তোর_মনের_অরণ্যে,৩৮,৩৯

তোর_মনের_অরণ্যে,৩৮,৩৯
সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩৮.

-“কি মিস্টার ইমরান আপনি বুঝি এখানে আমাকে আশা করেননি তাইনা? সোহা বাঁকা হেসে বলে ওঠে ।

-” আরে উনি তোমাকে ভূত ভাবছেন হয়তো। আমন ও বাঁকা হেসে বলে ওঠে।

-“হুম তাইতো উনিতো নিজের হাতে তোকে মারার ব্যবস্থা করে এসেছিলো তাইনা হটাৎ করে তোকে বেঁচে থাকতে দেখলেইতো ভূত দেখার মত মনে হবে তাইনা। অ্যাস ও বলে ওঠে।

-“ওহ হ্যাঁ তো আমিও না ভুলে গেছি। তবে চিন্তা করবেন না মিস্টার ইমরান মেহতা আমি কোনো ভূত নই মানুষ দাঁড়িয়ে আছি। সোহা এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে।

-” আরে বসুন বসুন মিস্টার ইমরান আপনি এক্ষুনি দাঁড়িয়ে পড়লে হবে কি করে এখনও তো অনেক কিছুই বাকি আছে ততক্ষণে হয়তো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য পা ভেঙে পড়ে যেতে পারেন। আমন হাত গুটিয়ে বলে ওঠে।

ইমরান মেহতা ওদের কথা শুনে চুপচাপ বসে পড়ে। সোনিয়া মল্লিক এখনও একইভাবে তাকিয়ে আছে। এদিকে সোহা আমন অ্যাসের কথা শুনে বাকিরা চমকে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে এখানে কি কথা বলছে সেটাই বুঝতে পারছেনা।

-“অ্যাস এইসব কি কথা বলছো এখানে? এখানে আজকে একটা জরুরী কথা হচ্ছে আর সেখানেই কি সব কথা বলে যাচ্ছিস? সম্রাট চৌধুরী বলে ওঠে।

-” এখানে কি কথা হচ্ছে সেটা একটু পরেই দেখতে পাবেন মিস্টার চৌধুরী। আর স্যরি আমি এখন আমার ডিউটিতেই আছি তাই এখন আমি না কারোর মেয়ে আর না কারোর পরিচিত তাই চুপ করে বসে থাকলে আপনার জন্য ভালোই। অ্যাস কাট কাট কথা বলে ওঠে।

অ্যাসের কথা শুনেই সম্রাট চৌধুরীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রথম তিনি তার মেয়ের এমন রূপ দেখছেন একদম গম্ভীর সিরিয়াস তেজী কিন্তু তার মেয়ের কথা গুলো শুনেই আরো বেশি অবাক হয়ে গেছে কী বলতে চাইছে অ্যাস সেটা তিনি এখনও বুঝতে পারেনি ডিউটি মানে তাও এই বাড়িতে কিসের ডিউটি। তাই তিনি অবাক চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

-“ডিউটি মানে কিসের ডিউটির কথা বলছো তুমি আয়েশা বেটা। সাজিদ মল্লিক অবাক হয়ে বলে ওঠেন।

-” ডিউটি! কিসের ডিউটি মানে সেটাতো মিস্টার ইমরান ভালো বলতে পারবেন তাইনা মিস্টার ইম আমরা কারা? আচ্ছা মনে নেই ঠিক আছে আমরাই না হয় বলে দেই আমরা কিসের ডিউটিতে আছি। নীহার বলে ওঠে।

-” ব্ল্যাক ক্যাট নাম শুনেছেন তো? এন.এস.জি আন্ডার কভার অফিসার। অ্যাস বলে ওঠে।

অ্যাসের কথা শুনেই সোনিয়া মল্লিকের অবস্থা জলে কুমির ডাঙায় বাঘ এমন। সাজিদ মল্লিক ও চমকে গেছেন। ইমরান মেহতা শুধু শুধু বসে ঢোক গিলে যাচ্ছে আর ঘাম মুছে যাচ্ছেন।

