‘ তোমায় যদি বিয়ের আগেই ডিভোর্স দিয়ে দেই তাহলে কি তুমি খুব বেশি কষ্ট পাবে, বর্ষা?’
ভরা রেস্টুরেন্টে বসে হবু বরের মুখে এমন কথা শুনে পুরোই আঁতকে উঠলো বর্ষা। চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ তাঁর। বর্ষা কিছুটা বিস্মিত কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ মানে?’
‘ মানেটা খুব সোজা বর্ষা! আমি চাই না আমাদের বিয়েটা হোক। আর আমার মনে হয় না আমাদের বিয়ের এক বছরও কমপ্লিট হওয়ার আগে আমাদের ডিভোর্স হবে না। তাই আমি চাই এই বিয়েটা না হোক।’
এবার সত্যি সত্যি বুকটা কেঁপে উঠল বর্ষার। ছোট বেলা থেকে যে ছেলেকে মনে প্রানে স্বামী হিসেবে মেনে এসেছে। নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছে সেই ছেলের মুখে এমন কথা শুনে ঠিক কেমন রিয়েকশন দেওয়া উচিত সত্যি ভুলে গেছে সে। কিছুটা হতাশা ভরা কন্ঠ নিয়ে বলে উঠল বর্ষা,
‘ আমি কি কারনটা জানতে পারি, শুভ্র?’
এবার শুভ্র খুব সিরিয়াসভাবেই বলে উঠল,
‘ আমার মনে হয় তোমার সাথে আমার যায় না। তোমার চুপচাপ থাকার স্বভাব, হাঁটা চলা, কথা বলার ধরন, একটুতেই ভয় পেয়ে যাওয়া কোনোকিছুই আমার ভালো লাগে না। তুমি তো জানো আমি এতদিন বিদেশে ছিলাম বিদেশি কালচারেই বড় হয়ে ওঠা আমার। সেখানে আমার বিজনেস, বাড়ি, কাজ-কর্ম সবকিছু বিয়ের পর হয়তো আমায় তোমায় নিয়ে সেখানেই থাকতে হবে। আর আমার মনে হয় না তুমি আমার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে।’
শুভ্রের কথা শুনে প্রায় স্তব্ধ বর্ষা। সে বুঝতে পারছে না এর প্রতি উওরে ঠিক কি বলা উচিত। তাঁর চুপচাপ থাকা স্বভাবটাই তবে বিচ্ছেদের কারন হলো। ছলছল চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো বর্ষা,
‘ কারনটা কি শুধু এতটুকুই নাকি অন্যকিছু আছে,শুভ্র?’
বর্ষার কথা শুনে বিস্ময়ের ছাপ এসে ভর করলো শুভ্রের মুখে। ভ্রু-কুচকে বললো সে,
‘ আর কি কারন থাকতে পারে।’
প্রতি উওরে বর্ষা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে উঠল,
‘ আপনি এই কথাগুলো বাড়ির সবাইকে কেন বলছেন না?’
‘ বলতে তো চাই বর্ষা কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে আমি কিছুই বলতে পারছি না। তুমি তো জানো তোমার আর আমার বাবা দুজন সেই ছোট বেলার বন্ধু আর সেই সুবাদেই তোমার আমার বিয়ের কথা সেই ছোট বেলা থেকে ঠিক করে রেখেছে সবাই। আমি এখন আমার বাবাকে কিছু বললেও বুঝতে চাইবে না। তাই আমি চাই আমার বাবার সাথে তুমি কথা বলো আর আমি তোমার বাবার সাথে। আইথিংক তুমি বললে আমার বাবা মেনে নিবে। দেখো বিয়েটা হলো দুটো মানুষের জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর আমি চাই না এই বিষয়টায় কোনো গাফিলতি হোক। এতে তোমার আমার দুজনের জীবনই নষ্ট হয়ে যাবে। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কি বলতে চাইছি।’
শুভ্রের কথা হতাশার নিশ্বাস ছাড়লো বর্ষা তারপর বললো,
‘ হুম বুঝতে পেরেছি আপনার আমাকে পছন্দ নয় এই তো।’
উওরে কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে বলে উঠল শুভ্র,
‘ আমার কথাটা খারাপভাবে নিও না বর্ষা, সবাইকে কি সবার ভালো লাগে বলো।’
কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো বর্ষা তারপর বললো,
‘ ঠিক আছে আপনি যা বললেন তাই হবে। আমি কথা বলবো আপনার বাবার সাথে।’
বর্ষার কথা মুচকি হাসলো শুভ্র তারপর বললো,
‘ থ্যাংক ইউ বর্ষা।’
উওরে মৃদু হাসলো বর্ষা। এমন সময় শুভ্রের ফোনটা বেজে উঠল। শুভ্র এক পলক বর্ষার দিকে তাকিয়ে তক্ষৎনাত ফোনটা তুলে বললো,
‘ হ্যালো মা!’
