ধূসর_রঙে_আকাশ #পর্ব_১

0
333

জুসের বোতলে চুমুক দিতে গিয়ে লিপস্টিক লেপ্টে ফেলেছে রিম্মি। প্রায়ই এমন হয়। তবুও জুস খাওয়ার নেশা ছাড়তে পারে না। এখন কি হবে? আশেপাশে একবার তাকালো সে। সামনেই একটা কালো রঙের দারুণ চকচকে গাড়ি। গাড়িটির কালো গ্লাস ঝিলিক দিচ্ছে। সেখানে রিম্মির সুন্দর মুখটা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। রিম্মি ঝটপট ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ঠোঁটটা মুছল। তারপর সেই একই রঙের লিপস্টিক বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে নিল। কিছুটা রঙ দাঁতে লেগে গেছে। রিম্মি মুখ হা করে দাঁতের উপর লেগে থাকা রঙটা মুছে নেয়। তারপর হাত উঠিয়ে গ্লাসের দিকে একটা ফ্লায়িং কিস ছোড়ে। নীলাভ্র গাড়ির ভিতরে বসে এতোক্ষণ চুপ করে সব দেখছিল। কিন্তু ফ্লায়িং কিস পাওয়ার পর আর চুপ থাকতে পারল না সে। আস্তে করে গাড়ির কাঁচটা নামিয়ে দিল। হঠাৎ অচেনা আগন্তুকের চেহারা দেখে রিম্মি ভয় পেয়ে যায়। সাথে সাথেই মুখটা অস্বস্তিতে ভরে উঠে। হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রিম্মি। চেহারা আতঙ্কে জড়োসড়ো। নীলাভ্র মুচকি হেসে বলল,
” হাই, ভালো আছেন?”
নীলাভ্রর সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহারে রিম্মি যেন আরো ভড়কে যায়। সেকেন্ডের মধ্যে দৌড় পালায়। নীলাভ্র জানালা থেকে মাথা বের করে বলল,
” আরে শুনুন, যাচ্ছেন কোথায়?”
রিম্মি একবার পেছন ফিরে তাকালো।
নীলাভ্র গাড়ির দরজায় আঘাত করে বলল,” নাম কি আপনার?”
মেয়েটা চোখ বড় করে আরও জোরে দৌড় দিল। ওর গায়ে ছিল চকলেট কালার লেদারের জ্যাকেট আর জিন্স।এলোমেলো সোজা চুলগুলো পিঠে ছড়ানো অবস্থায় ডানে-বামে তরঙ্গের মতো দুলছিল, যখন মেয়েটি দৌড়াচ্ছিল। তার দৌড়ানো দেখে মনে হলো যেন সে চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে। এখন প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছে।
নীলাভ্র হেসে উচ্চারণ করল,” অদ্ভুত তো!”
সে ভয় পাওয়ার মতো কি এমন বলল যে মেয়েটা এইভাবে পালিয়ে গেল? কিন্তু তার কাছে ব্যাপারটা ভীষণ মজা লেগেছে। বড় বড় চোখের ভোলাভালা দৃষ্টি। মায়াবী মুখে একঝাঁক আতঙ্ক। ফ্লায়িং কিস দেওয়ার স্টাইলটাও দারুণ ছিল। নীলাভ্র হাসতে হাসতে গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে। হাসি আর থামে না!