-“ত ত তুমি কে? এরই মধ্যে সোনিয়া তুতলিয়ে উঠে।

-” কেনো কারোর মুখের সাথে মিল পাচ্ছেন বুঝি? সোহা বাঁকা হেসে বলে ওঠে ।

-“এটা কি করে হতে পারে? সেই মুখ? সেই একই সব কিছু? কি করে সম্ভব? সোনিয়া মল্লিক বলে ওঠে কেঁপে কেঁপে।

-” কেনো সম্ভব নয় মিসেস সোনিয়া? আর কার সাথে আমার মুখের এত মিল পাচ্ছেন শুনি আমিও একটু। সোহা আবারো তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে ওঠে।

-“সম্ভব নয় কারণ সেতো বহু বছর আগে মারা গেছে কোনো ভাবেই বেঁচে থাকতে পারেনা। সোনিয়া মল্লিক উত্তেজনার বশে বলে ওঠে।

-“রাইট প্রায় চব্বিশ বছর আগে মারা গেছে তাইনা তাহলে সত্যি তো এই মুখ কিভাবে আবার সামনে এলো? সোহা মুখে আওয়াজ তুলে বলে ওঠে।

সোহার মুখে থেকে এমন কিছু শুনেই সোনিয়া মল্লিক প্রায় আতকে উঠেছে। এবার যেনো মনে হচ্ছে তার দম টা প্রায় বেরিয়ে আসবে। আর সাজিদ মল্লিকের ও অস্বস্তি শুরু হয়ে গেছে সোহার কথা শুনে। আরহান সব কিছু শুনছিলো এতক্ষণ কিন্তু সোহার মুখে বছরের হিসাব শুনতেই সেও চমকে যায়।

-“সোহা চব্বিশ বছর মানে তুই কি বলতে চাইছিস? আরহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” ভাইয়া আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো সব কিছু জানতে পারবে। সোহা বলে ওঠে।

এবার যেনো বাড়ির সবাই চমকে ওঠে সোহা আর আরহানের কথা শুনে। ভাইয়া তারমানে কি সোহা আর আরহান আগের থেকে পরিচিত। আমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে হচ্ছে টা কি

-” তা মিসেস সোনিয়া মল্লিক আমাকে কি ঠিক এই মহিলার মতোন লাগছে দেখুন তো একটু? সোহা তার ফোনে একটা ছবি বের করে ওদের সকলের সামনে তুলে ধরে।

-” আরিনা! প্রায় আতকে উঠে সোনিয়া মল্লিক ও সাজিদ একসাথে বলে ওঠে।

-“যাক চিনতে পেরেছেন তাহলে এখনও মনে রেখেছেন এই মুখ। স্মৃতি শক্তির তারিফ করতে হয়। সোহা বিদ্রুপ করে বলে ওঠে।

-“কে তুমি? কি তোমার পরিচয় আর এইসব কিছু তুমি কি করে জানলে? আর আরিনার সাথে তুমি কি করছো? তার মানে কি আরিনা এখনও বেঁচে আছে? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব আরিনা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে ? সাজিদ এক নিঃশ্বাসে বলে ওঠে।

-” সত্যি এটা তো সবথেকে বড় প্রশ্ন যেখানে আপনি নিজেই আরিনা মল্লিক অর্থাৎ আপনার প্রথম স্ত্রী কে মেরে ফেলেছেন সেখানে বেঁচে কি করে থাকতে পারে তাইনা মিস্টার সাজিদ মল্লিক? সোহা কঠিন কন্ঠে বলে ওঠে।

-” এইসব কি বলছিস সোহা মামকে বাপি মেরেছে মানে? মাম তো অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আরহান বলে ওঠে।

-” ওহ রিয়েলি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে মিস্টার মল্লিক। আপনি যে প্ল্যান করে তাকে মেরে ফেলেছেন সেটা বুঝি বলেননি আপনার ছেলে কে। সোহা বিশ্রী হেসে বলে ওঠে।

