তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৩২,৩৩

তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৩২,৩৩
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩২

বিছানা ছেড়ে ধরফরিয়ে উঠে বসল সায়রা। এলোমেলো চুল ঘুমঘুম চোখ। শরীরের রক্ত দ্রুতবেগে চলাচল করছে। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে। বিছানার পাশে ডিভাইনটায় হেলান দিয়ে বসে ছিল আরমিন। সায়রাকে জাগতে দেখে, দ্রুত পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে সায়রা,

–” আমি বাগানে ছিলাম, এখানে আসলাম কি করে? উনি কই?”

–” কার কথা বলছিস সায়রা?”

আগের মত অস্থির আওয়াজে বলল সায়রা,

–” আরসাল! কোথায় উনি?”

আরমিন তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। বিরক্তি সহিত উত্তর দিলো,

–” আরসাল ভাই কোথা থেকে আসবে? হোটেলের কোন একজন গেস্ট তোকে বাগানে অচেতন পড়ে থাকতে দেখে রিসিপসনে নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে আমাদের কল এসেছে। আচ্ছা, সায়রা এমন বেখেয়ালিপনা কেউ করে? যদি উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে যেত!”

আরমিনের কথা কর্ণ কুহরে পৌঁছাল না সায়রার।ঝটপট প্রশ্ন ছুঁড়ল,

–” তোমরা লোকটাকে দেখেছ?”

আরমিন ভাবুক কন্ঠে উত্তর দিলো,

–” না! আমরা পৌঁছানোর আগেই রুমে ফিরে গেছেন তিনি। অনেক রাত হয়েছে তাই আমরাও বিষয়টা ঘাটতে যাইনি। তোকে নিয়ে রুমে ফিরে এসেছি।”

দ্বিতীয় কোন কথা বলল না সায়রা। গায়ে কোন রকম ওড়না জড়িয়ে দ্রুত পায়ে বিছানা থেকে নেমে নিচে রিসিপসনে চলে গেল। সেখানকার একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করল,

–” গতরাতে আমাকে যিনি বাগান থেকে নিয়ে এসেছে আপনি উনাকে চিনেন? উনার রুম নাম্বার দেওয়া যাবে প্লিজ! ইট’স আর্জেন্ট! ”

স্টাফের সায়রাকে চিনতে ভুল হলো না। গতরাতে তিনি- ই ডিউটিতে ছিলেন। এখনি ব্যাগপত্র গুছিয়েছে বাড়ির জন্য রওনা হতেন। এমন সময়ই সায়রা এসেছে। ভাগ্যিস এসেছে , না হয় এখনি বের হতেন তিনি। ভদ্রলোক মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলেন,

–” হ্যাঁ চিনি! কিন্তু সরি, আমি তা বলতে পারবো না! এভাবে গেস্টের ইনফরমেশন অন্যকারো সাথে শেয়ার করা আমাদের হোটেল রুলসের খেলাফ! কথাটা ছড়াছড়ি হলে বিপদে পড়ব আমি।”

সায়রার করুন কন্ঠে বলল,

–” প্লিজ! আমার সাহায্য করুন। আমি কাউকে কিছু বলব না উনার সাথে দেখা করাটা আমার জন্য ঠিক কতটা ইম্পরট্যান্ট তা আমি বলে বুঝাতে পারব না!”

লোকটা কিছু একটা ভেবে বললেন,

–” উনি 314 রুমে আছেন।”

সায়রার চোখেমুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। চোখ জোড়া জলে ভরে এলো। অনুগৃহীত কন্ঠে বলল,

–” আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।”

সায়রা যেতে নিলে পেছন থেকে লোকটা ডেকে বললেন,

–” ব্যাপারটা প্লিজ গোপন রাখবেন! ”

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল সায়রা। মুচকি হেসে চোখের জল মুছতে মুছতে লিফটের দিকে ছুটে গেল। লিফট চার তলায় আটকে আছে। অপেক্ষা করার মত বিন্দু মাত্র ধৈর্য নেই সায়রার। সিড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে গেল। রুম নাম্বার 314 এর সামনে এসে দাঁড়াল সায়রা। নিশ্বাসের গতি বাড়ছে। ভিতরে প্রচন্ড ভয় কাজ করছে। কাঁপাকাঁপা হাতে দরজা নক করল সায়রা। ভেতর থেকে মাঝবয়সী এক নারীর কন্ঠ ভেসে এলো। সায়রা চাতক পাখির মত অপেক্ষা করতে লাগল। এই মিনিট দুএকের ব্যবধান যেন হাজার বছর সমান। রুমের দরজা খুলল এক মাঝবয়সী মহিলা। সায়রার দিকে সাবধানী চোখ বুলিয়ে বললেন,

–” ইয়েস! কাকে চাই?”

