তোমাকে,পর্ব 13.1,14.1
অনিমা হাসান
পর্ব 13.1
অনিমার সারা শরীর কাঁপছে I মনে হচ্ছে জ্বর এসে গেছে I অনিমা ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল I ওর মাথা বন বন করছে I মুনির এর মত ভদ্র একটা ছেলে এইরকম কাজ করতে পারে এটা ওর ধারণারও অতীত I তাছাড়া এমন নয় যে মুনির এমন সুযোগ আগে কখনো পাইনি I অনেকবার পেয়েছে I এমন অনেক সময় এসেছে যখন ওরা দুজন অনেক কাছাকাছি ছিল I ও চাইলে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারতো I সবচেয়ে বড় কথা অনিমা হয়তো ওকে বাধা ও দিত না I কিন্তু আজ ও এইরকম একটা অদ্ভুত কাজ কেন করল ? শুধুমাত্র ওকে রাজি করানোর জন্য ? অনিমার একবারও মনে হলো না যে একটা দুর্বল অসহায় মেয়েকে একা পেয়ে মুনির এই কাজটা করেছে I অনিমা জানে মুনির এমনটা করতেই পারেনা I তবে কেন? কেন বলল যে ও দয়া করছে না বরং চাইছে I এসব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ওই দিতে পারবে আর সেটা তখনই সম্ভব যখন অনিমা ওর সঙ্গে দেশে যাবে I
অনিমা ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে উপরে চলে গেল I তারপর ওর শরীরটা বিছানার উপরে এলিয়ে দিয়ে সেজুতিকে টেক্সট করল
-তুমি কোথায় মা ?
-ক্লাস শেষ করে ফিরছি
-একা?
-হ্যাঁ I আঙ্কেল কে আসতে মানা করেছি আজ I অর্ধেক পথ ফ্রেন্ডের সাথে এসেছি I মা, আইএম ভেরি হ্যাপি ফর ইউ I আঙ্কেল ইজ এ ভেরি নাইস ম্যান I
– আর ইউ শিওর ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি প্রবলেম উইথ দ্যাট ?
-অফকোর্স মা I আমরা এটা অনেক আগে থেকে প্ল্যান করছিলাম
-কোনটা ? অনিমা অবাক হয়ে লিখল
-হোয়েন ,হাউ এন্ড হোয়ার টু প্রপোজ ইউ I আই টোল্ড হিম ইওর ফেভারিট স্পট
অনিমা এই ধাক্কাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না I তারমানে মুনির সেঁজুতির সঙ্গে অনেকদিন ধরেই এগুলো নিয়ে কথা বলছে ? অনেকদিন ধরেই এসবের প্রস্তুতি চলছে? ওই কিছু জানত না ? মুনির বলছিল ওর বাসার সবাই সেজুতিকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছে I তারমানে ওদের সঙ্গেও সেঁজুতির যোগাযোগ হয়েছে? কবে হল এসব? অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I ওর আর কিছু ভাবতে ইচ্ছা করছে না I তবে খুব ইচ্ছা করছে মুনির কে জিজ্ঞেস করতে WHY ME? WHY NOW?
