তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
পর্ব:39
Suraiya_Aayat
” আয়াশের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে, প্রিয়ন্তি মোস্তাফার চোখ থেকেও ঝরছে জল , আজ কত বছর পর তার সাথে তার ছেলের দেখা হয়েছে তা উনি জানেন না, এই অন্ধকার কুঠুরিতে তিনি কতো দিন কি কত মাস কি কত বছর কাটিয়েছেন তা উনি বলতে পারেন না ৷
নূরের চোখের জল, শাড়ির আঁচল দিয়ূ জলটা মুছে খানিকটা ভাঙা কন্ঠে বলল
” আপনার আম্মু ৷”
আয়াশ চোখের জলটা মুছে ধীর পায়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেল,প্রিয়ন্তির গলার আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীন হয়ে আসছে ৷ নূর বউটার দিকে ইশারা করে বলল
” তোমার এই ঋন যে আমি বা আমরা
কি করে শোধ করবো জানি না, তবে এতদুর যখন দায়িত্ব নিয়ে এনেছো তখন ওনাকে মুক্তি করার দায়িত্বটাও সুন্দর করে পালন করেন ভাবী ৷”
উনি ওনার স্বামীর চোখের জল মুছে এবার চাবিটা হাতে নিয়ে ওনার গেটের তালা খুলতে যাবেন তখনই আয়াশ বলে উঠলো
” নাহ, চাবি খোলা হবে না ৷ যেমন আছে তেমনই থাকবে ৷”
আয়াশের কথা কানে যেতেই বাড়ির বড়ো ছেলে বলে উঠলো
” এটা তুমি কি বলছো ভাই ? তালা খুলবে না কেন, আর দিনটার জন্য আমরা যে কতো অপেক্ষা করেছি তা তুমি জানো না ৷”
নূর ও অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
” এটা আপনি কি বলছেন? আর তালা খুলবে না কেন?কারনটা কি?”
আয়াশ গম্ভীর স্বরে বলল
” নাহ,তালা খোলা হবে না, যে যেখানে আছে সে সেখানেই থাকবে ৷ তোমরা এখান থেকে চলো ৷ ওদেরকে থাকতে দাও এখানে ৷”
আয়াশের মা আয়াশের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন, তারপর রড ধরে মেঝেতে বসে বললেন
” তোমরা এখান থেকে চলে যাও ৷”
আয়াশের কথা ওর মায়ের শুনে বলল
” হমম আমাকে একা ছেড়ে দাও ,এতো গুলো বছর যখন একা কাটাতে পেরেছি তখন আর বাকিটা জীবনও পারবো , আর আমি এখানে বেশ আছি ৷”
কথাটা শোনা মাত্রই নুর দাঁতে দাঁত চেপে আয়াশের কলার ধরে বলল
” আপনি কি পাগল হয়েছেন? আপনি কি মানুষ?নিজের মা কে এভাবে একা ফেলে রেখে যেতে কষ্ট লাগছে না ? আমার ই তো কষ্ট হচ্ছে দেখে আর সে তো আপনার মা ৷”
আয়াশ ওর জামার কলার থেকে হাতটা সরিয়ে বলল
” একদিন বলেছিলাম না আমার জামার কলার ধরে কথা বলবে না,,আই হেট ইট ৷”
কথাটা শুনেই নূর একটা থাপ্পড় মারলো আয়াশের গালে ৷ আয়াশের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে কিন্তু নুরের ওর কাজের জন্য বিন্দুমাত্র অনুসূচনা নেই কারন ও জানে যে ও যা করেছে ঠিক করেছে ৷
আয়াশ এবার জোরে ধমক দিয়ে বউটার দিকে তাকিয়ে বলল
” এখান থেকে তুমি তাড়াতাড়ি যাও নাহলে আজকেই তোমার শেষ দিন ৷”
বউটাও আয়াশের এমন ব্যাবহারে রেগে গেল, রেগে গিয়ে বলল
” আমি আমার স্বামীকে আজ এখান থেকে নিয়েই যাবো ৷ আর আজ যদি না নিয়ে যাই তাহলে ওরা আমার স্বামীকে মেরেই দেবে আর আমি তা কখনো হতে দেবো না ৷”
কথাটা বলার সাথে সাথে আয়াশ পকেট থেকে একটা কাগজে মোড়ানো পাউডার জাতীয় কিছু বার করে বলল
” তোমার কোন ধারনা আছে আমি এখন কি করতে পারি ?”
