তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
পর্ব:30,31
Suraiya_Aayat
পর্ব:30
” কাল ভোরেই তুই আর নূর বেরিয়ে পড়বি, তোর মামু ফোন করেছিলেন ৷ তারা তোদের কালকে যেতে বলেছেন, নেহাতই নূর অসুস্থ নাহলে তোদের তো অনেক আগেই যাওয়ার কথা ছিলো ৷”
সোফাতে বসে আয়াশের মা প্রিয়ন্তীর ছবির দিকে তাকিয়ে আছে আয়াশ, গভীর দৃষ্টিতে ছবিটা দেখছে যেন কতকাল দু চোখ ভরে দেখা হয়নি ৷ ওনার কথা শুনেও আয়াশের মাঝে পরিবর্তন এলো না ৷ তেহেরাত সাহেব ও আয়াশের সাথে প্রিয়ন্তীর ছিবির দিকে তাকালেন ৷ পরনে লাল শাড়ি , হাত ভরতি চুড়ি, শাড়ির আঁচলটা কাধ থেকে কোমর ওপর অবধি নামানো, কথায় খোঁপা , হালকা গোলাপী ঠোঁট আর মৃদু রঙিন ছবিতে কতোটা মোহনীয় লাগছে দেখতে , এক কথায় অপরুপ , চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিলেন তিনি ৷ তেহেরাত সাহেব চোখ সরিয়ে পুনরায় বললেন
” আহানের সাথে কথা হয়েছে ? সে কেমন আছে আমাকে বলতে পারো ? আমার সাথে তার হালকা মনোমালিন্য হয়েছিলো তার দেশের বাইরে যাওয়া নিয়ে, বিষয়টাতে আমার তীব্র আপত্তি ছিলো ৷ তোমার কি তার সাথে কথা হয়েছে ?”
আয়াশ এখনো গালে হাত রেখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে ৷ আয়াশকে ভাবলেষহীন হয়ে থাকতে দেখে উনি বলেন
” আয়াশ !”
খানিকটা জোর বলায় আয়াশের ঘোর ভাঙলো, একটু থতমত খেয়ে বলল
” কিছু বলিছিলে ?”
উনি একটু গরম নিশ্বাস ছেড়ে বললেন
” আহানের খবরা খবর কিছু জানো? সে কোথায় আছে কি করছে জানো ? আমার সাথে তার কথা হয়নি ৷”
” হমম হয়েছে ৷ ভাইয়ার ক্লাস শুরু হবে কালকে থেকে৷আর সে ভালোই আছে ৷ কথা হয়েছে আমার সাথে ৷”
উনি একটু চিন্তিত হয়ে বললেন
” কবে ফিরবে জানো ?”
আয়াশ খানিকটা মুচকি হেসে বলল
” ফিরবে হয়তো আমি যেদিন ফোন করে ফেরার কথা বলবো ৷”
উনি একটু চিন্তা গ্রস্থ হয়ে বললেন
” আমার সাথে ঠিক থাকুক না থাকুক নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটা কখনো খারাপ আর তিক্ততা পূর্ন হতে দিও না ৷”
আয়াশ ওর বাবার হাতে হাত রেখে বলল
” একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো তোমাকে ?”
“হমম বলো ৷”
” আমার মা মানে তোমার প্রিয়ন্তি ছিলো অপরুপ এক সুন্দরী মহিলা , শত শত জমিদারের ছেলে তাকে বিয়ে করতে উতলা হয়ে পড়েছিলো , কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে জয়ী হয়েছো তুমি , কারন ভাগ্য ! এগুলো সব গল্প শুনেছি ৷ ”
উনি নিল্পিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন
” হমম , ঠিকই শুনেছো ৷”
আয়াশ এবার খানিকটা গাঢ় কন্ঠে বলল
” শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বৌদি কাদম্বরী দেবীর প্রেমে পাগলপ্রায় ছিলেন কারন কাদম্বরী দেবী তার স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভালোবাসা পাইনি, তিনি ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল ৷ রবীন্দ্রনাথ ও তার মোহে আটকা পড়েছিলেন ৷ একটা নারীর রুপ আর মোহ একটা পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ! আমার মা অপরুপ সুন্দরী ছিলেন, তার প্রেমে পড়েছিলো সেই সময়কার বহু যুবক , তবুও তার মনে একটাই আক্ষেপ ছিলো……তা কি তুমি জানো ?”
