#তিক্ত_বুকের_বাঁ-পাশ
#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৭(নতুন বিয়ে নাকি!)
মনটা বড্ডো আনচান করছে রায়হান সাহেবের। নম্রমিতার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই কেমন যেনো নির্ঘুম কাটে তার প্রতিটা রাত। আরুশির চেয়ে বেশি তিনি ভালোবাসেন নম্রমিতাকে। আরুশি হয়েছে লাজুক নমনীয় প্রকৃতির। অথচ নম্রমিতা একেবারে তার দাদির প্রতিবিম্ব। অবিকল সেই চাহনি, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আর কঠোরতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা। নম্রমিতার মাঝে নিজের মরহুম মাকে খুঁজে পান বলেই হয়তো একটু বেশিই ভালোবাসেন রায়হান সাহেব। নিজের চোখের মণিকে এতো দ্রুত কাছছাড়া করতে চাননা তিনি। কিন্তু আজ হোক বা কাল এ কাজ যে তাকে করতেই হবে। মেয়ে মানেই তো অন্যের সম্পদ। শৈশবে পাড়ি দেওয়া জীবনটা তার নয়। আবার বিয়ের পর সে ঘরও তার হয়না। তবুও যে বুকে পাথর চেপে অন্যের সংসারে মেয়েকে পাঠানোই সমাজের রীতি। রায়হান সাহেবের আজকাল ইচ্ছে করে সেই ছোট্ট নম্রকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে।
অস্থিরতায় ঘাম ছুটে ঘুম ভেংগে যায় রায়হান সাহেবের। রাত পেরোলেই নম্রমিতার বিয়ে। সবটা ঠিকঠাক হবে কিনা এ নিয়ে তার ভাবনার শেষ নেই। নির্ঘুম রাতে অস্থির করতে করতে অতিষ্ট হয়ে যান তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুটা সময় ব্যালকলিতে দাড়িয়ে নিজের মাঝে টেনে নেন বিশুদ্ধ বাতাস। অতঃপর ভারি হয়ে পড়া বুক নিয়েই পা চালান নম্রমিতার রুমের দিকে। রুমের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই হাঁ হয়ে যান তিনি। থর থর করে কাঁপতে থাকেন দরজার কাছে দাঁড়িয়েই। নম্রমিতা নেই। এদিক ওদিক সব জায়গায় খুঁজে নিজেকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ফলাফল শূন্য। দুশ্চিন্তায় ধপ করে বসে যান চেয়ারে। এ জন্যই বুঝি এতটা নীরব ছিলো নম্রমিতা! সেদিনের পর থেকে আর টু শব্দটুকুও পর্যন্ত করেনি।
হতাশায় বুঁদ হয়ে বসে আছেন রায়হান সাহেব। বাড়ির কাউকে জাগানোরও সাহস পাচ্ছেন না তিনি। এভাবে তার সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা তো নম্রমিতার নয়! নিশ্চই ওই ছেলের অসৎ সঙ্গতে তার এ অবনতি। ভাবনার মাঝেই তার চোখ যায় টেবিলের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকা ফোনের দিকে। মেসেজ এসেছে কারোর। নম্রমিতার ফোন হাতে উঠিয়ে শান্ত মেজাজে চেক করেন আগের মেসেজ। শেষ মেসেজে লেখা রয়েছে বাসস্টপের ঠিকানা। তার মানে এখানেই দুজনের দেখা করার কথা। আকস্মিক এক বুদ্ধি খেলে যায় রায়হান সাহেবের মাথায়। রাফিদের পাঠানো মেসেজের রিপ্লাই করেন তিনি।
“বাসস্ট্যান্ডের আশেপাশে কেউ আমাদের চিনে ফেলতে পারে। আমরা বরং ট্রেনে করে যাবো। অপেক্ষা করছি স্টেশনে।”
