তরঙ্গিনী_পর্ব_১৯ #আরশিয়া_জান্নাত

#তরঙ্গিনী_পর্ব_১৯

#আরশিয়া_জান্নাত

আজ পিহুর অ্যাঙ্গেজমেন্ট। সকালেই ইভেন্ট ম্যানেজার তার টিম নিয়ে এসে পড়েছে। কাজিনরা সবাই একজোটে আড্ডা আর খোশগল্পে মত্ত। এ সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ের ডেট ফিক্সড হয়েছে। তাই আত্মীয় স্বজনসকলেই চলে এসেছে একদম বিয়ে পর্যন্ত থাকার প্রস্তুতি নিয়ে। তাই কাজ নেই বললেও অনেক কাজ।

আরাফ রুমে বসেই ল্যাপটপে কাজ করছে, তখন রেবা ব্যস্তভঙ্গিতে এসে বলল, আপনার কিছু লাগবে? কল করলেন যে?

এতো ছোটাছুটি করছেন কেন আপনি হুম? অনেক মানুষ আছে তো। আপনার হাল দেখে তো আমি চিন্তায় পড়ে যাচ্ছি!

রেবা বেডের প্রস্থে সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করল। পিঠটা যেন আরাম পেয়ে শরীর ছেড়ে দিচ্ছে।

আপনিও না কেমন! আমার ননদের অ্যাঙ্গেজমেন্ট, আমি একটু তদারকি করবোনা? তাছাড়া সবাই এসেছেন, আমি যদি চুপচাপ ঘরে বসে থাকি ওনারা কি ভাববে বলুন তো?

আরাফ রেবার পেটে মাথা রেখে শুয়ে বলল, ওসব কেউ ভাববে না। সবাই জানে এখনকার বৌরা স্মার্ট আর অলস হয়। ওরা অনুষ্ঠানে কাজ করার চেয়ে পরিপাটি থাকতেই বেশি পছন্দ করে।

টিপ্পনীটা ভালো ছিল। তবে এরকম করে ভাবাটা ভুল। বড়লোকদের খবর জানিনা , তবে আমরা তো অনেক খাটতাম, আপা আর ভাইয়ার বিয়েতে দম ফেলবার জো ছিল না। সবার পাতে ঠিকঠাক খাবার পড়লো কি না, কেউ আবার না খেতে পেয়ে চলে গেল কিনা সহ কতদিক দেখতে হয়। প্রতিটা খাবার টেবিলে গিয়ে হাজিরা না দিলে কত বদনাম হয় জানেন? বলে দাওয়াত দিয়ে এনে আপ্যায়ন করছেনা, একেকজনের ফুট ফরমায়েশ খাটতে খাটতে শরীর একদম অর্ধেক হয়ে যায়,,, আমিতো ওভাবে দেখেই অভ্যস্ত। বিয়ে মানেই অনেক কাজ আর লাল পিপড়ের মতো বিষকামুড়ে খোঁচা! ঘরের লোকের পরিপাটি হয়ে থাকা সেখানে বিলাসীতা।

আরাফ হেসে বলল, তা যা বলেছেন। অনেক মানুষ জমায়েত হওয়া মানেই কত কি আলাপ আলোচনা। ঐসব বিষকামুড়েই বটে!

রেবা ওর অনামিকার রিংটা নাড়াচাড়া করে বলল, আপনার পছন্দ সবসময়ই খুব সুন্দর!

তাই? হঠাৎ এই কথা কেন?

এই শুনুন

হুম?

আমায় রিংটা আবার পড়িয়ে দিন তো,,

আরাফ উঠে বলল, কি ব্যাপার বলুন তো আবার বিয়ে করতে মন চাইছে বুঝি?

নাহ,,, পড়ান না?

আরাফ রেবার অনামিকায় রিং পড়ালো। রেবা হেসে বলল, কিউট না ব্যাপারটা?