তেহেরাত সাহেব বেশ ঘাবড়ে গেলেন আয়াশের কথা শুনে , বেশ বিষন্ন মুখ নিয়ে বললেন
” কি !”
আয়াশ একটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর বলল
” স্বামীর ভালোবাসা পেয়েও নিজেকে কাদম্বরী দেবীর ন্যায় অনুভব করা বড়োই পাপের কাজ যা আমি করে চলেছি ! তিনি স্বামীর ভালোবাসা পাননি, আর আমি ! তাং-28শে বৈশাখ,2001″
কথাটা শুনে উনি স্তম্ভিত হয়ে বললেন
” থামো আয়াশ , আমি তোমার মুখ থেকে পুরোনো কোন কথা শুনতে চাইনা ৷ পরিস্থিতির স্বার্থে তোমার মায়ের লেখা পুরোনো ডায়েরিটা তোমার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছি বলে সেটাকে দূর্বলতা ভেবে বসোনা , পুরোনো কাসুন্দী ঘাটতে যেওনা, নাহলে তা তেঁতো হয়ে যাবে ৷”
আয়াশও ওর চোয়াল শক্ত করে বলল
” ঠিক ঠিক, আর ভুল তো ভুল,,,,,,বরং সঠিকটাকে যে ভুল হিসাবে প্রমানিত করতে চাই সে কাপুরুষের সমতুল্য ৷”
উনি হুংকার দিয়ে বললেন
” আয়াশ ! তুমি ভুলে যাচ্ছো যে আমি তোমার,,,,,৷”
” বাবা, তুমি আমার বাবা, যেও নিজের বংশের ধারা বজায় রাখার জন্য পরকীয়া করেছে !”
উনি নিজের গায়ের শালটা জড়িয়ে ধরলেন শক্ত করে, এই বয়সে এসে অতীত নিয়ে ছেলেদের মুখ থেকে ইর্ষান্বিত কথা শোনা যে শরীরে কাঁটার মতো এসে বিধছে ওনার ৷
আয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে গেল ৷
তেহেরাত সাহেব বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন, প্রিয়ন্তির নিঁখোজ হওয়াতে উনি নিজেও অনেকটা দায়ী, নিজের অপরাধ আর পাপবোধকে মুছে ফেলতে উনি বাইরে আসেন না, লোক সমাজে মুখ দেখান না, অপেক্ষায় আছেন কোনদিন প্রিয়ন্তি আসবে তারপর ওনার অপরাধের শাস্তি দেবেন ৷ কথাগুলো ভাবতেই ওনার চোখে নোনা অশ্রূধারা বয়ে গেল ৷
___
” মাথায় হাত রেখে চেয়ারে বসে আছে আয়াশ,চোখ মুখে ক্লান্তির রেশ ৷ বিছানায় বসে জামাকাপড় ট্রলিতে ভরছে নূর ৷ মাঝে মাঝে আয়াশের দিকে তাকাচ্ছে, কেমন ঝিম মেরে বসে আছে ও ৷ পাশে রেখে দেওয়া কফিটা দু চুমুক খেয়ে রেখে দিয়েছে তা থেকে এখনো উষ্ন ধোঁয়া উড়ছে ৷ নূর শাড়িটা ভাজ করে, ট্রলির চেনটা দিয়ে হালকা নরম সুরে বলল
” আপনার কি শরীর খারাপ ৷”
কিছুখন থেমে আয়াশ উত্তর দিলো
” নাহ !”
নূর ট্রলিটা বিছানা থেকে নামিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবে ভাবলো , আয়াশের কন্ঠস্বর শুনে মনে হলো সে যেন এখন কাউকে তার আশেপাশে চাইছে না, একটু একা থাকতে চাইছে, কথাটা ভেবে নূর রুমের বাইরে পা বাড়াতে নিলেই আয়াশ বলে উঠলো
” কোথাও যাবে না তুমি আমার সামনে সামনে থাকো ৷”
নূর বেশ অবাক হলো,মানুষটা ঠিক করে কিছু বলছে না আবার দূরেও যেতে দিতে চাইছে না,হলো টা কি ?”