— ” এই রুমের মালিক মানে… গতরাতে যিনি আমাকে বাগানে… থেকে আমাকে নিয়ে এসেছেন। উনাকে একটু ডেকে দেওয়া যাবে!”

সায়রার কথা বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নার্ভাসনেসে ঠিকঠাক গুছিয়ে বলতে পারছে না সে। সামনে মাঝবয়েসী মহিলাটা বুঝল ব্যাপারটা। কম্ফোর্ট করার জন্য চওড়া হেসে বললেন,

–” ধন্যবাদ জানাতে এসেছ বুঝি! গতরাতে তোমার কথা বলেছে ইফতি। ডিফেন্সের লোক তো কাউকে বিপদে দেখলে থেমে থাকতে পারেনা। সাহায্যের জন্য ছুটে যায়। ছেলেটা আমার ছোট থেকেই এমন। আচ্ছা, মেয়ে এখন কেমন আছো তুমি? ইফতি তো রুমে নেই, একটু বেরিয়েছে! তুমি কি ভিতরে আসবে?”

সায়রা চমকাল। ইফতি? এই ইফতি কে? তার স্পষ্ট মনে আছে গতরাতে সে আরসালকে দেখেছে। তাকে ছুঁয়েছে। জড়িয়ে ধরেছে। এই ইফতি লোকটা এলো কোথা থেকে। তবে কি সেটা সত্যি তার স্বপ্ন ছিল! আরসাল কল্পনায় এসেছিল! এত বাস্তবানুগ স্বপ্নও কি হয়! ভেতরে ভেতরে আবারো গুঁড়িয়ে গেল সায়রা।
সায়রার ভাবনার ছেদ পড়ল সুশ্রী কন্ঠে। মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাল সায়রা। মাঝবয়েসী মহিলার পেছনে বাইশ- তেইশ বছর বয়েসী এক মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। ভীষণ মিষ্টি চেহারা তার। মহিলাকে মা বলে সম্বোধন করলেন। ধীর আওয়াজে বললেন,

–” মা ভিতরে চলুন, আপনার ঔষধের সময় হয়েছে।”

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সায়রা। মাঝবয়েসী মহিলা সায়রাকে হতভম্ব চেয়ে থাকতে দেখে বললেন,

–” ও, আমার ইফতির হবু বউ প্রীথি! আমি একটু অসুস্থ। এই তো আমার অপারেশনের পরই ওদের বিয়ে। সুন্দর নাহ আমার বউমা!”

সায়রা ম্লান হাসল। মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল,

–” ভীষণ সুন্দরী আন্টি! অভিনন্দন আপনাকে।”

সায়রার কথায় তেমন একটা প্রতিক্রিয়া করল না প্রীথি মেয়েটা। কৃত্রিম হাসল শুধু। বিদায় নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল সায়রা। টলতে টলতে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে সে। আর কতবার নিরাশ হবে তাকে। আর কতবার ভাঙলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে! দেড় বছর ধরে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে যাচ্ছে। যখনি বাড়ির বাহিরে বেরিয়েছে তার চোখ শুধু আরসালকেই খুঁজে গেছে! কিন্তু প্রত্যেকবার শুধু নিরাশাই মিলেছে। আর পারছেনা সে। আর পারছেনা! কি এমন পাপ করেছে সে, যার জন্য এত যন্ত্রণা এত কষ্ট ভুগতে হচ্ছে তাকে। এরচেয়ে মৃত্যুও শান্তির!

