তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৭,৮
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৭
শ্রাবণের অগোছালো বাতাসে জানালার সাদা পর্দাগুলো এলোমেলো উড়ছে। দূর আকাশ কালো মেঘে সেজে আছে। এই বুঝি! ঝরঝর করে শ্রাবণধারা নামছে। ঘর ভর্তি লোকজন অথচ পিনপতন নীরবতা। বিয়েবাড়ির উৎসব মুখর পরিবেশটা কেমন জানো নিস্তেজ শোকসভায় পরিণত হয়েছে। সকাল সাতটা। ঘন্টা খানেক আগেই আহনাফ সাহেব, স্ত্রী মুনতাহা বেগম, ছোট ভাই জাহিদ ও তার স্ত্রীর সঙ্গে পৌঁছেছেন। ভোরে বন্ধু মাহির আহমেদের ফোন পেয়ে ক্ষান্ত থাকতে পারেননি তিনি, ছুটে এসেছেন সায়রাকে দেখতে। মাহির আহমেদ ফোনে জানিয়েছেন জরুরী তলব আছে। তাই দেরী না করে স্ত্রীকে নিয়ে ভোরেই রওনা হয়েছে। জাহিদ সাহেবের স্ত্রী জুলেখা ভীষণ কৌতূহল প্রবল মানুষ। জরুরী তলবের খবর শুনে তিনি শান্ত থাকতে পারেননি, স্বামীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে। খবর শুনতে বড় ভাই আর জায়ের সাথে ঠিক চলে এসেছে।
সবার চোখে মুখে বিস্ময়ের ছাপ। আহনাফ সাহেব চেয়ারে মাথা চেপে বসে আছেন। সামান্য দূরত্বে বিছানার সামনাসামনি চেয়ারটায় আরসাল বসে। আরসাল সায়রা মুখোমুখি।
বিছানায় মায়ের সাথে জড়সড়ভাবে ঠাই বসে আছে সায়রা। মুখশ্রী ভয়ে চুপসে গেছে। গত রাতে প্রচণ্ড জ্বর ছিল তার। যার রেশ এখনো কিছুটা রয়ে গেছে। গায়ে ভারী চাদর মুড়ানো, ঠাণ্ডার প্রলেপ থেকে বাঁচতে হাত পা চাদরে গুছিয়ে রেখেছে।
মাথা উঁচু করে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলাল সায়রা। সবার মুখ গম্ভীর। আরসালের দিকে তাকাতে দেখল, ক্রুদ্ধ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। সায়রা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নুয়িয়ে নিলো। অশ্রুস্নাত ভীতু আঁখি জোড়ায় টলমল চাহনি। মনে অভিশঙ্কা, তবে কি সত্যি শুনে সবাই তাকে চরিত্রহীনা ভাবছে? শাস্তি দিবে তাকে? কি শাস্তি দিবে!