সোহার কথা শুনে ওখানে থাকা উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি বলছে এইসব কথা। আরিনা মল্লিক এই নাম তারা প্রথম শুনছে কিন্তু সোহার সাথে এই মহিলার কি সম্পর্ক সবাই ভেবে চলেছে। এমনকি অ্যাস নীহার আকাশ সানি সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কারন তারাও জানে না এইসব কথার মানে।

-“এই কে তুমি আর এখানে এসে এই সব কি কথা বলে যাচ্ছো শুনি এখনই এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। মণিকা তেড়ে এসে বলে ওঠে।

-” ওহ জাস্ট শাট আপ ডার্টি ওম্যান । সোহা হুঙ্কার করে বলে ওঠে।

-“এই তোমার সাহস তো কম নয় আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকেই নোংরা মেয়ে বলে গালি দাও এখুনি এই বাড়ির থেকে বেরিয়ে যাবে তুমি। মণিকা রাগে চিৎকার করে বলে ওঠে।

-“ওহ রিয়েলি এটা তোমার বাড়ি নাকি? আচ্ছা তুমি একবার তোমার বাপি কে অন্তত জিজ্ঞেস করে নাও এটা আসলেই ওনার বাড়ি কিনা তারপর তো নিজের বাড়ি বলবে ? সোহা বলে ওঠে।

-” ওহ আর একটা কথা আমি আমার বাড়িতেই দাঁড়িয়ে আছি তাই কাউকে বেরিয়ে যেতে হলে সেটা তোমরা যাবে আমি নই। সোহা বলে ওঠে।

-” মানে কি বলতে চাইছো তুমি? এটা অবশ্যই আমার বাপির বাড়ি আর সেই সূত্রে এই বাড়ি ও আমার। আর তোমার বাড়ি এটা স্বপ্ন দেখছ নাকি? মণিকা তর্ক করে বলে ওঠে।

_” অবশ্যই না। এটা তোমার বাবার বাড়ি ও নয়। এটা মিস আরিনা জৈনের বাড়ি । নাকি তোমার বাবার বাড়ি। তাই তোমার বাড়ি হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সোহা তাচ্ছিল্য করে বলে ওঠে।

-“আর এই বাড়িতে থাকার একমাত্র অধিকার এই বাড়ির দুই ছেলে আরহান মল্লিক আক্রম মল্লিক ও আমি সোহা জৈনের আছে। কারণ বাড়িটা আমাদের তোমাদের নয়।

-“মানে এই বাড়ি মামের? আরহান জিজ্ঞেস করে ওঠে।

-” ইয়েস ভাইয়া এই বাড়ি মামের। সোহা আরহানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

-” তোমার অধিকার মানে? তুমি এইসব কথা কি করে জানলে? কে তুমি? সাজিদ মল্লিক বলে ওঠে।

-” ডটার অফ আরিনা মল্লিক ওপশ আরিনা জৈন । সোহা বলে ওঠে।

সোহার কথা শুনে রুমের মধ্যে একটা বড়ো সড়ো বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। সাজিদ মল্লিক ধপাস করে দাঁড়িয়ে থাকা থেকে বসে পড়ে। আর রুমে থাকা বাকিরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সোহার দিকে । আমন এক ভাবে তাকিয়ে আছে সোহার দিকে তার মাথার ভিতরে দ্রুত চলতে থাকে প্রায় একমাস আগের ঘটনা যেদিন সে সোহাকে নামাজরত অবস্থায় দেখেছে তার মনে কৌতুহল ও জেগে ছিল সে নিজের মত করে ভেবে নিয়েছিলো। এর পর সোহা নিজেও বলতে চেয়েছিলো তার পরিচয় এর ব্যাপার নিয়ে। কিন্তু সে শুনতে চাইনি তারমানে এটাই সত্যি যে সোহা হিন্দু নয় সে মুসলিম। সে মুসলিম বংশের সন্তান। তাহলে শ্রেতা জৈন উনি কে আর জৈন পরিবারের সাথে বা কি সম্পর্ক সোহার ভাবতে থাকে আমন নিজের মনে।

