ধূসর পাহাড়,পর্ব_২৪ (সমাপ্তি পর্ব)
লেখিকা আমিশা নূর
তখনি অরণ্যের ঘুমটা ভেঙে গেলো।বালিশের নিচ থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলো দুটো বাজছে।তিনটায় কুয়াশার সাথে দেখা করার কথা মাথায় আসতেই তাড়াতাড়ি উঠে বসলো।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখলো বিছানায় কালো শার্ট আর পেন্ট রাখা।ভ্রু কুচকে অরণ্য শার্টটা হাতে নিলো।এর সাথে ছোট একটি চিরকুট লাগানো আছে।যাতে লিখা “বাইরে যাওয়ার সময় এই শার্ট পড়বেন।” অরণ্যের বুঝতে বাকি রইলো না এই কাজ কার।রেগে গিয়ে অরণ্য আলমারি’র কাছে গেলো।সেখানে আরো একটি চিরকুট লাগানো আছে।যাতে লিখা,”কুয়াশার পছন্দের কালার কালো!”অরণ্যের মনে পড়ে গেলো সত্যিই তো কুয়াশার পছন্দের রং কালো।অনেক দিন দেখা হয়নি আর কালো ড্রেসে দেখলে নিশ্চয়ই খুশি হবে।বাকি আর না ভেবে অরণ্য রেডি হয়ে গেলো।
অরণ্য বেরিয়ে যেতেই প্রকৃতি সীয়ামার রুমে গেলো।রুমে গিয়ে দেখলো সীয়ামা মেডিসিন নিচ্ছে।
“সীয়ামা কীসের ঔষধ নিচ্ছো এগুলা।দেখি আমি…”
“না..নাহ।আমার মাথাব্যথা করছিলো তাই…”
“কিন্তু এইটা তো মাথাব্যথা’র ঔষধ না সীয়ামা।দেখি দাও আমাকে..”
সীয়ামার থেকে জোর করে ঔষুধ’টা নিয়ে দেখলো পাতা’টা পুরা সাদা।কোনো নাম নেই দেখে প্রকৃতি অবাক হলো।ওষুধের ঘ্রাণ নিয়ে প্রকৃতি নাক চিটকালো।কারণ এটি অনেকটা চেনা চেনা।ড্রাগসের মতো।কিছু কিছু ড্রাগসকে এভাবে বিক্রি করা হয়।
“সীয়ামা এটি ড্রাগস?”
“আ…আআআ না”
“মিথ্যা বলবে না আমি ভালোই বুঝেছি এইটা ড্রাগস।কেনো নিচ্ছো এসব?”
“কী করবো তাহলে আমি?রৌদ্রময়কে ভূলতে একমাত্র রাস্তা এইটা।”
“সীয়ামা কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ!আর কতো কষ্ট পাবে?তুমি একবার ভেবে দেখেছো তোমার দাদা জানতে পারলে কী করবে?”
“আমি কিচ্ছু জানি না।রৌদ্রময়’কে ছাড়া বাঁচবো না আমি।ও কী করে থাকছে আমাকে ছাড়া?”
এটুকু বলেই সীয়ামা কেঁদে দিলো।প্রকৃতি সীয়ামা’কে জড়িয়ে ধরে বললো,”সীয়ামা একবারও কুয়াশার কথা ভেবেছো?ও কী করবে যখন সব কথা জানতে পারবে?আজ মনে হয় অরণ্য সব কিছু বলে দিবে কিন্তু কুয়াশা?কী করে বেঁচে থাকবে?”
প্রকৃতির কথা শুনে সীয়ামা কিছুটা শান্ত হলো।কী থেকে কী হয়ে গেলো?রৌদ্রময় সীয়ামার সাথে সব সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে অন্যদেশে চলে গেলো।অধ্রী নিজেও চলে গেলো।শুধু মাত্র একটা দিন সবার জীবনে অভিশাপ হয়ে এসেছিলো।
২৮.