অনিমার হঠাৎ মনে পড়ল বহু বছর আগে কোন এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় অনিমা মুনির এর কাছে আসতে চেয়েছিল I সেদিন মুনির ওকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেয় নি I নিষ্ঠুরের মত প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছে I তবে আজ এত বছর পর কেন ? এটা কি শুধুই দয়া নাকি সহানুভূতি ? নাকি ভালোবাসা ? কোনটা অনিমাকে এটা জানতে হবে I জানতেই হবে I
নিজের কৃতকর্মের জন্য মুনির এর কোনো অনুশোচনা নেই I এই বোকা জেদি অভিমানী মেয়েটা মরে যাবে তবু কারো সাহায্য নেবে না I মুনির আগেও অনেক চেষ্টা করেছে ওকে সাহায্য করার কিন্তু ও এড়িয়ে গেছে I কাজেই এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না I সেদিন বাগানের ওই দৃশ্যটা দেখার পর মুনির ঠিক করেছে কিছুতেই অনিমাকে এখানে ফেলে যাবে না কিছুতেই না I যদি ওকে জোর করতে হয় তবু করবে I
মুনির মনে মনে একটু হাসলো I আজ অনিমা খুব রেগে গেছিল I এই প্রথম ওকে এত রাগতে দেখল মুনির I ওর রাগ কমানোর জন্য ওকে একটা শক দেবার দরকার ছিল I মুনির তাই করেছেI অনিমা কেমন কাঁপছিল I মুনির এর খুব ইচ্ছা করছিলো ওকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরতে I কিন্তু অতটা হয়তো অনিমা নিতে পারত না I সত্যি বলতে কি আজ অনিমাকে দেখে একটা ধাক্কা খেয়েছে মুনির I ওকে এইরূপে বহু বছর পর দেখেছে I শেষ দেখেছিল 13 বছর আগে , সেই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় I সেদিনও এমনই একটা পোশাক পড়েছিল ও I আজ ওকে দেখে মনে হল সেই ছোট্ট অনিমা আবার ফিরে এসেছে I সেদিন ওকে খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল মনিরের I ইচ্ছে হয়েছিল ভালোবেসে কাছে টেনে নিতে কিন্তু সাহস হয়নি I সেদিন যদি সাহস করতো তাহলে আজ হয়তো ওদের সম্পর্কের সমীকরণটা অন্যরকম হতো I সেদিনের ভুলটা আবার করতে চায় না মুনির I একবার ওকে হারিয়ে এতগুলো বছর কষ্ট পেয়েছে I ভাগ্য ওকে আরেকটা সুযোগ দিয়েছে এবার আর কিছুতেই অনিমাকের হারাতে পারবে না ও কিছুতেই নাI
ঠিক সাড়ে সাতটার সময় মুনির উপরে উঠে যায় এবং আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করে টেবিলের উপর একটা পাসপোর্ট আর দুইটা ফটো আইডি রাখা I মুনির একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ডকুমেন্টগুলো নিয়ে নিচে নেমে যায় I
পর্ব 13.2
অনিমা ঠিক করেছে মুনিরকে আর বিরক্ত করবে না I মুনির ওকে ভালোবাসে না এটা ও বুঝে গেছে I নিজেকে সামলে নিতে অনিমার কয়েকটা দিন লেগে গেল I ভাগ্যিস পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে I তা নাহলে হয়তো পরীক্ষাটা দিতে পারত না I অনিমা মেনে নিয়েছে কিন্তু মুনির এর সঙ্গে বন্ধুত্বটাও নষ্ট করতে চায়না I কদিন হয়ে গেল ও ক্লাসে যাচ্ছে না I এমন নয় যে মুনির এর সামনে যেতে ওর অবস্তি হচ্ছে আসলে খুব কষ্ট হচ্ছে I এই পৃথিবীতে আর কেউ ওকে এভাবে বুঝতে পারেনি, কেউ এত যত্ন করে নি , এভাবে ওর মনের কাছাকাছি আসেনি I অনিমা ভেবেছিল হয়তো মুনির ওকে ভালবাসে I সবটাই ভুল ছিল I হয়তো মুনির ওর গান শুনে অপ্রস্তুত হয়েছে I তা না হলে এভাবে চলে যাবে কেন? অনিমা আর কখনো ওকে কিছু বলবেনা I কক্ষনো না I
থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হয় I এখনো রেজাল্ট হয়নি I ল্যাব শুরু হবে আজকে থেকে I মুনিরের এবার পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে I মুনির বরাবরই খুব অ্যাম্বিসিয়াস এবং প্র্যাকটিক্যাল I ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর থেকেই ও নিজেকে তৈরি করেছিল কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড এর জন্য I ইচ্ছা ছিল একটা মাল্টিন্যাশনাল জয়েন করার I যত দ্রুত সম্ভব প্রতিষ্ঠিত হয় পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর I কিন্তু সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল I হঠাৎ একজনের জন্য ওর জীবনের লক্ষ্য বদলে গেল I মুনির প্রথম যেদিন অনিমা দের বাসায় গেল সেদিন একটা বড় ধাক্কা খেয়েছিল I অনিমাকে দেখে ও বুঝতে পারেনি যে ওদের আর্থিক অবস্থা এমন I প্রাইভেট জব করে হয়তো ওর কিছুটা সচ্ছলতা আসবে কিন্তু সেটা এমন কিছু না যেটা নিয়ে ও অনিমার বাবার সামনে দাঁড়াতে পারবে I তাইতো ও ওই পথে আর ভাবেনি বরং ঠিক করেছে এমন একটা কিছু করবে যাতে ওর একটা সামাজিক অবস্থান তৈরি হয় I আর সেটা তখনই সম্ভব যখন ও ফ্যাকাল্টি হিসেবে জয়েন করবে I সেকেন্ড ইয়ারে খুব একটা পরিশ্রম না করেই ওর সেকেন্ড পজিশনে ছিল I এবার ও অনেক পরিশ্রম করেছে Iকিন্তু এই সবকিছু বৃথা হয়ে যাবে যদি অনিমা ওকে ভুল বুঝে I মুনির জানে সেদিন ঐ ভাবে চলে আসায় অনিমা কষ্ট পেয়েছে I ও সবটা ওকে বলতে চায় কিন্তু অনিমা আসছে না কেন ?