এদিকে আক্রম এতক্ষণ সব কিছু শুনলে ও এই মুহূর্তে সোহার বলা কথা গুলো শুনেই সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে। সোহা তার মায়ের মেয়ে মানে তার বোন। তার মা কে ঠিক করে তার মনে নেই তাই সে সোহাকে ঠিক করে চিনে উঠতে পারিনি। কিন্তু সে তার মায়ের নাম জানে তার মায়ের ছবিও দেখেছে কয়েকবার কিন্তু সেই ভাবে মনে নেই তার মায়ের সব গল্পই শুনেছে সে তার ভাইয়ের থেকে। কিন্তু তার যে একটা বোন আছে সেটা জানতো না। আক্রম আরহানের দিকে প্রশ্ন চোখে তাকালে আরহান ইশারা করে। আক্রম এক পা এক পা করে সোহার দিকে এগিয়ে যায় সোহার সামনে দাঁড়িয়ে এবার সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজের বোন কে দেখতে থাকে। তার বোন কে একদম তার মায়ের মতো দেখতে তাই এরা দেখে এমন চমকে গেছিলো। পুরো তার মায়ের জেরক্স কপি দাঁড়িয়ে আছে। আক্রম কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে নিয়ে সোহাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। সাথে সোহা ও জড়িয়ে ধরে তার ভাই কে। সে ছোটো থেকেই জেনে এসেছে তার আরো দুটো ভাই আছে কিন্তু সময় এবং সুযোগ কোনোটাই হয়নি তাদের ভাইদের দেখার আজকে সে পূর্ণ তার ভাইদের সে পেয়ে গেছে। আরহান ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখে পানি নিয়ে দেখে যাচ্ছে তার আত্মার দুই অংশ। তার আত্মা তার মায়ের সন্তান তার ভাই ও বোন আর তার দুই সহোদর। আর রুমের মধ্যে থাকা বাকিরা তাজ্জব হয়ে সব কিছু দেখে যাচ্ছে । সব কিছুই যেনো তাদের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আমন কিছু কিছু বুঝতে পারলেও আভা চৌধুরী সম্রাট চৌধুরী থামের মতো দাঁড়িয়ে আছে তারা কিছুই বুঝতে পারছে না, তারা এর আগে শুনেছিল যে সাজিদ মল্লিকের আগের স্ত্রী মারা গেছেন আর আরহান আর আক্রম তার আগের স্ত্রীর সন্তান কিন্তু এইসব কি শুনছে তারা। অ্যাস নীহার আকাশ সানি এতদিন সোহার সাথে থাকলেও তারা এইসব কিছুই জানতো না। তাদের তো এখন রীতিমত মাথা খারাপের জোগাড় হয়েছে সোহা যদি আরিনা মল্লিকের মেয়ে হয় তাহলে শ্রেতা জৈন ধীরাজ জৈন কে? তারা তো এতদিন জানতো সোহা জৈন পরিবারের মেয়ে শ্রেতা জৈন আর ধীরাজ জৈন এর মেয়ে তাহলে আর ওদের দেখেও তো কখনো মনে হয়নি যে সোহা ওদের মেয়ে নয়। আর তাছাড়া ও সোহার সমস্ত সার্টিফিকেটেও শ্রেতা জৈন ও ধীরাজ জৈন এর নাম আছে তাহলে কি সম্পর্ক তাদের মধ্যে সেটাই বুঝতে পারছে না তারা।

চলবে….. ❣️

#তোর_মনের_অরণ্যে
#সাবিয়া_সাবু_সুলতানা
৩৯.
আরহান অশ্রু ভেজা চোখে তার আত্মা তার মায়ের দুই অংশকে দেখে যাচ্ছে যারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নিজেদের ইমোশনকে কন্ট্রোল করে যাচ্ছে। কিন্তু আরহানের মাথায় জমেছে আরো কিছু প্রশ্নের স্তূপ যা তার মাথায় কিলবিল করছে উত্তর জানার জন্য। আক্রম সোহা একে অপরের থেকে সরে দাঁড়াতে আরহান প্রশ্ন করে ওঠে।

-“সোহা আমি বুঝতে পারলাম এটা মামের বাড়ি মানে কি করে? আমিতো জানতাম মামের কেউ নেই তাহলে?