সে যেই শাস্তি দেখ, সায়রা সব মাথা পেতে নিবে। তবুও কেউ যেন তাকে ঘৃণা না করে। আর যাই হোক ঘৃণা নিয়ে বাঁচা যায় না। মনের অধীরতা তীব্র শঙ্কা নিয়ে সায়রা মুখ খুলল। ভীতু স্বরে নত গলায় বলল,
–“আমি জানি আমি যা করেছি, তা ক্ষমার অযোগ্য! তবুও আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইবো। বার বার হাজারবার ক্ষমা চাইবো। আপনাদের যেই কোন শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো। তবুও কেউ আরসাল ভাইয়ের উপর এই সম্পর্কটা চাপিয়ে দিবেন না। আমার ভুলের শাস্তি আমাকে দিন, আরসাল ভাইকে না।”
জুলেখা বেগম রাগে ফোঁস করে উঠলেন। রাগে কটকট চাহনি সায়রার দিকে নিক্ষেপ করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
–“ভাইজান, আমি আগেই বলেছিলাম এই মেয়ে সুবিধার না। নিশ্চিত আমাদের ছেলেকে ফাঁসিয়েছে। দেখলেন! দেখলেন তো আমার কথা ঠিক মিলে গেল। এই মেয়েকে দেখতে যতটা সহজ সরল মনে হয়, ততটা সরল এই মেয়ে নয়। ভীষণ চতুর। দেখলেন, তো কি করে আমাদের ছেলেকে ফাঁসাল? যেই দেখেছে বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে। অঢেল টাকাপয়সার মালিক। সুদর্শন। ওমনি লোভে পড়ে গেল। তুখোড় বুদ্ধি খাটিয়ে জঘন্য আরোপ লাগিয়ে ফাঁসিয়ে নিলো আমাদের ছেলেকে। এই মেয়ের জন্য শুধু শুধু আমাদের ছেলের সম্মান নষ্ট হলো। সবার সামনে ছোট হলো। বিনা অপরাধে সাজা পেল। কত বড় বদমাইশ চারিত্রহীন মেয়ে! দেখেছ ভাবী?”
আহনাফ সাহেব ক্ষিপ্ত স্বরে বিরক্তি সহিত ধমক দিলেন,
–“আহ জুলেখা! চুপ করবে তুমি!”
–“অপরাধ নিবেন না বড় ভাইজান, এই মেয়ের চেহারায় যাবেন না, ভীষণ চালাক মেয়ে! না হয় এমন ভাবে কাউকে ফাঁসায়? চরিত্রহীনা মেয়ে কোথাকার!”
লজ্জা অপমানে সায়রার চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। মুখ বুজে, নত মাথায় জুলেখা বেগমের সব আরোপ শুনছে। বুক চিঁড়ে হাহাকার চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঘন ঘন নিশ্বাস ভারী হচ্ছে সায়রার। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এমনটা তো হওয়ারই ছিল। যে ছেলেমানুষী সে করেছে তার ফলস্বরূপ কোনো একজনকে তো চরিত্রহীনার ট্যাগ লাগারই ছিল। বিনাদোষে আরসাল কেন সেই ট্যাগ নিবে? দোষ যেহেতু সায়রার, সেই সব অপমান সায়রাই সহ্য করবে!
জুলেখার কথায় আরসাল রাগে ফোঁসফোঁস করছে। সিন্থিয়া বেগম জুলেখার প্রতিবাদে কিছু বলতে গেলে, সায়রা হাত চেপে থামিয়ে দেয়। নিচু গলায় থেমে আসা স্বরে,
— “মা তুমিই বলেছিলে কর্মের ফল সবাইকে পেতে হয়, এখন আমার সাথে যা হচ্ছে তা আমার কর্মের ফল। অপরাধ যেহেতু আমার! উনাদের আমার উপর রাগ জেদ প্রকাশ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। ”
সিন্থিয়া বেগম আহত দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ সাহেব ক্ষুণ্ণ নয়নে সায়রার মুখপানে চেয়ে ভাঙা স্বরে বললেন,
–“তুই তো আমার মেয়ের মত সায়রা! তোর থেকে এমন কিছু আশা করিনি ।বড় বাবার সাথে এতো বড় মিথ্যা বলতে পারলি? ”