.
সারা সকাল মন খারাপে কাটল সায়রার। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে পাশেই চা বাগানে বেড়াতে গেল সবাই। সায়রাকে জোরাজোরি করলেও রাজি করতে পারেনি কেউ- ই! সায়রা যাবেনা বলে সাথে আরমিন তুর্জয়ও রয়ে গেল। সারা দুপুর রুমে কাটিয়ে শেষ বিকালে আরমিন তুর্জয়ের জোরাজুরিতে বাগানে বেড়াতে বের হলো সায়রা। আরমিন তুর্জয় কথা বলছে। পাশেই নিশ্চুপ হাঁটছে সায়রা। গভীর কোন চিন্তায় ডুবে। গতরাতের কথা ভেবে চলছে বারংবার। কিছুতেই সেই ছবি গুলো স্মৃতি থেকে মুছতে পারছে না। গেটের বাহিরে হাওয়াই মিঠাই দেখে চেঁচিয়ে উঠল আরমিন। উল্লাসিত আওয়াজে বলল,

–” আমরা ছোটবেলায় হাওয়াই মিঠাই খেয়ে জিহ্বা লাল করতাম তোর মনে আছে সায়রা? মামীমা তা দেখে কি বকুনি- ই না দিতো! ”

মিহি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল সায়রা,

–” হ্যাঁ, মনে আছে আপু!”

তুর্জয় প্রশ্ন ছুঁড়ল,

–” হাওয়াই মিঠাই খাবে তোমরা?”

সায়রা না করতে চাইল। কিন্তু তার আগেই আরমিন জানাল ‘সে খাবে’। তুর্জয় হাওয়াই মিঠাই আনতে গেল। সায়রা আরমিন পাশেই একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। আরমিন গল্প করছে সেই দিকে বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই সায়রার। সে চেয়ে আছে লেকের ওপারে বেঞ্চের দিকে। চোখ ঘুরাতেই থমকে গেল সায়রা। সামান্য দূরে ছাউনির সামনে কারো উপর চোখ আটকাল তার। পড়ন্ত বিকালের শেষ বেলার হলদেটে আলো মানুষটার মুখে পড়ছে । ক্ষিপ্র মুখশ্রী। কানে ফোন। কারো সাথে কথায় ব্যস্ত। সায়রার চোখ মুখ বিস্ময়ে ভরে এলো। উঠে দাঁড়াল সে, গাল বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে। ছুটে গেল মানুষটার দিকে। ধপ করে বুকে পড়ল তার। নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে নিলো সায়রা। অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সে। ভাঙ্গা আওয়াজে বলল সায়রা,

–” অবশেষে আমি আপনাকে পেয়েছি আরসাল! আমার তপস্যা সফল হয়েছে! আমি আপনাকে খুঁজে পেয়েছি!”

আর কিছু বলতে পারল না সায়রা। চিৎকার করে কাঁদছে তো কাঁদছেই সে। এই দেড় বছরের সকল কষ্ট, আবেগ যেন আজ কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে। যতটা শক্ত করে পারছে সামনের মানুষটাকে জড়িয়ে ধরছে। হাতের বাঁধন হালকা হলেই যেন হারিয়ে যাবে সে। সামনের মানুষটার বুকে মাথা ঠেকিয়ে পিঠ খামচে ধরেছে সায়রা, যেন এখনি বক্ষপিঞ্জরে ঢুকে পড়বে সে। সেখানে লুকিয়েই তার পরম শান্তি।

সায়রাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে পিছুপিছু আরমিনও ছুটে এসেছে। সামনে আরসালকে দেখে স্থব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এটা কি আদৌ সত্যি নাকি কল্পনা! এটা কি সত্যি আরসাল। সায়রার দৃঢ় বিশ্বাস কি ফিরিয়ে এনেছে আরসালকে! দুজনকে এক সাথে দেখে খুশিতে চোখ ভরে এলো আরমিনের। ততক্ষণে তুর্জয় চলে এসেছে। আরমিনের মত তারও একই দশা। বিস্ময় তার আকাশ চুম্বী!
আশেপাশে ভিড় জমেছে। এভাবে লোক সম্মুখে জড়িয়ে থাকতে দেখে লোকে কথা বানাচ্ছে। হঠাৎ ভিড় ঠেলে সকালের সেই মাঝবয়েসী মহিলাটা বেরিয়ে এলো। সায়রার হাত টেনে দূরে ছিটকে ফেলল। চিৎকার করে বলল,

–” তোমাকে ভালো মনে করেছিলাম! তুমি তো দেখছি রাস্তার মেয়ে। তোমার সাহস কি করে হলো আমার ছেলের সাথে ছ্যাঁচড়ামো করার! শুনো মেয়ে এসব কাজ করার হলে রাস্তায় যেয়ে করো। আমার ছেলের দিলে চোখ দিলে চোখ তুলে নিবো। ইফতি তুই এই মেয়েটাকে কিছু বলছিস না কেন বাবা! এরা দয়ার মানুষ না। এরা সুযোগ সন্ধানী। বড়লোক সুন্দর দেখলেই গলায় ঝুলে পড়ে। এই মেয়ের এমন কাজে প্রীথির কতটা কষ্ট পাচ্ছে তোর ধারণা আছে?”

