তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৩৪,৩৫
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩৪
আরসাল চলে গেছে। সায়রা ঢাকায় ফিরে এসেছে। সিলেট থেকে ফিরে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিয়েছে। আগের চেয়ে আরো বেশি গম্ভীর নিশ্চুপ হয়ে গেছে। নিজের সবচেয়ে কাছের, প্রিয় মানুষটা থেকে এত বড় ধাক্কাটা মেনে নিতে পারেনি সায়রা। নির্বাক কষ্ট গুলো তার ভিতর কুরে কুরে খাচ্ছে। দহনে পুড়ছে সারাক্ষণ।
দুমাস কেটেছে। এই দুমাসে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে,
এই তো সাপ্তা দু এক বাদে তুর্জয় আরমিনের বিয়ে। শেষবার সিলেট থেকে ফিরে যখন তুর্জয় নিজের ভালোবাসা অনুভূতির স্বীকারোক্তি করেছিল, ফিরিয়ে দিতে পারেনি আরমিন। সে বেশ বুঝেছে যেই মানুষটা তার দুর্দিনে হাত বাড়িয়ে ছিল সেই মানুষটা আর যাই হোক কখনো তাকে ছেড়ে যাবেননা। দুই পরিবারের সম্মতিতে বেশ ধুমধাম আয়োজন করে বিয়ে হবে তাদের।
প্রতিদিনের মত আজও ঠিকঠিক বারটায় ফোনটা বেজে উঠল সায়রার। সে জেগেই ছিল। আজকাল দুচোখে ঘুম খুব কম বললেই হয়। দিন দিন সে কি নিশাচর হচ্ছে! কি জানি! ফোনের দিকে চোখ বুলাল, ‘ আননোন নাম্বার ‘! বুক চিড়ে চাপা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো । সে জানে ‘আরসাল’ ফোন করেছে। কিন্তু কথা বলার মত বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই তার। সিলেট থেকে ফিরার পর আরসালের সাথে কথা বলেনি আর। এই দুমাসে বেশ কয়েকবার মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেবকে ফোন করেছে আরসাল। কিন্তু সায়রার সাথে কথা হয়নি একবারও। ফোন করলেও তুলেনি সায়রা। বুকে শক্ত এক অভিমান জমেছে। এই অভিমানের বরফ এত তাড়াতাড়ি গলবে না। আরসাল তার সাথে যা করেছে, তা ভীষণ জঘন্য। কারণ যাইহোক না কেন, সে এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে ক্ষমা করতে পারবেনা আরসালকে। ভাবল সায়রা।
ফোন বাজছে তো বাজছেই! বেশ কয়েকবার বাজার পর বিরক্ত হয়ে ফোন তুলল সায়রা। অপর পাশ থেকে শান্ত আওয়াজ ভেসে এলো,
–” কি চাস মরে যাই? এমনিতেই তোর থেকে দূর ছটফট করছি সারাক্ষণ, তার উপর ফোনটাও তুলছিস না! আমার উপর তোর এত অভিমান, এত রাগ!”
উত্তর দিলো না সায়রা। বেশ কিছুক্ষণ উত্তরের আশা করল আরসাল। উত্তর মিলল না। পিনপতন নীরবতা, নীরবতা ভেঙে বলল আরসাল,
–” আগামীকাল অনেক বড় একটা দিন। সবটা ঠিকঠাক হলে খুব দ্রুত তোর কাছে ফিরব! ”
এবারো সায়রা চুপ রইল। আরসালের নিমিষ আওয়াজ,
–” শুনে খুশি হোসনি? কিছু বলবি না!”
এবার মুখ খুলল সায়রা। প্রত্যুত্তরে বলল,
–” আপনার জীবন আপনি কি করবেন, কি করবেন না আপনার সিদ্ধান্ত। এখানে আমি খুশি কি না তার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে!”