আয়াশের বারন শুনে নূর বাইরে গেল না, বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলো ওর বাবার থেকে কল এসেছে , কালকে তাদের সাথে দেখা না করেই ফিরে এসেছে তাই জন্যই হয়তো ফোন করছে ৷ আয়াশের দিকে তাকালো,আয়াশ হাত দিয়ে রিতীমতো কপাল চাপড়াচ্ছে, মাথা ব্যথা করছে কি তাও বোঝার উপায় নেই কারন আয়াশ অতো আবেগপ্রবন না ৷ নূর এই মুহূর্তে আর ফোন না করে ফোনটা রেখে বলল
” আপনার কি মাথা ব্যাথা ? ”
কথাটা শোনামাত্রই আয়াশ চেয়ার থেকে উঠে গেল তা দেখে নূর ভাবলো আয়াশ হয়তো ওর কথাতে বিরক্ত হয়েছে , কিন্তু নাহ ! নূরকে অবাক করে আয়াশ এসে নূরের কোলে মাথা রেখে গুটিগুটি হয়ে শুয়ে রইলো ৷নূর অবাক হলো বেশ ৷ আয়াশ বললো
” মাথায় কোন ভারী বস্তু দিয়ে খুব জোরে আঘাত করবে প্লিজ ! যদি একটু শান্তি মেলে !”
নূরের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আয়াশ ভীষনরকম মাথা ব্যাথায় জর্জরিত তাই আর কোন কিছুনা ভেবে আয়াশের মাথাটা টিপে দিতে লাগলো , আয়াশ চোখ বন্ধ করে আছে,কিছুখন পর নুরের কোমরটা দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো , নুরের পেটে আয়াশের ঠোঁটের ছোঁয়াতে নূর মাঝে মাঝেই কেঁপে কেঁপে উঠছে ৷
হঠাৎই আয়াশ বলে উঠলো
” বড়ো আর উচ্চবিত্ত বংশের ছেলেরা অনেকাংশেই চরিত্রহীন হয়, তাদের বংশগত একটা ধারা অব্যহতি আছে যার নাম হলো পরকীয়া ৷ জানো নিশ্চয়ই !”
কথাটা শুনতেই নুর একটা দমে গেল, এতদিন ওউ জানতো এ কথাটা কিন্তু আয়াশের মুখ থেকে শুনবে ভাবেনি ৷ নূর মৃদু কন্ঠে বলল
“হমম ৷”
” আমাদের বংশেও সেই ধারা আছে , আর তা যদি আমি আজও টিকিয়ে রাখি তাহলে কেমন হয় বলোতো?”
কথাটা শুনে নূরের হাতের বাধন আলগা হতে লাগলো, আয়াশের থেকে দূরে সরে যেতে ইচ্ছা করছে, সত্যিই বড়ো কোন একটা বস্তু নিয়ে আয়াশের মাথাতে আঘাত করার ঈচ্ছা জাগছে প্রবল ৷ নূর চুপ করে রইলো ৷
আয়াশ এবার নুথের কোমর টা ছেড়ে নূরকে বিছানায় ফেলে নুরের দিকে ঝুকে নূরের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বলল
” বংশের ধারাকে বিলীন না হতে দেওয়ার দায়িত্বটা বরং আমিই নিয়ে নিই বলো ? নাহয় দু চারটে বিয়ে করলাম , সমস্যা কি ? কেউ বলতে আসবে না চরিত্রহীন কারন এতদিন এই বংশে এটাই হয়ে আসছে, যদিও একাধিক বিয়ে করা থেকে আমার বাবা আর আমার ছোট আব্বু বিরত ছিলেন ৷”
নূরের চোখে জল জমে এলো, ঠোঁট জোঁড়াও হালকা কেঁপে উঠলো ফুঁপিয়ে ওঠাতে,,আর কিছুখন শুয়ে থাকলেই চোখ দিয়ে জল গড়াবে, তাছাড়া সকালেই তো নিজের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছে, এমন তো নয় যে ও ওর মনের কথা বলেনি , তারপর ও আয়াশ এমন কথা বলছে দেখে নূরের শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে আসছে ৷ নুর উঠতে গেলেই আয়াশ আবাই বিছানায় ফেলে ওর হাতজোড়া মুঠি বদ্ধ করে নিলো ৷ নুর ফুঁপিয়ে উঠলো, অবশেষে সকল বাঁধা না মেনে চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই আয়াশ বলল
” আরেকবার বলো যে ভালোবাসি !”