সায়রা ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিল। এতবছর ভিতরে ভিতরে আহনাফ সাহেব মুনতাহা বেগমের নজরে ছোট হওয়ার ভয়ে প্রতিক্ষণ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। মনে অজানা শঙ্কিত ভয়টাকে সত্যি হতে দেখে, অস্থির হয়ে পড়ে সায়রা। চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। ডুকরে কেঁদে উঠে। আঁখিদ্বয় অনুতাপের অশ্রুতে জর্জরিত। আহনাফ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে জোর গলায় আওড়াল,
–“বেশ! সম্পর্কটা যেহেতু একটা ভুলে বোঝাবোঝির বসে হয়েছে। এই সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার কোন মানে হয়না। ভুল বোঝাবোঝি নিয়ে আর যাই হোক, সংসার হয় না। এতে আরসাল সায়রা দুজনই চিরকাল কষ্ট ভোগ করবে! আমার কথায় আরসাল সায়রার এংগেজমেন্ট হয়েছে। অনইচ্ছাকৃত সম্পর্কটা দুজনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খানিক থেমে বড় এক নিশ্বাস ফেলে আবার বললেন,
— “তো! এই সম্পর্কটাকে ভেঙে ফেলাই উত্তম।”
বাবার সিদ্ধান্তে আরসাল মাথা তুলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে একবার বাবার দিকে আরেকবার সায়রার দিকে তাকাল। সায়রার মুখপানে তাকিয়ে মন বোজার চেষ্টা করল। সায়রা নিশ্চুপ। সম্পর্ক ভাঙা নিয়ে চেহারায় ছিটাফোঁটা কষ্ট নেই তার। যেন এমন ঘোষণার অপেক্ষাতে সে এতকাল বসে ছিল। এতে আরসালের কেন জানো রাগ হলো। প্রচণ্ড রাগ!
আহনাফ সাহেবের ঘোষণায় সায়রার গলায় আটকে থাকা নিশ্বাস ফোঁস করে বেরিয়ে এলো। এবার হয়তো আরসালের জীবন নষ্ট করার অনুতাপ থেকে মুক্তি পাবে সে। সামান্য হলেও অনুতাপের আগুন শান্ত হবে তার।
আহনাফ সাহেব আবারো মুখ খুললেন,
–“আজকের পর এই নিয়ে কেউ সায়রাকে কোনপ্রকার দোষারোপ করবে না। তখন বয়স কম, অবুঝ ছিল! ছেলেমানুষির বসে ভুল করেছে। এ নিয়ে কেউ তাকে কথা শুনাবে না। বিশেষ করে জুলেখা তুমি! এব্যাপারে কোন প্রকার আলোচনা যেন এই ঘরের বাহিরে না যায়। এখানে সব মাটিচাপা দেওয়া হোক!”
আহনাফ সাহেবের কথায় ঘর ভর্তি বাকি সবাই সাই দিলো। মাহির আহমেদ বন্ধুর এই মহত্ত্ব দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি ভাবেননি বিষয়টা আহনাফ সাহেব পজেটিভলি নিবেন। যদি জানতেন তবে অনেক আগেই সত্য জানাতেন। এভাবে লুকিয়ে বাপ-ছেলের সম্পর্ক নষ্ট হতে দিতো না! মনে মনে ভীষণ আহত অনুতপ্ত হলেন তিনি।
সায়রা টেনেটুনে বাম হাতের অনামিকা আঙ্গুল থেকে এংগেজমেন্ট রিংটা খুলে ফেলল। মায়ের বকুনির ভয়ে, এই চারবছরে একবারের জন্যেও আংটি্টা খুলেনি সায়রা। তাই ভীষণ শক্ত ভাবে আংটিটা আঙুলের সাথে এঁটে গেছে। খোলার সময় আঙুলে নখের গাঢ় আঁচড় পড়ে, লাল হয়ে যায়। আরসালের চোয়াল শক্ত! ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে শুধু সায়রাকে দেখছে।
সায়রা নতজানু হয়ে আংটিটা আরসালের সামনের টেবিলে রাখল! তখনো আরসালের ক্রুদ্ধ চাহনি সায়রার দিকে। চারবছর আগের মত আজও আরসাল চুপ। এখানে সার্কাজম চলছে! তার জীবন নিয়ে নাটক হচ্ছে, নাটক!