অরণ্য ধূসর-পাহাড়ে এসে থমকে গেলো।স্বপ্নে দেখা মেয়েটি তার সামনক দাঁড়িয়ে আছে।তারমানে সেই মেয়েটি কুয়াশা ছিলো?কিন্তু সে তো কুয়াশাকে ভূলে যেতে চায় একেবারের জন্য!
“কেমন আছো অরণ্য?”
“হু…ভালোই!তুমি?”
“যেমন তুমি রেখেছো!”
এই তিন শব্দ অরণ্যের মনে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু বাইরে তাকে দেখে একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না তার মনের কী অবস্থা!তাই বরাবরের মতো কুয়াশা অরণ্য’কে ভূল বুঝলো।এক গুচ্ছ অভিমান নিয়ে বললো,”কেনো ডেকেছো?”অরণ্য ভালোভাবেই বুঝলো কুয়াশা অভিমান করেছে।কিন্তু কুয়াশার অভিমান ভাঙ্গানোর অধিকার যে তার নেই।
“আমি….”
“বলো..”
“আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ!”
“কীহ?সরি বু..বোঝিনিই।”
অরণ্য শীতল চাহনিতে কুয়াশার দিকে তাকালো।জলে ভর্তি হয়ে আছে সে চোখ।সে চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না অরণ্য!নাহলে যে এখনি গলে যাবে।নিজেকে কঠোর রেখে উত্তর দিলো,
“কুয়াশা লিসেন আমাদের এইখানেই ব্রেকআপ।”
“অরণ্য এসব কী বলছো তু..মি?”
“কেনো বুঝোনি?তোমাকে আমার বিরক্ত লাগে।তুমি যাস্ট…..”
চোখের জল মুচে নিজেকে শান্ত করে বললো,
“ফাইন!দেন টেল মি দ্যা রিজন।”
“কোনো রিজন নেই।তোমাকে আমার আর ভালোলাগে না।”
“হুয়াট ডু ইউ মিন বাই আর ভালোলাগে না?তুমি আমাকে ভালোবাসো অরণ্য।”
“আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”
“কী বললে তুমি?”
“হ্যা।আমি তোমাকে ভালোবাসতাম এখন বাসি না।কারণ আমি প্রকৃতি’কে ভালোবাসি!”
“হুয়াট?হু ইজ প্রকৃতি?”
“প্রকৃতি ইজ মাই ওয়াইফ।সিথুর পড়িয়েছি আমি ওর সিঁথিতে।তোমাকে আমার ফ্যামেলির কেউ মেনে নিবে না কজ ইউ আর এ মুসলিম!আর হিন্দু-মুসলিমের বিয়ে হওয়াটা শুধু মাত্র কল্পনা।তার চেয়ে…….”
অরণ্যের শেষের কোনো কথায় কুয়াশা কান অবধি পৌঁছাচ্ছে না।সে তো অরণ্যকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে মেনে নিয়েছিলো।কিন্তু আজ?আজ অরণ্যের জীবন সঙ্গী অন্যএকজন?আর অরণ্য তাকে মেনেও নিয়েছে?তারমানে এতোদিন ধরে অরণ্য কুয়াশার সাথে নাটক করছিলো?কিন্তু কী করে এতো নিখুঁত নাটক করেছে অরণ্য?কুয়াশা তো অরণ্যের চোখে দেখতো সে কতো ভালোবাসে!তাহলে সব কেনো মিথ্যাে হলো?কুয়াশা’র চোখ থেকে কোনো বাঁধা না মেনে জল গড়িয়ে পড়ছে।বরাবরের মতো কুয়াশা চেয়েছিলো সে যে কঠিন হতে পারে।কিন্তু তার চোখের জল বোধহয় তা চাইনি!এতো শকট নিতে না পেরে অরণ্যের কথার মাঝখানে কুয়াশা বললো,”স্টপ ইট অরণ্য!আমি জানি তুমি সব মিথ্যাে বলছো।তাই না অরণ্য?প্রকৃতি তোমার বউ হলেও আমাকেই তো ভালোবাসো তুমি?তাই না বলো অরণ্য?অরণ্য শুধু একটি বার বলো “ভালোবাসি!”