-” বাহ মিস্টার মল্লিক আপনার তারিফ করতে হয় কী সুন্দর মিথ্যা কথা বলে রেখেছেন। আচ্ছা আর কি কি মিথ্যা বলেছেন বলুনতো? সোহা সাজিদ মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে।

সোহার কথা শুনে সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ।সাজিদ মল্লিক চুপ করে পাথরের মতো বসে আছে। চোখ মুখে স্পষ্ট অপরাধ বোধ ফুটে উঠেছে। আর তার পাশে সোনিয়া মল্লিক ঘাবড়ে আছে সাথে ইমরান মেহতা ও।

-“এই বাড়িটা ইনফ্যাক্ট বাড়ি কেনো এই যে পুরো প্রপার্টি সব কিছুই মামের। আর মামের অবর্তমানে
এই সব কিছু তোমাদের দুইজনের এই ভাবেই উইল করা আছে আর সেইজন্য তোমরা এখনও এই বাড়িতে আছো নাহলে মামের সাথে সাথে তোমরাও এই বাড়ির থেকে হারিয়ে যেতে। কি ঠিক বলছি তো মিসেস সোনিয়া মল্লিক। সোহা বলে ওঠে।

-” সোহা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না প্লিজ তুই সব কিছু পরিষ্কার করে বল। আর এই সব কিছুর মধ্যে বাপি কোথায় থেকে এলো আর মামের কি হয়েছে তুই প্লিজ সবটা বল? আরহান বলে ওঠে।

-” হ্যাঁ বোনু বল সবটা আমিতো কিছুই জানি না প্লিজ বল। আক্রম বলে ওঠে।

সোহা ওখানে দাঁড়ানো সবাইকে একবার দেখে নেয় আমনের দিকে তাকাতেই সেই ইশারা করে। আমনের মুখে হালকা হাসি আর চোখের ইশারায় সোহা একটা নিঃশ্বাস নেয় সে জানে আমন সব সময়ে সব পরিস্থিতিতে আমন তার সাথে আছে পাশে আছে। আভা চৌধুরী সম্রাট চৌধুরী অ্যাস নীহার আকাশ সানি ও এক পাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোহার কথা শোনার জন্য। সোহা সবাইকে দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে।