তোহা রিকশায় বসে ঘামছে। প্রত্যেকদিন রেল লাইনের এই জায়গাটায় এসে সিগন্যাল পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে হয়। কেউ চাইলে রিকশা থেকে নেমে অন্য পাড়ে গিয়ে আরেকটা রিকশা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে রিকশা ভাড়া অর্ধেক দিতে হবে। এই যেমন, রিকশা ভাড়া যদি হয় বিশটাকা। তাহলে এই পাড়ে নামলে রিকশাওয়ালাকে দিতে হবে দশটাকা। ওই পাড়ে গিয়ে দিতে হবে আরও দশটাকা। মাত্র পাঁচমিনিটের কাজ। কিন্তু এই পাঁচমিনিটের কাজটুকুও আলসেমিতে করতে ইচ্ছে করেনা তোহার। তার চেয়ে আধঘণ্টা সিগন্যালে দাড়িয়ে থাকাও সহজ মনে হয়। তবে আজ বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আজকে মা-বাবার অ্যানিভার্সেরি বলে কথা।গিফট কিনতে হবে, নিজহাতে রান্না করতে হবে, সারপ্রাইজ প্ল্যান বানাতে হবে। কত কাজ! তোহা রিকশাটা ছেড়ে দিল। ওই পাড়ে গিয়ে অন্য রিকশা নেওয়ার উদ্দেশ্যে কাধে ব্যাগ নিয়ে রেললাইন ক্রস করছিল। তখনি বিকট শব্দে হর্ণ বেজে উঠল। রেলগাড়ি আসছে। তোহা আর ওই পাড়ে যেতে পারল না। দাঁড়িয়ে গেল। কাছ থেকে রেলগাড়ির ছুটে চলা দেখতে খুব ভয়ংকর লাগে। আর শব্দটাও কি তীক্ষ্ণ! মাথা ধরে যায়। তোহা কান চেপে ধরল। তারপর দ্রুত হাটতে লাগল। রেলগাড়ি চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব না। তাই সে নিজেই ট্রেনের বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করল। যেন জলদি রাস্তা পেরোতে পারে। তোহা চোখ বন্ধ করে হাঁটছিল৷ হঠাৎ কারো কান্নার গুনগুন শব্দে চোখ মেলে তাকালো সে। বেশ দূরে একটা ছেলে কানে হাত রেখে হু হু করে কাঁদছে। মুখের অবস্থা বিকৃত। রক্তে ভেসে গেছে সবুজ গেঞ্জি। দুটো হাতই লাল রক্তে রঙিন। তোহা আঁতকে উঠল। বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেল। চারদিকে মানুষ জড়ো হয়েছে। বুকের অবাধ্য নিষঙ্গতা নিয়ে তোহা ধীরপায়ে কিছুটা এগিয়ে গেল। ঘটনা কি বোঝার জন্য। ছেলেটা রেললাইনের পাশে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। পিছনে প্রকান্ড ভীড়। মানুষ জন তোহার মতোই অবাক হয়ে দেখছে। উড়ো কথা ভেসে এলো,
” বেয়াদবি করসিল.. দিসে কান কাইট্টা!”
কথাটা তোহার কানে ঝংকার তুলল। ছেলেটার কান কেটে দেওয়া হয়েছে? তোহা আর তাকানোর সাহস পেল না রক্তাক্ত ছেলেটির দিকে। কানহীন একজন মানুষ দেখতে কতটা ভয়ানক হয়? তোহার শরীর শিউরে উঠছে। ছেলেটাকে চার-পাঁচজন মিলে রিকশায় তুলল। বেচারা এমনভাবে কাঁদছে যেন সে কান্না করাটাও ভুলে গেছে। শুধু অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। কে যেন বলল,” কান কি জোড়া লাগানো যায় না?”