অপর পাশ থেকে কোন উত্তর এলো না। সায়রা কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত স্বরে বলল,
— ” আমার ঘুম পাচ্ছে, রাখছি! ”
বলেই ফোন কাটল। নিশ্বাসের প্রচণ্ড উঠানামা। থরথর কাঁপছে সারা শরীর। পাশ ফিরে অস্থির দৃষ্টিতে দেয়ালে টানানো আরসালের বড় ছবিটার দিকে তাকাল। আঁখি জোড়া জলে ভরে এলো। ঠোঁটের কোণঘেঁষা তৃপ্ত হাসি সায়রার।
.
রাত এগারোটা। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিক বৃষ্টির ঝুমঝুম আওয়াজে নাচছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। চায়ের কাপ হাতে শুধু সায়রা জেগে। ঝুম বৃষ্টি ভেজা রাত আর সাথে চায়ের কাপ, বেশ দারুণ কম্বিনেশন! এই বৃষ্টি ভেজা রাতে পুরানো অতীত কুরাচ্ছে সায়রা। বছর দু এক আগে এমনি এক ঝুম বৃষ্টির রাতে বাড়ি ফিরেছিল আরসাল। মন বলছে আজ এমনি কিছুর পুনরাবৃত্তি হবে আবার! বৃষ্টির আঁচ জানালা গড়িয়ে গা ছুঁইছে, হুশ ফিরল সায়রার। ওড়না প্রায় ভিজে একাকার। ওড়নার থেকে পানি ছাড়াতে ছাড়াতে বিছানা অবধি আসলো। এমন সময়ই নিচের ডোর বেল বেজে উঠল। ভ্রু কুঁচকে এলো সায়রার। এই সময়, এত রাতে কে এলো! দ্রুত পায়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াল। সায়রার আগেই মুনতাহা বেগম আহনাফ সাহেব বেরিয়ে এসেছে। কয়েক সিড়ি নিচে নামতেই পা থেমে গেল সায়রার। সায়রার বাবা মা বাকি সবাই ও এখানেই আছে। সাথে অচেনা মাঝবয়েসী একজন। ঘটনা কি জানতে সিড়ির দিকে বাড়াল কয়েক কদম বাড়াতেই আবারো থামল। চক্ষু তখন চড়কগাছ! ড্রাইং রুমে মাঝামাঝি সোফায় আরসাল বসে। বিদ্যুৎ চমকানোর মত চমকাল সে। হতভম্ব, কিংকত্র্তব্যবিমূঢ় সায়রা! শরীর কাঁপছে, মাথা ঘুরছে! নিজেকে সামাল দিতে শক্ত করে সিড়ির রেলিং চেপে দাঁড়াল। মাঝবয়েসী লোকটা কিছু বলছে, মূলত সবার দৃষ্টি উনার দিকেই। আরসাল মাথা নুয়ে চুপচাপ বসে। দূর থেকে স্পষ্ট কিছু শুনা যাচ্ছেনা। আরসালকে দেখে নিচের দিকে আর পা বাড়াল না সায়রা। দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল।
.
রাত তিনটা! থমথমে পায়ে ঘরের দিকে পা বাড়াল আরসাল। বৃষ্টি নেই। আকাশ এখন পরিষ্কার। মেঘেদের আড়ালে লুকিয়ে থাকা চাঁদটাও বেরিয়ে এসেছে। যার জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারিদিক। বৃষ্টি স্নান স্নিগ্ধ পরিবেশ। জানালার পর্দা গুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। চন্দ্রসুধা জানালা মাড়িয়ে বিছানায় পড়ছে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সায়রা। ফর্সা পিঠ স্পষ্ট ভেসে, এলোমেলো চুল গুলো বিছানায় ছড়িয়ে। রুমে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে চোখ বুজে নিলো সায়রা। চোখের কোণ বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল বালিশে। হাঁটু গেড়ে সায়রার মুখোমুখি বসল আরসাল। গাঢ় দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সায়রাকে। চাঁদের চাঁদনি চুয়ে চুয়ে পড়ছে তার মুখশ্রীতে। ভেজা চোখ, রক্তিম নাক। আঁখিপল্লব এখনো জলে ভিজে। আরসালের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো! ছুঁয়ে দিতে হাত বাড়াল আরসাল। অতি নিকটে সেই চিরচেনা ঘ্রাণকে অনুভব করে মুখ ফিরিয়ে নিলো সায়রা। দীর্ঘ দেড়বছর যেই মানুষটা তাকে ছেড়ে থাকতে পেরেছ, এখনো ঠিক পারবে! এক রাশ অভিমানে চোখ বেয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল সায়রা। চাই না এই মানুষটাকে তার, চাইনা আর!