-“আরিনা মল্লিক অর্থাৎ আরিনা জৈন একজন হিন্দু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। আরিনা জৈন আর ধীরাজ জৈন ছিলেন দুই ভাইবোন। ধীরাজ জৈন নিজেদের পরিবারিক বিজনেস এর জন্য লন্ডনে নিজের বাস গড়ে। আর দিল্লিতে আরিনা জৈন নিজের বাবা আশিস জৈন এর সাথে থাকতো। দিল্লীতে আরিনা জৈন এর সাথে পরিচয় হয় মিস্টার সাজিদ মল্লিকের তিনি আরিনা মল্লিক কে দেখেই তার প্রেমে পড়ে যান এরপর কৌশলে তার সামনাসামনি হতেন আরিনা জৈন ও একটু একটু করে দুর্বল হতে থাকেন এই মিস্টার সাজিদ মল্লিকের প্রতি আর তারপর থেকেই শুরু হয় তাদের প্রনয়। এইরকম করেই বেশ চলছিলো কিন্তু এরই মাঝে আশিস জৈন জানতে পারেন তাদের সম্পর্ক তিনি মেয়ে কে আটকে রাখেন দুইজন দুই ধর্মের তাই তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। বেশ কয়েকদিন ঘর বন্দি হয়ে থাকার পর আরিনা জৈন সাজিদ মল্লিকের সাথে যোগাযোগ করে পালিয়ে যান। সাজিদ মল্লিক সাধারণ পরিবারের ছেলে ছিলো। বেশ কয়েকমাস কেটে যাওয়ার পর আশিস জৈন নিজের মেয়ে কে খুব ভালোবাসতেন তাই তিনি মেয়ের খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সাজিদ মল্লিক একটা সাধারন পরিবারের ছেলে একটা বেসরকারী অফিসে চাকরি করে কোনো মতে নিজেদের সংসার চালায়। এরপরে আশিস জৈন নিজের মেয়ের নামে এই বাড়ি কিনে দেন সাথে তার মেয়ের নামে কিছু প্রপার্টি দেন যেগুলো দিয়েই তোমাদের এই মল্লিক এম্পায়ার। যাইহোক এইভাবেই খুব ভালো ছিলেন তারা বিয়ের দুই বছর জন্ম হয় তোমার ভাইয়া। বেশ ভালোই সংসার চলছিল আর তুমিও বড় হতে লাগলে আশিস জৈন ও মাঝে মাঝে এসে মেয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে যেতেন। তোমার যখন পাঁচ বছর বয়েস তখন জন্ম হয় আক্রম ভাইয়ের। মাম তোমাদের দুইজন কে পেয়ে খুব খুশি ছিলেন। তবে এরপর থেকে আসতে আসতে সব কিছু পাল্টাতে শুরু করে। সাজিদ মল্লিকের এর নাম তখন বিজনেসম্যানদের মধ্যে সেরা হয়ে উঠেছে তার বেশির ভাগ সময়ে কেটে যেতো বাইরে। আর এইসব কিছুর মাঝে তার জীবনে আসেন আরেক নারী মিসেস সোনিয়া। নিজের রূপের জালে সাজিদ মল্লিক মোহিত করে তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক শুরু করেন। বাড়তে থাকে তাদের ঘনিষ্ঠতা। আর এইসব কিছুর জন্য তিনি বাড়িতে মাসে একবার কি দুইবার আসতেন তাছাড়া তার বাকিটা সময় কেটে যেতো বিজনেস আর সোনিয়া কে নিয়ে। আরিনা জৈন এই লোকটা কে খুব ভালোবাসতো তাই কখনো সন্দেহ মনে আনেনি তিনি তোমাদের দুজন কে নিয়েই কাটিয়ে দিতেন আসতে আসতে তোমরা বড় হতে শুরু করলে। আর সাজিদ মল্লিক বাইরে সোনিয়ার সাথে নিজের অবৈধ্য সংসার করতেন। এরই মাঝে সোনিয়া প্রেগনেন্ট হয়ে যান তখনই তিনি সাজিদ মল্লিক কে ফুসলিয়ে বিয়ে করে নেন তখন সাজিদ মল্লিক এতটাই সোনিয়াতে মজে ছিল যে সোনিয়ার কোনো কথা বারণ করতে পারেননি। জন্ম হয় মণিকার। বাইরে সাজিদ মল্লিক সোনিয়া ও মণিকাকে নিয়ে খুশিতে কাটিয়ে দিত। মণিকার জন্মের পর থেকে সাজিদ মল্লিক একদম বাড়িতে আসা ছেড়ে দিলেন তখন তার ধ্যান জ্ঞান সবটাই ছিল সোনিয়া আর মণিকা। তার যে আরো দুটো ছেলে আছে একটা সংসার আছে সেটা তিনি ভুলে যান। আরিনা মল্লিক সাজিদ মল্লিক বাড়িতে না আসার জন্য মনে মনে অস্থির হতেন যোগাযোগ করলে সাজিদ মল্লিক তার কাজের বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যেতেন। তবুও আরিনা