তোহা প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালো না। প্রশ্নটা তাকে করাও হয়নি। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে রিকশাওয়ালাকে বলল,” যান চাচা, যান।”
তোহা হাতের ব্যাগটা খামচে ধরে সাহস করে ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। ভয়ে নিঃশ্বাস আটকে রাখে। তখনি দেখতে পায় চেয়ারে একটা ছেলে আয়েশ করে বসে আছে। তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে অসংখ্য মাথা। ছেলেটির চোখে কালো সানগ্লাস। ঘাড়টা একটু বাঁকানো। ঠোঁটে সিগারেট। দুইহাতে কালো পিস্তল ঠিক করায় মনোযোগী সে। ভ্রুদ্বয় কুচকানো।তোহা জীবনে প্রথমবার বাস্তব পিস্তল দেখছে। তার মনে হচ্ছে সে কোনো দুঃস্বপ্নে আছে। ছোট্ট আত্মাটার পানি শুকিয়ে যায় তোহার। ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়। কালো শার্ট পড়া ছেলেটির চোখমুখ ভয়ংকর শক্ত। ছেলেটা এতোই ফরসা যে গলার সবুজ শিরা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গাছের শিকড়ের মতো। দেখতে ভয় লাগে। সেই গলায় আবার সাদা সুতা দিয়ে ব্লেড আটকানো। এইটা দেখে তোহার কপাল গড়িয়ে এক বিন্দু ঘাম চোখের পাতায় এসে ঠেকল। তোহা চোখ বন্ধ করে নিল। তার মাথার শিরা দপদপ করছে লাফাচ্ছে। মস্তিষ্ক ছুটোছুটি করছে। বন্ধ চোখেও ভয়ংকর দৃশ্যটি ছুটন্ত মস্তিষ্কে ধরা দেয়। টাটকা ফরসা রঙের ছেলেটির ঠোঁটে রক্তহিম করা হাসি। গলায় আটকে থাকা ব্লেড টেনে খুলল সে। তারপর সবুজ গেঞ্জি পড়া ছেলেটির কান চিরিত চিরিত করে কাটতে লাগল। ছেলেটা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে। তোহাও হালকা চেচিয়ে উঠল। রাস্তার সব মানুষ ওর দিকে তাকায়। তোহা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাতেই আবার তার দৃষ্টি স্থির হয় চেয়ারে বসা মানুষটির দিকে। সে আগের ভঙ্গিতেই বসে আছে। তোহা দ্রুতগতিতে হেটে যায়। একটা জীবন্ত মানুষের কান কেউ এইভাবে কেটে দিতে পারে? এই লোক কি কসাইয়ের বংশধর? তোহার বারবার হ্যালুসিলেশন হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার কানটাই কেউ কেটে দিয়েছে। তোহা ডান কানে হাত রাখল। তারপর বামকানও চেপে ধরল। দুইটা কানেই ব্যথা লাগছে। তোহা অবাক হয়ে অনুভব করল তার কান দুটি সত্যি ব্যথা করছে, জ্বলছে। আর জীবনেও এই রাস্তায় আসবে না সে। কোনোমতে পা চালিয়ে হেঁটে গেল। আজকের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা সে সহজে ভুলতে পারবে না।

নীলাভ্র গুনগুন করতে করতে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। জুতা দুইটা কোনোমতে খুলে ড্রয়িং রুমের ফ্যান ছেড়ে দেয়। আয়েশী ভঙ্গিতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফায় বসল। তারপর ক্লান্ত গলায় তিলোত্তমাকে ডাকল,
” ভাবী, ও ভাবী!”
তিলোত্তমা ডাইনিং রুম পেরিয়ে ড্রয়িংরুমে ছুটে আসে। নীলাভ্রর খালি হাত দেখে বলে,
” কি ব্যাপার দেবরমশাই? তোমাকে না বলেছিলাম ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে সুপার শপে নেমে আমাকে ফোন দিতে?”
” সুপার শপে কেন?”
” পেঁয়াজ লাগবে পেঁয়াজ। ঘরে একটাও পেঁয়াজও নেই। এখন দুপুরের রান্নাটা হবে কিভাবে শুনি?”