হুম অনেক কিউট।

রেবা

জ্বি

রেডি হবেন না?

কয়টা বাজে? সময় হয়ে গেছে নাকি?

নাহ। এখনো ঘন্টাখানেক আছে।

তাহলে?

শুরু করে ফেলুন, টাইম তো লাগবেই না?

রহস্য কি বলুন তো? এতো তড়িঘড়ি কেন?

আপনি সাজবেন আর আমি দেখবো, আপনার সাজগোজ শেষ হবার পরো আপনি আমার সামনে বসে থাকবেন। আমি মন ভরে দেখবো। আমার তো মনে হয় ২ঘন্টায় পোষাবে না।

আপনি ও না পারেন বটে!

আমি কিন্তু সিরিয়াস।

আচ্ছা বেশ।

রেবা কাভার্ড খুলে সিলেক্ট করে রাখা লেহেঙ্গা বের করলো। ওয়াশরুমের দিকে যেতেই আরাফ তাকে আটকে বললো, কি বলেছি বোঝেন নি বোধহয়,,

রেবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আরাফ বললো, এখানেই চেইঞ্জ করুন, আমি হেল্প করি।

রেবার নিরবতাকে সম্মতি ভেবে আরাফ ওর কাধে থাকা আচলের পিন খুলল, সে নিজ হাতে ওকে শাড়ি বদলে লেহেঙ্গা পড়িয়ে দিলো। তারপর রেবা আয়নার সামনে বসে সাজতে শুরু করে। আরাফ তার দিকে অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে সাথে এটা ওটা এগিয়ে দেয়।

রেবা আরাফকে বলে, আপনি বুকে কাঁপুনী ধরানো কাজকর্ম করেন!

কই দেখি!

কি দেখবেন?

বললেন না কাঁপুনী ধরেছে একটু কান‌ পেতে শুনি কেমন কাঁপছে?

খুব চালাক না?

রেবা একটা সিক্রেট বলি শুনবেন?

কি?

আপনি যখন আয়নার সামনে বসেন আপনাকে অন্যরকম লাগে। মনে হয় ক্লিওপেট্রাও আপনার রহস্যের সামনে ফেইল। এতো আবেদময়ী লাগে কি বলবো!

বেশি বাড়িয়ে বলছেন।

নাহ সত্যি।

এদিকে আসুন তো

কেন?

গলার হারটা পড়িয়ে দিন।

আরাফ উঠে এসে হারের হুক এটে বলল, মনে আছে লাস্টবার এখানে আপনার পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম আর কি করেছিলেন?

রেবা নিজের খোপার কাঠি সরিয়ে সারা পিঠময় ঢেউ খেলানো চুল ছড়িয়ে বলল, সেদিনের মতো নিবিড় হয়ে জড়িয়ে ধরুন দেখি।

আরাফ টিপ্পনী কেটে বলল, শোধ করছেন বুঝি? শোধ হবেনা ওটা।

কে চাইছে শোধ দিতে?

চাইছেন না?

নাহ। ঐসব বিরহ ছিল বলেই তো এখন প্রতিটা স্পর্শ এতো অনুভূতিসম্পন্ন!

আরাফ ওর চুলে নাক ডুবিয়ে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলল, তাই বুঝি?

হুম। এই শুনুন

জ্বি?

আপনি কি জানেন আপনি যখন আমার পেছনে থাকেন, আপনার প্রতিটা নিঃশ্বাস আমি তীব্রভাবে অনুভব করি? আর এটা আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা,,,,

জানি।

কিভাবে?

আপনি কোন স্পর্শে বেশি প্রভাবিত হন তা আমি জানবো না তো কে জানবে?

তাও কথা!

বোকা মেয়ে।

হুহ! চালাক বর।

উহু চালাক না।

রেবা হঠাৎ পেছন ঘুরে পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে আরাফের ঠোঁটে চুমু খেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় আরাফ স্ট্যাচু হয়ে গেল। রেবা হাসির রিনঝিন শব্দ তুলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আরাফ নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে মুচকি হাসলো, পাগলী একটা!


