#তরঙ্গিনী পর্ব-২২
#আরশিয়া জান্নাত
তৌকিরের কর্মকান্ডের উপর কয়েকমাস ধরেই নজরদারী রাখছে এনএসআই। ওর প্রতিটা ফাইল ডিল করার গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে বিশেষভাবে। বলা বাহুল্য এর পেছনে আরাফের ভূমিকা রয়েছে, সে খুব ঠান্ডা মাথায় তৌকিরের ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করতে চায়। ওর এমন পরিণতি দেখতে চায় যেটা দেখে যে কারোই ওর জন্য দয়া হবে!
পেপার ওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে সেইসব নিয়েই ভাবছিল সে। এমন সময় রেবা দরজায় নক করে, আরাফ স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আসুন।
রেবা স্টাডি রুমে ঢুকে বলল, ঘুমাবেন না? কয়টা বাজে দেখেছেন?
সবেই উঠছিলাম,
কাজের প্রেশার বেশি?
নাহ। ঐ টুকটাক চলছে।
সামনে সময় পাবেন?
কিসের?
ভাবছিলাম অনেকদিন সিলেট যাইনি। ভাইয়ার ছেলেকেও দেখা হলো না। আপনার সময় হলে মাকে আমরাই নিয়ে গেলাম। আপার আবার কষ্ট করে যেতে হবেনা,,
ভাইয়া আসবেনা বিয়েতে?
ভাবীকে একা ফেলে আসতে চাইছেনা,, তবে বলেছে বিয়েরদিন উপস্থিত থাকবে।
ওহ! আচ্ছা মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি কি বলেন।
আচ্ছা। চলুন
বেডরুমে এসে বলল, রেবা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি কিছু মনে করবেন না?
হুম বলুন?
প্রাক্তনের প্রতি মায়া আছে?
রেবা হেসে বলল, ভয় পাচ্ছেন নাকি? প্রাক্তনের জন্য মায়া পুষে বসে আছি ভেবে?
নাহ এমনি জিজ্ঞাসা করছি, অনেকেই তো বলে প্রাক্তন একটা আবেগের নাম।
রেবা বেলকনীর রেলিং ধরে বলল, আবেগের নাম এটা মিথ্যে নয়, অতীতের মানুষটা কোথাও না কোথাও থেকেই যায়। জানিনা আপনি কিভাবে নেবেন।
আরাফ ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল, জানেন আমি যখন প্রথম জেনেছি আপনার অতীত আছে আমার ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। অতীতের মানুষটার জন্য কি অঝরেই না কেঁদেছেন! আমি জানি আপনি খুব কঠিন সময় পার করেছেন, প্রথম প্রেম ভোলা সহজ না। ঐটা নিয়ে অভিযোগ করার রাইট কারোই নেই। যেহেতু আমি আপনার বর্তমান আর আমি বর্তমানেই বাঁচি। তাই কখনো ভাববেন না আমি ঐসব নিয়ে আপনাকে খারাপ বলবো বা ভাববো।
আমার ভয় ছিল আমার হাজবেন্ড যখন জানবে আমার এক্স আছে আমাকে হয়তো ছুঁড়ে ফেলে দিবে,,,,কিন্তু আপনি ভীষণ আলাদা।
রেবা একটা কথা বলি,আপনার অতীত নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তবে বিয়ের পরের জীবন নিয়ে আমি খুব সিরিয়াস। আপনার মনে এখনো অন্য কেউ থাকলে আমি সহ্য করবোনা এ আমি বলে দিলাম!
রেবা ওর হাতের মাঝে হাত রেখে বলল, আমি তাকে বহু আগেই বিসর্জন দিয়েছি জনাব। মনের মাঝে স্মৃতিটুকু বাদে তার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ঐটাও হয়তো বিস্মৃতি হয়ে যাবে। তবে ভরসা রাখুন এখন আপনিই আমার সবটা জুড়ে আছেন।
আরাফ ওর কপালে চুমু একে বলল, ধন্যবাদ রেবা।
ধন্যবাদ আমার দেওয়া উচিত,আপনি সবসময় আমার পাশে থাকেন। আমায় কত ধৈর্য নিয়ে সহ্য করেছেন। এমনটা সবাই করেনা,,
আপনার উচিত এর শোধ দেওয়া, ধন্যবাদ দিয়ে দায়সারা হওয়া যাবে না।
শোধ?
