ফ্রিজে রাখা বাকি আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছি।
আরজু আর আরশান একসঙ্গে কপাল চাপড়ে বললো, হায়রে বাচ্চা মেয়ে একটা!
(ওপস আমার কি দোষ?)
সমাপ্ত