বউটা না যতোটা রেগে গেল তার থেকে নূর বেশি রেগে গেল ৷ রেগে গিয়ে বলল
” কি করতে পারেন আপনি , কি পারেন হ্যাঁ? যে ছেলে নিজের মা কে দেখে রাখতে পারে না তার সব যোগ্যতাই তুচ্ছ ৷”
আয়াশ এবার দাঁত কিড়কিড় করে বলল
” এই পাউডার যদি এখন তোমার স্বামীর নাকে সামনে ধরি তো এক সেকেন্ড ও সময় লগবে না সে কোমায় চলে যাবে ৷”
কথাটা শুনেই বউটা ভয় পেয়ে গেল ৷ নূর রেগে গিয়ে বলল
” আপনার নামে তো আমি পুলিশে কমপ্লেইন করবো ৷ আপনি এসব নিয়ে ঘুরে বেড়ান ৷”
আয়াশ হো হো করে হেসে বলল
” হাহা, কাকে শেখাচ্ছে রাজার পাঠ ৷ আমি একজন সায়েন্টিস্ট আর আমার কাছে সব ধরনের পারমিশন থাকে তাই ডু হোয়াটএভার ইউ ওয়ান্ট আফুসোনা ৷”
কথাটা শুনতেই নূর যেন আকাশ থেকে বলল
“কিহহহ !মজা করছেন আপনি ৷”
আয়াশ নুরের কাছে গিয়ে নুরের গালে স্লাইড করতে করতে বলল
” কেন জানো না আফুসোনা ?”
নূর আয়াশের কলার ধরে কাছে টেনে আনলো ,দাঁতে দাঁত চৈপে বলল
” আই হেট ইউ ৷”
কথাটা বলার সাথে সাথে নূর অঞ্জান হয়ে গেল ৷ আয়াশ তাড়াতাড়ি নূরকে ধরে নিয়ে নিলো , আর এই ঘটনা দেখে সেই বউটা ভয় পেয়ে গেল, সে ভাবলো আয়াশের সেই পাউডারের গন্ধে হয়তো নূর কোমায় চলে গেছে তাই ভয়ে ভয়ে বলল
” প্পিজ আমার স্বামীকে কিছু করবেন না, আমি যাচ্ছি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি কিন্তু একটা কথা ৷ আমার স্বামীর যদি কিছু হয় তো আমি বলে আমি আপনাকে ছাড়বো না ৷ মনে রাখবেন ৷”
কথাটা বলে উনি চলে যেতে নিলেই আয়াশ বলল
” উহু, ওই দিকে না, আমার পিছন পিছন আসুন ৷”
বউটা অবাক হলো, তারপর বলল
” মানে টা কি? কোথায় যাবো ?”
কথাটা বলতেই আয়াশ ওর মায়ের দিকে মুচকি হেসে তাকালো ৷ আয়াশ নূরকে নিয়ে অন্য একটা গলির দিকে যেতে লাগলো ,তখন বউটা অবাক হলো, এটা আবার কোন রাস্তা ৷”
উনি অয়াশের পিছন পিছন গেলেন ৷ প্রিয়ন্তি মুস্তফা দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেন ৷ বড়ো ছেলে বলে উঠলো
” আমরা কি এখান থেকে কখনো বার হবো না? তোমার ছেলে তো চিরকালের মতো সব রাস্তা বন্ধ করে দিলো,এখন ওরা যদি আমাদেরকে মেরে ফেলে?”
উনি মুচকি হেসে বললেন
” আয়াশ আমার ছেলে কৌসর, আমি তাকে জানি ,সে কারন ছাড়া কখনো কিছু করে না ৷ বিগত 8 বছর ধরে সে আমাকে খুঁজছে আর তুমি কি ভাবলে যে সে এভাবে আমাকে হারাতে দেবে?”
কৌসর অবাক হয়ে বলল
” মানে ?”
” মানে টানে কি আমি জানি না তবে এটুকু বলবো যে অপেক্ষা করো ৷”
কৌসর কিছু বলতে যাবে উনি তখনই বললেন
” উহু ,শুধু অপেক্ষা করো ৷”
ওনারা বেশ কিছুখন নিরব রইলেন তারপর হঠাৎ ই বেশ কয়েকটা পায়ের আওয়াজ এলো ,আওয়াজ আসতেই কৌসর চমকে গেল ৷ভয় পেয়ে বলল
” কে আসছে? আয়াশ আসছে নাকি ?”