হুম
কিভাবে করবো!
আমায় অনেক অনেক ভালোবাসবেন, আদর করবেন তবেই শোধ হবে। আমি ৩০০ দিন কঠোর তপস্যা করেছি কি ভেবে জানেন? এই কঠিন সাধনার অমৃত সুধা হবেন আপনি। আপনার মাঝে যখন আমি ডুবে থাকবো সব কষ্ট নিছক হয়ে যাবে। দেখুন আমার কাছে এখন সেই সময়ের কষ্ট নিছকই মনে হয়। আপনার সঙ্গে প্রতিটাদিন আমার কাছে অনেক উপভোগ্য।
রেবা আরাফকে জড়িয়ে বললো, আপনার মন যেন কখনো পরিবর্তন না হয়, আপনি সবসময় এমনি থাকবেন প্লিজ,,
উহু সেটা তো সম্ভব নয়
কেন?
আমি প্রথমদিন যে পরিমাণ ভালোবেসেছি এখন তো সেই পরিমাণ ভালবাসিনা,,, দিনদিন এই ভালোবাসা চক্রবৃদ্ধি মুনাফায় বেড়েই যাচ্ছে!
রেবা আরাফের হৃদস্পন্দনে কান পেতে রইলো, এই মানুষটার সঙ্গে কথায় পারা যাবেনা।
রেবা!
জ্বি?
এভাবে দাঁড়িয়েই ঘুমানোর প্ল্যান করেছেন নাকি?
হ্যাঁ বললে কি এভাবেই বুকে রেখে দাঁড়িয়ে থাকবেন?
আপনি চাইলে রাখলাম, তারপর ঘুমিয়ে গেলে বিছানায় রেখে দিবো,,
আমার ঘুম ভাঙার শাস্তি দেই যদি?
আপনার ঘুম ভাঙবেনা, ঘুমালে আপনি এই জগতে থাকেন না।
সেই সুযোগে কত কি করেছেন কে জানে?
যাই করেছি পর কাউকে করিনি, নিজের একমাত্র বৌকেই করেছি।
হুম হুম স্বীকার করলেন তাহলে!
করিনা কোনদিন হুম?
জ্বি সেটাই,,
।
।
পিহুর হলুদ সন্ধ্যায় মেয়েরা থিম অনুযায়ী গারারা পড়লেও সানজেনা পড়লো ব্ল্যাক শাড়ি। স্মোকি সাজ আর হালকা অর্নামেন্টে ওর ওপর যে কারোই নজর পড়তে বাধ্য। সানজেনা মনে মনে তৃপ্তির হাসিই হাসছিল। সব ছেলেরা ওর দিকে যেভাবে তাকিয়ে আছে এতে ও নিশ্চিত এখানে সবচেয়ে সুন্দর ওকেই লাগছে।
রুহি আর মুহতাসিম কোল্ড ড্রিঙ্কস হাতে নিয়ে সানজেনার ভাবভঙ্গি দেখছে।
মুহতাসিম– কিছু বুঝলি আপু?
রুহি–না বোঝার কি আছে? থিমের বাইরে গিয়ে ইউনিক সাজার প্রচেষ্টা!
—সেটা তো স্বাভাবিক। তবে মনোযোগ এখানে নেই, ভাইয়াকে খুঁজছে হয়তো।
—আমি বুঝিনা একটা বিবাহিত পুরুষকে আকৃষ্ট করার মানে কি? আগে যা ছিল ছিল এখন তো সংযত হওয়া উচিত!
—কিছু মেয়ে থাকেই এমন। এরা নিজের পছন্দকে স্যাক্রিফাইজ করতে চায়না।
—ভাইয়া ভাবী কোথায়?
