দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-৩
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
সানভি ও সারিকা রিথীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা শয়তানী বুদ্ধি করে। এরপর রিথীর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সারিকা বলে,
–এতো ঝলমলে সন্ধ্যাতে কি তোমার মৃত স্বামীকে মনে করছো?
রিথী ধ্যান ভাঙে সারিকার কথা শুনে। পাশ ফিরে সারিকা ও সানভিকে দেখে। তারপর আবার আগের মতো আকাশের দিকে তাকায়। উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না তার। সবসময় আমাদের মন কথার জবাব দিতে সায় দেয়না। তখন নিরবতাকে সঙ্গি করাটাকে শ্রেয় মনে হয়। সানভি খোঁচা মারা টাইপ বলে,
–মৃত স্বামী তো মরেই গেছে। এখন ব্র্যান্ড নিউ খুজতেছে। মৃত স্বামীর জন্য কি সে তার যৌবন নষ্ট করবে নাকি!
সারিকাও তাচ্ছিল্য করে বলে,
–মানুষের স্যামপ্যাথি পাবার জন্য এমন ভান ধরে থাকে এরা। পরে ঠিকই নতুন একটা পটিয়ে ফেলে।
রিথীর চোখ দিয়ে জল গড়ায়। তার এসব কিচ্ছু ভালো লাগে না। যদি খুব দূরে কোথাও যেতে পারতো! যেখানে সে তার নিদ্রকে অনুভব করে ঘোরের মাঝে কাটিয়ে দিতে পারবে। সেখানে কেউ কটু কথা বলবে না। কেউ বাস্তবতা মানতে বাধ্য করবে না। রিথী ভাবে,
“সে কি রবিনসন ক্রুসো হতে চায়! তাহলে তো ভালোই হয়। এক নির্জন জনমানবহীন দ্বিপে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাটিয়ে দিতে পারবে।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রিথী। অতঃপর আবারো বিশালাকার অন্তরিক্ষে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। যদি তার হৃদয়স্থল প্রফুল্ল থাকতো তাহলে সে উচিত জবাব দিতো কিন্তু বিষন্নতা তাকে গ্রাস করেছে বলেই পাল্টা জবাবের ইচ্ছা পোষণ করছে না। আর এদের এখন বললেও লাভ হবে বলে মনে হয়না।
ততোক্ষণে মালিহা আসে সেখানে। মালিহা সারিকার কথা গুলো শুনেছে। মালিহা ফস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ওদের কাছে গিয়ে বলে,
–রিকা, সানু! কি দরকার তোদের আপুর সাথে কথা বাড়ানোর। সে তো আর কিছু বলেনি তোদের। একাকি দাঁড়িয়ে আছে। কেনো খামাখা তাকে এভাবে হার্ট করছিস?
সারিকা মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
–তোর এতো গায়ে লাগছে কেনো? তোকে তো বলছি না। যাকে বলছি সে তো চুপ করেই আছে।
মালিহা এবার কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলে,
–রিকা, ভুলে যাস না যে এটা একটা ফ্রেন্ডশিপ এন্ড সেলিব্রেশন রিউনিয়ন। সানু ও আমার বাবা তাদের বন্ধুর সেলিব্রেশনে পার্টিসিপেট করতে এসেছে। তোকে সানু এনেছে। তাই আমাদের বাবার কোনো ফ্রেন্ডের মেয়েকে এভাবে হার্ট করিস না। আর সানু তোকেও বলছি, নিজের বাবার সম্মানের দিকটা একটু ভাব! আঙ্কেলের কতোটা খারাপ লাগবে সেটা ভাব।
কথা গুলোতে সারিকা অপমানিত বোধ করে। সানভি শুধু বেখায়ালি রিথীর দিকে তাকায়। সারিকা সানভিকে নিয়ে রুমে চলে যায়। মালিহা ওদের যাওয়ার গমন পথে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এরপর রিথীর পাশে এসে দাঁড়ায়। আর বলে,
–স্যরি আপু। ওদের বিহেভিয়ারে আমি স্যরি।
রিথী ঘুরে তাকায় মালিহার দিকে। হলুদাভাব ফর্সা মুখশ্রী মালিহার। মায়াবি লাগে রিথীর কাছে। রিথী মালিহার এক গালে হাত রেখে বলে,
–তুমি খুব মিষ্টি। ওদের সাথে চলাফেরা করার পরেও তোমার মন সাফ।
মালিহা মুচকি হাসে তারপর বলে,