অবশেষে মুনিরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অনিমা এল I মনির সেকেন্ড বেঞ্চে বসেছিল অনিমাকে ঢুকতে দেখে ইচ্ছে হল তখনই ছুটে গিয়ে কথা বলতে কিন্তু অনিমা ওর দিকে তাকালো না I অন্যসময় ওর চোখে চোখ পড়লেই অনিমা কি সুন্দর করে হাসে অথবা বাচ্চাদের মতন হাত নাড়ে কিন্তু আজ এসব কিছুই করলো না ক্লাসে ঢুকে একপাশে বসে পরলো I ক্লাস শেষে ও বেরিয়ে গেল অন্য মেয়েদের সাথে I
অনিমা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল অন্য মেয়েদের সঙ্গে I এরকম কতবার হয়েছে যে মুনির অনেকের মাঝখান থেকে অনিমাকে বের করে নিয়ে এসেছে কিন্তু আজ সাহস হচ্ছে না I যদিও না আসে I মুনির কিছুক্ষন ইতস্তত করে এগিয়ে গেল I জটলাটার কাছে গিয়ে বলল
-একটা এনাউন্সমেন্ট আছে I সবাই একটু ভেতরে আসবে ?
মুনির দাঁড়িয়ে রইল I সবাই ভেতরে এলে ও অনিমার সঙ্গে একটু কথা বলবে I কিন্তু অনিমা ভেতরে এলো না I উল্টো দিকে হেঁটে চলে যেতে লাগলো I অনিমা ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে I মুনির নিতে পারছে না I মনে হচ্ছে ভেতরটা ভেঙেচুড়ে যাচ্ছে I অনিমার ও কি এমন কষ্ট হয়েছিল সেদিন ও চলে আসাতে I
ল্যাব শুরু হতে আরও এক ঘন্টা বাকি I মুনির দেখল অনিমা আস্তে আস্তে ল্যাবের দিকে যাচ্ছে I অনিমা দের ল্যাব টা কার্জন হলের একেবারে শেষমাথায় I মেয়েরা সাধারণত রিক্সা নিয়ে যায় Iঅনিমা কেন হেটে যাচ্ছে তাও এতক্ষণ আগে ? মুনির একটু অবাক হলI যাক ভালই হয়েছে ওকে একটু একা পাওয়া গেল I মুনির দ্রুত রাস্তা পার হয়ে অনিমার কাছাকাছি গিয়ে ডাক দিল I অনিমা একবার একটু পাশ ফিরে চেয়ে আবার হাঁটতে লাগলো I মুনির এর চোখের দিকে তাকালো না I
– অনিমা ল্যাব শুরু হতে আরও এক ঘন্টা বাকি
– হ্যাঁ জানি
– চলো চা খাই
অনিমা কিছু বলল না I চকিতে একবার তাকিয়ে আবার হাঁটতে লাগলো I
– অনিমা তোমাকে সেদিন একটা কথা বলা হয়নি
– কি ? অনিমা নিচের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করল
– তোমার গানটা অসম্ভব সুন্দর ছিল
– তাই নাকি? এজন্যই বুঝি আমার অডিয়েন্স ভয়ে পালিয়ে গেল
– না না ছি I কি বলছ I আমার আসলেই একটা জরুরী কাজ পড়ে মনে পড়ে গেছিল I তবে তোমার গানটাকে আরো সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত I তুমি চাইলে অনেক বড় মাপের..