মাটি থেকে তুর্জয় আরমিন টেনে তুলল সায়রাকে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা তারা। মহিলার কথায় হতভম্ব সায়রা। এসব কি বলছে উনি? আরসালকে বার বার ইফতি বলে ডাকছে কেন। এটা তো আরসাল। তার আরসাল!

ইফতি নামক লোকটার গালে হাত ছুঁয়ে কান্না করতে করতে বলল সায়রা,

–” এসব উনি কি বলছে আরসাল! বলুন সব মিথ্যা। আপনি আরসাল। আমার আরসাল তাইনা ? বলুন উনাকে এসব মিথ্যা! আপনি ইফতি না আরসাল। আমার আরসাল! চলুন আমার সাথে! চলুন! ”

ইফতি হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইল সায়রা। পেছন থেকে মহিলা আটকাল। বড় বড় শ্বাস ফেলছেন উনি। আক্রোশে চিৎকার করে বললেন,

–” আমার ছেলের হাত ছাড়ো মেয়ে। না হয় বড় কোন অঘটন ঘটে যাবে তোমার! ছাড়ো বলছি!”

শেষ চিৎকারে মহিলা হাঁপিয়ে উঠলেন। ধীরেধীরে গায়ের শক্তি ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। ঝাড়ি মেরে সায়রার হাত ছেড়ে মহিলাকে জড়িয়ে ধরলেন ইফতি। পেছন থেকে প্রীথি মেয়েটাও ছুটে আসল। ইফতির গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন মহিলাটি। ইফতি নামক লোকটা আশ্বস্ত কন্ঠে বললেন,

–” শান্ত হও মা। আমি কোথাও যাচ্ছি না । এই দেখো তোমার কাছেই আছি।”

— ” এই মেয়েটা এসব কি বলছে ইফতি। কি বলছে এসব!”

অসুস্থ স্বরে ধীর আওয়াজে বললেন মহিলা। ইফতি সায়রার দিকে নরম দৃষ্টিতে একবার চাইল। অঝোরে কান্না করছে সায়রা। বাচ্চাদের মত কাঁদছে সে। আরমিন তুর্জয় কোন রকম চেপে ধরে আছে। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিলো ইফতি। নরম স্বরে বললেন,

–” আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে আমি আরসাল না ইফতি!”

এতটুকু বলেই মহিলাকে নিয়ে জায়গা ছাড়ল ইফতি। এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করল না। পেছন থেকে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সায়রা। সেই চিৎকার কান্না ভারী আহাজারি কান অবধি পৌঁছাল কি ইফতির!

চলবে……….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

তোমার প্রণয় নগরে
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব- ৩৩

থমথমে বসে আছে সায়রা। চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছে। চোখ মুখ অসম্ভব লাল। সায়রার মাথায় তোয়ালে মুড়িয়ে চুলের পানি ঝরাচ্ছে রিদ্ধি। রুম জুরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সবাই। সবার দৃষ্টি সায়রার উপর। রিদ্ধি আলতো আওয়াজে বলল,

–” তুই চিন্তা করিস না সায়রা। ঐ লোকটার চৌদ্দ গুষ্টির খোঁজখবর বের করে ফেলবে সায়ন। ঐ লোকটা আমাদের আরসাল নাকি উনাদের ইফতি ঠিক বেরিয়ে আসবে।”

রিদ্ধির কথা কানে তুলল না সায়রা। বেশ শান্ত আওয়াজে বলল সে,

–” আমি বিয়ের জন্য তৈরি দি। কাল সকালে ব্রেকফাস্টে আবির সাহেবকে আসতে বলো। আর শুনো, তুমি কি সাথে করে এক্সট্রা শাড়ি এনেছ? হাজার হোক পাকা দেখা শাড়ি না পড়লে বড্ড বেমানান দেখায় তাইনা!”