” ওহ, সরি। ভাইয়াকে দিয়ে আনাও ভাবী। আমি ভুলে গেছিলাম।”
” তোমার ভাই? তাকে তো দুপুরে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলেও ছ্যাত করে উঠে। এখন যদি বলি বাসায় পেঁয়াজ নেই তাহলে কুরুক্ষেত্রম শুরু হবে।”
নীলাভ্র উঠে দাড়িয়ে বলল,
” থাক, থাক৷ আমিই পাশের বাজাররে গিয়ে নিয়ে আসছি। ভাইয়াকে বলার দরকার নেই।”
” দাঁড়াও, বাজারের ব্যাগ দেই।”
” দাও।”
তিলোত্তমা নিজের বেডরুমে গেল। নীলাভ্র পানি খাওয়ার উদ্দেশ্য ডাইনিং রুমে ঢুকতে যাবে তখনি চমকে উঠল। ডাইনিং রুমে সেই ফ্লায়িং কিসওয়ালা মেয়েটি বসে আছে। ওর এক হাতে মোবাইল আরেক হাতে জুসের গ্লাস। নীলাভ্রর পিলে চমকে উঠল। নখ কামড়ে কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল সে। তারপর বলে উঠল,
” হাই, আপনি তো সেই ফ্লায়িং কিস, না?”
মেয়েটা নীলাভ্রর দিকে তাকালো। সাথে সাথে ভয় পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাড়াল। নীলাভ্র হেসে বলল,
” আরে ভয়ের কিছু নেই, বসুন।”
নীলাভ্র মেয়েটার কাছে এগিয়ে আসল। হাসিমুখে আবারও বলল,” আমি নীলাভ্র পাটোয়ারী। আপনার নাম কি?”
নীলাভ্র হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েটা ভয়ে নড়াচড়া করল কিছুক্ষণ। অদ্ভুত চোখে আশেপাশে তাকালো। কোনো শব্দ করল না। তারপর হঠাৎ নীলাভ্রর হাতটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেল। সামনের রুমে গিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল। নীলাভ্র এমন আচরণে বোকা বনে গেল। মেয়ে এমন কেন করল? আচ্ছা, ফ্লায়িং কিস বলায় মাইন্ড করেনি তো? তিলোত্তমা নীলাভ্রর কাধে হাত রেখে বলল,
” নাও দেবরমশাই। দুইকেজি পেঁয়াজ আনবে। সস্তা পেলে পাঁচকেজি নিয়ে এসো। আচ্ছা তুমি তো আবার দামাদামি করতে পারো না। থাক সমস্যা নেই, পাঁচকেজি লাগবে না। দুইকেজিই আনো। এখন যেহেতু লাগবেই।”
নীলাভ্র ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” ভাবী,মেয়েটা কে?”
তিলোত্তমা অবাক হয়ে বলল,” কোন মেয়ে?”
” একটু আগেই ডাইনিং টেবিলে বসেছিল। গায়ে চকলেটি কালার জ্যাকেট। লম্বা লম্বা চুল।”
তিলোত্তমা হেসে বলল,” ও আচ্ছা রিম্মির কথা বলছো? ও আমার ছোটবোন।”
নীলাভ্র তুমুল বিস্ময়ে বলল,” কি? আমি তো জানি ভাইয়ার কোনো শালি নেই৷ তাহলে এইটা আবার কোথ থেকে?”
” আসলে আপন বোন না। আমার মামার মেয়ে ও। পাঁচবছর পর অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। এখানে বেড়াতে এনেছি ওকে।”
” ওহ, কিন্তু বিদেশী মেয়ের আচরণ এতো আজব কেন?
” কি করেছে?”
” বাঙালী মেয়েদের মতো লজ্জা পায়। আমি একটু কথা বলতে এসেছিলাম। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়ালাম, সে উত্তর তো দিলোই না উলটা আমার হাতে ধাক্কা মেরে দৌড়ে চলে গেল। ওই ঘরে দরজা আটকে বসে আছে। অদ্ভুত! আমি কি ওকে খেয়ে ফেলবো?”