মেসেজটা সেন্ড করেই ক্রুর হাসেন তিনি। একটা কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এবার বাকি রইলো নম্রমিতাকে ফিরিয়ে আনার। বাড়ির কাউকে কিছু না জানিয়েই তিনি বেরিয়ে পড়েন বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
দুই ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে নম্রমিতা অপেক্ষা করছে। অথচ রাফিদের কোনো খোঁজ নেই। ভোর হওয়ায় আশেপাশে কোনো লোকজনও নেই। নয়তো কারোর ফোন থেকে রাফিদকে কল করা যেত। দুশ্চিন্তা আর হতাশায় কান্না পায় নম্রমিতার। জীবনে প্রথম এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তাও বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে। সে কি ভুল করেছে! ভুল করেছে রাফিদকে বিশ্বাস করে! ভাবনার মাঝেই মাথায় কারোর আদুরে স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকায় নম্রমিতা। হ্যা বাবা দাড়িয়ে আছে তার সামনে। লজ্জায় ভয়ে কেঁদে দেয় সে। রায়হান সাহেব কান্নারত মেয়ের মাথা টেনে নেন বুকে।
“বুঝলাম, তুই অনেক ভালবাসিস ওই ছেলেকে। নাহলে বাবার বিরুদ্ধে হয়ে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কখনোই নিতে পারতিস না। কিন্তু আর কতক্ষন অপেক্ষা করবি? ছেলেটার যদি আসার হতো এতক্ষণে তোরা অনেক দূরে চলে যেতি।”
“বাবা, রাফিদ আসবে। প্লীজ বাবা আমাকে যেতে দাও। আমি ওকে অনেক ভালোবাসি। এই বিয়ে করতে পারবোনা আমি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এতক্ষন যখন অপেক্ষা করেছিস, আরো ত্রিশ মিনিট নাহয় অপেক্ষা কর। কিন্তু এরপরেও যদি সে না আসে তবে তোকে আদিলকে বিয়ে করতে হবে। ফিরে যেতে হবে আমার সাথে।”
অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায় নম্রমিতা। তার মন বলছে রাফিদ তাকে ঠকাতে পারেনা। সে আসবে, ঠিক আসবে। এরপর তারা একসাথে চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু অপেক্ষার প্রহর গড়িয়ে গেলেও রাফিদ আসলোনা। ভয়ে ঘামে চুপচুপে হয়ে গেছে নম্রমিতা। কান্নার ফলে চোখ মুখের বেহাল দশা। রায়হান সাহেব বিনাবাক্য ব্যয়ে একহাতে নম্রমিতার হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির পথ ধরেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার সাথে পা মেলায় নম্রমিতাও। যেনো শুধু শরীরটাই যাচ্ছে তার সাথে, মনটা এখানেই বাসস্ট্যান্ডের আনাচে কানাচে কোথাও ফেলে রেখে যাচ্ছে সে।
বাড়িতে ঢোকার মুখে নানা মানুষের নানান রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাদের। রায়হান সাহেব খুব সন্তর্পনে সত্যটা আড়াল করে সকলের মুখ চুপ করিয়ে দেন। মেয়েকে নিয়ে সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন বলে নিজেদের ঘরে ঢুকে যান।
যথারীতি সমস্ত রীতিনীতির মধ্য দিয়ে আদিলের অর্ধাঙ্গিনী রূপে বিদায় নেয় নম্রমিতা। কাঠের পুতুলের মতো অনুভূতিশূন্য হয়ে বসে ছিল নম্রমিতা পুরোটা সময়। সত্যিই সে হারিয়েছে তার আত্মা। রাফিদ যেনো নিজের সাথে করে নম্রমিতার সমস্ত সুখ, হাসি, আনন্দ নিয়ে চলে গেছে বহুদূরে। যার ফিরতি কোনো পথ অবশিষ্ট নেই।
৮.