আচমকা সায়রাকে কোলে তুলে নিলো আরসাল। শক্ত ভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। চোখমুখ কুঁচকে নিলো, বিন্দুমাত্র নড়চড় করল না সায়রা। নিজেকে শক্তভাবে চেপে রাখল। নিমিষ আওয়াজে বলল আরসাল,
–” আমি তোর অপরাধী! শাস্তি দেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে তোর। তাই বলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিস না! ছটফট করতে করতে মরে যাবো আমি।”
কোন প্রতিক্রিয়া করল না সায়রা। আগের মতই নিজেকে শক্ত ভাবে চেপে রাখল। আরসাল আবার বলল,
–” আমাকে নিজের দিক এক্সপ্লেইন করার একটা সুযোগ দিবি সায়রা?”
উত্তর দিলো না সায়রা। সায়রার মৌনতাকে সম্মতির লক্ষণ মেনে নিলো আরসাল। নিজে থেকে বলতে শুরু করল,
–” দেড়বছর আগে সেই দিন বাড়ি ফেরার পথে গাড়ীর ব্রেক ফেইল হয়ে এক্সিডেন্ট হয় আমার। নিরিবিলি রাস্তা হওয়ায় এক্সিডেন্টের পর ঘন্টা খানেক সেখানে সেভাবেই পরে ছিলাম। সাহায্যের জন্য কাউকে পাইনি। সেই এক্সিডেন্টের রাস্তায় রিটায়ার মেজর তাহির সাহেব উনার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলেন। এক্সিডেন্ট দেখে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন তিনি। হসপিটালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে কোমায় চলে গেছি আমি। এক বছর চার মাস পর যখন কোমার থেকে ফিরলাম, তখন আমার চারিদিক পুরোপুরি পাল্টে গেছে। মেজর তাহির আহমেদের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন, আমাকে উনার মৃত ছেলে ইফতি মানতে শুরু করেছে। আমি সবটা ক্লিয়ার করতে চাইলে তাহির সাহেব বাঁধা দেয় আমাকে, তিনি জানান, আমার এক্সিডেন্টের ঠিক ছয় মাস আগে তার বিয়ের কিছুদিন আগে এক এক্সিডেন্টে ইফতি মারা যায়। একমাত্র সন্তানকে হারানোর শোকে মেজরের স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারায়। এক্সিডেন্টের দিন আমাকে দেখে মেজরের স্ত্রী নিজের মৃত ছেলে ইফতি ভাবতে শুরু করে। কারণ ইফতিরও ঠিক একই ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছিল। উনার হার্ট ডিজিজ ছিল, অবস্থা ছিল ক্রিটিকাল! খুব শীঘ্রই অপারেশন করার কথা ছিল। মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় ডক্টর তা করতে সাহস জোটাতে পারেনি। আমাকে পেয়ে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাই মেজর আর আমার ঠিকানা খুঁজে বের করেনি। স্ত্রীর প্রাণ বাঁচাতে বিষয়টা গোপন রেখেছিল। কোমা থেকে ফিরে যখন বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলাম। তখন আমার কাছে খুব করে অনুরোধ করেন মেজর সাহেব। আমি যেন অপারেশন অবধি ইফতি হয়ে উনাদের কাছে থাকি। অপারেশনের বাঁচার চান্স ছিল অল্প, তাই যতটুকু সময় উনার হাতে আছে উনি যেন হাসি খুশি থাকে, আমি উনার কাছে উনার ছেলে হয়ে থাকি। মেজর সাহেবের অনুরোধ ফেলতে পারিনি আমি। ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। বাবা মা তুই নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলি অনেকটাই। যোগাযোগ করে ব্যাপারটা ঘাটতে চাইনি। তাই আমিও আর সামনে আসিনি। চারটা মাসের ব্যাপারই তো! এই চারটা মাস নিজেকে আড়াল করে রাখতে চেয়েছিলাম, অপারেশন শেষে আমি নিজেই তোদের কাছে ফিরে আসতাম।
কিন্তু ঢাকা থেকে অদূর সিলেটে যে হুট করে তোর সাথে দেখা হয়ে যাবে। তা আমার কল্পনাতীত ছিল। হ্যাঁ সেই রাতে আমিই তোর পাশে ছিলাম! সেদিন উনার সামনে অচেনাদের মত আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি।
সেদিন যদি সিলেটে এভাবে হুট করে দেখা না হতো হয়তো তোর এতটা রাগ অভিমান হতো না! আমি তোকে ঠকাইনি সায়রা! কৃতজ্ঞতা বশত বাধ্য ছিলাম শুধু!”