প্রিয়ন্তি মোস্তাফা বললেন
” নাহ,,,ওরা আসছে ৷ ভয় পেয়ো না, শুধু চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বধীনতা লাভ করার স্বপ্ন দেখো ৷”
কৌসর ভয়ে কেঁদে ফেলল কারন এদেরকে বিশ্বাস করার মতো নেই এরা এদের কার্য সিদ্ধ হলেই সব রকম কাজ করতে পারে ৷ আওয়াজ ক্রমশ বাড়তেই একটা পুরুষালি কন্ঠে কানে এলো
” আজকে ওদের শেষ দিন ৷”
কথাটা শুনে প্রিয়ন্তি মোস্তফা খানিকটা কেঁপে উঠলেন তবুও নিজেকে ভাঙতে দিলেন না , আর এদিকে কৌসর কাঁদছে ৷হঠাৎ করে আয়াশের মামা এলেন আর তার সাথে দুজন লোক ,তাদের হাতে বন্দুক রয়েছে ৷ ওনাদেরকে আসতে দেখে প্রিয়ন্তি মোস্তফা উঠে দাঁড়ালেন তারপর ওনাদের দিকে তাকিয়ে বললেন
” কি ব্যাপার আজ এতো বছর পর নিজের বোনের কথা মনে পড়লো বুঝি?”
আয়াশের মামা রেগে গিয়ে বললেন
” তুই বোন নাকি কালসাপ আমি জানি, যে কারনে তোকে এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলাম সেই কারনটাও আজ ফুরিয়েছে ৷”
উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন
“তা কি কারন শুনি ?”
উনি রেগে বললেন
” সেটা এখন আর তোর জেনে লাভ নেই ৷”
উনি হাহা করে হেসে বললেন
” কাপুরুষ, বলার সাহস টুকু নেই ৷”
উনি রেগে গিয়ে বললেন
” আজ শুধু তোর তার তোর স্বামীর জন্য আমি আমার বউকে হরিয়েছি ৷ আমি ওকে অনেক ভালোবাসতাম কিন্তু ও, ও কি করলো? তোর স্বামীর সাথে পরকীয়া, সে নাকি তেহেরাত কে ছাড়া বাঁচবে না ৷ তাহলে এতো বছর বেঁচে ছিলো কীভাবে ৷”
” ওনার হায়াত ছিলো এত বছর তাই ৷”
” কিন্তু তোর স্বামী ওর সাথে এই সম্পর্কে না জড়ালে এতো গুলো বছর জীবিত অবস্থায় ও আমার কাছে থাকতো , না ওকে পাগল হতে হতো আর না ওকে ওর ছেলের বউকে একঘরে হয়ে থাকতে হতো আর না কৌসর আজ এখান থাকতো, মাথায় করে রখতাম ওদেরকে ৷”
প্রিয়ন্তি মুস্তফা এবার চেঁচিয়ে বলল
” আমিও আমার স্বামীকে সুযোগ দিয়েছিলাম, তুমিও ভাবীকে সুযোগ দিতে !”
” আমি ওকে সুযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু ওই যে কুকুরের লেজ যেমন সোজা হয়ন তেমনি ওর মাথা থেকেও তেহেরাতের ভুত নামেনি ৷ তাই বাধ্য হয়ে এতোগুলো বিয়ে করি আমি ৷ তবে আজ অবধি কখনো কাউকে ওর মতো করে আমি ভালোবাসিনি আর শেষমেষ ও আমাকে এভাবে কষ্ট দিলো? কি ছিলোনা আমার ?”
প্রিয়ন্তি মোস্তফা থেমে বললেন
” তাই বলে তুমি আমাকে এভাবে আটকে রাখবে?
তুমি আর তোমার ছোট বোন মিলে আমার প্রতি ষড়যন্ত্র করেছো, তা কি আমি জানি না? শুধু তুমি একা না সে ও ৷”
কথাটা বলতেই ওনার চোখ থেকে জল গড়ালো ৷ আয়াশের মামা রেগে বললেন
” ও যা করেছে সম্পত্তির ভাগীদার হওয়ার জন্য করেছে যার অধিকার ও হারিয়েছিলো পালিয়ে বিয়ে করার সময়, বাবা ওকে ত্যাজ্য করেছিলো ৷ আর আমি করেছি তোর আর তোর স্বামীর প্রতি রগে আর সব সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারে ৷ তেহেরাতকে দেখলে আজও আমার রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে , আমার সুখের সংসার নষ্ট করেছে ও ৷”
উনি মাথা নীচু করে বললেন
” তা আজ কি কাজে এলে হঠাৎ?”
