ধূসর পাহাড়,পর্ব_২২
লেখিকা আমিশা নূর
ফোন কেটে দিয়ে কুয়াশা স্কিনের দিকে তাকালো।অরণ্য হাসি মাখা চেহেরাটা ভাসছে।খুব ভালোবেসে ফেলেছে মানুষটাকে!এক সপ্তাহ দেখা না করে কীভাবে থাকবে?যাই হোক থাকতে তো হবেই।
.
.
অরণ্যের ঘুম ভাঙাতেই মাথায় হাত দিলো।এখনো ব্যাথা করছে।বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নিতে গিয়ে দেখলো মোবাইল নেই।আয়ন নিয়ে গেইম খেলছে হয়তো।বিছানা থেকে নেমে আয়নার সামনে গিয়ে দেখলো গিফটপেপার মোড়ানো কিছু একটা।আশেপাশে থাকিয়ে চারকোনা বস্তুটা হাতে নিলো।।উপরে “To Oronno” লিখা আছে।তারমানে এইটা তারজন্যই পাঠানো হয়েছে।গিফট পেপারটা টা উঠিয়ে দেখলো ভিতরে একটি বক্স।বক্সটি খুলে অরণ্য ‘হা’ করে রইলো।ছোট্ট একটি খুঁড়ে ঘর,চিকন একটি রাস্তাও আছে,দূরে আবার নদীর মতো,ফসলের মাঠও দেখা যাচ্ছে!তবে সব কৃত্রিম!সবগুলো লাইটিং করা।যেন একটা সম্পূর্ণ গ্রামের পরিবার।সাদা একটি কার্ডে লিখা আছে “DreAm WiTh mY LoVe”.অরণ্য ভালোভাবে বুঝলো এটি কুয়াশা পাঠিয়েছে।বিষয়টা নিয়ে তখনি সিওর হলো যখন ছোট চিরকুট চোখে পড়লো।
” তুমি জানো তো অরণ্য!
অরণ্যের মাঝে কুয়াশাকে কতোটা পরিপূর্ণ লাগে?
ধূসর-পাহাড়ের রাজা তুমি আমার!”
চিরকুট পড়ে অরণ্য মনে মনে বললো,”আর তুমি আমার ধূসরি!”
২৬.
প্লেনে উঠে কুয়াশা জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।অরণ্য বলেছিলো সাড়ে এগারো টাই আসবে।কিন্তু এখনো আসছে না।প্লেনের এনাউন্সমেন্ট শুরু হতেই কুয়াশা সিটব্লেট পরে নিলো।ওর পাশে শব্দ আর তিহান দিব্যি গল্প করে যাচ্ছে।কিন্তু সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে যদি এক পলক অরণ্যকে দেখতে পাওয়া যায়।কিন্তু কুয়াশা মিথ্যা প্রমাণিত হলো যখন দেখলো অরণ্য এলো না।টানা কয়েক ঘন্টা জার্নি করে কুয়াশা ইন্ডিয়ায় এয়ারপোর্টে এলো!সব ফর্মালিটি পূরণ করে বাইরে আসতেই দেখলো সামায়রা আর মাহির দাঁড়িয়ে আছে।কুয়াশাদের দেখতে পেয়ে সামায়রা দৌড়ে এসে ওদের তিনজনকে জড়িয়ে ধরলো।
“আই ক্যান নট বিলিভ দোস্ত।তোরা তিনজন এখন আমার সামনে।”
সামায়রার কথা শেষ হতেই শব্দ ওর হাতে চিমটি কাটলো।ব্যাথা পেয়ে সামায়রা “আউচ” শব্দ করলো।সামায়রা খেয়াল করে দেখলো কুয়াশার মুখটা কেমন করে রেখেছে।আলতো করে মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,”মন কী এখনো বাংলাদেশে রেখে আসছিস নাকি বদ্দু?”
“বাংলাদেশে কেনো রাখবো?এই দেখ তোর সামনে মন নিয়ে হাজির।”
কথা বলতে বলতে ওরা সামনে এগিয়ে এলো।ততক্ষণে মাহির গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সামায়রা মাহিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠলো।গাড়িতে করে ওরা সোজা সামায়রা’র বাসায় হাজির হলো।সামায়রা’র মা মিসেস আনিকা যথা সম্ভব ওদের আপ্যায়ন করলো।
রাতে……..
