দ্বিতীয় বসন্ত,সূচনা_পর্ব
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
বাম হাতের শিরার উপর করা ব্যান্ডেজের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিথী। কয়েক ঘন্টা আগে তার বিয়ে হয়েছে নিজের থেকে বয়সে ছোট এক ছেলের সাথে। এই বিয়েতে রিথী একদম রাজী ছিলো না। রাজী না হবারও যথেষ্ট কারন আছে তবে সব থেকে বড় কারন রিথী নিদ্রের জায়গা আর কাউকে দিতে চায়না। নিদ্রকে সে আগেও ভালোবাসতো, এখনো বাসে এবং ভবিষ্যতেও বাসবে। রিথীর প্রথম ভালোবাসা ও প্রথম স্বামী নিদ্র। কপালে সুখ সইলো না ভবিতব্য এটাই ধরণীর বুকে তাদের ভালোবাসার যাত্রা এতটুকুই তাই তো নিদ্রকে নিয়ে গেল বিধাতা তার নিজের কাছে।
রিথীর এখন যার সাথে বিয়ে হয়েছে তার নাম রুদ্ধ। নিদ্র মারা গেছে প্রায় বছর গড়িয়ে যাচ্ছে। রিথী কেনো অনুষ্ঠান, উৎসবে থাকে না। পড়ালেখাতেও গ্যাপ পরে গেছে। সব মিলিয়ে সে নিজেকে এক ঘরে বন্ধি করে রাখে। চঞ্চল রিথী হয়ে যায় এক নিশ্চুপ পুতুল। যে তিক্ত নিজের জীবনের প্রতি, নিজের ভাগ্যর প্রতি। রিথীর বাবা-মা, দুই বোন, বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য আত্নীয়-স্বজনরা যারা ওর ভালো চায় তারা সবাই ওকে সাপোর্ট করেছে।
“রিক্ষিয়া রিথী” অনার্স তৃতীয় বর্ষে ফার্মেসিতে পড়ে। উজ্জল শ্যাম বর্ণের ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট এক ২১ বছরের তরুণী। বাবা-মায়ের বড় মেয়ে। রিথীর ছোট দুইটা বোন আছে। মেঝো বোন রিনি ইন্টার পরিক্ষার্থী ও ছোট বোন রিহা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে।
রিথীর বাবা মিস্টার বাশার একজন কলেজের প্রফেসর। তিনি এক্স ক্যাডেট। সেই অনুসারে সকল এক্স ক্যাডেট ও তাদের পরিবারকে নিয়ে প্রেজেন্ট ক্যাডেটদের সাথে পূর্ণমিলনী হয়। চার বছর বা দুই বছর অন্তর। আজ সকালে,
রিথীর বাবা রিথীকে ও রিথীর ছোট বোন রিহাকে নিয়ে তার ব্যাচমেটদের একজনের আয়েজন করা এক পার্টিতে যায়। এই পার্টিতে সবার পরিবার আনতে হবে। রিথীর মেঝো বোন রিনির যেহেতু এইচএসসি পরিক্ষা আর মার্চ মাস চলছে তাই রিনি ও তার মা মিসেস রোজী বাড়িতে থেকে যান। রিথীর দাদাভাই অসুস্থ তাই রিথীর মা এমনিতেও যেতে পারতো না। রিথীর কাকি তার ছোট বাচ্চা সামলিয়ে সাথে শ্বশুরের যত্ন একা হাতে করতে পারবে না বিধায় রিথীর মা যায় না। রিথীর বাবা রিথীকে একপ্রকার জোর করে নিয়ে যায়। রিথীর মা, বাবা, কাকা, কাকি বাকিরা সবাই মিলে বুঝায়। তারপর রিথী রাজী হয়।
নিদ্র মারা যাবার পর থেকো রিথী বাড়ি থেকে বের হয় না একদম। এমনকি ইউনিভার্সিটিতে ছয় মাস গ্যাপ পরে গেছে। এখন চলতি সেমিস্টারটা সবার সাপোর্টে কন্টিনিউ করছে।