বিস্ময়ে সারা ঘর জুড়ে থমথমে নীরবতা বিরাজ করছে। রিদ্ধি হতভম্ব আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল সায়রার দিকে,

–” পানির বদলে ওয়াশরুমের কল দিয়ে কি ওয়াইন বের হচ্ছিল সায়রা? এসব উল্টাপাল্টা কি বকছিস তুই। এতদিন কোন আশার ছাড়া যেই মানুষটার জন্য অপেক্ষা করেছিস, আজ যখন একটা আশার প্রদীপ জ্বলেছে এখন তুই হার মানছিস! বোন আমার ধাক্কাটা কি খুব বেশি লেগেছে। ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো তোকে !”

বিরক্ত হলো সায়রা। কন্ঠে বিরক্তি জড়িয়ে রুক্ষ আওয়াজে উত্তর দিলো,

–” আমি জানি, আমি কি করছি। যা করছি সজ্ঞানে করছি। এতদিন তোমরাই বিয়ের জন্য জোরাজোরি করেছ। আজ যখন আমি বিয়ের জন্য তৈরি, তোমরা পিছুপা হচ্ছ! তোমরা কল করবে? নাকি আমি আবির সাহেবকে কল করব! ছাড়ো আমিই কল করছি!”

রিদ্ধির হাত থেকে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে গেল সায়রা। সায়রার এমন স্বাভাবিক আচরণে হতভম্ব সবাই। এসব হচ্ছে কি!

.
সকাল সকাল শাড়ি পরে বেশ পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে নিচতলায় রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে সায়রা। বারবার আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে। আচমকা সামনের চেয়ারটায় আবির এসে বসল। ঘোর কাটল সায়রার। চওড়া হেসে আবির বলল,

–” সরি, সরি লেট হয়ে গেল! খুব বেশি অপেক্ষা করাইনি তো!”

সায়রা কৃত্রিম হেসে না সূচক মাথা নাড়াল। বিস্তৃত হাসল। গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে ধীর আওয়াজে প্রশ্ন করল,

–” কেমন আছেন আপনি?”

–” হু, ভালো!”

সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সায়রা আবারো আশেপাশে কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আবির বিষয়টা লক্ষ করল। কিন্তু তেমন গুরুত্ব দিলো না।

–” আপনি কি নার্ভাস সায়রা! আমার সম্পর্কে কিছু জানার হলে আপনি সংকোচহীন জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

সায়রা এবারো কৃত্রিম হাসল। আচমকা চোখ আটকাল রেস্টুরেন্টের দরজায়। ইফতি নামক লোকটাকে ঢুকতে দেখে বাঁকা হাসল সায়রা। আবিরের সাথে বেশ ফ্রেন্ডলি হেসে হেসে কথা বলতে লাগল যেন তার কতদিনের চেনা! ইফতি দূর থেকে লক্ষ করে চোখ কুঁচকে নিলো। আবিরের পেছনের টেবিলটায় সায়রার মুখোমুখি হয়ে বসল ইফতি। ইফতি লক্ষ করল সায়রার চেহারায় আজ অন্যরকম এক চমক। হাসি উজ্জ্বল মুখশ্রী। অন্যরকম এক সৌন্দর্য। শুধু সৌন্দর্য- ই না সাথে চাপা জেদও বটে। হঠাৎ এভাবে বদলে কেন মেয়েটা? কিছু কি আন্দাজ করতে পারল! কি চলছে সায়রার মনে! ইফতি ভাবল।
আবির সায়রার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

–” সায়নের বিয়েতে আপনাকে প্রথম দেখেছি সায়রা । সত্যি বলতে প্রথম দেখায় আমি আপনার মুগ্ধতায় আটকে গেছি। আপনার হাসি কথা ফেস এক্সপ্রেশন সব কিছু আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সেই বিয়েতেই আপনার বাড়িতে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পরে সায়ন থেকে জানতে পারি আপনার বাগদান হয়ে গেছে।”

সায়রা মাথা নুয়ে চুপ করে আছে। আবির কিছুক্ষণ চুপ থাকে। আচমকা সায়রার এক হাত চেপে ধরে, করুন কন্ঠে আবার বলল,

–” বিশ্বাস করুন সায়রা, আমার আপনার অতীত নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। আপনি আমাকে ভালো না বাসলেও কোন আক্ষেপ নেই। আপনি শুধু আমার হন। আমার চোখের সামনে থাকেন এতেই আমার শান্তি। আর কিছু চাইনা আমার।”