সিলেট থেকে রেবার মা আর আপা আসেন। গতমাসে ওর ভাইপো হওয়ায় ভাই ভাবি আসেনি। অনেকদিন পর মা বোনকে পেয়ে রেবার আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে গেল। সবার সাথে কুশল বিনিময় করার পর রেবা তাদের একটা ঘরে নিয়ে বসায়। রেবা বলল, ভাইয়া ভাবী মিমি, বাবু সবাই ভালো আছে?

হুম ভালো আছে। জামাই কোথায় ওকে দেখছি না যে?

একটু আগেই বের হয়েছে, চলে আসবে। ছোটন এমন গাল ফুলিয়ে রেখেছে কেন?

আপা বলল, ওর কথা আর বলিস না, মোবাইলটা হাত থেকে নিলেই গাল ফুলে লুচি হয়। বদ হচ্ছে দিনদিন।

দুলাভাই ভালো আছেন? আসেননি কেন?

সে এখন ছুটি পায় নি, আমি বললাম বিয়েতে তো আসতেই হবে। তখনই বরং এসো।

ওহ!

হ্যাঁ রে শুনেছি খুব ভালো জায়গায় সম্বন্ধ করেছে। ছেলে কি করে?

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার।

বাহ!

আপা তোরা ফ্রেশ হয়ে নে, আমি কিছু নিয়ে আসি।

নাহ কিছু লাগবেনা, তুই আসবার আগে তোর চাচীশাশুড়ি খাইয়েছেন।

আচ্ছা। আমি যাই দেখি পিহুর কি অবস্থা। তোমরা তৈরি হয়ে আসো।

রুহি মুখ ভার করে পিহুর অপরপাশে বসে আছে। ওদিকে মেকাপ আর্টিস্ট সেই কখন থেকেই পিহুর মুখে কত কি ঘষে যাচ্ছে! রেবাকে দেখে রুহি বলল, ওয়াও ভাবী তোমাকে যা লাগছে না! আমার ভাইয়া তো আরেকবার তোমার প্রেমে পড়ে যাবে।

পিহু বলল, আসলেই ভাবী তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে, আমিতো ভাবছি সবাই আমাকে বাদ দিয়ে তোমার দিকেই না তাকিয়ে থাকে!

তোমাদের দুজনকে ফেলে আমার দিকে চোখ দেওয়ার ফুরসত পাবেনা গো ননদীরা। ঐসব ছাড়ো, মা বলেছেন উনারা রওয়ানা দিয়ে ফেলেছে তোমাদের আর কতক্ষণ লাগবে?

এই তো ম্যাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ে যাবে।

আচ্ছা।

বৌমা তোমাকে বড় ভাবী ডাকছেন, জলদি যাও।

রেবা দোতলায় তার শ্বাশুড়ীর রুমে গিয়ে বলে, মা ডেকেছেন?

হ্যাঁ এদিকে আয়। পিহু রেডি হয়েছে?

হুম আরেকটু বাকী।

আরাফ কোথায় গেছে?

উনার কোন ফ্রেন্ড নাকি আসছে, তাকে আনতে গেছেন।

ওহ।

মা আপনার কি খারাপ লাগছে? চেহারা কেমন যেন দেখাচ্ছে!