–বাবার কাছে শুনেছি, তাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবার মধ্যে বাশার আঙ্কেলের ঘর আলো করে তুমিই প্রথম পৃথিবীতে এসেছিলে। পুরো বন্ধুমহলে তুমিই একমাত্র সন্তান। বাকিদের তখন বিয়ে হয়েছে আর রাশেদ আঙ্কেলে ওয়াইফ তখন প্রেগনেন্ট। সবাই তোমাকে অনেক স্নেহ করে। বন্ধুর মেয়ে এবং বন্ধুমহলে তুমিই প্রথম সন্তান। সবার আলাদা একটা টান। তোমার ছোট বেলার ছবি বাবা আমাকে দেখিয়েছে। এক অসম্ভব মায়াবী বাচ্চা। ডাগর ডাগর চোখ, উজ্জল বর্ণ ও গোলাপি ঠোঁট। ফেস কাটিংটাও মাশাআল্লাহ। বিশ্বাস করো আপু, তোমার ওই বাচ্চা ছবিটার মতোই এখনো তোমাকে কিউট লাগে। তোমাকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে। দুই বছর আগে তুমি কি সুন্দর হাসি-খুশি ছিলে। তখন সত্যি আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম।
রিথী হাসে তারপর বলে,
–রঙহীন আমি। হাসির খোঁড়াক হারিয়ে গেছে। আমার জীবনে বসন্তের সূর্য ডুবে গেছে। সেটা আর কখনোই দ্বিতীয় বসন্ত হয়ে উঠবে না আমার হৃদয় আকাশে।
মালিহা ও রিথীর সব কথা কেউ শুনছে আঁধারের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে। ব্যালকনিতে অনেকখানি দূরত্ব পরপর সোডিয়াম লাইট। সোডিয়াম লাইটের হলুদাভাব ও পুরো রিসোর্ট মরিচবাতির আলোকে সজ্জিত। লম্বা ব্যালকনিতে এক সারিতে চারটা রুম আর সোডিয়াম লাইট মাত্র একটা। চারদিক ঘিরে রিসোর্টের রুম তাই পুরো দোতালায় চারটা বাতি। যে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে সে হচ্ছে রুদ্ধ।
মালিহা রিথীকে কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেসা করে,
–আপু, তোমার লাভ স্টোরিটা একটু বলবে প্লিজ!
রিথী মলিন হাসে তারপর কিছুক্ষণ নিরবতাকে সাক্ষি করে বলে,
–ওর সাথে আমার পরিচয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়। ভর্তি পরিক্ষাতে টিকার পর যেদিন ভর্তি হতে গিয়েছিলাম সেদিন ও ভলান্টিয়ার হিসেবে ছিল। ও তখন থার্ড ইয়ারে। অনেক আন্তরিকতা নিয়ে আমাকে ও আব্বুকে সাহায্য করেছিল। তখন ওর নাম জানতে পারি “নিদ্র”। নামের মতোই সে আমার রাতের নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। নাম যতোই নিদ্র হোক না কেনো তার প্রতি জন্ম নেওয়া অজানা অনুভূতি আমার রাতের নিদ্রাকে হারাম করে দিয়েছিল। এরপর প্রথম দিন ক্যাম্পাসে ক্লাস করতে যেয়ে ওকে অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু পাইনি এরপর পরেরদিন ওকে পেলাম। তখন জানতে পারি সে জেনেটিকসের ছাত্র। আর আমি তো ফার্মেসি। এরপর ক্যাম্পাসে কোনো দরকার পরলে সে হেল্প করতো। এর মধ্যেই তাকে আমি ভালোবেসে ফেলি কিন্তু জানতাম না সে আমায় ভালোবাসে কি না! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় তিন মাস পর জানুয়ারি মাসে যেদিন আমার জন্মদিন সেদিন সে চকলেট কেক সাথে হরেক রকমের গোলাপ ফুলের তোড়া সাথে একটা চুড়ির ডালা। আমার কাছে সব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছিলো। ইউ নো, আই ওয়াজ ক্রাইং দেট টাইম।
কথাটা বলতে বলতে রিথী চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়ায়। মালিহা চেয়ে রয় শুধু। কতোটা অনুভব নিয়ে বলছে সব। এদিকে রুদ্ধ কাছেও মনে হচ্ছে প্রথম ভালোবাসা কতোটা সুন্দর হয়।
রিথী আবার বলতে লাগে,
–জানো, পুরো ক্যাম্পাসে সবাই ক্ল্যাপ করছিলো। আমি তখন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন বান্ধবীদের ডাকে ধ্যান ফিরে। আর নিদ্র তখনো হাঁটু গেড়ে বসেছিল। আমি কি করবো বুঝতে না পেরে হুট করে ফুল গুলো নিয়ে নেই। সে কিন্তু একটা ছন্দও বলেছিল। দাঁড়াও মনে করি। হ্যাঁ, মনে পড়েছে,
” এক গুচ্ছ গোলাপ হাতে,
নিও আমার হৃদয়ও কথা।
রাতের নিদ্রা শূন্য নিদ্র যে,
তোমার আঁখি তটে বিলিন সে!”