সায়রা আবিরের কথায় ইতস্ততবোধ করল। সে আবিরকে নিজের কার্য হাসিলের উদ্দেশ্যে ডেকেছে । কিন্তু আবিরের এই গভীর অনুভূতি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই সায়রার। বেশ অবাক হয়েছে সেই সাথে নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার। আবিরের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে সায়রা অমনি ইফতি এসে সায়রার হাত আবিরের হাত থেকে ছাড়িয়ে টেনে নিজের সাথে দাঁড় করাল। বিনাবাক্যে রেস্টুরেন্ট থেকে টেনে হিচড়ে সায়রাকে নিয়ে যাচ্ছে ইফতি। হতভম্ব আবির। বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে! আটকানোর সাধ্যি কই তার! যতক্ষণে হুশ ফিরল আবিরের ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে গেছে তারা।

লোকটা সায়রাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে তেজি আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়ল সায়রা,

–” এসব কি ধরনের অসভ্যতা! আপনি আমার হাত টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ইফতি! ছাড়ুন আমার হাত! ছাড়ুন বলছি!”

পেছন ফিরে সায়রার দিকে থমথমে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকাল লোকটা। চুপ হয়ে গেল সায়রা, কিন্তু ক্ষান্ত হলো না। হাত ছাড়ানো আপ্রাণ চেষ্টা তার। সায়রার জোরাজোরিতে অতিষ্ঠ হয়ে লোকটা কাঁধে তুলে নিলো সায়রাকে, লিফটে চড়ল।

.
চুপচাপ বিছানার এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সায়রা। হাত মুখ বাঁধা। অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে ক্রোধের রক্তিম আভা! সামনের মানুষটার আঁখি জোড়া ভীষণরকম শান্ত। গালে হাত ছোঁয়াতে গেলেই মুখ ফিরিয়ে নেয় সায়রা। ছোট নিশ্বাস ছাড়ল আরসাল। চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিতে দিতে বলল,

–” হ্যাঁ আমি- ই তোর আরসাল! আমাকে জেলাস ফিল করানোর জন্য এসব করেছিস, এই দেখ আমি সত্যি- ই জেলাস! ভীষণ জেলাস। এবার এই নাটকের ইতি টান! ঐ আবির দ্বিতীয়বার যেন তোর ত্রিসীমানায় না আসে।”

ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সায়রা। জোর গলায় কিছু বলতে চাইল, কিন্তু মুখ বাঁধা হওয়ায় আওয়াজ করতে পারল না। চোখ থেকে টপটপ পানি ঝরছে সায়রার। আরসাল এবার জোর করে কলে তুলে নিলো । সায়রার কপালের সাথে কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে নিলো। আবেশিত আওয়াজে বলল,

–” তোর সাথে ঢাকা থেকে অদূর সিলেটে দেখা হওয়াটা টোটালি আনএক্সপেক্টেড। দেড়বছর পর তোকে এভাবে এতটা কাছে পাবো কল্পনাতীত ছিল। এক্সিডেন্টের পর লাস্ট একবছর চার মাস কোমাতে ছিলাম। আর দু’মাস আগে যখন কোমা থেকে ফিরলাম তখন আমার চারপাশের সবটাই বদলে গেছে। এলোমেলো হয়ে গেছে সব। না চাইতেও কৃতজ্ঞতাবশত একটা সম্পর্কে জড়িয়ে গেছি। তাই বলে এই না যে আমি তোদের ভুলে গেছি। এই দু মাসে এমন কোন দিন নেই যেদিন আমি তোর আর বাবা মায়ের খোঁজ নেইনি। প্রত্যেকটা দিন গলা কাটা মুরগীর মত ছটফট করছি আমি। আমাকে একটু সময় দে আমি এদিকটা গুছিয়ে তোদের কাছে ফিরে আসবো। কথা দিচ্ছি!”

সায়রা কাঁদছে তো কাঁদছেই। কান্নার বেগে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে সায়রার। হাত মুখের বাঁধন খুলে দিলো আরসাল। তড়াক করে আরসালের কোল থেকে উঠে দাঁড়াল সায়রা। আরসাল সায়রার দিকে এগিয়ে আসতেই চিৎকার করে বলল সায়রা,

–” রক্তের সম্পর্ক থেকে এই কৃতজ্ঞতাবশত সম্পর্ক দামী হয়ে গেল আপনার? এই দেড় বছর আমাদের কেমন কেটেছে ধারণা আছে আপনার? বাড়িতে বাবা মা কেমন করে বাঁচছে সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আইডিয়া আছে!”