মল্লিক নিজের মনে স্বামীর জন্য সন্দেহ আনেনি। তিনি তার ছেলেদের নিয়ে কাটিয়ে দিতেন। সাজিদ মল্লিক বছরে একবার কি দুইবার বাড়িতে আসতেন। কারণ তিনি কোনও ভাবেই আরিনা মল্লিককে হাত ছাড়া করতে চাইতেন না আর কেইবা চাইবে পয়সার খনিকে হারিয়ে ফেলতে তাই তিনি যোগাযোগ রেখেছিলেন। এই ভাবেই সময়ে গড়িয়ে যেতে লাগে। সোনিয়া মল্লিক সাজিদ মল্লিককে জোর করতে থাকেন তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু বাড়িতে আরিনা মল্লিক থাকার জন্য তিনি এই রিস্ক নিতে চাইতেন না তখন সোনিয়া মল্লিক প্ল্যান করেন যে আরিনা মল্লিককে রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলার। আর এই প্ল্যানে সাজিদ মল্লিক ও সায় দেয়। সেই মতো প্ল্যান করে সাজিদ বাড়ি ফেরেন। সব সময়ে আরিনা মল্লিকের কাছে কাছে থাকতেন আবারো একদম প্রথমে মতো সম্পর্ক করে নেওয়ার জন্য দূরে থাকার জন্য কিছুটা দূরত্ব হয়েছিলো সেটাই মেটানোর চেষ্টা ছিল। তোমাদের দুই ভাই থাকার জন্য প্ল্যান সফল হচ্ছিলো না তাই তোমাদের কে বোডিং পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে এতেও সাজিদ মল্লিক কে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো আরিনা মল্লিক কে রাজি করাতে। প্রায় পাঁচ মাসের প্রচেষ্টায় সফল হয় সাজিদ মল্লিক। এই পাঁচ মাস তিনি বাড়িতে থেকে তার প্ল্যান মত কাজ করে গেছে। তোমাদের ও বোডিং পাঠাতে সফল হয়। তবে এর মাঝেই সাজিদ মল্লিকের উপর আরিনা মল্লিকের সন্দেহ হয় তাকে প্রায় রাতে ফোনে কথা বলতে দেখত। তিনি নিজের স্বামীর উপর সন্দেহ করছে ভেবে নিজের উপর রাগ হতেন। তোমাদের বোর্ডিং পাঠিয়ে দেওয়ার পরের দিন সাজিদ মল্লিক তার প্ল্যান এর অন্তিম টানার জন্য সব কিছুই রেডি করে নেন। তিনি সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আরিনা মল্লিককে ফোন করে বাইরে ডাকেন সারপ্রাইজ এর নাম করে। আরিনা মল্লিক ও রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েন। তবে মাঝ পথে আসতে তার ফোনে একটা ভিডিও আসে। যেটা দেখতেই তার পুরো পৃথিবী থমকে যায়। তিনি এটাও জানতে পারেন তার মৃত্যু খুব নিকটে তার স্বামী তার মারার জন্য প্ল্যান করেছে। তিনি পাথর হয়ে যান সব কিছু জানার পর কিন্তু তার ছেলেদের কথা মাথায় আসতে তার ধ্যান ভাঙে কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে সামনের দিকে থেকে একটা ট্রাক তাদের গাড়ির দিকে ধেয়ে আসে। ট্রাক টা গাড়িতে ধাক্কা মারে গাড়িটা ধাক্কা খেয়ে কিছুটা দূরে ছিটকে পড়ে যায় আর তার পরেই ব্ল্যাস্ট করে যায় আর সব শেষ হয়ে যায়। আর দূরে থেকে সবটাই দেখ ছিল মিস্টার সাজিদ মল্লিক আর সোনিয়া মল্লিক। গাড়িটা ব্ল্যাস্ট হবার পরই ওখানে থেকে কেটে পড়েন সাজিদ মল্লিক ও সোনিয়া মল্লিক । তাদের প্ল্যান কাজ করে গেছে সেই আনন্দে ফিরে যান। তারপর কিছুদিন নাটক করে আবার তার জীবনে ফিরে যান। তবে এর মাঝে আরো একটা ঝামেলা তৈরী হয়ে যায়। আরিনা মল্লিকের মৃত্যুর পর সব কিছু ওনার দুই ছেলের নামে চলে যায়। আর ওনার দুই ছেলের যদি কিছু হয় মৃত্যু বা নিখোঁজ হয় তাহলে সব কিছু চ্যারিটিতে চলে যাবে। তাই তোমরা সেই সময়ে বেঁচে যাও। আর তার ঠিক পাঁচ বছর পর তোমাদের কে জানানো হয় যেহেতু তোমাদের জানাতেই হবে তাই তখনই জানানো হয় যে তোমাদের মা অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছে।