_______তিথি
রুদ্ধ এবার ঠোঁটের কোণে মুগ্ধতার হাসি ঝুলিয়ে আলো আঁধারিতে এক ঠোঁটে হাসি ও অশ্রুজলে পরিপূর্ণ রমণীকে দেখছে। সে যদি পারতো এই রমণীর চোখের জল মুছে দিতে!
রিথী ছন্দ বলার পর বলে,
–আমি ফুলটা নিয়ে লজ্জাতে তাকাতে পারছিলাম না তার দিকে। তাই দৌড়ে চলে গিয়েছিলাম সেখান থেকে। কেক আর কাটা হয়নি। সেদিন সারারাত আমি চোখের পাতা এক করতে পারিনি। অন্ধকারে আমি শুধু একা একা নিঃশব্দে মুচকি হেসেছিলাম নিদ্রর প্রোপোজের ঘটনাটা মনে করে করে। পরেরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে শুনি যে কেকটাকে নাকি গরিব বাচ্চাদের খাইয়ে দিয়েছিল সে। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। এরপর কিভাবে কিভাবে আমি ওকে একসেপ্ট করলাম তা বুঝতেও পারলাম না। আমার যখন সেকেন্ড ইয়ার শেষ এরপর আমি বাসায় বলি কারন নিদ্রর বাড়ি চট্টগ্রাম। তাই সে মাস্টার্স চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটিতে করতে চায়। আর ওর বাবা তখন অসুস্থ ছিলো আর বিজনেসের দিকটা বড় ছেলেকে দেখতে বলছিল। নিদ্রর ছোট ভাই তখন ইন্টারে পড়ে। ওদের পুরো পরিবার আমাদের বাসায় আসে আর আমাদের আকদ হয়। যেদিন আকদ হয় সেদিন সারারাত আমরা দুজন ব্যালকনিতে বসে আকাশ দেখেছিলাম ও গল্প করেছিলাম। বিয়ের এক মাস পর আবার যখন এলো তখন আমরা কাছাকাছি এসেছিলাম। দুইদিন থেকে ও চলে যায় আবার। এর এক সপ্তাহ পর আবার ওকে ঢাকা আসতে হতো তাই রওনাও হয়েছিল কিন্তু পথিমধ্যে ঘটে যায়…
রিথী নিচে বসে পরে। ঢুকরে কাঁদতে থাকে মুখে হাত দিয়ে। মালিহা রিথীর পাশে বসে জড়িয়ে ধরে সামলানোর চেস্টা করছে। রুদ্ধ আকস্মিক রিথীর কান্না দেখে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে যেতে নেয় রিথীর কাছে কিন্তু সে গেলে রিথী অপ্রস্তুত হয়ে যাবে তাই আর যায় না। রিথীর কান্না থামছে না। ওই ঘটনাটা যে কি সেটা মালিহা ও রুদ্ধের বুঝতে অসুবিধা হয়না।
মিনিট দশেক পর রিথী শান্ত হয়। তারপর চোখ মুছে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে,
–কেন ইউ প্লিজ লিভ মি এলোন?
মালিহা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়। রিথী চুপচাপ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মালিহা চলে যাবার কিছুক্ষণ পর রুদ্ধ আসে রিথীর কাছে। তারপর সগোউক্তি করে বলে,
” তোমার চোখের কাজল হবার অধিকার দিবে!”
রিথী চমকে তাকায় পেছোনে আর দেখে,
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।