– আমি চাইনা
– কি চাওনা?
– আমি সবার জন্য গান গাইতে চাই নাI আমি শুধু আমার নিজের জন্য আর আমার খুব কাছের মানুষদের জন্য গান করতে চাই
মুনির একটু থমকে গেলI তবে কি একটা ভেবে ওর ঠোঁটের কোণে একটা সূক্ষ্ম হাসির রেখা দেখা গেল
– চলো চা খাই I মুনির তারা দিল
– এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে না I তুমি যাও আমি পরে আসবো I
অনিমা আর কিছু না বলে সামনের দিকে হাঁটা দিলI
ল্যাবের উল্টোদিকে একটা বিশাল বাঁদরলাঠি গাছ I নিচটা হলুদ ফুলে ছেয়ে আছে I অনিমা আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে গাছটার নীচে বসলো I কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রেখে একটা বই বের করে অন্যমনস্ক ভাবে কিছু লিখতে আরম্ভ করলো I
অনিমার পরনে সাদা পোশাক I হাটুর উপর চিবুক রেখে ও অন্যমনস্ক ভাবে বসে আছে I চুলগুলো কাঁধের দুপাশে আলগোছে ছড়ানো I ওর চারপাশে হলুদ আভা I ওপর থেকে হলুদ ফুলের পাপড়ি ওর উপর পড়ছে I মুনির দূর থেকে দৃশ্যটা দেখল I ওর মনে হলো এটা এই জগতের নয় কোন এক অপার্থিব জগতের দৃশ্যI এই দৃশ্যটা যদি ফ্রেমে বন্দী করা যেত তবে ও সেটা সারা জীবন বুকের মধ্যে ধরে রাখত I মুনির সিঁড়ির ধাপে বসে অপলক চেয়ে রইল I
– খালি চাইয়া থাকলে হইবো মামু ?
– হাসিব চল ল্যাব এ যাই I মুনির একটু লজ্জা পেয়ে বলল
– আরে ব্যাটা এমনি খালি চাইয়া থাকলে একদিন দেখবি চিড়িয়া নাই
– কি সব বলিস
– ঠিকই কইI কবে কবি ওরে ?
– কালকে ইনশাল্লাহ
– কালকে কি রে ? পাশ থেকে সুমন জিজ্ঞেস করল
– আরে কালকে আমাগো হিরো হিরোইনরে প্রপোজ করব
– ওয়াও! CONGRATS ম্যান
পেছন থেকে সুমি কথাগুলো শুনে দ্রুত ল্যাবের ভেতর ঢুকে পরল I নীলার কাছে গিয়ে বলল
– কিরে শুনলাম মুনির নাকি তোকে কালকে প্রপোজ করবে
– কে বলল? নীলা অবাক হয়ে জানতে চাইল
– ও নিজেই বলছিল
– ও তাই নাকি
নীলা বেশ প্রশন্য বোধ করল I একটা মফস্বলের ছেলে এতদিন ধরে নীলিমা রায়হান কে ঘোরাবে এটাতো হজম করা যায় না I যাক এবার তাহলে লাইনে এসেছে I খবরটা একবার অনিমাকে জানাতে হয় I নীলা ল্যাবে অনিমা কে দেখতে পেল না I বাইরে গিয়ে ও খুঁজলো কিন্তু অনিমাকে কোথাও পাওয়া গেল না I ফোন করে জানতে পারলো অনিমার শরীর খারাপ লাগছিল ও বাসায় চলে গেছে I
চলবে….