কোন উত্তর এলো না। ডুকরে কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো শুধু। আরসাল সায়রার দিকে হাত বাড়াতেই সরে গেল সায়রা। চিৎকার আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
–” সব বুঝলাম! কিন্তু এসব কিছুতে আমার কি দোষ ছিল আরসাল? দিনের পর দিন আপনার অপেক্ষা করেছি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। পাইপাই মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছি! আপনি জানেন এই দেড় বছর আমাকে কি কি সহ্য করতে হয়েছে? অলক্ষ্মী, অর্থলোভীর মত আরো কত ট্যাগ লেগেছে আমার উপর। অনেকে তো এটাও বলেছে আমি আমার স্বামীকে খেয়েছি। রাক্ষসী আমি! পারবেন আমার সব অপমান কষ্ট গুলো মুছে দিতে!”
চলবে…….
তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩৫
গতরাতের ভারী বর্ষনের পর, আজ চকচকে আকাশ। প্রভাতের আলো ভুবনের কোণা কোণা ছুঁয়েছে। আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলল আরসাল। নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করল। কিছুটা চমকাল সে। তবে কি গতরাতে এখানেই চোখ লেগে গেছে! ফ্লোর থেকে উঠে বিছানায় বসল। চারিদিকে একবার সন্ধানী চোখ বুলাল। সায়রা নেই! সায়রা কোথায়? নিচে, কিচেনে! ভাবল আরসাল। কাবার্ড খুলতেই দেখল সবকিছু আগের মতই সুন্দর গোছানো। এই দেড়বছরে কিছুই পাল্টায়নি।সবটা যত্ন করে রেখেছে সায়রা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আরসাল ফিরবে। ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি ফুটল আরসালের। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌঁছাল আরসাল। আহনাফ সাহেব, মুনতাহা বেগম আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। ছেলের সাথে সময় কাটাবে বলে আজ অফিসে যাননি। আরসাল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সায়রার তল্লাসী করছে। আশেপাশে কোথাও দেখছে না তাকে, মাকে কি একবার জিজ্ঞাস করবে? বেশ কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তায় কাটিয়ে মুনতাহা বেগমকে প্রশ্ন করল আরসাল,
–” মা সায়রা কোথায়?”
মুনতাহার স্বাভাবিক উত্তর,
–” বোনের বিয়ে, বাবার বাড়িতে গেছে!”
আরসাল তেতে উঠল। রাগী আওয়াজ করে বলল,
–” এতদিন পর আমি বাড়ি ফিরেছি আর ও আমাকে ফেলে বোনের বিয়ে খেতে বাবার চলে গেল? ওর বাবার বাড়ি কি শ’ মাইল দূরে! সাতদিন আগে যেতে হবে তাকে!”
আহনাফ সাহেব খাবার ছেড়ে চোখ উঠিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলেটা শুধরাল না আর, সেই আগের মত লাগামহীনই রয়ে গেল। মুনতাহা বেগমের আগের মত স্বাভাবিক উত্তর,
–” বোনের বিয়েতে বাবার বাড়িতে যাচ্ছে সায়রা, আমি বাঁধা দেব! লোকে বলবে আমি পুত্রবধূর উপর অত্যাচার করি। বাবার বাড়ি যেতে দেই না!”