সঙ্গে সঙ্গে অপরপাশের চিন্তিত কন্ঠ নিয়ে হতভম্ব হয়ে বললো শুভ্রের মা,
‘ কোথায় তোরা তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। বর্ষা তো তোর সাথে তাই না?’
‘ হুম মা। কিন্তু কি হয়েছে তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?’
উওরে হতভম্ব হয়ে কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো শুভ্রের মা,
‘ তোর দাদুর যেন কি হয়েছে শুভ্র? তাড়াতাড়ি তোরা দুজন বাসায় আয় আমি কিছু বুঝতে পারছি না তোর বাবাও বাড়িতে নেই শুভ্র, তাড়াতাড়ি আয়।’
‘ তুমি টেনশন নিও মা আমি আর বর্ষা এক্ষুনি আসছি।’
‘ তাড়াতাড়ি আয় বাবা।’
‘ হুম আসছি।’
এতটুকু বলে ফোনটা কেটে উঠে দাঁড়ালো শুভ্র। শুভ্রকে দাঁড়াতে দেখে বর্ষাও চিন্তিত কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ কি হয়েছে?’
‘ দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছে বর্ষা তোমায় আর আমায় এক্ষুনি যেতে হবে।’
‘ কি হয়েছে দাদুর?’
‘ তা তো জানি মা বললো তাড়াতাড়ি তোমায় আমায় যেতে।’
‘ ঠিক আছে চলুন তাড়াতাড়ি।’
‘ হুম চলো।’
এতটুকু বলে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো বর্ষা আর শুভ্র।’
____
হতভম্ব হয়ে শাড়ির কুঁচি ধরে একপ্রকার দৌড়ে শুভ্রদের বাড়ি ঢুকলো বর্ষা আর তাঁর পিছনে শুভ্র। বর্ষা দৌড়ে দাদুর রুমের দিকে গিয়ে হতভম্ব কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ কি হয়েছে দাদুর?’
বিছানায় শুয়ে ছিল শুভ্রের দাদু। আর তাঁকে ঘিরে ধরে চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রের বাবা মা, বর্ষার বাবা মা সাথে আরো কিছু লোকজন। বর্ষার ভয়েস শুনে সবাই তাকালো বর্ষার দিকে। তক্ষৎনাত বর্ষার মা এগিয়ে এসে বললো,
‘ তোরা চলে এসেছিস, হুট করেই বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে তোদের দাদু, ডাক্তারও এসেছিল বললো মিনিস্টক করেছি নাকি।’
‘ কি বলো মা?’
এতটুকু বলে দৌড়ে চলে যায় বর্ষা দাদুর কাছে তারপর চিন্তিত গলা নিয়ে বললো,
‘ তুমি ঠিক আছো দাদু?’
উওরে মৃদু হেঁসে বুকে হাত রেখেই বলে উঠল শুভ্রের দাদু,
‘ হুম আমি ঠিক আছি।’
দাদুর কথা শুনে অভিমানী স্বরে বললো বর্ষা,
‘ তুমি এমন কেন দাদু একটুও নিজের যত্ন নেও না।’
বলতে বলতে কেঁদে ফেললো বর্ষা। বর্ষার কান্না দেখে শুভ্রের দাদু ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
‘ তুই কাঁদছিস কেন পাগলী আমি ঠিক আছি।’
উওরে ছলছল চোখে তাকালো শুধু বর্ষা দাদুর মুখ পানে।’
অন্যদিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্র একবার দাদু তো একবার বর্ষার দিকে তাকাচ্ছে। শুভ্র বুঝে না এই মেয়েটা একটুতেই এত ইমোশনাল হয়ে যায় কেন? বিরক্ত লাগে শুভ্রর। ছোট বেলা থেকেই তেমন একটা পছন্দ করে না শুভ্র বর্ষাকে কেন করে না এটা সে নিজেও জানে না। শুধু এতটুকুই জানে তাঁর পছন্দ নয় বর্ষা নামক মেয়েটিকে। শুভ্রের বাবা আর বর্ষার বাবা হলো ছোট বেলার বন্ধু একসাথে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি শেষ করেছে তাঁরা। আর তখন থেকেই তাঁরা ঠিক করে রাখে তাদের ছেলেমেয়ে হলে বিয়ে দিয়ে তাদের বন্ধুত্বটাকে আরো গভীর করবে। আর সেই জন্য শুভ্র আর বর্ষার বিয়ে দেওয়া। আগামী একমাসের মধ্যে তাঁরা ভেবে রেখেছে শুভ্র দেশে ফিরলেই ওদের বিয়েটা দিয়ে দিবে। ছোট বেলা থেকেই শুভ্র বর্ষা জানতো তাদের বিয়ে হবে। যদিও তখন বিয়ে নামক জিনিসটা আসলে কি বুঝতো না তাঁরা কেউ। শুভ্র কখনোই চায় নি তাঁর সাথে বর্ষার বিয়ে হোক। এই জন্যই দেশে আসতে চাই নি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাঁকে দেশে আসতে হয়েছে। কিন্তু শুভ্র ভেবে রেখে দরকার পড়লে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যাবে সে তারপরও বর্ষাকে বিয়ে করবে না। হঠাৎই শুভ্রের ভাবনার মাঝখানে শুভ্রের দাদু বলে উঠল,
‘ দাদুভাই তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন এদিকে আসো?’