লেখনীতে
অনিমা হাসান
তোমাকে
পর্ব 14.1
-অনিমা, তোমার ভাইয়ের ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা আমার লাগবে
অনিমা চমকে উঠলো I ও ভেবেছিল একবার দেশে গেলে আর মুনিরের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখবে না I ধানমন্ডির যে বাড়িতে আগে ওরা থাকত সেখানে এখন আর কেউ থাকেনা I হাসান সাহেব মারা যাবার পর আবরার ওর বউ সহ মহাখালী ডিওএইচএস এর ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠেছে I অনিমা ভেবেছিল দেশে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আবার ফিরে আসবে I মুনির নিশ্চয়ই ওদের খুঁজে পাবেনা I কিন্তু এখন ঠিকানা ফোন নাম্বার চাইলে তো সমস্যা I
– তুমি কি শুনেছো আমি কি বলছি ?
– হ্যাঁ শুনেছি I ঠিকানা ফোন নাম্বার কেন লাগবে ?
– আমি অফিশিয়ালি ওকে জানাতে চাই I উনি তো এখন তোমার গার্জিয়ান তাই না ?
– তোমার কিছু জানাতে হবে না I আমি জানিয়ে দেবো
– সে তোমারটা তুমি জানাবে I কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে জানাতে হবে I আমার মা ওর সঙ্গে কথা বলবে
অনিমা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল I মুনির এতদূর ভেবে ফেলেছে I যা মনে হচ্ছে ওরা অফিশিয়ালি প্রস্তাব পাঠাতে যাচ্ছে I এরকম করলে তো সমস্যা I এমনটা হলে তো ও কিছুতেই পালাতে পারবে না I
– এবার তুমি আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে না অনিমা
অনিমা রীতিমতো কেঁপে উঠলো I এই লোকটা কি এখন মনের কথা ও টের পাচ্ছে নাকি ? অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I তারপর মনে মনে বলল ভয় নেই আমি পালাবো না I নিজের কাছ থেকে পালাতে পালাতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি I মুখে বলল
– ঠিক আছে টেক্সট করে দিচ্ছি
অনিমা ঠিকানা ফোন নাম্বার টেক্সট করে দিল I মুনির চেক করে দেখলো এসেছে কিনা I মুনির চলে যাচ্ছে না I দাড়িয়েই আছে I বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে I অনিমা রান্না মাত্র শেষ করেছে I আজ ওর ছুটি I একটু বাইরে যেতে হবে বলে রাতের রান্না আগেই করে ফেলেছে I অনিমার হঠাৎ মনে হল মনিরকে খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে I মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাই নি I হয়তো খায়ওনি কিছু I অনিমার একটু মায়া হল I বলল
– বস
মুনির চেয়ার টেনে বসে পরলো I অনিমা চিঁড়ের পোলাও করেছিল I একটা বাটিতে একটু বেড়ে চামচ দিয়ে এগিয়ে দিল I মুনির একটু অবাক হয়ে তাকালো তবে কিছু বলল না I বাটিটা টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো I মুনির খুব আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে দেখে বোঝা যাচ্ছে ওর প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছিল I অনিমার চোখে পানি এসে গেল I নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে I কি হয়েছে ওর I কারণে অকারণে শুধু চোখে পানি এসে যায় I মুনির খাওয়া শেষ করে বলল
– কি জিনিস এটা খেতে এতো ভালো
– চিঁড়ের পোলাও তুমি খাওনি আগে কখনো ?
– না , খুব ভালো খেতে
-আরেকটু দেই ?
– দাও
অনিমা বাটিতে আরো অনেকটা ঢেলে এগিয়ে দিল I গ্লাসে পানি ঢেলে দিল I মুনির খেতে খেতে বলল
– আমার একটু শপিং করতে হবে তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে?
অনিমা নিজের ভেতরকার দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে কর্কশ কন্ঠে বলল
-না
মুনির আর কিছু বলল না I মোবাইল স্ক্রল করতে লাগলো I ওর খাওয়া শেষ হয়ে গেছে তবু চলে যাচ্ছে না বসেই আছে I অনিমা জিজ্ঞেস করল
-আর কিছু খাবে ?