রেহানা হেসে বললেন, না রে তেমন কিছু না। মেয়ের বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে তো, খারাপ লাগছে।

রেবা উনার পাশে বসে জড়িয় ধরে বলল, মন খারাপ করবেন না মা।

রেহানা ওর হাত ধরে বলল, মাঝেমধ্যে কি ভাবি জানিস! এ নিয়ম সৃষ্টি না হলে কি হতো? ছোট থেকে আদরযত্নে বড় করা মেয়েটাকে পরের ঘরে পাঠানোর দরকার কি? বুঝদার মনটাও অবুঝ হয়ে যায়। আমার বড় মেয়েটাতো দেশেই আসেনা, সেই বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকে। মেয়েটাকে কতদিন ধরে আদর করিনা, গায়ের গন্ধ নিতে পারি না। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিলে আগের মতো চাইলেও আদর করা যায়না, যখন তখন যাওয়া যায়না ওরাও আসতে পারেনা। অথচ একটা সময় ছিল চোখের সামনে না দেখলে বুক ধড়ফড় করতো, রাতে কপালে চুমু না দিলে ঘুম হতোনা। রুহি পিহু সারাক্ষণ পিছে পিছে ঘুরে, ওদের বিয়ে দিয়ে দিলে ওরাও আর আঁচল ধরে থাকবেনা, পরের বাড়িতে গিয়ে মায়ের কথা ভুলে যাবে,,,,,,,,

মা শান্ত হন। আপনি এখুনি ভেঙে পড়লে চলবে বলুন?

কি করবো বল, মন যে মানতে চাইছেনা। আমার ছোটছোট সন্তানেরা কত বড় হয়ে গেল! সেইদিন ই তো ওঞদের স্কুলে ভর্তি করালাম যেন,, হেলায় খেলায় কত বেলা হয়ে গেল না রে! তোকেও তো অন্যের কলিজা ছিড়ে এনেছি। নতুন সম্পর্কে এসেছিস।

রেবা চুপচাপ তাকে ধরেই বসে রইলো। রেহানা ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, আমার কত ভয় ছিল জানিস? ছেলের বৌ কেমন হবে, আমার সংসারটায় মন টিকাতে পারবে কি না। আমার ছেলেমেয়েদের ভালোবাসবে কি না। আল্লাহর রহমতে আমি তোকে পেয়েছি। তুই আমার এই ভরা সংসারটাকে একজোটে রাখিস। কখনো ভাঙতে দিস না। সামনেই ছেলেগুলোর বিয়ে করাবো, নতুন বৌয়েরা আসবে। আমরা জায়েরা যেমন মিলেমিশে থাকি তোরাও তেমন থাকার চেষ্টা করিস। একা থাকায় কষ্ট অনেক বুঝলি,দেখিস নি ওখানে একা হাতে সামলাতে তোর কত সমস্যা হয়েছিল, ভরা ঘরে থাকাই ভালো। বাচ্চারাও হাতে হাতে বড় হয়ে যায়। একা লাগেনা। অবশ্য এখন মানুষ একা থাকতেই পছন্দ করে। শ্বশুড় শাশুড়িদের নিয়ে খেতে চায় না।

একজন দরজায় কড়া নেড়ে বললো, ম্যাডাম গেস্টরা এসে গেছেন।

রেহানা চোখমুখ মুছে ব্যস্তস্বরে বলল, দেখেছ কান্ড ওরা চলে এসেছে আমি কি না রাজ্যের গল্প জুড়ে বসলাম। কে জানে তোর বাবা আর আরাফ কোথায়। ওরা দরজায় দাড়ালো কি না!

চলুন গিয়ে দেখি।

বৌমা একটু খেয়াল রাখিস কেমন? আপ্যায়নের যেন ত্রুটি না থাকে।

চিন্তা করবেন না মা আমরা সবাই আছি তো।

রেহানা মৃদু হাসলো।

চলবে,,,

(যারা পেইজে সকল পর্ব ওপেন করতে পারেন না তারা আমার গ্রুপে এড হতে পারেন https://facebook.com/groups/1971957486313015/
আর আমি পেইজ ব্যতীত কোথাও গল্প পোস্ট করিনা, তাই অনুগ্রহ করে কেউ পেইজের লিংক ব্যতীত কপিপোস্ট করবেন না। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here