মায়ের বক্তব্যে আরসালের রাগ বাড়ল। প্রচণ্ড রাগ হলো। শেষমেশ মাও তার সাথে পাল্টি নিচ্ছে, নিশ্চয় আরসালকে জ্বালাতে দুজনের প্লান এসব। রাগী আওয়াজে বলল আরসাল,
–” এখন পুত্রবধূ বলা হচ্ছে! এতদিন তো ঠিক মেয়ে মেয়ে বলে জান দিতে, এখন সবাই মিলে আমার সাথে প্রতিশোধ নিচ্ছ! বদলা নিচ্ছ তাই না?”
মুনতাহা বেগম কিছু বলল না মিটমিট হাসল শুধু। সকালের নাস্তা আর করা হলো না আরসালের। ক্ষিপ্ত মেজাজে খালি পেটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
দুপুর দেড়টা। দরজা খুলে আরসালকে দেখে বিন্দুমাত্র চমকাল না সিন্থিয়া বেগম ।আরসাল আসবে তা যেন আগে থেকেই জানতেন তিনি। বেশ সৌজন্য ভাবে স্বাগতম জানালেন আরসালকে। বিয়ের পর প্রথমবার শ্বশুরবাড়ি এসেছে, খালি হাতে তো আসা যায় না! কাঁচা শাকসবজি থেকে শুরু করে, ভাজাভুজি, ফলমূল, রকমারি মিষ্টান্ন কোন কিছু আনতে বাদ রাখেনি আরসাল।
এতকিছু ঘটে গেছে, দেড়বছর কেটে গেছে। আরসাল কিঞ্চিত লজ্জাবোধ করল। সোফায় বসে আশেপাশে চোখ বুলাল। চোখ শুধু সায়রাকেই খুঁজছে। সকাল থেকে একবারের জন্য দেখেনি। কোথায় মেয়েটা? এত জ্বালাচ্ছে কেন তাকে!
বাহিরের হৈ চৈ আওয়াজে ঘুমঘুম চোখে টলতে টলতে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সায়রা। এখান থেকে বসার ঘর স্পষ্ট একদম। সোফার রুমে আরসাল সিন্থিয়াকে বসে থাকতে দেখে, ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। হকচকিয়ে উঠল। চোখের ঘুম কোথাও উড়ে গেল। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে গম্ভীর কোন আলোচনা চলছে। এখান থেকে স্পষ্ট কিছু শুনা যাচ্ছেনা। রুমে চলে গেল সায়রা। খট করে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগে বড়বড় শ্বাস ফেলছে আর নখ কামড়াচ্ছে। খানিক বাদে দরজার কড়া নড়ল, বাহির থেকে সিন্থিয়া বেগমের উঁচানো আওয়াজ ভেসে এলো,
–” সায়রা ! আরসাল এসেছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে, খাওয়া দাওয়া করবি!”
ঘুমের অভিনয় করে, ভাঙ্গা আওয়াজে বলল সায়রা,
–” পরে করবো মা, এখন ঘুম পাচ্ছে আমার! ”
–” সেই সকাল থেকে ঘুমাচ্ছিস আর কত ঘুমাবি তুই? কতক্ষণ হলো ছেলেটা অপেক্ষা করছে!”
সায়রার মুখ থেকে বিরক্তিতে ‘চ’ শব্দ বেরিয়ে এলো। গলা উঁচিয়ে ফোঁস করে উত্তর দিলো,
–” উনাকে খেয়ে চলে যেতে বলো, আমার ঘুম হয়নি আমি আরো ঘুমাব!”
বাহির থেকে সিন্থিয়া বেগমের ঝাঁজাল বিরবির আওয়াজ এলো। তোয়াক্কা করল না সায়রা। ফিসফিস করে বলল,
–” এই দেড় বছর অনেক জ্বালিয়েছেন, অনেক কষ্ট পেয়েছি আমি। এবার কষ্ট পাওয়ার পালা আপনার আরসাল। একচুলও ছাড় দেবনা আপনাকে, হুহ!”
বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইল সায়রা। বিকেল সাড়ে চারটা। সূর্যের তাপ তখন নরম হয়ে এসেছে। আকাশে রক্তিম আলোর খেলা। বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সায়রা। প্রিয় বান্ধবী তাইবাকে ফোন করল। আজ বাহিরে খাবে সারা সন্ধ্যা শপিং করে কাটাবে। বেশ সুন্দর করে সেজে তৈরি হয়ে নিলো সায়রা। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো। খারাপ না, বেশ ভালোই লাগছে। জুতা জোড়া হাতে তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার বাহিরে তাকাল। কেউ নেই। ড্রইং ফাঁকা। আরসাল চলে গেছে? আলতো পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সে। পিয়াসের রুম থেকে শব্দ আসছে। তবে কি উনি পিয়াসের ঘরে? ভাবল সায়রা। কয়েক কদম সামনে যেতেই আরসালকে দেখল সায়রা। পিঠ দেখা যাচ্ছে উনার। বেশ সচেতন পায়ে বাড়ি থেকে নেমে গেল সায়রা। রিক্সায় চড়ে মাকে ফোন করে জানাল, তাইবার সাথে শপিং- এ যাচ্ছে, ফিরতে রাত হবে। রাতের খাবার বাহির থেকেই খেয়ে আসবে! সিন্থিয়া বেগমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটল। সুইচ অফ করে ফোনটা ব্যাগে রেখে দিলো।
স্বপ্নের শহর ঢাকা। দিনের আলো থেকে রাতে কৃত্রিম মিটমিট আলোর ঢাকা বুঝি বেশ সুন্দর। এই কৃত্রিম, অপ্রাকৃত জিনিস গুলোতেও যেন মানুষের মত মোহমায়ায় মাখানো। থানা রোডের চারতালা বিল্ডিং- এ এক নামীদামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে সায়রা তাইবা। সায়রার দৃষ্টি সচ্ছ কাচের বাহিরে ব্যস্ত রাস্তায়। ভীষণ সাধারণ দৃশ্যকে এমন গভীর দৃষ্টিতে দেখছে, যেন বিশেষ কিছু! তাইবা বেশ ঠাহর চোখে সায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট থেকে দুজন একসাথে। স্কুল কলেজ একত্রেই ছিল, ভার্সিটিতে একত্রেই আছে। সেই সাপেক্ষে সায়রার রগরগ সম্পর্কে অবগত তাইবা। সায়রাকে এমন আনমনা দেখে প্রশ্ন করল তাইবা,
–” শুনলাম আরসাল ভাই ফিরে এসেছে।”
সায়রার আনমনা উত্তর,
–” হুম”
–” এতদিন যার জন্য এত অপেক্ষা, এত তপস্যা। এখন যখন সেই মানুষটা তোর কাছে ফিরে এসেছে, তাকে এভাবে এড়িয়ে চলছিস কেন? ”
–” কে বলল, এড়িয়ে চলছি? আমি তো পালাচ্ছি!”
–” পালাচ্ছিস! কেন পালাচ্ছিস তুই?”
–” আমার ভয় হয়, প্রচণ্ড ভয় নিজেকে। উনার মুখোমুখি হলে আমার ভিতরের চেপে থাকা রাগ জেদ বড় কোন ঝড়ের রূপ নিয়ে সব তছনছ করে না দেয়!”
তাইবা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল,
–” তুই আরসাল ভাইকে ঘৃণা করিস?”
–” আমার দ্বারা তা অসম্ভব!”
–” এখনো ভালোবাসিস?”
–” প্রচণ্ড, প্রচণ্ড ভালোবাসি! ”
–” তাহলে মেনে নিচ্ছিস না কেন উনাকে?”
–” কি করবো, পারছি না যে ক্ষমা করতে। দেড় বছর অনেক ভুগেছি, অনেক সহ্য করেছি। এখন না পারছি উনার কাছে থাকতে, না পারছি দূরে থাকতে! তাই তো পালাচ্ছি শুধু!”
