#দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-১১
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
ইলিশ, হরেক রকমের ভর্তা ও পানি দেওয়া গরম ভাত দিয়ে সকালের নাস্তা সারলো সবাই। রুদ্ধর কাছে রিহা ও রিনি বায়না ধরেছে, তারা রমনার বটমূলে যাবে। রিথীকেও ওরা রাজী করে ফেলেছে। রিথীর মনে পরে যায়, শেষবার যখন নিদ্রর সাথে রমনাতে গিয়েছিল! সেদিন দুজনেই লাল-সাদাতে সেঁজেছিল। রিথী লাল পেড়ে সাদা সাদা জামদানি শাড়ি ও নিদ্র সাদা পাঞ্জাবিতে লাল সুতোর কাজ করা। নিদ্র মারা গেল প্রায় ৮ মাস পেরিয়ে গেল।
আগস্টের ২৪ তারিখ বিয়ে হয়েছিল। রিথীদের সেকেন্ড ইয়ারের শেষের দিকেই বিয়ে হয়েছিল। শুধু পরিক্ষাটা বাকি ছিল। আর মারা গেল, সেপ্টেম্বরের ২৯ তারিখ।
___________
রিথী আজও লাল পাড়ের সাদা জামদানি শাড়িটাই পড়েছে। রুদ্ধর জন্য মিস্টার বাশার লাল জমিনে সাদা ব্লকের কাজ করা পাঞ্জাবি এনেছে। রিনি, রিহা, রিথী ও রুদ্ধ চারজনেই লাল-সাদাতে সজ্জিত আজ। রমনাতে গেল তখন ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১২ টার বেশি বাজে। দুপুরের খাবার টিএসসি থেকে খাবে। ভুনাখিচুড়ি, ইলিশ ভাজা ও গরুর মাংসের কালাভুনা। রুদ্ধর বরাবর এগুলো প্রিয় খাবার। রিথীরো পছন্দ। দুপুরের খাবার খেয়েই ওরা ঘুরবে।
রিথী রুদ্ধকে ভুনাখিচুড়ি, ইলিশ ভাজা ও গরুর কালাভুনা খাওয়ার সময় সাথে শুকনো মরিচ ভাজা খেতে দেখে ওর নিদ্রর কথা মনে পড়ে যায়। নিদ্ররো এগুলো সব পছন্দের ছিলো। এভাবেই টিএসসিতে ওরা দুজন খেতো। রিথী খেয়াল করছে, রুদ্ধর অনেক কিছু স্বভাব ও আচরণ নিদ্রর সাথে মিলে। রিথীর কেনো এসব মনে হচ্ছে রিথী নিজেও বুঝতে পারছে না। রুদ্ধের মতো নিদ্রও রিথীর মাঝে মাঝে করা অহেতুক ক্ষতিকর বাচ্চামোতে ধমক দিতো।
রিথী ভাবে,
“এতো মিল কেনো আমার চোখে ধরা দিচ্ছে দুজনের? নিদ্রর জায়গা আমি কাউকে দিতে পারবো না। তবে কি রুদ্ধও ওর মনে নিদ্রর পাশাপাশি জায়গা করে নেওয়ার প্রচেষ্টারত!”
ক্ষণিকের মাঝে রিথীর মনে আশংকা হয়,
“সে কি নিদ্রকে ভুলে যাবে! না, না, কখনোই না। নিদ্রকে কখনো ভুলতে পারবে না সে। যত যাই হোক না কেনো, মৃত্যুর পরেও নিদ্রকে সে আগে মতোই ভালোবাসে। প্রতিরাতে তার নিদ্রর ছবির সাথে কথা বলে। এমনো হয়, গভির রাতে ঘুম ভেঙে উঠে ব্যালকনিতে যেয়ে আকাশপানে নিদ্র নামক তারাটাকে খোঁজে। ভালোবাসা সত্যি হলে সেটা মৃত্যুর পরেও অম্লিন হয়।”
_______দুপুরের খাবার শেষে ওরা রমনাতে ঘোরাফেরা করে। সারাটাদিন দারুন গেছে সবার। আর রিথী! সে তো পুরোনো আর নতুন স্মৃতির দোলাচলে কাটিয়ে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার আগে রুদ্ধ রিথীকে একটা বকুল ফুলের মালা কিনে দেয়। এক পিচ্চি বাচ্চা হাতে দুইটা শুকনো বকুল ফুলের মালা নিয়ে ঘুরছিল। পথিমধ্যে এক কপোত-কপোতী একটা কিনে নেয় আর রুদ্ধরো সেটা দেখে নিজের বসন্তরানীর জন্য শুকনো বকুলের মালা কিনতে মন চায়।
বকুল ফুলের ঘ্রাণ যেমন শুকোনোর পরেও থেকে যায়, ঠিক তেমনি ভালোবাসা পুরোনো হলেও এর তীব্রতা ততোটাই থাকে।
“এক শুকনো বকুলের মালাতে তিনজন গাঁথা। সবই ভালোবাসা!”