কুয়াশার কথা শুনে অরণ্য রেগে গেলো।এতো বুঝানোর পরও মেয়েটা সমানে জেদ করে যাচ্ছে?হ্যা! কুয়াশা’কে থামানোর জন্য অরণ্য বললো,”আই হেইট ইউ,আই হেইট,আই হেইট ইউ!”
কিন্তু অরণ্য তো জানতো না এটি শুনে কুয়াশা সারাজীবনের মতো হারিয়ে যাবে!তিন অক্ষরের বাক্যটি কানে আসতেই কুয়াশা অবাক হয়ে গেলো।একদিন কুয়াশা অরণ্যকে বলেছিলো,”আই লাভ ইউ,আই লাভ ইউ,আই লাভ ইউ!আর আজকে উল্টো’টা শুনলো?যেটা কোনোদিন কল্পনাও করেনি।কুয়াশা হতাশ হলো।এক রকম জেদ আসলো, “অরণ্যবিহীন কুয়াশার কোনো মূল্য নেই!”
“বাই অরণ্য ভালো থেকো!”
তখনি অরণ্যের মাথায় আসলো কুয়াশা ইজ সো ক্রেজি!ওর তো মাথা’তেই ছিলো না কুয়াশা সুইসাইড করার ট্রাই করেছিলো!
কুয়াশা দিকে তাকিয়ে বললো,”কুয়াশা ডোন্ট ডু দিস!”
কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা ধেরি হয়ে যায়।
~কুয়াশাআ,,আই সেড ডোন্ট ডু দিইইইইস,,কুয়াশাআআআআআ
অরণ্য দৌড়ে পাহাড়ে শেষ সীমানায় গেলো।কিন্তু ততক্ষণে কুয়াশা’র দেহ সমুদ্রের জোড়ার অনেক নিয়ে গেলো। অরণ্য তার ধূসরী’র মৃতদেহটাও দেখতে পেল না।অরণ্য শেষ বারের মতো কুয়াশা’র নাম ধরে চিৎকার দিলো।তার চিৎকারে গাছের ডালে বসে থাকা রংবেরঙের পাখিগুলা উড়ে গেলো।সমুদ্রের জোড়ার গুলোও হইতো থেমে যেতে চাইছে।কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম যে ভঙ্গ করা যায় না।
“স্তব্ধের চোখে জল টলমল করছে।অনেক স্ট্রং মেয়ে স্তব্ধ।কিন্তু তবুও কুয়াশা’র মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।বইটা উল্টা-পাল্টা করলো কিন্তু কোথাও লিখা খুঁজে পেলো না।শেষ পৃষ্ঠায় দেখলো একটা চিঠি।স্তব্ধ চিঠি’টা পড়তে লাগলো,
প্রিয় কুয়াশা❤
কেমন আছো?তুমি নিশ্চয়ই অনেক ভালো আছো।কিন্তু তুমি চলে গিয়ে আমাদের সবাইকে অসুখি করে গেলে।তুমি জানো,তুমি কেমন?খু-ব জেদী তুমি।যখন তখন যা তা বিশ্বাস করে নাও।অরণ্য যখন তোমাকে এতোগুলা কথা বলছিল তখন তুমি পারোনি তাকে আটকাতে?আমি তো শুধু মাত্র তোমাদের মাঝে এক দেওয়াল ছিলাম।চাইলেই তুমি সেই দেওয়াল সরানো যেতো।কিন্তু তুমি একবারও জানতে চাইলে না আমাকে মানে প্রকৃতি’কে অরণ্য কেনো বিয়ে করেছে?নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস ছিলো তো কুয়াশা তোমার!তুমি ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার পর দিদুন অসুস্থ হয়ে পড়ে।