নুর আয়াশের থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো, আয়াশ নূরের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো, আয়াশের নরম নিশ্বাস নুরের গলায় পড়ছে, নুর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আয়াশ হাতটা ছেড়ে দিয়ে নূরের গলা থেকে সরে এসে ঠোটের এক কোনায় কামড়ে ধরতেই নূর ধাক্কা দিলো আয়াশকে, আয়াশ কামড়ানো অংশটুকু ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বলল
” একবার বলেছো বলেছো বাট আর কখনো উচ্চারন ও করবে না ভালোবাসি শব্দটা ৷ নয়তো খারাপ হবে খুব ?”
কথাটা বলে আয়াশ চলে গেল ৷ নূর চোখটা মুছে আয়াশের দিকে তাকালো, মানুষটাকে যতই বোঝার চেষ্টা করছে ততই যেন আরও গোলক ধাঁধা হয়ে যাচ্ছে , সকালেই তো কতো খুশি হলো আর এখন এতো পরকীয়া, বিয়ে ,ভালোবাসি না বলা এগুলোর তাৎপর্যতা নূর খুঁজে পাচ্ছে না ৷
চলবে,,,,,
#তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
#পর্ব:31
#Suraiya_Aayat
রাত 9.30টা,,,,,,
বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে স্মোক করছে আয়াশ, আকাশে বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ছে ৷বাসার দারোয়ানকে আজ বিকালেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে আয়াশ কারন জিজ্ঞাসা করলে বলেছে যে এমনিই একদিন ইচ্ছা হলো তাই তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দিয়েছে ৷ সিগারেটটা শেষ হতে নিলেই আয়াশ পকেট থেকে ফোনটা বার করে কল করলো
” খালামনি ওনার খাওয়া শেষ?”
” হ্যাঁ আয়াশ বাবা ,ওনার খাওয়া শেষ ৷”
উনি আবার একটা শুকনো ঢোক গিলে বললেন
” ওনাকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যাই না ? নাহ মানে এতবছর ধরে ওনার দেখাশোনা করতে করতে মানুষটার ওপর একপ্রকার মায়া পড়ে গেছে আরকি !”
আয়াশ একটা তাচ্ছিল্যর হাসি হাসলো,চোখে জল টলমল করছে ৷ আয়াশের মুচকি হাসির আওয়াজ ফোনের ওপাশে আয়াশের খালামনি মানে ইফার মায়ের কাছে পৌছালো না ৷ উনার কন্ঠ রিতীমতো কাঁপছে , অদ্ভুত এক চাপা কষ্ট অনুভব করছেন মনের মাঝে ৷ আয়াশ আকাশের দিকে তাকিয়ে তারপর ফোনে বলে উঠলো
” তুমি চলে এসো, আমি যাচ্ছি ৷”
কথাটা বলে আয়াশ ফোনটা কেটে দিলো ৷ দরজার এপাশ থেকে আয়াশের খালামনি চাপা স্বরে কথাগুলো বলছিলেন নূরের মায়ের আড়ালে ৷ আয়াশ গাড়ি ড্রাইভ করে বেরিয়ে এলো, ব্যালকনি থেকে সমস্তটা নূরের চোখে পড়েছে , আয়াশের মতিগতি বোঝার সাধ্য নূরের নেই ৷নূর চঞ্চল আর বিষন্ন মন নিয়ে রূমে চলে এলো ৷ রুমে এসে ফোনটা হাতে নিলো, ভাবলো ওর বাবার কাছে ফোন করবে ৷ ফোন করতে গিয়ে দেখলো ট্রলিটা দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে রাখা, মনে পড়ে গেল কালকে ওরা নাটোর যাবে, ভোর ভোর বার হতে হবে ৷ ভাবনা চিন্তা গুলো আপাদত দূরে সরিয়ে ফোন ধরালো নূর ৷ বেশি কিছুখন রিঙ হওয়ার পর নূরের বাবা ফোনটা ধরলেন তারপর উনি চুপ হয়ে রইলেন ৷ নূর বিষন্ন কন্ঠে বলল
” কেমন আছো বাবা ?”