অতীতের দোলাচল থেকে বেরিয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে নম্রমিতা। ভাবনার মাঝে কখন যে বিকেল থেকে রাত হয়ে গেছে খেয়াল নেই। আকাশে জ্বলতে থাকা মিটিমিটি তারারা হাতছানি দিয়ে যেনো ডাকছে তাকে। শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের দেবদাস উপন্যাস নিয়ে বিকালের দিকে ব্যালকনিতে বসেছিল সে। উপন্যাসটা শেষ করার পর বুক ভারী হয়ে আসে নম্রমিতার। আকাশে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হুট করেই চোখ বন্ধ করে পাড়ি জমায় অতীতে। তাদের বিচ্ছেদের মর্মান্তিক সেই ঘটনা মনে পড়তেই ফুঁপিয়ে ওঠে। বিয়ের আগে নিজের ফোন চেক করার সুযোগ পায়নি নম্রমিতা। বাসরঘরে ফুলে সজ্জিত খাটে অনুভূতিশূন্য হয়ে বসে ছিল সে। ঠিক তখনই ফোনের শব্দে চোখ তুলে তাকায় নম্রমিতা। চিরপরিচিত সেই নাম স্ক্রিনে ভেসে উঠতে দেখে ছোঁ মেরে লুফে নেয় ফোন। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা উঠিয়ে কানে ধরতেই ঝর ঝর করে কেঁদে দেয় নম্রমিতা। হ্যা, সেদিনই রাফিদের থেকে জেনেছিল তার না আসার আসল কারণ। তবে রাফিদ আজও অজানা এ পরিকল্পনা সম্পর্কে। মূলত নম্রমিতা ইচ্ছে করেই বলেনি। সে চেয়েছিল রাফিদ নিজেকে গুছিয়ে নিক। তার জন্য নাহয় খানিকটা দোষী সে হলো! একটু নাহয় বেইমান হলো রাফিদের কাছে! তবুও অন্তত সে তো ভালো থাকবে! সময়ের স্রোতের সাথে ঘা কিছুটা হলেও তো ভরবে!
খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসে আছে সবাই। তোহা খাওয়ার মাঝে মাঝে আড়চোখে একবার করে তাকাচ্ছে রাফিদের দিকে। রাফিদ বেশ কিছুক্ষন ধরে খেয়াল করছে তোহাকে। অবশেষে তোহার দিকে না তাকিয়েই বলে ওঠে,
“কিছু বলবি!”
“আসলে ভাইয়া, ফ্রেন্ডরা সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছে। আমাকেও যেতে বলছে সাথে।”
“আগে বড়ো হ। তারপর ঘুরতে যাস একা একা।”
“একা কোথায় ভাইয়া? ওরা সবাই তো আছে। চাইলে তুমি আর ভাবিও চলো সাথে।”
“নাহ, কোথাও যেতে হবেনা তোকে।”
“তুমি দিন দিন এমন একগুঁয়ে স্বভাবের কেনো হচ্ছো বুঝিনা। মেয়েটা যখন যেতে চাইছে যাক না। আর সাথে তোমরাও যাবে। এমনিতেও বিয়ের পর কোথাও যাওয়া হয়নি নম্রমিতার। নতুন নতুন বিয়ে করে একটু ঘোরাঘুরি করতে মন চায় তো মেয়েটার নাকি!”
বাবার কথা শুনে খেতে খেতে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে রাফিদ বলে,
“এটা কি ওর নতুন বিয়ে নাকি? আগেও তো..”
মুখ ফসকে ভুল কিছু বলে ফেলেছে রাফিদ। নিজের কথা খেয়াল হতেই থমকায়। খাওয়া বন্ধ করে তাকায় নম্রমিতার দিকে। অশ্রুসিক্ত চোখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে নম্রমিতা আনোয়ারা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আম্মা, উঠছি আমি।”
উত্তরের অপেক্ষা না করেই এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায় নম্রমিতা। রাফিদও খানিক্ষন ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে চলে যায় নিজেদের ঘরে। দুজনের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে শ্বাস ছাড়েন আরিয়ান চৌধুরী আর আনোয়ারা খাতুন দুজনেই।
#চলবে!
রোজ পর্ব দিলে এরচেয়ে বড়ো দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। হয়তো একদিন পর পর দেবো বড়ো করে নয়তো রোজ দিলে এমন দেবো। কোনটা করলে ভালো হবে, আপনারাই জানাবেন।
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/