” আচ্ছা বাদ দাও। ওর সাথে বেশি কথা বলার দরকার নেই।”
” কেনো? ”
” কারণ ও তোমার কথা বুঝবেই না।”
” তোমার বোন কি বাংলা জানে না নাকি? ছি ভাবী! আচ্ছা অস্ট্রেলিয়ায় ছিল ভালো কথা। তাই বলে নিজের মাতৃভাষাটাও শিখবে না? এটা তো অন্যায়। বাংলাদেশে কেন এসেছে তাহলে?”
” নীল, শুধু বাংলা কেন? ইংলিশ,উর্দু, ফারসি, যা ইচ্ছা ট্রাই করো। ও কিছুই বুঝবে না।”
নীলাভ্র হাত ভাজ করে বলল,
” তাহলে কি বুঝবে? উগান্ডার ভাষা?”
” না নীল। সাংকেতিক ভাষা লাগবে।”
নীলাভ্র ভ্রু কুচকে বলল,” কিহ?”
” আসলে ওর ছোটবেলায় অনেক বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। তারপর থেকে বোবা। কানে শুনতেও পায়না, মুখে কিছু বলতেও পারেনা। তাই ওর সাথে কথা বলতে গেলে ইশারায় বলতে হয়। এটাকে বলে সাংকেতি ভাষা। তুমি তো আর সাংকেতিক ভাষা জানো না। তাই ওর সাথে তোমার কথা না বলাই ভালো। ও আবার একটু ভীতু টাইপ। হয়তো তুমি কিছু একটা বলবে, ও ভাববে তুমি ওকে বকছো। তারপর ভয়ে পালিয়ে যাবে।”
হতভম্ব নীলাভ্রর হাতের ভাজ খুলে গেল বিস্ময়ে। সে আর কিছুই বলতে পারল না। এতো মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে বাক প্রতিবন্ধী? কানেও শুনতে পায়না, আবার মুখেও কিছু বলতে পারে না! ভাবতেই কষ্ট লাগে! নীলাভ্রর বুকের বামপাশটা তীব্র ব্যথায় ছেয়ে গেল।

তোহা চপিং বোর্ডে সবজি কাটছে। খুব ধীরে ধীরে। তার হাতের আঙুল কাঁপছে। ছুরিটাও ঠিকমতো ধরে রাখা যাচ্ছে না। বাসায় তোহা আর পূরবী ছাড়া কেউ নেই। মা-বাবা একসাথে লাঞ্চ ডেইটে গেছে। ফিরবে সন্ধ্যায়। এর মধ্যেই তোহা পূরবীকে নিয়ে সারপ্রাইজের সব ব্যবস্থা করে ফেলবে। ঘড়িতে বিকাল চারটা বাজে। হাতে সময় মাত্র দুইঘণ্টা৷ এখনো কোনো কাজ শেষ হয়নি। তোহা ফ্যানের নিচে দাড়িয়েও ঘামছে। যেদিকেই তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে রক্ত আর রক্ত। ভয়ে হাত-পা শিথিল হওয়ার উপক্রম। পূরবী তোহার অবস্থা দেখে ওকে এক হাতে ধাক্কা মারল। তোহা ভয়ে চমকে উঠল। মুখ দিয়ে শব্দ করল,
” আহ!”
পূরবী হাসতে শুরু করল। তোহা কপালের ঘাম মুছে বিরক্ত গলায় বলল,
” কি সমস্যা তোর?”
পূরবী হাসতে হাসতে বলল,” আগে তোর নিজের সমস্যা বল। এভাবে কাঁপছিস কেন? তখন থেকে কি জানি ভাবছিস আর ভাবছিস। কাজ তো করছিসই না, আরও বাড়াচ্ছিস। টেবিলের ওয়ালমেটটাকেও ছুরির আঘাতে নষ্ট করে ফেলছিস।”
তোহা সঙ্গে সঙ্গে টেবিলে তাকালো।ওয়ালমেটে অনেকগুলো ছুরির আঁচড়। তোহা অবাক হয়ে বলল,
” এমা, এসব কিভাবে হলো?”