উনি চুপ করে রইলেন কথা বললেন না কোন হয়তো বলার ইচ্ছা শক্তিটা মৃতপ্রায় ৷ ওনাকে চুপ থাকতে দেখে নূর আবার বললো
” বাবা !”
উনি এখনো চুপ , নূর ভাবলো হয়তো ওনার মন খারাপ বা কোন সমস্যা হয়েছে বা নূরের ওপর রগে আছে ৷ নূরের চোখে জল ভার করে এলো, বেশ ভাঙা কন্ঠে বলল
” বাবা তুমি আমার ওপর রেগে আছো ?ও বাবা !”
নূরের এই কথাটা শোনার পর থেকে উনি বলে উঠলেন
” আমাকে ক্ষমা করে দিস মা আমি তোদের সবাইকে মিথ্যা বলেছি ৷”
কথাটা বলে উনি যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন ৷ ওনার কান্নার আওয়াজ শুনে নূর বেশ ভেঙে পড়লো তারপর নূর ও কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল
” তুমি একথা বলছো কেন বাবা ? কি হয়েছে আমাকে বলো ৷”
উনি ফোনর মধ্যে থেকেই বেশ শব্দ করে হাওহাউ করে কেঁদে উঠলেন , নূরের চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, হঠাৎ এমন আচমকাই এমন পরিস্থির সম্মুখীন হবে নূর ভাবেনি ৷ চোখের জলটা মুছে আবার প্রশ্ন করে উঠলো
” কি হয়েছে তুমি আমাকে সব বলো, আর এভাবে কেঁদোনা প্লিজ ৷”
উনি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলেন
” তোর মা বেঁচে আছে নূর, আমি বুঝতে পারিনি, তোর মায়ের মতো মৃত রক্তাক্ত লাশ দেখে সেদিন আমি সেটাকে তোর মা ভেবেছিলাম নূর ,আমি চিনতে পারিনি ৷”
নূর যেন আকাশ থেকে পড়লো এমন কথা শুনে ৷ এতো বছর পর যখন সবাই একটা মানুষকে মৃত হিসাবে ধরেই নিয়েছে তখন হঠাৎ ওর বাবার বলা একটা কথা যেন সবকিছুকে পাল্টে দিলো ৷ নূর উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো
” কি বলছো কি তুমি এসব ? তুমি ঠিক জানো ? আম্মু বেঁচে আছে ? আম্মু কোথায় ? আর সব প্রশ্নের উত্তর কি বাবা ৷”
উনি ওনার কান্নার মাঝে দম আটকা কাশি কেশে বললেন
” আমিও জানতাম না কিছুই , আজ তোর মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দেখি কবরের গায়ে অন্য এক মহিলার নামের নেমপ্লেট বসানো ৷ প্রথমে দেখে খানিকটা অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু বিষয়টা কোন ছোটখাটো বিষয় না দেখে আমি গেলাম সেখানকার এলাকার ম্যানেজারের কাছে ৷ ওনাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করাতে যে সেখানে অন্য কোন মহিলার নামের নেমপ্লেট কেন তখন উনি বললেন
” যার কবর তার নামের ই নেমপ্লেট দেওয়া আছে, তাছাড়া ওটা আপনার স্ত্রীর কবর না ৷ আপনাকে আমি দেখেছি কবর জিয়ারত করতে আসতে তাই আমি আপনাকে চিনি , কিন্তু কয়েকদিন আগে একটা পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য এসে জানান যে এখানে যার কবর দেওয়া হয়েছে ওনারা তাদের পরিবারের লোক, কথাটা শোনামাত্রই আমার আপনার কথাটা মাথায় আসে, আমি তখন খানিকটা আন্দাজেই ওনাদের সাথে তর্কে জড়ালাম তারপর সব জিজ্ঞাসা করতেই ওনার আমাকে সবটা বুঝিয়ে বললেন যে