” তোদেরকে আমি আর বাঁচতে দেবো না, কালকে সব সম্পত্তির ভাগ বাটোরা হবে আমি চাই না তোদের মতো জঞ্জাল রেখে আমার রাস্তা নোংরা হোক তাই সরিয়ে দেওয়াই ভালো ৷”
” নিজের ছেলেটাকে অন্তত রেহায় দাও ৷”
” নাহ, ও বেঁচে থাকলে সব ফাঁস করে দেবে আর আমি তা হতে দেবো না,,তাই ওর ও তাই হবে ৷”
কথাটা ফলে উনি হাতে বন্দুক নিয়ে প্রিয়ন্তি মোস্তফার দিকে তাক করতে গেলেই হঠাৎই পুলিশ এসে বলল
” হ্যান্ডস আপ ৷”
হঠাৎ হুড়হুড় করে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ এসে ঘিরে গেল, সহকারী দুটো লোক পালাতে গেলেই ওদেরকে ধরে ফেলা হলো ৷
আয়াশের মামা এদিক ওদিকে তাকিয়ে চমকে গেলেন,অপরদিকে প্রিয়ন্তি মুচকি হসছেন ৷ আয়াশ হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে বউটা, নুর এখানে নেই নেই ৷ এতোগুলো পুলিশ দেখে উনি ঘাবড়ে গেলেন, কিন্তু ওনার শরীরে রাগের বন্যা তাই উনি এবার বন্দুক তাক করলেন প্রিয়ন্তির দিকে
” আমার কি হবে আমি জানি না কিন্তু আমি তোকে বাঁচতে দিবো না ৷ ”
কথাটা বলে উনি গুলি চালাতে গেলেই অয়াশ ওনার হাত বরাবর গুলি মারলো ৷ উনি আহহ করে শব্দ করে উঠলেন আর ওনার হাত থেকে বন্দুকটা পড়ে গেল ৷
আয়াশ বলে উঠলো
” সবই তো বুঝলাম মামু তাই বলে নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে এতো বড়ো মিথ্যা অপবাদ দেবে?”
উনা মাটিতে বসে কাতরাচ্ছে ৷ হঠাৎ হুইল চেয়ারে করে আয়াশের খালামনি মানে ইফার মা আয়াশের বড়ো মামীকে সবার সামনে আনতেই সবাই চমকে গেলেন এক প্রকার ৷ প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে বলল ” ভাবী তুমি ?”
কৌসর চেঁচিয়ে বলল
” আম্মু ৷”
আয়াশের বড়ো মামি মুচকি হেসে বললেন
” হ্যাঁ আমি ৷ আমি বেঁচে আছি কিছ্ছু হয়নি আমার, আল্লাহ হয়তো আমার হায়াত এই অবধি রাখেননি, আরও বেশি রেখেছেন তাই আমি জিবীত ৷”
ওনার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন
” সত্যিই কি তুমি আমাকে কখনও ভালোবেসেছিলে? আমাকে পরকীয়ার দোষারোপ করো, কিন্তু দিনের পর দিন তুমি কতো রাত অন্য মেয়ের সাথে কাটিয়েছো তোমার ধারনা আছে? তোমার ছিলো কেবল লোভ যার কারনে তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে আর এরপর আরও চারটে,ভালোবাসাটা তো কেবল বাহানা ৷ মানুষ পরকীয়া করে তুমি জানো ? যখন সে ভালোবাসার মরূভুমিতে চলে আসে আর হাজার খুজলেশ ভালোবাসা পাই না তখন ৷”
কথাটা বলে উনি কেঁদে ফেললেন ৷ পুলিশ আয়াশের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল
“থ্য৷ংক ইউ, আপনি এতো কিছু করে প্ল্যান না সাজিয়ে আমাদেরকে না ডাকলে হয়তো আমরা বিশ্বাস ই করতাম না ৷ আসলে কারোর প্রতি প্রমান ছাড়া কিছু করা যাই না তাই এতো কিছু শোনা আমাদের জন্য দরকার ছিলো ৷”
আয়াশ মুচকি হাসলো ৷ দরজার তালা ভেঙে ওর আম্মুকে বার রে আনতেই জড়িয়ে ধরলেন উনি আয়াশকে, উনি অনবরণ কাদছেন আয়াশকে ধরে ৷ আয়াশের চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে ৷ পুলিশ আয়াশের মামাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলেন না, ওনাকে গ্রেফতার করা হলো ৷
চলবে,,,,