কুয়াশা নিজের ফোন অনেকবার চেক করলো।কিন্তু অরণ্যের আইডি থেকে একটা মেসেজও আসেনি।এমনকি অধ্রীরাও কোনো মেসেজ দেয়নি। কিন্তু ওদের পারসোনাল গ্রুপে ঠিকই সবাই কথা বলেছে।প্রচন্ড অবাক হলো কুয়াশা।ওরা সবাই কী কুয়াশাকে ভূলে গেছে?নাকি কোনো প্রবলেমে পড়েছে?এসব ভাবতে ভাবতে ছাঁদে আসছিলো শব্দ আর সামায়রা’র সাথে।তখনি মেসেঞ্জারের কল রিংটোন শুনা গেলো।স্কিনে তাকিয়ে দেখলো অরণ্য কল করছে।মনে এক রকম প্রশান্তি এলো।ওদের থেকে দূরে গিয়ে কুয়াশা কল রিসিভ করলো।
“হ্যালো অরণ্য!তুমি ঠিক আছো তো?সারাদিন কোথায় ছিলে?”
“কুয়াশা আমি বিজি ছিলাম।তাই তোমার খবর নিতে পারিনি।তুমি পৌঁছে গেছো?”
“হুম।কী নিয়ে বিজি ছিলে?”
“দাদা তোকে দিদুন আশীর্বাদের জন্য ডাকছে।”
ওপাশের কথা শুনে কুয়াশা থমকে গেলো।কার আশীর্বাদের কথা হচ্ছে?কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কিসের আশীর্বাদ?”
“আশীর্বাদ?ওহ হ্যা আমাট কাজিন এর।তুমি চিনবে না।”
“ওহ।”
সীয়ামা দেখলো অরণ্য ইশারায় বলছে চলে যেতে।কিন্তু সীয়ামা এইটা কিছুতেই বুঝছে না যে অরণ্য মিথ্যা কেনো বলছে?পরে জেনে নেওয়া যাবে ভেবে সে চলে গেলো।সীয়ামা চলে যেতেই অরণ্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা কে বললো,”শুনো,তোমাকে আমি পরে কল করবো।”
কুয়াশার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অরণ্য ফোন কেটে দিলো।মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কুয়াশা ঠোঁট কামড়ে ধরলো।চোখের জল গুলো বিনা বাঁধায় গড়িয়ে পড়ছে।তিহানের কন্ঠস্বর শুনে কুয়াশা চোখের জল মুচে নিলো।
“তুই এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”
“কিছু না।ঐ হাওয়া খেতে আসছিলাম।”
“কাঁদছিলি তুই?”
“কাঁদ..কাঁদছিলাম নাকি?চোখের পোকা ঢুকেছিলো।”
“ওহ।ছাঁদে চল।”
“তুুই যা আমি আসছি।”
“না এখন চল”
তিহান এক প্রকার জোর করে কুয়াশাকে ছাঁদে নিয়ে গেলো।কুয়াশাকে দেখতে পেয়ে সামায়রা বললো,”কই ছিলি তুই?”
“এমনি নিচে।”
চারজন বন্ধু আজ একসাথে হওয়ায় অনেকক্ষণ আড্ডা দিলো।কিন্তু কুয়াশা’র মনটা যেন বাংলাদেশেই পড়ে আছে।ও ভেবেছিলো অরণ্য ওকে প্রতিদিন কল করে খবর নিবে।কিন্তু ইন্ডিয়ায় এসে ঠিক তার উল্টো’টা হলো।দেখতে দেখতে তিনটা দিন গড়িয়ে গেলো।সামায়রার গায়ে হলুদও এসে গেলো।এই তিনদিনে অরণ্য মাত্র তিনবার কল করেছিলো তাও একটুখানি কথা বলেই কেটে দিতো।অধ্রীদের তো খবরই নেয়।সবাই একসাথে মিলে যেনো কুয়াশাকে এভয়েড করছে।কুয়াশার ইচ্ছে করছে দৌড়ে বাংলাদেশে চলে যেতে।কিন্তু আধো তো সেটা সম্ভব না।এসব ভাবতে ভাবতে কুয়াশা সামায়রার রুমে গেলো।কুয়াশা গিয়ে দেখলো সামায়রা মুখ ভার করে বসে আছে।
“এভাবে বসে আছিস কেনো?কী হয়েছে?”
“গায়ে হলুদে নাকি হলুদ শাড়ি পড়তে হয়।তুই তো জানিস আমার ” হলুদ” রং পছন্দ না।”
“কিন্তু আজকে একদিন তো পড়তে হবে।”
“নোওওও ওয়ে।আমি কিছুতেই এই শাড়ি পড়বো…”
সামায়রার কথা শেষ হবার আগেই ওর মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।ওপাশের মানুষটির সাথে কথা বলা শেষ করে কুয়াশা’কে বললো,”কুয়াশা একদিন হলুদ শাড়ি পরলে কিছু হবে না।”
“হাহ।ফোনে কে ছিলো?”