” যেদিন ওই রোড এক্সিডেন্টটা হয় সেদিন ওনাদের পরিবারের লোক আর সারাদিন বাসায় ফেরেননি তাছাড়া ওনাদেরকে ফোন করে কেউ জানিয়ে ছিলেন যে তাদের বাসার কেউ একজন মারা গেছেন কিন্তু ইতিমধ্যে আপনি আপনার ওয়াইফের মৃতদেহ ভেবে তাকে নিয়ে যান কিন্তু তার আসল পরিবারের লোক এসে আর পাইনি , যখন যানলেন যে আপনারা নিয়ে গেছেন তখন আপনাদের খোঁজার চেষ্টা করেও পাইনি কারন আপনারা বাসা পরিবর্তন করেছিলেন ৷ তারপর হঠাৎ কিছুদিন আগে ওনারা বেশ কিছু প্রমানসহ জানালেন যে এটা ওনাদের পরিবারের একজনের কবর ৷ তাছাড়া এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর আপনারা কি বুঝতে পেরেছিলেন যে উনি আপনাদের বাড়ির লোক ৷ ”
তখন আরাফাত সাহেব মাথা নাড়িয়ে না জানালেন ৷
সব কথা আরাফার সাহেব নূরকে বললেন, উনি রিতীমতো ভেঙে পড়েছেন, কি বলবে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না ৷ কথাগুলো শুনে নূর কেঁদে ফেলল তারমানে ওর মা বেঁচে আছে ৷ নূর ও কাঁদছে , হঠাৎ আরাফাত সাহেব চোখের জল মুছে বললেন
” তোর মা এখন কোথায় আছে কি অবস্থায় আছে আমি জানিনা মা , আমি জানিনা, আর তোর মা ই বা সেদিন আর ঘরে ফিরলো না কেন আমি তা ও জানি না ৷ পারলে আমাকে ক্ষমা করিস ৷”
নূর ও নিজের চোখের জল মুছে বলল
” তুমি কেন ক্ষমা চাইছো, তোমার তো কোন দোষ নেই, ভাগ্যতে যা ছিলো তাই হয়েছে ৷ তাছাড়া এতো বছর পর আম্মু কোথায় থাকতে পারে আর আম্মুকে কোথায় বা খুঁজবো আমারা ?”
” আমি জানিনা মা আমি জানিনা ৷”
দুজন আরো বেশ কিছুখন কথা বলার পর নূর ফোনটা কেটে দিলো,, নূর আয়াশের ফোন করে খবরটা জানাবে বলে ফোন করতেই কলটা গেল না, ফোন সুইচ অফ, নূরের আর তর সইছে না কথাটা বলার জন্য, নূর না পেরে রুমের মধ্যে পাইচারি করছে আর আয়াশকে ফোন করার চেষ্টা করছে বারবার ৷ হঠাৎ বাইরে থেকে শো শো আওয়াজ শোনা যেতেই নূর জানালার দিকে তাকালো, জানকলাটা খোলা, নূর খুব ভুতের ভয় পাই তাই সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে জানালা দিয়ে দেই কিন্তু আজকে জানালাটা খোলা রেখেছে কেন নূর বুঝতে পারছেনা, হয়তো ভুলে গেছে ভেবে জানালাটা দিতে গেলেই বাইরের অন্ধকারে কেঁপে উঠলো নুর,তারপর হাত বাড়িয়ে জানালাটা বন্ধ করতে গেলেই নূর ওদের বাসার বিপরীতে কিছুটা দুরে আলো জ্বলতে দেখলো আর দুটো মানুষের অবয়বকে হাটতে দেখে ভয়ে জানালটা জোরে শব্দ করে টেনে দিয়ে বিছানায় বসে পড়লো নূর,ভীষনরকম ভয় পেয়েছে ও ৷ নূর বিছানায় পা গুটিয়ে বসে মনে মনে অনেক সুরা পড়ছে ভয় কাটানোর জন্য ৷ ওটা যে গাড়ির হেডলাইটের আলো টিপটিপ করে জ্বলছিলো তা নূর বুঝতে পারেনি ৷
____
ফাঁকা রাস্তার মাঝে গাড়িটা দাড় করিয়ে রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ আর নূরের মা ৷ আয়াশের চোখে আছে হিংস্রতা আর নূরের মায়ের চোখে বিরক্তি আর রাগ ৷ গাড়িটা রাস্তার মাঝে রাখা, গাড়ির আলো একবার জ্বলছে একবার নিভছে ৷ নূরের মা বিরক্ত হয়ে বললেন