সায়রার কথায় তাইবা হাসল। মেয়েটা প্রচন্ড জেদি। ভাঙবে তবুও মচকাবে না!
রাত নয়টা। বাস স্ট্যান্ডে রিকশা থেকে নেমে গেল তাইবা। স্ট্যান্ডের পাশেই তার বাড়ি। তাইবাকে বিদায় দিয়ে সেই রিকশায় চলে গেল সায়রা। জ্যামে পড়ে বেশ দেরী হয়ে গেছে। নিশ্চয় মা চেঁচাবে! ভাবল সায়রা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো হাওয়া বইছে। রাতে ঝুম বৃষ্টি নামবে নিশ্চয়! দোকানীরা হুড়মুড় করে দোকান গুছাচ্ছে, বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে। রাস্তার ধুলাবালির সাথে নোংরা পলিথিন ব্যাগও বাতাসে উড়ছে। ওড়না দিয়ে মুখ চেপে নিলো সায়রা। বাড়ির সামনে রিকশা থামতেই ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত নেমে পড়ল সে। আচমকা লোডশেডিং হয়। চারিদিক অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। বিরক্তির নিশ্বাস ফেলল সায়রা। বিরবির করে বলল,
— ” অসহ্য! এখনি কি লোডশেডিং হওয়ার ছিল!”
ফোনের টচ জ্বালিয়ে। যেই গেটে পা রাখবে অমনি কেউ পেছন থেকে হাত চেপে ধরে। ভয়ে শরীরের রক্ত হিম সায়রার। টচ নিয়ে পিছন ফিরে আরসালকে দেখে ছোট নিশ্বাস ফেলল। খেয়াল করে দেখল- চোখমুখ ভয়ংকর রকম লাল আরসালের। বেশ শান্ত আওয়াজ তার,
–” বাড়ি চল সায়রা”
ধীর আওয়াজে বলল সায়রা,
–” আমি যাবো না, হাত ছাড়ুন !”
বোঝানোর আওয়াজে বলল আরসাল,
–” তুই বাড়ি চল, তোর সব শাস্তি মাথা পেতে মেনে নিবো আমি।”
–” কাউকে কোন শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে নেই আমার। হাত ছাড়ুন!”
বলেই হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো সায়রা। সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে হেচকা টান পড়ল। আরসালের বুকে যেয়ে পড়ল সায়রা। সায়রাকে নিজের সাথে শক্তভাবে জড়িয়ে নিলো আরসাল। ফিসফিস করে বলল,
–” আমি তোকে ছাড়া ভালো নেই। একদম ভালো নেই। সারাটা দিন আমার কেমন কেটেছে তোর কোন আইডিয়া আছে? পাগল হচ্ছি আমি সায়রা। জাস্ট পাগল হচ্ছি। আমি তোর অপরাধি! শাস্তি দিবি তো? তোর সব শাস্তি মাথা পেতে নিবো আমি। শুধু তুই বাড়ি ফিরে চল!”
–” মাত্র অর্ধেক দিনে আপনার এই হাল আরসাল? আমি যে দেড়বছর ছটফট করেছি ! … যাকগে, এই রাতে আপনার সাথে কথা বাড়াতে চাইনা। ছাড়ুন আমাকে। অসহ্য লাগছে আমার!”
আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে নিজেকে আরসালের বাহুডোর থেকে ছাড়িয়ে নিলো। বড়বড় পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেল সায়রা। আরসাল পেছনে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। সায়রাকে চলে যেতে দেখে পেছন থেকে চিৎকার করে বলল,
–” চলে যাচ্ছিস তো! বেশ! যেই অবধি তুই বাড়ি না ফিরবি আমিও বাড়ি ফিরবো না। আমি এখানেই রাস্তায় তোর অপেক্ষা করব!”
সায়রা পিছন ফিরে ছোট ছোট চোখ করে আরসালের দিকে তাকাল একবার। তারপর পায়ের গতি বাড়িয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল।
চলবে……