পিঠে মায়ের হাতের স্পর্শ পেতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় আরসাল। টেবিলের উপর থেকে এংগেজমেন্ট রিংটা তুলে একবার সায়রার দিকে ভস্ম করা দৃষ্টিতে তাকায়, তারপর মুঠো শক্ত করে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়! যাওয়ার আগে, সামনের টেবিলে পা দিয়ে সজোরে এক আঘাত করে গেল। টেবিল ছিটকে দূরে সরে যায়। আরসালের এহেন কাণ্ডে সবাই হতভম্ব! সবচেয়ে বেশি অবাক সায়রা নিজে। আরসালের এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ তার বোধগম্য হলো না!
চলবে……..
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৮
দখিনের খোলা জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। মেঘলা আকাশ। চারিদিক কালো মেঘেদের অন্ধকারে ছেয়ে। কোথাও ঝুম বৃষ্টি নামবে কি? হয়তো! বিছানায় আড়াআড়িভাবে শুয়ে আছে আরসাল। দৃষ্টি হাতে থাকা আংটিতে সীমাবদ্ধ। গভীর কোন চিন্তায় সে ডুবে। সকাল থেকে মন বড্ড অশান্ত! নিজেকে কেমন যেন এলোমেলো ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। সবকিছু তো আগেরই মত আছে! তবে এই হাহাকার কেন, কেন এই শূন্যতা? সে তো এমনটাই চেয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত সম্পর্কের শেকড় থেকে মুক্তি। তবে এই অস্বস্তি, বুক জ্বালা পোড়া কেন!
.
ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। দিনের আলো একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে বাড়ির লাল নীল মরিচ বাতি গুলো পিটপিট করে জ্বলছে । জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সায়রা। নজর সদর দরজার দিকে। বরযাত্রা রিদ্ধিকে নিয়ে ফিরছে।অশ্রুভারাক্রান্ত নয়নে তাকিয়ে আছে সায়রা। আজকের এই বিশেষ দিনে বোনটার পাশে থাকা হলো না তার। সকালে সেই ঘটনার পর, অস্বস্তি লজ্জাবোধে ঘর থেকে বের হয়নি সে। শরীর খারাপের বাহানা করে রুমেই থেকে গেছে। যাওয়ার আগে রিদ্ধি সায়রার সাথে দেখা করতে এসেছিল। জড়িয়ে ধরে দুবোন খুব কেঁদেছে। ধীরেধীরে গাড়ি সদর দরজা পেরিয়ে, চোখের আড়ালে ছুটে চলল। সায়রা ঠাই সে দিকে তাকিয়ে।চোখ ফিরাতেই আচমকা বাম হাতের অনামিকা আঙুলে নজর আটকায় তার। থমকে যায় সে। বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত শূন্যতায় নাড়া দিয়ে উঠে। আংটির ছাপ এখনো রয়ে গেছে। ভীষণ খালিখালি অনুভব হচ্ছে। অভ্যাস ভীষণ বাজে জিনিস! একবার পিছু নিলে সারাজীবন আঠার মত লেগে থাকে। হয়তো আংটিটা সায়রার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই তো এই শূন্যতা!
–” বিয়ে ভাঙা নিয়ে কি তোর বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই সায়রা! কষ্ট হচ্ছে না তোর?”
আরমিনের কথায় সায়রার হুশ ফিরে। পিছন ফিরে জোর পূর্বক হাসি হাসি মুখ করে বলে,
–” কষ্ট হবে কেন! বরং খুশি হচ্ছে।আজ এতো বছর পর অনুতাপ থেকে মুক্তি পেলাম।”
আরমিনের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। ক্ষীণ দৃষ্টিতে সায়রার দিকে তাকিয়ে। হতভম্ব স্বরে বলল,
— ” আর আরসাল ভাই? উনার কথা একবার ভাবলি না? উনি কি চায় জানতে চাইলি না!”