” মানেটা কি আয়াশ, তুই এসব আলতু ফালতু প্রশ্ন করছিস কেন? আর তোর কি মনে হয় যে আমি তোকে মিথ্যা বলছি ? তোকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ ! ওটা যেমন তোর মা তেমনি আমার বড়ো আপু ৷”
আয়াশ ভারী গলায় বলে উঠলো
” আমার আম্মু কোথায় খালামনি ? এখনো সুযোগ আছে বলো যে সে কোথায় নাহলে আজকেই তোমার শেষ দিন আর তোমাকে শেষ করতে আমি দুইবার ও ভাববো না ৷”
উনি রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বলল
” তুই যে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাকে দোষী প্রমান করবি ভাবিনি আয়াশ, তোকে আমি নিজের সন্তানের মতো ভাবতাম আর তুই কিনা তার এই প্রতিদান দিলি ৷ ছিহ! এখন তো ভাবলেই গা ঘিনঘিন করছে যে আমার ফুলের মতো মেয়েটার জীবনসঙ্গী হিসাবে আমি তোকে ঠিক ভেবেছিলাম ৷”
আয়াশ পকেট থেকে রিভলবারটা বার করে বলল
” খবরদার তোমার ওই মুখে আমার আফুসোনার নাম নিয়েছো তো তোমাকে মেরে ঝাঝরা করে দেবো ৷ অনেক বছর সময় দিয়েছি তোমাকে আর না ! আজ তোমার পর্যাপ্ত সময় শেষ, আমি আর একবার জিজ্ঞাসা করবো যে আমার আম্মু কোথায় ৷ বলো কোথায় , শেষ বারের মতো বলছি, আর তোমার মেয়েকে আমি এমনি এমনি বিয়ে করিনি, নিজের কাজ হাসাল করার জন্যই করেছি, নাহ আছে ওর প্রতি অনুভূতি আর না আছে ভালোবাসা,ওর মতো হাজার হাজার মেয়ে আমার পিছন পিছন ঘোরে বুঝেছো ? আর সে আমার প্রেমে পাগল আমি না ৷”
” ছিহ আয়াশ , ছিহ ! আমার মেয়ে সমন্ধে কোন বাজে কথা আমি শুনতে চাইনা,তুই কি মানুষ ?”
” মানুষ আমি কখনোই ছিলাম না, আমি হলাম ডেভিল আর তোমার মেয়েটাও কতো বোকা , আমি কাছে টানলেই সুড়সুড়করে কাছে চলে আসে, মেয়ে মানুষের স্বভাবই এমন ডাকলে না করতে পারেনা, না জানি এতো আবেগ কই পাই ৷”
কথাটা শুনে উনি ওনার কোমরে গুঁজে রাখা চাকুটা বার করতে গেলেই পরপর দুটো গুলি এসে ওনার শরীরকে ভেদ করে গেল, উনি মাটিতে পড়ে গেলেন, চারিদিকে রক্ত, আয়াশ বন্দুকটা নামিয়ে একবার পিছন দিকে তাকালো , খালি অন্ধকার আর অন্ধকার ৷আয়াশ বন্দুকটা হাত থেকে ফেললো না, বন্দুকটা হাতে রেখেই নূরের মায়ের বডির কাছে হাটু গেড়ে বসলো আর রক্ত দিয়ে পিচের ওপর লিখলো
” আই এম দা ভিলেন ইন ইউল লাভ স্টোরি আফুসোনা ৷”
কথাটা বলে হাসলো আয়াশ, তারপর ওনার দিকে তাকিয়ে বললেন
” তোমাকে মারা তো যাস্ট একটা বাহানা ! সো স্যাড ! ”
____
ভয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে নুর,রাত 1টা বাজে, আয়াশ এখনো বাসায় ফেরেনি ৷নূর ও আর ঘর থেকে বার হয়নি, ইফার মাথা ব্যাথা করছিলো বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো আর ইফার মা ওনার বোনের ছেলে অসুস্থ বলে সন্ধ্যাবেলা আর একবার বাসা থেকে বেরিয়ে গেছিল তাই নুর বলার মতো কাউকে সুযোগ পাইনি ৷