রুদ্ধ আজকে আর রিথীদের বাড়িতে যায় না। পহেলা বৈশাখ তো নিজের পরিবারের সাথেও কাটাতে হবে তাইনা! সেজন্য রুদ্ধ ওদের তিনজনকে ওদের বাড়ির রাস্তায় দিয়ে চলে যায় আর ওদের বুঝিয়ে বলে যাতে সবাইকে কারনটা বলে। রিথীর পরিবারো আর দ্বিরুক্তি করেনি। তারাও বুঝেছে, পরিবারের সাথেও তো সময় কাটাতে হবে।
______________
সময় বয়ে চলে নিরন্তর। সময়ের স্রোত কখনো থামে না কারো জন্য। রিথী এক সেমিস্টার গ্যাপ দেওয়াতে ফাইনালে এসে সবার থেকে বেশি প্রেশারে পড়ে গেছে। চতুর্থ বর্ষে উঠবে তবে ফাইনালের পর যখন সবাই দুই মাসের কাছাকাছি ছুটি কাটাবে তখন রিথী পরিক্ষা দিবে ওই গ্যাপ দেওয়া সেমিস্টারের।
ফাইনালের আগেই রিথী ও নিদ্রর প্রথম বিবাহবার্ষিকী। রিথী নিজের হাতে কিছু অনাথ বাচ্চাদের খাইয়েছে। আর সারাদিন কোনোমতে কাটানো গেলেও রাতে তার সঙ্গী খোলা মস্ত বড় আকাশ। রিথী আকাশপানে তাকিয়ে আউরায়,
“প্রথম বিবাহবার্ষিকী মোবারক নিদ্র! আফসোস আমার, তোমার সাথে বিয়ের প্রথম বসন্ত কাটাতে পারলাম না। আর না পারলাম একান্ত তোমার হয়ে থাকতে! তোমার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতেও তোমার বিধবা থাকতে পারলাম না। হয়ে গেলাম অন্যকারো বসন্তরানী! ছেলেটা ভালোবাসে আমায় কিন্তু আমি যে পারছি না তোমাকে ছাড়া আর কাউকে হৃদমাজারে জায়গা দিতে। অন্যায় তো তার প্রতিও হচ্ছে, কারন ইসলামিক মতে বিয়ে তো হয়েছে। তাহলে কি আমি জঘন্য স্ত্রী হয়ে গেলাম? আমি কি পরকালে তোমার সাথে থাকতে পারবো না রুদ্ধকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য! আজ যেই এতিমখানাতে গেছিলাম, সেখানে এক বৃদ্ধা মহিলা আমার সব শুনে এগুলোই বলল। আমি চাই না রুদ্ধকে ঠকাতে, তাইতো ওকে মেনে নেওয়ার মিথ্যা নাটক করতে পারি না। তবে এটা স্বিকার করবো, রুদ্ধের সাথে তোমার আচরণে অনেক মিল আছে। অমিল শুধু এটা যে, তুমি শান্ত ও ঠান্ডা স্বভাবের আর রুদ্ধ তার বিপরীত। তোমার সাথে মিলের কারনেই হয়তো আমি রুদ্ধকে মেনে নিতে শুরু করেছি। এখন আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। একসময় সময়ের বহমানতায় হয়তো রুদ্ধকে তোমার পাশে স্থান দিবো! রুদ্ধ কখনো ভুলতে বলেনি তোমায়। তাই জন্যই ওর সাথে সহজ হতে পেরেছি। নিদ্র, তোমার এংড়িবার্ডকে এখন রুদ্ধ সামলাতে জানে জানো! আমার কথা চিন্তা করে এখনো রুদ্ধ ওর বাবাকে আমার ও রুদ্ধের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। মনে আছে! তুমি একবার বলেছিলে যে, তুমি না থাকলে তোমার এংড়িবার্ডকে কে সামলাবে! আজ দেখো, এসে গেছে সে! তবে শত আক্ষেপের মাঝে, ভালোবাসি! ভালোবাসি নিদ্র। ”