আরসালের নাম শুনতেই সায়রার প্রচণ্ড অভিমান হলো। গলায় কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে। বারবার উপচে আসতে চাইছে। কন্ঠে একরাশ অভিমান ঢেলে উদাসী স্বরে,
–” ভেবেছি তো! উনার কথা ভেবেই সব করেছি। আরসাল ভাই আমাকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে আপু! তিনি স্পষ্ট জানিয়েছে আমার সাথে কথা বলা তো দূর, আমার চেহারাও দেখতে চাননা তিনি। সেখানে সারাজীবন এক ছাদের নিচে থাকা অসম্ভব! এতো ঘৃণার ভেতর সংসার গড়া যায়না আপু। বিয়ে হলেও বিচ্ছেদ নিশ্চিত। তাই পূর্বেই দুজনের আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো। অন্তত কারো জীবন তো আর নষ্ট হবে না।তা ছাড়া সবার নিজেস্ব পছন্দ আছে। হয়তো আরসাল ভাইয়েরও আছে! বিনাদোষে এই অনুভূতিহীন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার কোন মানে হয়না আপু।”
–” এই চারবছরে তুই একবারের জন্যও কি আরসাল ভাইকে ভালোবাসিসনি? ”
সায়রা তাচ্ছিল্য হাসে। দূর আঁধার ঢাকা আকাশে চোখ মেলে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
–” ভালোবাসা জিনিসটা আপেক্ষিক! যা সবার প্রতি জন্মায় না। না ভালোবাসার উপর জোর খাটানো যায়। আমরা দুজন দুজনার জন্য না। তাই- ই হয়তো ভালোবাসাটাও জন্মায়নি!”
.
সেই ঘটনার পর আরো দুদিন কাটল। এই দুইদিন আরসাল নিজের ঘর থেকে একবারের জন্য বের হয়নি। সারাদিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। মুনতাহা টাইম টু টাইম তিনবেলা খাবার নিয়ে যায়। মায়ের জোরাজোরিতে কখনো খায় , কখনো আবার ফিরিয়ে দেয় আরসাল। ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখে ভীষণ চিন্তিত তিনি। কি চায় আরসাল? কেন এই রাগ জেদ! ছেলেমেয়েরা যত বড় হয় বাবামায়েদের তাদে্রকে বুঝার ক্ষমতা ধীরেধীরে কমে যেতে থাকে! তাদের মন বুঝতে ততটাই অক্ষম হয়ে পরে। মুনতাহার ভীষণ আফসোস হচ্ছে, কেন যে ছেলেটা বড় হয়ে এমন হয়ে গেল! ছোটই তো ভালো ছিল মায়ের কাছে ছোট বড় সব কথা শেয়ার করতো! মনের সব সংশয় দূর করত।
বিকালের দিকে তুর্জয় বাড়িতে আসে। আরসালের খোঁজ করতেই মুনতাহা তার সকল অভিযোগের ঝুলি খুলে বসে। ছেলের এই অনিয়ত, ঘরবন্ধি থাকায় ভীষণ চিন্তিত তিনি। তিনি ছেলেকে স্বাভাবিক দেখতে চায়। আর কতদিন এই অনিয়ম চলবে? কি চায় সে? স্পষ্টভাবে কেন বলছে না!
ফুপুর কথা শুনে তুর্জয় আরসালের ঘরের দিকে অগ্রসর হয়। দরজায় নক করতেই দরজা খুলে যায়। আরসাল রুমে নেই। বারান্দায় হয়তো!
বিকালের শেষভাগ। পরিষ্কার আকাশ। তুলার মত মেঘরাশি গুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে উড়ছে। রক্তিম কমলাবর্ন সূর্যটা পশ্চিমা আকাশে হেলে পড়ছে। বেতের চেয়ারটায় বসে সামনের কাচের টেবিলের উপর পা তুলে কফি খাচ্ছে আরসাল। দৃষ্টি সায়রার বারান্দার বন্ধ দরজায় নিরূদ্ধ। এত চমৎকার মনমুগ্ধকর বিকেল। তবুও আরসালের চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি। তুর্জয় ধপ করে আরসালের সামনের চেয়ারটায় বসে পড়ল। বলল,
–” কংগ্রাচুলেশন! অবশেষে অনিচ্ছাকৃত সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেলি। ট্রিট কবে দিচ্ছিস বেটা?”