” অন্যদিকে তাকিয়ে কাজ করলে তো এমন হবেই। আচ্ছা তুই কি চিন্তা করছিলি?”
তোহা মুখে মালিশ করে বলল,” কিছু না।”
পূরবী তোহার সামনে এসে দাড়াল। চোখ ছোট করে দৃঢ় গলায় বলল,” বল।”
তোহা চলে যেতে নিল। পূরবী ওর হাত ধরে ধমকের গলায় বলল,” বলবি না?”
তোহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসল। পূরবীও ওর সামনে বসল। তোহা কলেজ থেকে ফেরার পথে যা দেখেছিল সব পূরবীকে বলল। সবকিছু শোনার পর পূরবী শিহরিত গলায় উচ্চারণ করল,
” রগ কাটা শাহ!”
” মানে?”
” তুই যাকে দেখেছিস সে খুব বিখ্যাত সন্ত্রাসী। নাম রগ কাটা শাহ। পুরা নাম মনে নেই। আমি এই লোকাল নামটাই জানি। মানুষ এই নামে তাকে চেনে। আসলে সে মানুষের রগ কেটে বেড়ায়। আমি পেপারে এটা নিয়ে অনেক বড় একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। কিছুদিন আগে ফেসবুক পেইজও দেখেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কি জানিস? ছেলেটাকে দেখতে পুরো রাজপুত্রের মতো। এতো ইনোসেন্ট চেহারা! তুই ছবি দেখলে ক্রাশ খেয়ে যাবি। এতো ইনোসেন্ট মুখ নিয়ে এসব সাংঘাতিক কাজ করে কিভাবে আল্লাহ মা’বুদ জানে।”
তোহা ভীত গলায় বলল,” আমি তো রগ কাটতে দেখিনি। কান কাটতে দেখেছি। তারপর থেকে আমার দুইকানে ব্যথা করছে। আর এখন তোর কাছে রগ কাটার কথা শুনে আমার রগেও ব্যথা লাগছে।”
পূরবী হেসে বলল,” ধ্যাত পাগল। কান কেটেছে ওই বেটার। তোর ব্যথা লাগবে কেন?”
” জানিনা। আচ্ছা ওই রগ কাটা শাহ এতো নিষ্ঠুর কেন? আমার না এখন আব্বু-আম্মুর জন্য ভয় লাগছে। ওরা তো বাহিরে আছে। যদি ওদেরকে মেরে ফেলে?”
” একটা থাপ্পড় দিবো এসব আলতু-ফালতু কথা বললে। বলদি নাকি তুই? আন্টি-আঙ্কেল ওর কি ক্ষতি করেছে যে মারবে?”
” ও হ্যা তাইতো। আচ্ছা, এই মাস্তানটা মানুষের এতো ক্ষতি করে। তাহলে ওকে পুলিশ ধরে না কেন?”
” ধরে তো। প্রায়ই ধরে। বছরের অর্ধেক সময়ই তো সে জেলে কাটায়। কিন্তু বেশিদিন ওকে আটকে রাখা যায়না। কোনো না কোনো ভাবে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। তারপর আবার যেই লাউ সেই কদু।”
” জেল থেকে ছাড়া পেয়েও আবার মাস্তানি করে?”
” হুম।”
” একে র‍্যাবের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ। ক্রসফায়ারে মরুক।”
পূরবী মুখে হাত দিয়ে হাসতে লাগল। তখনি কলিংবেল বেজে উঠল। তোহা আঁতকে উঠল। পূরবী দরজা খোলার জন্য উঠে দাড়াতেই তোহা ওর হাত ধরে বলল,
” খুলিস না প্লিজ।”
” কেন?”
” যদি রগ কাটা শাহ আসে?”
পূরবী বিরক্ত হয়ে বলল,” ধুর,ওই লোক কেন আসবে? তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি।”
তোহা ভয়ে চেয়ারে গুটিশুটি হয়ে বসে রইল। পূরবী দরজা খুলতেই দেখল নীলাভ্র এসেছে। পূরবীর মুখে হাসি ফুটল। কপালের চুল গুলো কানে গুজে পূরবী লজ্জারাঙা মুখে বলল,
” হাই, কেমন আছো নীল?”
