দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-২

দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-২
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি

নন এলকোহলিক ওয়াইনের গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্ধ। রুদ্ধ তার বয়সি বা তার থেকে ছোট তার বাবার বন্ধুর ছেলেদের সাথে কথা বলছে কিন্তু রুদ্ধর চোখ এখন,
এক হরেক রকমের আলোক সজ্জিত সন্ধ্যায় এক রঙহীন রমণীর দিকে। রমণীটিকে কালোতে দারুন মানিয়েছে এই ঝলমলে সন্ধ্যায়।

অপরদিকে,
রিথীর নিজেকে বেমানান লাগছে, এতো রঙ বেরঙের আলোক সজ্জা, ফ্লাওয়ারের সাঁজে সজ্জিত পরিবেশে। যাকে ঘিরে নিজেকে সাঁজিয়েছিল সেই তো সব রঙ নিয়ে চলে গেল। রিহা জোর করে ওকে হিজাব ছাড়া এখানে এনেছর। রিথী যেটুকু পারে সেটুকু চেষ্টা করছিলো কিন্তু সুন্দর হচ্ছিলো না। রিহা তার বোনকে জোর করে নিয়ে এসেছে চুল গুলোকে একবারে খোলা রেখে দিয়ে।

আসলে সানভিদের কথাতে রিহার রাগ হয়েছে। সানভিরা যেভাবে রিথীকে বলছিলো সেটা শুনে রিহা ওদের দেখিয়ে দিতে চায় যে তার বোনও কম সুন্দরী না! রিহা নিজে কস্ট করে রিথীকে একদম নরমাল ও ফ্রেশ ভাবে সাঁজিয়েছে। রিথী মানা করেছিলো কিন্তু শুনেনি। রিথীকে কালো থ্রিপিসের সাথে হোয়াইট স্টোনের এয়ার রিং, ব্রেসলেট পড়িয়ে কালো নেটের ওড়নাটা সামনে সুন্দর করে ছড়িয়ে দিয়ে একপাশের ওড়না মাথায় টেনে দেয় আলতো করে। তারপর মাথায় চুলে কালো পিন ও ওড়নাতে হিজাব পিন দিয়ে সিকিউর করে দেয়। ঠোঁটে বেবি পিংক লিপস্টিক, চোখের পাতার উপরে আইলাইনার।

সব সাঁজ কম্পলিট করে রিহা তার বোনের দিকে তাকায়। ওর কাছে ওর বোনকে পাকিস্তানি নায়িকাদের মতো লাগছে!

_____রিথী ওরেঞ্জ জুস হাতে চারপাশ দেখছে। রিহা তার বাবার কাছে গেছে। হঠাৎ রুদ্ধ রিথীর সামনে এসে দাঁড়ায় আর হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,

–Hi, Myself Ruddho seikh. What’s your name beautiful lady?
(হাই। আমি রুদ্ধ শেখ। তোমার নাম কি সুন্দরী রমণী?)

আচমকা কারো এভাবে এসে কথা বলাতে রিথী কিছুটা ঘাবড়ে যায়। তারপর বলে,
–Its Rikkhia Rithi.
(আমি রিক্ষিয়া রিথী।)

–Wow, nice name. Why are you standing here alone?
(খুব সুন্দর নাম। তুমি এখানে একা কেনো দাঁড়িয়ে আছো?)

–No, my sister was with me but she went to my father a while ago.
(না। আসলে আমার বোন আমার সাথে ছিলো কিছুক্ষণ আগে কিন্তু সে আমার বাবার কাছে গেছে।)

–Oh ok. Would you like some wine?
(ওহ আচ্ছা। তুমি কি একটু ওয়াইন নিবে?)

–No no. Not needed. Thank you.
(না। তার দরকার নেই। ধন্যবাদ।)

রিথী সেখান থেকে সরে আসে। রুদ্ধ বাঁকা হাসে তারপর বলে,
–She is incredible! Her talking style is just wow. impressive. I like it.
(সে অবিশ্বাস্য! তার কথা বলার ধরনটাও সুন্দর। আকর্ষণীয়! আমি এটা পছন্দ করি।)

রিথী যাবার পর সানভি ও তার বান্ধুবীরা আসে আর এসেই সানভি রুদ্ধর হাত ধরে বলে,

–বেবি! ডু ইউ নো হাউ মাচ আই মিস ইউ?