এমনিতেই তুর্জয়ের উপর সুপ্ত এক রাগ কাজ করছে আরসালের। সায়রা আশেপাশে তুর্জয় ঘুরঘুর না করলে তার এত রাগ হতো না। না সায়রার সাথে সেদিন বাজে ব্যবহার করত। তুর্জয়ের কথায় আরসালের চেহারার বিরক্তি ভাবটা স্পষ্ট হলো। তুর্জয় লক্ষ করল কিন্তু তোয়াক্কা করল না। বলল,
–” অবশ্য, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। সায়রা দেখতে আহামরি তেমন কিছুনা। ঐ গায়ের রঙ ফর্সাই যা। মেয়েদের সৌন্দর্য চোখ আর হাসিতে। যার কোনটাই সায়রার নাই, ইউ ডিজার্ভ বেটার।”
আরসাল হুংকার দিয়ে উঠে। নির্বেদ দৃষ্টিতে তুর্জয়ের দিকে চেয়ে ঝাঁঝাল স্বরে বলল,
— ” সায়রা যথেষ্ট সুন্দরী, মোহ মায়ায় ঘেরা বাস্তব পুতুল। ওর টানাটানা চোখে অদ্ভুত এক সরলতা আছে। যেই সরলতায় হাজার বছর অনায়াসে ডুবে থাকা যায়। আর হাসি! ঐ মুক্তা ঝরা হাসিতে নেশাকারী কিছু তো আছে, যা দেখার পর চোখ ফেরানো দুষ্কর হয়ে যায়। তাছাড়া কে আমার জন্য বেটার, কে না। তা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না তুর্জয়। আমার ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা আছে!”
এতোটুকু বলে আরসাল থামল। রাগে ফোঁসফোঁস করছে। আরসালের বাচ্চাদের মত এমন কাণ্ডে তুর্জয় কিটকিটে হেসে ফেলে। নিজের মনের অনুভূতি গুলো বলছে তাও রাগে গরগর করে।কন্ঠে সামান্যতম আবেগ নেই। এত চড়া মেজাজ কারো কি করে হয়? যে ছেলে নিজের মনের অনুভূতির সাথে অপরিচীত, বদ মেজাজি! এমন ছেলের সাথে কোন মেয়ে বিয়ে ভাঙবে না তো কি করবে?
তুর্জয় হাসি থামিয়ে উৎফুল্ল স্বরে বলল,
–” কংগ্রাচুলেশন ব্রো! ইউ আর ইন লাভ। তুই তোর না মানা এক্স ফিওনসেকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তাও প্রচণ্ড! বুঝলি আরসাল, সায়রা তোর গলায় কাটার মত বেজে গেছে এখন না ফেলতে পারছিস, না গিলতে পারছিস!”
প্রত্যুত্তরে আরসাল রেগে কিছু বলতে চাইল। কিন্তু পারল না। থমকে রইল। কয়েক পলক তুর্জয়ের দিয়ে চেয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে সিগারেট জ্বালাল। গম্ভীর হয়ে ভাবল, তুর্জয় ভুল কিছু তো বলেনি। সত্যিই তো, সায়রা তার গলায় কাটার মত বিঁধে আছে। না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। তার উপর সায়রাকে নিয়ে এই এলোমেলো ভাবনা। সায়রাকে সে কেন এত ভাবছে? কেন এই অস্থিরতা, শূন্যতা! সত্যি কি সায়রাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে!
আচ্ছা, আমরা মানব জাতি এমন কেন? হারানোর পরেই কেন তার মর্ম বুঝি।
চলবে……
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।