–” উনাদের কাছে তুই আছিস! তাছাড়া অনেক কিছু আছে যা এখনি আমি তোকে ব্যাখ্যা করতে পারছিনা। আমি কেন এসব করছি প্লিজ এর কারণ জিজ্ঞেস করিস না। আমাকে একটু সময় দে, আর দুটো মাস! আমি সবটা এক্সপ্লেইন করব!”

কয়েক পলক স্থব্দ চেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সায়রা। আরসাল পা বাড়াতেই রাগে জিদে ইচ্ছেমত বুকে আঘাত করল সায়রা। শার্টের বোতাম ছিঁড়ে ফেলল আরসালের। সজোরে চিৎকার করে বলল,

–” আমার জীবনে কেন এসেছিলেন আপনি? কেন এভাবে এলোমেলো করে দিলেন আমাকে? আপনিহীন বেশ ভালো ছিলাম আমি। কেন খনিকের ভালোবাসার লোভ দেখিয়ে এক সমুদ্র কষ্ট দিলেন!”

আরসাল বেশ শান্ত দৃষ্টিতে সায়রার দিকে চেয়ে আছে। নিখুঁত ভাবে দেখছে এলোমেলো কাজল ল্যাপটানো সায়রাকে। সায়রা সেই কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এসি রুমে ঘামে গা ভিজে আছে তার। অস্থির হয়ে গেছে। আরসাল আবারো কোলে তুলে নিলো। বুকে সজোরে আঘাত করছে সায়রা। এতে আরসালের পা থামল না। সায়রাকে বিছানায় বসিয়ে তার পায়ের কাছে বসল। একের পর এক অনবরত সায়রার হাতের পিঠে চুমু খেতে লাগল আরসাল। ঝাড়ি দিয়ে হাত সরিয়ে নিতে চাইল সায়রা। পারল না। শক্ত ভাবে চেপে ধরল আরসাল!
পিটপিট দৃষ্টিতে আরসালকে দেখছে সায়রা। অনেকটা বদলে গেছে আরসাল। ফর্মাল ড্রেসাপ, আর্মিদের মত খাটো খাটো চুল। কপালে বড় এক দাগ। বেশ গভীর ভাবে দেবে গেছে দাগটা। আচ্ছা এই দাগ কিসের? আগে তো ছিল না। এক্সিডেন্টের কি? আনমনে আরসালের কপালের দিকে হাত বাড়াল সায়রা। আলতো স্পর্শে দাগটা আঙ্গুল ছুঁয়ে দেখতে লাগল। চোখ উঁচিয়ে সায়রাকে দেখছে আরসাল। অকস্মাৎ সায়রার কোমর জড়িয়ে কোলে শাড়ির ভাজে মাথা রেখে চোখ বুজে নিলো আরসাল। ফিসফিস করে বলল সায়রা,

–” যত যাই করেন, আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না আরসাল! কোনদিন না”

শুনে মুচকি হাসল আরসাল। টু শব্দ করল না সায়রা। মূর্তির মত শক্ত হয়ে বসে রইল শুধু। ঘন্টা খানেক এভাবেই কাটল। হঠাৎ আরসালের ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভ করে কানে ধরল আরসাল। অপর পাশ থেকে কি বলল শুনল না সায়রা। আরসাল সায়রার দিকে একবার তাকাল। ভ্রু কুঁচকে নিলো সায়রা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফোনের অপর পাশের মানুষটাকে জবাব দিলো আরসাল,

— ” আসছি আমি”

ফোন কাটল। সায়রার দিকে এগিয়ে এসে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আরসাল। দৃঢ় আওয়াজে বলল,

–” আমাকে এখন ফিরতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি তোর কাছে ফিরে আসবো!”

সায়রা আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আরসালের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে করুন কন্ঠে বলল,

–” এত কষ্ট! এত কষ্টই কি আমার পাওনা ছিল আরসাল? আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না। কোনদিন না!”

আরসাল হাতের মুঠো শক্ত করে নিলো। সায়রার কপালে গাঢ় করে চুমু এঁকে ভাঙ্গা আওয়াজে বলল, “সরি পুতুল বউ!”

চট করে সায়রা থেকে দূরে সরিয়ে হাতের পিঠে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আরসাল। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল সায়রা। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

–” আরসাল!!!! আমি আপনাকে কোনদিন ক্ষমা করব না! ক্ষমা করব না!”

চলবে……….

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here