উওরে শুভ্রও বেশি কিছু না বলে চুপচাপ এগিয়ে গেল দাদুর দিকে। শুভ্রকে নিজের দিকে আসতে দেখে চোখের ইশারায় শুভ্রকে পাশে বসতে বললেন দাদু। শুভ্রও বেশি কিছু না ভেবে চুপচাপ বসে পড়লো পাশে। তারপর দাদুভাই শুভ্র আর বর্ষার হাত ধরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘ দেখো আমার তো বয়স হয়েছে কখন মরে যাই তাঁর ঠিক নেই।’
দাদুর কথা শুনে বর্ষা কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো,
‘ দাদু তুমি এগুলো কি বলছো?’
‘ আমি যা বলছি ঠিক বলছি বর্ষা দেখো আজ হোক বা কাল আমায় তো যেতেই হবে তোমাদের দাদির কাছে। আমার জীবনের শেষ মুহূর্তের একটা ইচ্ছে হলো তোমার আর শুভ্রের বিয়েটা দেখা। তাই আমি চাই তোমরা খুব শীঘ্রই বিয়েটা করে ফেলো।’
দাদুর কথা শুনে শুভ্রের বাবা বলে উঠল,
‘ হুম বাবা তুমি সুস্থ হলেই বিয়েটা করিয়ে দিবো আর এমনিতেও আগামী মাসে ওদের বিয়ের তারিখ ঠিক করে নিবো তা তো জানোই।’
উওরে দাদু কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বলে উঠল,
‘ তোমরা বুঝতে পারছো না। আমি বেশিদিন থাকবো না তোমাদের সাথে তাই আমি চাই আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে ওদের বিয়েটা দিতে।’
দাদুর কথা শুনে বর্ষা শুভ্র দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকালো একে অপরের দিকে। বর্ষা দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ দাদু?’
উওরে বর্ষার কথার মাঝেই বলে উঠলেন দাদু,
‘ তোমার কথা পরে শুনবো এখন আমায় বলতে দেও আগে।’
এতটুকু বর্ষাকে বলে আবারো বলে উঠল শুভ্রের দাদু,
‘ তোমরা কি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।’
উওরে বর্ষার বাবা আর শুভ্রের বাবা দুজন কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বলে উঠল,
‘ ঠিক আছে আপনি যা চাইবেন তাই হবে।’
উওরে মুচকি হাসলো শুভ্রের দাদু। আর বর্ষা শুভ্র দুজনেই প্রায় হতাশ হয়ে তাকিয়ে রইলো এঁকে অপরের দিকে। আর শুভ্র তো মনে মনে ভেবেই নিয়েছে,
‘ বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে যাবে তারপরও বর্ষাকে বিয়ে করবে না সে।’
#চলবে….
#ধূসর_শ্রাবণ💚
#লেখিকা:#তানজিল_মীম💚
#সূচনা_পর্ব
[আসসালামু আলাইকুম গাইস। অনেকদিন পর তোমাদের মাঝে হাজির হলাম নতুন গল্প নিয়ে। আশা করি তোমাদের ভালো লাগবে তোমাদের ভালো লাগলেই নেক্সট পার্ট দিবো।প্রথম পর্ব তাই ছোট করে দিলাম ইনশাআল্লাহ নেক্সট পার্ট বড় করে দিবো]
#TanjiL_Mim♥️