__________যথারিতি পরিক্ষা শেষ হয়। এরপর আসে নিদ্রর মৃত্যুবার্ষিকী। রুদ্ধ আসে রিথীর সাথে সব জায়গাতে। রিথী আবারো এতিমদেরকে খাওয়াতে যায়। সাথে কিছু পথশিশুদের। রুদ্ধ প্রতিটি পদক্ষেপে তার বসন্তরানীর সাথে ছিল। রিথী মনে মনে খুশি হয় রুদ্ধের নিদ্রর জন্য এতো করতে দেখে। রিথীর মনে হয় আজ,
“এই ছেলেটার জন্য হৃদকোণে একটা স্থায়ী জায়গা তৈরি হচ্ছে। রুদ্ধর কেয়ারিংগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রুদ্ধের মাঝে নিদ্রর ছাঁয়া যেনো দিনদিন রিথীর চোখে প্রকট করে ধরা দিচ্ছে।
রিথী কাল রাতেও স্বপ্ন দেখেছে যে, নিদ্র এক সাদা ধোঁয়াটে পরিবেশে এসে রুদ্ধের সাথে রিথীর হাত মিলিয়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল ধোঁয়ার মাঝে।
রিথী সময় দেবে এবার তার জীবনের দ্বিতীয় বসন্তকে। এতো ভালোবাসা পায়ে ঠেললে হয়তো সেটা একসময় অভিশাপে রূপ নিবে। সবার কপালে কি এতো সুন্দর দ্বিতীয় বসন্ত থাকে? যার থাকে সে ভাগ্যবান বা ভাগ্যবতি।
রিথী কিছুক্ষণ রুদ্ধের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল। রুদ্ধ বাচ্চাদের খাবার দেবার সময় রিথীর দিকে নজর গেলে দুই জোড়া আঁখিযুগলের শুভদৃষ্টি ঘটে। রুদ্ধ ভ্রুঁ নাচিয়ে ইশারায়, “কি হয়েছে?” জিজ্ঞাসা করে। রিথী তখন মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে “কিছু না” বলে নিজেও বাচ্চাদের পাতে খাবার তুলে দিতে থাকে।
এক অদৃশ্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে চলেছে রুদ্ধ রিথীর মনের মাঝে। এক নতুন বসন্তের আবেশ ছড়াচ্ছে যার নাম দ্বিতীয় বসন্ত।
সারাদিন পর রুদ্ধ রিথীকে রিথীর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যায় নিজের বাড়ি। আজকে রাত কিছুটা বেশি হবার পরেও রুদ্ধ সবার বলাকে তোয়াক্কা করে থাকে না রিথীদের বাড়িতে। আজকে রিথীর জীবনে কি! সেটা রুদ্ধ বুঝতে পারছে তাই স্পেস দিতে চায়। সম্পর্ক আস্তে আস্তে এগোনো ভালো। তাহলে দুটি হৃদয় একে অপরকে ভালোভাবে বুঝতে সক্ষম হয়। রুদ্ধ চলে গেলে রিথী নিজের রুমে এসে নিদ্র ছবি বের করে সেটার সাথে কথা বলতে থাকে। এই ছবির সাথে কথা বলাটা রিথীর প্রিয় একটা কাজ।
চলবে ইনশাআল্লাহ,