– চা খেতে পারি
অনিমার নিজের ও চা খাওয়া হয়নি সকালে I ও চা বানিয়ে এনে মুনির কে দিল I নিজেও এক কাপ নিল I তারপর একটু ইতস্তত করে বলল
– আমি গ্রোসারি করতে যাচ্ছি I তোমাকে কি কোথাও নামিয়ে দেবো ?
– নামিয়ে দিয়ে লাভ হবে না I এসব জিনিস কোথায় পাওয়া যায় আমার কোনো ধারনাই নেই I
– কি জিনিস ?
– দেশ থেকে লিস্ট পাঠিয়েছে
– কোথায় দেখি
মুনির মোবাইল এগিয়ে দিল I অনিমা দেখল কিছু ব্র্যান্ডের কসমেটিক্স পারফিউম আর ব্যাগের নাম লেখা I
– আমি যেখানে যাচ্ছি সেই মল এই পাওয়া যায় এসব I আমি নিয়ে যাচ্ছি I এখনই বেরোবে তো ?
– তোমার যদি কোন সমস্যা না হয়
– ঠিক আছে বস তাহলে আমি রেডি হয়ে আসছি I
কেনাকাটা শেষ করে ওরা একবারে সেজুতিকে পিক করে নিল I মুনির বলল
– চলো একবারে ডিনার করে বাসায় যাই
অনিমা কিছু বলার আগেই সেঁজুতি বলল
– THAT WILL BE GREAT
-কি খাবে বলো ?
– LETS TRY আফগানি টুডে
– PERFECT
মুনির তাড়াতাড়ি মোবাইল সার্চ করে অর্ডার দিয়ে দিল I তারপর ঠিকানা দেখে অনিমা কে বলল ওখানে যেতে I অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I মনে হচ্ছে ও একজন ড্রাইভার I ওর মতামতের কোনই গুরুত্বই নেই I রেস্টুরেন্টে যাবার পরও ওকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না I দুজন দিব্যি গল্প করতে করতে খেতে লাগলো I অনিমা আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল I গল্প করা শেষ I এখন একটা মুভি দেখছে সেঁজুতির মোবাইলে I অনিমা কিছু শুনতে পাচ্ছে না I মনে হচ্ছে কোন হাসির মুভি I সাবটাইটেল দেখে দুজন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরছে I অনেকদিন পর সেজুতিকে এত খুশি হতে দেখল অনিমা I একবারের জন্য ওর মনে হলো সেঁজুতির জন্য হলেও ওর বোধহয় বিয়েটা করা উচিত I
পর্ব 14.2
মুনির রোকেয়া হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আধা ঘন্টার উপরে I কল পাঠিয়েছে এখনো নাজমার কোন খবর নেই I মনিরের অসম্ভব বিরক্ত লাগছে I ও ঠিক করে ফেলেছে নাজমা নেমে এলে ওকে টেনে দুটো চড় বসিয়ে দেবে I কোনো টাইম সেন্স নেই I যত্তসব I শুধু যদি এমন সেনসিটিভ ইসু না হত তাহলে ও কখনই নাজমার হেল্প নিত না I
নাজমা মুনিরের ছোট বোন I এ বছরই ইউনিভার্সিটিতে চান্স পেয়েছে I মুনির যতটা চুপচাপ আর গম্ভীর নাজমা ঠিক ততটাই চঞ্চল আর ছটফটে I ক মাসের মধ্যেই অসংখ্য বন্ধু বানিয়ে ফেলেছে I তবে নাজমা অসম্ভব বুদ্ধিমতী , চটপটে আর দায়িত্বশীল মেয়ে I ওর উপর কোন কাজের দায়িত্ব দিলে নির্ভর করা যায় I
আরো প্রায় মিনিট 15 পর নাজমা নেমে এলো I দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলল
– সরি ভাইয়া গোসল করছিলাম
– 2 ঘন্টা ধরে গোসল করলে পড়াশোনা কখন করিস ?
– সরি ভাইয়া ভুল হয়ে গেছেI তোমার কোন কাজ ছিল?
-হ্যাঁ
মুনির ওর ব্যাগ থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে নাজমার হাতে দিয়ে বলল
– এটা তোর জন্য এনেছিলাম কক্সবাজার থেকে
নাজমার হাসি আরো বিস্তৃত হল I তারপর সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
– শুধু এটাই দিতে এসেছিলে?