সোহা একসাথে সব কিছু বলেই থেমে যায়। তার চোখ দুটো পানিতে ভরে আছে গাল দুটো ভেজা ভেজা। আরহান তার মায়ের প্রতি এই নির্মম কাহিনি শুনেই ভেঙে পড়ে সাথে আক্রম ও। আমন সোহার কাছে গিয়ে এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে নেয় ভরসা দেয়। যাতে এই পুরোনো তিক্ততার জন্য সোহাও ভেঙে না পড়ে । রুমের মধ্যে থাকা বাকিরা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারাও আজ স্তব্ধ হয়ে গেছে। অ্যাস নীহার আকাশ সানি একসাথে এসে সোহাকে জড়িয়ে ধরে। সম্রাট চৌধুরী ও আভা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে গেছে সব কিছু শুনে । সাজিদ যে এতটা নিকৃষ্ট জানতে পেরে ঘৃণা হচ্ছে তাদের।

সাজিদ মল্লিক মাথা নিচু করে বসে আছে চুপচাপ। সোহার সাথে সাথে তিনিও পুরোনো দিন গুলো মনে করতে থাকে তিনি ও তার অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে কিন্তু এখন হাত কামড়ালেই কি কিছু আর ফিরে পাবে। যা চলে গেছে তার আর পাবার নয়। তাই এখন যতোই অপরাধ বোধে ভুগুগ না কেনো এই অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাবে না। সোনিয়া মল্লিক সব কিছু চুপ করে আছে সাথে ইমরান মল্লিক ও । তবে ইমরান মল্লিক বসে বসে পালানোর প্ল্যান করছে কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব। বাড়ির ভিতরে গার্ডে ভর্তি সাথে বাড়ির বাইরেও গার্ড দিয়ে রেখেছে তাই সহজেই পালাতে পারবেনা চাইলেও না। তাই চুপ করে বসে আছে।

কিন্তু এখনও কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। এখনও কিছু ধোঁয়াশা রয়ে গেছে যেগুলো পরিষ্কার হওয়া চাই। আরহান সব কিছু শুনে ভেঙে পড়লেও শেষে তার মায়ের শেষ পরিণতির কথা শুনে তার মনে প্রশ্ন জাগে তার মা যদি তখনই শেষ হয়ে যায় তাহলে সোহাকে? সোহা কোথায় থেকে এলো আর তার মায়ের মুখের সাথে এত মিল এলো কোথায় থেকে। আর সাথে এত কথা জানলো বা কি করে সোহার পক্ষে তো এত কিছু জানা সম্ভব নয় তাহলে? এখনও সব প্রশ্ন রয়ে গেছে। তার মায়ের মৃত্যু রহস্য পরিষ্কার হলেও এখনও আসল রহস্য রয়ে গেছে সোহার রহস্য? কে এই সোহা? কি তার আসল পরিচয়। আর সেতো কিছুক্ষণ আগেই বলেই নিজের মুখে বললো যে সে আরিনা মল্লিকের মেয়ে কিন্তু এটা কি করে সম্ভব সোহা তো বললো তার মা মারা গেছে কিন্তু তাহলে সোহা কোথায় থেকে এলো আর কেনো বা বললো সে তার মায়ের মেয়ে আর তার মায়ের মত দেখতেই বা কেনো? এই প্রশ্ন গুলো আরহানের মাথায় ঘুরতে থাকে। যার প্রশ্নের উত্তর একমাত্র দিতে পারেন সোহা।

চলবে…. ❣️

ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন…। নিজেদের মতামত জানাবেন ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here