গাজীপুরের দিকে একটা রিসোর্টে পার্টি এরেঞ্জ করা হয়েছে। রিসোর্টটা অনেক বড়। রেস্ট করার জন্য রুম আছে। রিথীর বাবার ২৫ জন ফ্রেন্ড এসেছে তাদের পরিবার নিয়ে। বাকিরা দেশের বাহিরে বা কেউ মারা গেছে। রিথী ও রিহা তাদের বাবার বন্ধুদের ও তাদের পরিবারের সাথে সৌজন্য বিনিময় করে রিসোর্টের একটা রুমে যায়। একটা রুমে যায় রেস্ট করতে। দুইদিন থাকবে তাই পুরো রিসোর্টটা সবাই মিলে বুক করে ফেলেছে। রিথী ও রিহার সাথে রুম শেয়ারে আরো তিনটা মেয়ে আছে। এক্স ক্যাডেটরা একসাথে থাকবে বলে তাদের ওয়াইফরাও একসাথে সব থাকবে আর বাচ্চারা একসাথে। রিথীর রুমের বাকি তিন জন মেয়ে একটু এক্সট্রা মর্ডান। মেয়েগুলোর বয়স ১৮ হবে। রিথী তো আসতে চায়নি তারউপর করবে সাঁজ-গোজ!
বাড়ি থেকে আসার সময় রিনি তার বড় বোনকে সুন্দর করে পরিপাটি করে দিয়েছে। জোর করে হালকা ফাউন্ডেশন, আইলাইনার ও লিপস্টিক দিয়ে দিয়েছে। আর রিহাকে সাঁজানো লাগেনা। পাকনা মেয়ে নিজেই ভালো সাঁজতে পারে।
জার্নি করে আসার কারনে সবাইকে আধঘণ্টা বিশ্রাম করে ফ্রেশ হয়ে তারপর গার্ডেন সাইডে আসতে বলেছে। রিথী রিহাকে আগে ফ্রেশ হতে পাঠায়। ওদের আগেই ওই তিনটা মেয়ে ফ্রেশ হয়ে এখন বসে বসে মেকআপ করছে আর রিথীদের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মেয়ে তিনটাকে দুই বছর আগে রিথী দেখেছিল। তখন ওই মেয়েগুলো সবে কলেজে পড়তো। আর এখন তো ভার্সিটিতে নতুন ভর্তি হয়েছে। রিথী খেয়াল করে মেয়েগুলো ওকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। বাড়ি থেকে বের হবার সময় রিথী জার্নি করবে বলে হিজাব পড়ে এসেছে। এমনিতে রিথী হিজাব মাঝে মাঝে কোথাও যাওয়ার সময় পড়ে তাছাড়া পড়ে না। নিজে নিজে ঠিক করে পড়তেও পারেনা। রিহা ফ্রেশ হয়ে বের হলে রিথী যায়। রিহা ও রিনি মিলে রিথীর ব্যাগ প্যাক করেছে আর রিহা নিজেই ঠিক করে দেয় যে সন্ধ্যার জন্য কোন ড্রেসটা প্রিফারেবল তার বোনের জন্য।
রিথী কালো রঙের জর্জেটের একটা থ্রিপিস পড়ে যেটাতে ফুল বডি কালো সুতার কাজ ও কালো স্টোন বসানো। মাগরিব নামাজের আজান হয়ে গেছে তাই রিথী একবারে ওজু করে বের হয়। আসরের নামাজটা তার মিস হয়ে গেছে। এখন দুই ওয়াক্তের নামাজ একসাথে পড়বে। রিথী সাথে করে আনা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে যাবে তার আগে মেয়েগুলোকে বলে যাতে ফোনে অন করা মিউজিক অফ করে। রিথীর কথা শুনে একটা মেয়ে অফ করতে নেয় তখন আরেকটা মেয়ে যে কিনা একটু বেশি মর্ডান! সে বলে,
–হেই ইউ, এখানে তুমি একা থাকছো না যে নিজের ইচ্ছে মতো যা চাইবে তা পাবে। রুম শেয়ারে থাকছো তো যেমন আছে তেমন মেনে নেও। নামাজ পড়ছো ভালো কথা পড়ো। আমাদের কেনো ডিস্টার্ব করছো? নিজের স্বামীকে তো ধরে রাখতে পারলে না! এখন এসেছে নামাজ পড়তে!