– না , আমার একটা কাজ করে দিতে হবে
– কি বলো
মুনির একটু ইতস্তত করে বলল
– একটা শাড়ি কিনে দিতে পারবি ? নীল রঙের তাঁতের শাড়ি I
নাজমার চোয়াল ঝুলে পড়ল I আকাশ থেকে পরী নেমে এলে, জঙ্গল থেকে দৈত্য বের হয়ে এলে কিংবা মহাকাশযানে করে এলিয়েন নেমে এলেও হয়তো ও এত অবাক হতো না I ভাইয়া ওকে শাড়ি কিনে দিতে বলছে I এই শাড়ি নিশ্চয়ই ওর বা মায়ের জন্য নয় I তারমানে ভাইয়ার বিশেষ কেউ আছে I
– মুখ বন্ধ কর I রাস্তার মধ্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? পারবি কিনে দিতে ?
– অবশ্যই পারব I কিন্তু একটা শর্ত আছে I আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে
– আচ্ছা সেটা পরে দেখা যাবে
– নামটা অন্তত বলো
– এখন না I সামনে ওর একটা প্রোগ্রাম আছে I আগে ওখানে শাড়িটা পড়ুক তারপর
– কিসের প্রোগ্রাম?
– গানের
– গানের? তারমানে অনিমা আপু ? নাজমা আনন্দে চিৎকার করে উঠলো I ওদের রুমের সবাই অনিমার ফ্যান I
মুনির ঠোটে আঙ্গুল তুলে বলল
– চুপ I যতটুকু বলেছি ততটুকু কর I আমার আজকে রাতেই লাগবে I পারবি ?
– ডেফিনেটলি পারব
মুনির নাজমা কে 2000 টাকা দিল I সামনেই inter-university সিঙ্গিং কম্পেটিশন I গত বছর এই কম্পিটিশনে অনিমা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল I সেমিনারের সামনে ওর একটা ছবি আছে ট্রফি হাতে I মুনির যতবার সেমিনারে যায় ওই ছবিটা দেখে I অসম্ভব ভালো লাগে ওর I মুনির ঠিক করেছে অনিমাকে একটা নীল শাড়ি দেবে আরেকটি চিঠি লিখবে I যদি অনিমা ওকে ভালোবাসে তবে যেন প্রোগ্রামের দিন এই শাড়িটা পড়ে আর না হলে ওদের বন্ধুত্ব যেমন আছে তেমনি থাকবে I মুনির কোন অবস্থাতেই অনিমা কে অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না I তবে কেন জানিনা মুনিরের মনে হয় অনিমা ও ওকে ভালবাসে I ঠিক ততটাই যত টুকু মুনির ওকে ভালোবাসে কিংবা হয়তো তার চাইতেও বেশি I
নাজমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুনির নীলক্ষেতের দিকে হাটতে লাগল I মোড়ের কাছে এসে দেখল অনেকটা ভিড় জমে আছে I মনে হচ্ছে কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে I মুনির স্টুডেন্টের বাসায় যাচ্ছিল I আজকে যাওয়াটা খুব জরুরী I হাতে একদম টাকা নেই I মুনির পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ মনে হল ভিড়ের মধ্যে অনিমা কে দেখলো I ওতো চলে গেছে অনেকক্ষণ I তাহলে ? মুনির দীর্ঘশ্বাস ফেলল I সবখানেই এখনও অনিমা কে দেখা শুরু করছে ? মুনির ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে গেল I একটা বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে I একটা লোক মুখ থুবড়ে পড়ে আছে রাস্তার মধ্যে I চারপাশেটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে I পাশেই একটা ছোট বাচ্চা বয়স 5 বা 6 হবে পড়ে আছে I সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে I কেউ এগিয়ে আসছে না I মুনির অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অনিমা দৌড়ে এসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল তারপর ভিড় থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতে লাগলো I মুনির হতভম্ব হয়ে গেল I অনিমা এখানে কি করছে ?
চলবে……
লেখনীতে
অনিমা হাসান