“মাহির।ও বলেছে হলুদ শাড়ি পরলে আমাকে নাকি অনেক সুন্দর লাগবে।আর অনেক চকলেট পাঠাবে বলেছে।আজ এমনিতেও আমার হিটলার মা হলুদ রংয়ের শাড়ি পরিয়েই ছাড়বে।”
সামায়রার কথা শুনে কুয়াশার মনে পরে গেলো অরণ্যও একবার তাকে শাড়ি পরানোর জন্য আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলো।সেদিন অরণ্যের পছন্দের রং “নীল” পড়েছিলো।অরণ্য শুধু হা করে তাকিয়ে ছিলো।
সামায়রা’র সাড়া পেয়ে কুয়াশা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো।সামায়রা’র বলা কথা গুলা মনে পড়তেই বললো,
“তুই না।আসলেই পারিস এসব ঢং করতে।”
“হিহিহিহি।তোরই তো বেস্টু।”
“হয়েছে।চল শাড়িটি পড়িয়ে দিই।”
সামায়রাকে শাড়ি পরানো শেষ হলে বাড়ির পিছনের বৈঠকে নিয়ে এলো।সামায়রা চেয়ারে বসতেই একজন একজন করে সবাই সামায়রাকে হলুদ লাগিয়ে দিলো।
বিয়ের দিন…
সামায়রাকে এক এক করে সবাই ডাকতে গেছে।কিন্তু কেউ ঘুমতে তুলতে পারেনি।কাল রাতে দেরিতে ঘুমাতে যাওয়ায় সামায়রার ঘুম ভাঙছে না।সবার শেষে শব্দ আর কুয়াশা গেলো।কুয়াশা ডাকতেই সামায়রা বললো,”আজকে নই।কালকে বিয়ে করবো।”
সামায়রার কথা শুনে কুয়াশা ফিক করে হেসে ফেললো।শব্দ ওয়াশরুম থেকে এক মগ পানি এনে সামায়রার মুখের উপর ঢেলে দিলো।বৃষ্টি হচ্ছে মনে করে সামায়রা উঠে বসলো।
মুখের উপর লেগে থাকা পানির ফোঁটা গুলা মুচে শব্দের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে ওর পেছনে তাড়া করলো।কুয়াশা বিরবির করে বললো,”এই মেয়েগুলো কোনোদিনও ঠিক হবে না।”
.
.
“সামায়রাকে আজ খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।কালো খয়েরী রংয়ের লেহেঙ্গা,হাত ভর্তি ডিজাইন করা চুরি,চোখে কাজল,নোলক,কানে বড় বড় ঝুমকো,পাথর রংয়ের টিকলি!একদম পারফেক্ট বিয়ের সাজ!কিন্তু সামায়রাকে দেখে কেউ বলবে না আজ তার বিয়ে।সাধারণত বিয়ের দিন মেয়েরা কান্না করে কিন্তু সামায়রা হাসি-খুশিতে মেতে আছে।এমনকি বিয়ের সাজ নিয়ে ড্যান্সও করে ফেলেছে।কুয়াশা শুধু চেয়ে দেখলো তার বান্ধবী কতোটা হ্যাপি!ভালোবাসার মানুষকে পেলে বুঝি এমন আনন্দ হয়?কিন্তু অরণ্য তো তাকে ভূলেই গেছে।সকাল থেকে তার ফোনের অপেক্ষায় ছিলো কিন্তু ওপাশ থেকে একবারও সাড়া পায়নি।কাল রাতে কুয়াশা অরণ্যের আইডিতে গিয়ে দেখে দিবানির সাথে প্রচুর চ্যাট!অথচ সে এতটাই বিজি যে কুয়াশাকে একটিবারেও জন্যও কল করতে পারে না।এসব ভাবতেই আবারো চোখের জল নেমে এলো।ভেবেছিলো ইন্ডিয়া আসলে হয়তো সবচেয়ে বেশি খুশি হবে কিন্তু এখানে এসেই কষ্টটা বেশি হচ্ছে।বরযাত্রী এলে সামায়রাকে কুয়াশাকে বললো,” এখন তো একটু কাঁদ সামু।”
“নো ওয়ে।এতো সুন্দর করে সেজেছি কী কাঁদার জন্য?”
“তুই না কাঁদিস তাহলে লোকে বলবে তোর লজ্জা সরম নেই।”
“আচ্ছা? ”
“হুম।”
“ভ্যাএএএএএএ”
সামায়রা কাঁদার অভিনয় দেখে কুয়াশা হেসে দিলো।সামায়রার মোবাইল রিংটোন বাজতেই লাফিয়ে উঠে বললো,
“মাহির কল করেছে ভিডিও কল।ওয়াও আমার বর কত্তো ভালোবাসে আমায়!”
কুয়াশা সামায়রার রুম থেকে বেরিয়ে এলো।মাহির সামায়রাকে একটুও চোখের আড়াল করে না।কিন্তু অরণ্য?সে তো কুয়াশাকে এভয়েড করছে।সকাল থেকে এতো মেসেজ দিলো কিন্তু রিপ্লে এলো না।
কুয়াশা মনে মনে ঠিক করে নিলো অরণ্যকে আর কল,মেসেজ কিছু করবে না।
(চলবে)