আর আমার বাবা তাদের আত্মীয় ছিলো।সেদিন পরিবারের জন্য অরণ্য তোমাকে ত্যাগ করে।শুধু তোমাকেই নই ওর বন্ধুদের সাথেও ঝগড়া করে অধ্রী আর রৌদ্রময় বার বার বলছিলো যাতে পরিবার আর তোমার মধ্যে অরণ্য তোমাকে বেচে নে।কিন্তু তুমি তো খুব ভালো করেই জানো অরণ্যের কাছে ওর পরিবার সবার আগে।তাই বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করে।কিন্তু অধ্রী তার জন্য রেগে গিয়ে মুম্বাই চলে যায়।সাথে রৌদ্রময় ও।কিন্তু অরণ্য বলেছিলো তোমার কথা ফ্যামেলিতে।তুমি মুসলিম বলে তারা কেউ রাজী হন না।আর অন্যদিকে রৌদ্রময় সীয়ামার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করে দূরে সরে যায়।ছোটবেলায় মা বলতো আমি নাকি অন্যের উপকার করতে কখনো পিছপা হয় না।কিন্তু দেখো এখন আমি সবার ক্ষতি করে বসে আছি।অরণ্য ভীষণ রাগি হয়ে গেছে।কারো সাথে ঠিক মতো কথা বলে না।অধ্রী আর রৌদ্রময় কাননের সাথে যোগাযোগ করে ঠিকই কিন্তু অরণ্য কথা বলে না।আর তোমার খালা তোমাকে ভীষণ মিস করে নাকি।সেদিন গেছিলাম তোমাদের বাসায়।তোমার বাবা ভিষন অসুস্থ!পরিবারে কেমন যেনো টান টান লাগে।হয়তো তুমি নেই বলে।নিপু আর আয়ন রোজই তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।কিন্তু উত্তর দিতে পারি না। নিপু তোমার মতোই জেদি।সেদিন তোমার কথা জিজ্ঞেস করায় চুপ করে ছিলাম যার কারণে বাড়ির অর্ধেক জিনিস ভেঙে ফেলেছে।আর জানো কৃষ্ণা বৌদির মেয়ে হয়েছে।নাম রেখেছে #কুয়াশা।হ্যা তোমার নামই রেখেছে।অরণ্য আর আমার সম্পর্কের নামটা বিবাহ হলেও সত্যি কারের স্বামী-স্ত্রী তো নয় আমরা।অরণ্য আমার নাম অবধি ধরে ডাকে না।কেনো চলে গেছো কুয়াশা?একবারও কী তোমার ফ্রেন্ডদের কথা মাথায় আসেনি?আমাদের কথা মনে পড়েনি?
তোমার খুব পছন্দ সমুদ্র তাই আমি এই ডায়েরিটা সমুদ্রে পলিথিন মোড়ে রেখেদিলাম।কেউ জন তো অন্তত তোমার কাহিনী পড়বে।তাই না?
ইতি,
প্রকৃতি❤
স্তব্ধ মনে মনে বললো,”মানুষ পুরো ঘটনা না যেনে অনেক কিছুই করে ফেলে।কিন্তু অতিরিক্ত ইমোশনাল মেয়েরা সুইসাইডের পথ বেচে নেয়!ইগনোর,ডিপ্রেশন এসব তারা একদম মানতে পারে না।অরণ্যের কুয়াশাকে বুঝানো রাস্তা সঠিক ছিলো না।এরকম মেয়েদের সব ধীরে ধীরে বুঝাতে হয়।কিন্তু অনেকে আছে ওদের বিরক্তি মনে করে তাদের আঘাত করে ফেলে!কুয়াশার সাথেও এরকম টাই হয়💗
❤সমাপ্ত❤