নীলাভ্র কড়াচোখে তাকাতেই পূরবী বলল,
” ভাইয়া, কেমন আছো?”
নীলাভ্র এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তোহার সামনে এসে দাড়াল। তোহার মনে প্রশান্তি ফিরেছে নীলাভ্রকে দেখে। তোহা মৃদু হেসে বলল,
” নীল ভাইয়া তুমি?”
নীলাভ্র কাটছাট গলায় বলল,” তোর কাছে সাংকেতিক ভাষা শেখার বই আছে?”
” কেন?”
” একটু লাগবে।”
তোহা চেয়ার থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল,” আব্বুর বইয়ের আলমারিতে দেখতে হবে। থাকতেও পারে।”
নীলাভ্র শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
” যা তো, দেখ গিয়ে। আমি বসছি।”
নীলাভ্র চেয়ারে বসল। তোহা বলল,
” তুমি কি করবে বই দিয়ে?”
” সাংকেতিক ভাষা শিখবো।”
” কেন?”
” কেন আবার? কথা বলার জন্য!”
” সাংকেতিক ভাষায় কেন কথা বলতে হবে? তুমি কি মুখ দিয়ে কথা বলতে পারো না?”
” আমি পারি। কিন্তু আমার মতো সবাই পারে না। তাই সাংকেতিক ভাষা শেখা দরকার। দেরি করিস না, যা তো। দেখ বই আছে কিনা। নাহলে আমাকে আবার নীলক্ষেত যেতে হবে।”
” আচ্ছা যাচ্ছি।”
তোহা তার বাবার ঘরে চলে গেল। পূরবী নীলাভ্রর পাশে বসে গালে হাত রেখে কোমল গলায় বলল,
” চা দেই?”
নীলাভ্র আড়চোখে তাকিয়ে বলল,” আমি যেন তেন চা খাই না।”
” ইশশ কি ভাব! সাংকেতিক ভাষা শিখে কার সাথে কথা বলবে?”
” তোর কি? তুই নিজের কাজ কর। যাহ!”
পূরবী একটা মুখ ঝামটা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। তোহা একটা মিডিয়াম সাইজের বই এনে বলল,
” ধুলা আছে অনেক। ঝেড়ে নিও। আমার মনে হয় এটাই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের বই। কিন্তু ইংরেজি ভার্সন।”
নীলাভ্র বইটা নিয়ে এপিঠ-ওপিঠ দেখল। তারপর হেসে বলল,
” থ্যাংকস। ”
তোহা বলল,” ওয়েলকাম।”
নীলাভ্র বই নিয়ে চলে গেল। কিন্তু দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে রেখে গেল। তোহা দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। জোরে শব্দ হল। পূরবী ভয় পেয়ে বলল,
” ওরে বাবা। এটা কি হলো? এতো জোরে কেউ দরজা বন্ধ করে?”
তোহা দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,” আমার ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে এখনি রগ কাটা শাহ চলে আসবে।”
পূরবী একটু মজা নেওয়ার জন্য বলল,” আচ্ছা তোহা, মনে কর ওই রগ কাটা শাহের সাথে তোর বিয়ে হয়ে গেল। তখন কি করবি?”
তোহা একথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেল। টেবিল থেকে ছুরিটা নিয়ে কিড়মিড় করে বলল,
” পূরবীর বাচ্চা, এখন আমি তোর রগ কাটবো।”
পূরবী খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। কে জানতো?ওর দুষ্টমীর ছলে বলা কথাটাই একদিন চরম সত্যি হবে!

চলবে

#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১
লিখা: Sidratul Muntaz

( সবাই কিন্তু কমেন্ট করবেন।🤨)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here