রুদ্ধর বিরক্তি লাগে। এই সমস্ত মেয়ে তার পছন্দ না। সে হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে বলে,

–ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট। নাহলে আমি ভুলে যাবো তুমি আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে।

রুদ্ধ সেখান থেকে চলে আসে আর সানভি ফুঁসতে থাকে। রুদ্ধ যেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে সানভিও সেখানে পড়ে। সানভি “নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে” সবে ফ্রেশার স্টুডেন্ট।
আর রুদ্ধ সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে।

★★রুদ্ধ শেখ। বাবা-মায়ের এক ছেলে ও ছোট একটা বোন আছে। রুদ্ধর বয়স আর এক মাস পর ২১ হবে। রুদ্ধর বাবা একজন আর্মি অফিসার। ফর্সা, ৫ ফিট ১১ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট এক সুদর্শন যুবক। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে ত্রিপলিতে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।★★

সানভি রাগে ফসফস করতে বলে,
–আমার সাথে রুডলি কথা বলে কিন্তু ওই বিধবা রিথীর সাথে কিনা হেসে হেসে কথা! আমি তোমাকে দেখে নিবো রিথী। নিজেকে খুব ভদ্র প্রমান করো তাইনা! জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।

সারিকাও সানভির সাথে তাল মিলায়। মালিহা সানভির রাগ কমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

রিথী তার বাবা ও বোনের কাছে যায়। তার বাবা নিজের বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। রিথী গেলে ওর বাবা তার বন্ধুদের বলে,

–এই তো রিথী এসে গেছে।

রিথী সবাইকে সালাম দেয়। রুদ্ধর বাবা মিস্টার রাশেদ বলে,
–শুনো মা, যা চলে গেছে তা নিয়ে যদি নিজেকে শেষ করে দাও তো তোমার বাবা-মায়ের কি হবে সেটা কি ভেবেছো? নিজেকে শক্ত করো। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। নিজেকে শক্ত করো।

সানভির বাবা সহ অনেকে বুঝায়। সানভির বাবা লোকটা অনেক ভালো। সে বলে,

–আমার মেয়েটাকে ঠিক করতে বাংলাদেশে নিয়ে আসলাম কানাডা থেকে কিন্তু মেয়ে আমার সারিকা নামক আমাদের পাশের বাসায় থাকা মেয়ের সাথে থেকে আরো বেপরোয়া হয়ে গেলো। আমার স্ত্রী তো কানাডার বাসিন্দা। তিন বছর আগে মেয়েকে নিয়ে আমি চলে এসেছি যাতে আমার মেয়ে সঠিক ভাবে চলাচল করে তারপর তো জোর করে এখানকার কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করলাম। এখন আমার স্ত্রী সামনের মাসে বাংলাদেশে আসবে। এই সারিকার সাথে পরিচয়ের পর থেকে সারিকাকে ছাড়া সানভি কোথাও যায় না। মাসুদের মেয়ে মালিহার সাথে একসাথে ভর্তি করলাম যাতে মালিহা আমার মেয়েটাকে সৎ সঙ্গে নিয়ে আসে।

মিস্টার মাসুদ সানভির বাবার কাঁধে হাত রাখে। সবাই তাকে বুঝায় যে একদিন সানভি ঠিক হবেই।

তখন সেখানে রুদ্ধ আসে। মিস্টার রাশেদ বলে,
–এই তো আমার ছেলে রুদ্ধ।

রুদ্ধ সবার সাথে সৌজন্য প্রদান করে। মিস্টার রাশেদ বলে,
–রুদ্ধ, তুমি কি তোমার বাশার আঙ্কেলের মেয়ে রিথীর সাথে পরিচিত হয়েছো?