হঠাৎ কম্বল সরিয়ে গলায় উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই নূর কেঁপে উঠলো,,বুঝতে পারলো যে আয়াশ ফিরেছে তাই অযথা ভয় না পেয়ে বরং আরো সাহস পেলো ,হৃদস্পন্দন ক্রমাগত বাড়ছে আয়াশের স্পর্শে, আবেগে ব্ল্যাংকেট আকড়ে ধরলো নুর,হঠাৎ আয়াশ নুরকে ঘুরিয়ে ওর মুখমুখি করে নূরের গলায় মুখ ডুবিয়ে দালো, আচমকাই আয়াশের এমন ব্যাবহার নূরের কাছে একটু অদ্ভুত লাগলেও অবাক হলো না কারন আয়াশ এমনই আর নূর এগুলোতে অভ্যস্ত ৷আয়াশ ও কিছু বলছেনা আর নূর ও কিছু বলছেনা, রুম জুড়ে চলছে পিনপনত নিরবতা , কেবল অনুভূত হচ্ছে আয়াশের উষ্ণ ছোঁয়া আর নূরের ছন্দহীন হৃদস্পন্দন ৷ আয়াশ নূরের শরীরে ওর স্পর্শ গুলো গভীরভাবে দিতে লাগলেই নূর কানিকটা লজ্জা আর কম্পিত কন্ঠে বলে উঠলো
” প্লিজ এতো কাছে আসবেন না ৷”
আয়াশ নূরের গলা থেকে মুখ সরিয়ে কিছুখন নূরের মুখের দিকে চেয়ে রইলো, মেয়েটার মুখে একরাশ লজ্জা আর ভয় কাজ করছে ৷ আয়াশ একহাত দিয়ে নুরের পেটিকোটের ফিতেটায় হাত দিতে গেলেই নূর একনিশ্বাসে বলে উঠলো
” আমি অসুস্থ , প্লিজ ! ”
আয়াশ বুঝতে পারলো নূর ঠিক কি বোঝাতে চাইছে, নূরের ইশারা বুঝতে পেরে আয়াশ ওর হাতটা সরিয়ে নিয়ে নূরের ঠোঁটজোড়া দখল করে নিলো ৷ নূর আয়াশের শার্ট ধরে খামচি মেরে ধরলো, ভয়টা ক্রমে ক্রমে কমে আসছে ৷ কিছুখন পর আয়াশ নূরকে ছেড়ে নূরের পেটে মাথা রাখলো আর দু হাত দিয়ে নূরকে জড়িয়ে ধরলো, আয়াশ ভাবলো যে নূর হয়তো এতখন পেটের ব্যাথায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ছিলো আর এই অবস্থায় পেটে পেইন হওয়াতে অসম্ভব কষ্ট হয়, আয়াশ নূরের পেইন কমাতে নূরের পেটে মাথা রাখলো, নূর কিছু বলছেনা ৷ বেশ অনেকখন আয়াশ ওভাবেই রইলো হঠাৎ নুরের মনে পড়লো ওর আম্মু কথা, কথাটা ভাবতেই নূর উত্তেজিত হয়ে বলল
” জানেন তো আমার আম্মু বেঁচে আছে এখনো, আমার আম্মুর কিছু হয়নি ৷ ”
কথাটা বলেও আয়াশের তরফ থেকে কোন রিপ্লাই এলো না দেখে নূর ভাবলো আয়াশ হয়তো সবটা বলেই তারপর কোন মন্তব্য করবে তাই নূর একে একে সব কথা আয়াশকে বললো ৷ সব কথা শুনেও আয়াশ কিছু বলল না দেখে নূর ধীমে কন্ঠে বলল
” আমার আম্মু হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো হ্যাপিনেস,আম্মুকে পেলে আমার আর কিছু চাইনা ৷”
তবুও আয়াশের কোন রিপ্লাই নেই দেখে নুর এটু উঁচু হয়ে দেখলো আয়াশ ঘুমিয়ে পড়েছে, নূর নিজের মাথায় চাপট মারলো তারমানে এতখন ও নিজে নিজেই বকে গেছে একা একা কথাটা ভেবে নিজেকে স্টুপিড মনে হলো ৷ নূর ও আর বেশি কিছু না ভেবে ঘুমিয়ে পড়লো ৷ প্রায় 10 মিনিট পর আয়াশ নূরের ওপর থেকে সরে এসে নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর নিজের মনে মনে বলল
” সো স্যাড আফু সোনা , ডেভিলকে কি কেও ড
ডেভিলের গল্প শোনায় সো স্যাড ! আর কি বললে সে তোমার বড়ো হ্যাপিনেস ? তাহলে আমি কি ?”
চলবে,,,,,