রিথী বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে তো শুধু নামাজে বিঘ্ন হবে তাই কয়েকমিনিটের জন্য মিউজিক অফ করতে বলেছিল। মেয়েগুলো আজান হবার সময়েও মিউজিক অফ করেনি। তাই রিথী রিকুয়েস্ট করেছিল। এই জন্য তাকে তার স্বামীর মৃত্যুর কথা বলবে! রিথীর চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে। রিহা এসব দেখে রেগে যায়। রেগে রিহা বলে,
–এই! তোমাদেরকে আমার আপু কি এমন বলেছে যে তোমরা আমার আপুকে কাঁদাও? নামাজের সময় যে গান-বাজনা শুনে না তা কি জানো না? আমি এতো ছোট তাও জানি আর তোমরা জানো না!
রিহার কথায় ওই মেয়েটা রেগে যায়। ওদের মধ্যে একজন ওই মেয়েটাকে শান্ত হতে বলছে আর আরেকজন উস্কে দিচ্ছে। ওই মেয়েটার নাম সানভি। আর সানভিকে শান্ত হতে বলছে মালিহা আর সানভিকে উস্কে দিচ্ছে সারিকা।
সানভি রিহার দিকে আঙুল তুলে বলে,
–হেই লিটল গার্ল, কিপ ইউর মাইথ সাট। তোমরা তোমাদের মতো থাকো। আমাদেরকে বাঁধা দেবার ট্রাই করবে না। নিজের বাড়ি পাওনি যে সবকিছুতে নিজের মতো চলতে হবে।
রিহা মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
–সেম টু ইউ। তুমিও নিজের বাড়ি পাওনি যে নিজের মতো করে চলবে।
এবার সারিকা বলে,
–দুই বছর আগে তো বড় বোনের মুখের বুলি ফুটতো আর এখন ছোট বোনের। বড় বোনটাতো একবারে নিজের হাসবেন্ডকে শেষ করে ক্ষান্ত হয়েছে। এই পিচ্চিটার কথা ফুটেছে এখন।
সানভি ও সারিকাকে থামাতে মালিহা বলে,
–উফ সানু আর রিকা। প্লিজ ঝগড়া বন্ধ কর। এই আপু তো কয়েক মিনিটের জন্য অফ করতে বলেছে। নাথিং এলস। অফ না করলে হেডফোন লাগিয়েও তো শুনতে পারি আমরা।
রিহা আবার কিছু বলতে নিবে তার আগেই রিথী চোখ রাঙিয়ে মানা করে দেয়। রিহা সবসময় তার বড় বোনকে ভয় পায় কারন ওর বড় বোন প্রচন্ড রাগী। কিন্তু ওর দুলাভাই নিদ্র মারা যাবার পর থেকে ওর বড় বোনটা একদম নিশ্চুপ নিরবতায় নিজেকে আচ্ছাদিত করে ফেলেছে। কারো সাথে রাগ দেখায় না। কথা বলতে চায়না। পারোতো পক্ষে সবাইকে এড়িয়ে চলে। তাই রিহাকে যখন রিথী চোখ রাঙালো তখন রিহা ভয় পায়নি বরং অনেকটা খুশি হয়েছে। রিহা অনেকদিন পর তার বোনের চোখ রাঙানো দেখেছে। যে বোন তাকে কোনো ভুল করলে সেটা না শুধরানো পর্যন্ত রাগ ঝারা থামাতো না সেই বোনের নিশ্চুপতা রিহাকে কস্ট দেয় অনেক।
মালিহার অনেক বুঝানোতে সানভি ও সারিকা নিজেদের কানে হেডফোন লাগিয়ে নিজেদের মেকআপ করতে থাকে। আর রিথী নামজ পড়ে নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।