–হ্যাঁ বাবা। মিস রিথী অনেক কম কথা বলে, আমি যা বুঝলাম।

রুদ্ধর রিথীকে মিস বলাতে রিথীর খারাপ লাগে তাই রিথী বলে,
–মিস না মিসেস হবে। আমি বিবাহিতা মিস্টার রুদ্ধ।

রুদ্ধ বাঁকা হেসে বলে,
–উপস, মাই,মিসটেক। আসলে আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি বিবাহিতা। আর আপনি যথেষ্ট পিচ্চি দেখতে।

রিথীর রাগ লাগছে এখন। এক অচেনা ছেলে ওকে পিচ্চি বলছে যা ওর বিরক্ত লাগছে। পরক্ষনেই রিথীর মনে প্রশ্ন জাগে যে সে এতো গুলো মাস পর আজ আবার কারো প্রতি বিরক্তিতে জবাব দিচ্ছে! কই সানভিদের সাথে ঝামেলার সময়ও তো ওর এতো রাগ লাগেনি! তাহলে?

মিস্টার বাশার মেয়ের আগের মতো কথা বলার একটু ঝলক দেখে খুশি হন। মিস্টার রাশেদ তার বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে ভরসা স্বরূপ।
রিথী আর কথা বাড়ায় না। সে তার বাবাকে বলে রুমে চলে যায়। আধ ঘন্টা পর রাতের খাবার তখন আসবে।

রিথী চলে গেলে মিস্টার রাশেদ বলে,
–বলেছিলাম না বন্ধু, যে আমার ছেলেই পারবে তোর মেয়েকে আগের মতো করতে।

মিস্টার বাশার চোখের কোণের অশ্রুকণা মুছে ফেলে।মিস্টার বাশারের বাকি বন্ধুরাও খুশি হয় অনেক। আর রুদ্ধ রিথীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দেয়।
____________

এদিকে সানভির খুব বিরক্ত লাগছে রিথীর সাথে ওর বাবার এতো সুন্দর করে কথা বলা ও রুদ্ধর এতো দুষ্টামি পূর্ণ কথা রিথীর সাথে। রাগে যে হাতের ড্রিংকসের গ্লাসটা ফ্লোরে আছড়ে ফেলে। সানভির বাবা সহ বাকিরা শব্দ পেয়ে তাকায় সেদিকে। সানভির বাবা নিজের মেয়ের কাছে এসে বলে,

–কি হয়েছে মামনি? গ্লাসটা ফেললে কেনো?

–নাথিং ড্যাড। তুমি তোমার কাজ করো।
এই বলে সানভিও চলে যায়। সানভির সাথে সাথে সারিকাও। মালিহা সানভির বাবাকে ইশারায় “সে দেখছে” বলে সানভির পিছে যায়।
মেয়ের এমন অধঃপতন সানভির বাবার ভালো লাগে না। কানাডা থেকে যেই কারনে নিয়ে আসলো সেটাতো হচ্ছেই না।

রিথী রিসোর্টের ভিতর গিয়ে রিসোর্টের ব্যালকনিতে দাঁড়ায়। এখান থেকে সব কিছু সুন্দর ভাবে দেখা যায়। রিথী এগুলো দেখছে আর ফোনের স্ক্রিনে নিদ্রর ছবি বের করে সেটার সাথে কথা বলছে,

–কেনো আমায় একা করে চলে গেলে নিদ্র? তুমি আমার রাতের নিদ্রা কেড়ে এক রঙহীন জিবন উপহার দিয়ে গেলে। আজ নিজেকে বেমানান লাগে এই শত শত আলোক সজ্জার ভীরে। যেই আমি সবসময় এই ঝলমলে সন্ধ্যার আলোক সজ্জার মতো সজ্জিত হতে চাইতাম আর আজ সেই আমি এগুলো থেকে দূরে থাকি। আমার বসন্তের সব রঙ নিয়ে চলে গেলে আর রেখে গেলে এর রঙহীন, বসন্তহীন আমাকে।

কথা গুলো রিথীর মনের দীর্ঘশ্বাস। এগুলো বলে আকাশের দিকে চোখ সরায়। নিকষ তারকা খচিত কালো অম্বর। রিথীর প্রতি ওয়াক্তে নামাজের মুনাজাতে এই পার্থনা থাকেই যে, তার নিদ্র যেনো জান্নাতবাসী হয়।

তারকারাজির দিকে তাকালে রিথীর মনে হয় নিদ্র তাকে দেখে হাসছে। রিথীর তখন ভালো লাগে। মনটা শান্ত হয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here