—আসেনি এখনো।
—আমার বিশ্বাস ভাইয়ার চোখ তবুও ভাবীতেই আটকে থাকবে, এর দিকে তাকাবার সময়ই পাবে না।
—সেটা ঠিক। তবে এর কিছু করা উচিত। সবসময় এসব দেখতে ভাল্লাগেনা।
— বড় আপার ননদ বলে চুপচাপ আছি, নয়তো আমি ওরে কি যে করতাম,,,,
আরাফ আর রেবা একসঙ্গে লনের দিকে আসছিল, রেবা আর আরাফ কাপল ড্রেসকোড মেইনটেইন করেছে। যা এখানে সবার চেয়ে ভিন্ন। রেবা পড়েছে পার্পেল আর হোয়াইটের কম্বিনিশনের কাজ করানো গর্জিয়াস শাড়ি,আর আরাফ হোয়াইট পাঞ্জাবীর উপর লাইট পার্পেল কোটি।
রেবাকে আজ অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, আরাফ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওর সবকিছু সিলেক্ট করে দিয়েছে। মেকাপ আর্টিস্ট তার কথামতোই মেকাপ করেছে।
রুহি বলল, মাশাআল্লাহ আমার ভাবীকে তো পরীর মতো লাগছে! দিল খুশ হো গ্যায়া!!!
আরাফ রেবাকে বলল, আমার হাত ধরে চলুন,
সবার সামনে?
হুম। এটা এখানে কিছুই না। ডোন্ট ওরি!
রেবা আরাফের বাহু ধরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো। সবার দৃষ্টি ওদের উপর,
মেঝ চাচি বললেন, এই দেখো আমাদের আরাফ আর রেবাকে কি সুন্দর লাগছে!
মেঝ চাচা, হুম অনেক সুন্দর লাগছে।
রেবা আর আরাফ এসে ওদের বাবা মায়ের পাশে বসলো।
রেহানা রেবার চিবুক তুলে বলল, মাশাআল্লাহ আমার বৌমাকে এতো সুন্দর লাগছে! কারো বদনজর না লাগুক।
আরজু বলল, রেবা সত্যিই তোমাকে ভীষণ ভালো দেখাচ্ছে।
সবার প্রশংসায় রেবা লজ্জায় লাল হয়ে গেল, আরাফ সেই লজ্জামিশ্রিত মুখটার দিকে এতোটাই মগ্ন হয়ে রইলো যে কোনোদিকে তার খেয়াল নেই।
রুহি বলল,দেখলি বলেছিলাম না আমার ভাইয়ের সময়ই হবেনা ওর দিকে তাকানোর।
মুহতাসিম, সানজেনা আপু কয়বার ওর সামনে চক্কর দিলো দেখলি?
রুহি, শাকচুন্নি একটা!
সানজেনা বিরক্তিতে রুমে গিয়ে ড্রিঙ্ক করতে শুরু করলো। কি আছে এই রেবার মধ্যে যা আমার মধ্যে নেই? এতো মুগ্ধতা, এতো চোখে হারানো? আরাফ আমায় তো কোনোদিন ঐ দৃষ্টিতে দেখেনি, আমি তো সেই প্রথম দেখা থেকেই তার প্রেমে পড়েছিলাম। তার একটু এটেনশন পেতে কত কি করেছি। অথচ পাত্তাই দেয় নি কখনো। আমি ভাবতাম উনি রসহীন পুরুষ, ভালোবাসতে জানেনা। কিন্তু রেবার বেলা সে এতো কনসার্ন কেন? এতো কেয়ার, এতো লাভ! এসব কি আসলেই হয় নাকি! আমার এবার আসাই উচিত হয়নি। আমি কেন এসেছি এখানে? আরাফ তো আমার হবার নয়, আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন এই সহজ কথাটা মেনে নিতে??
সানজেনা পুরো রাত কেঁদেই কাটালো, অথচ কেউ টেরই পেলো না।
।
অনুষ্ঠান শেষে রেবা বলল, আপনাকে না আমি বুঝিনা, কখনো বলেন হেভি সাজ পছন্দ না, আবার কখনো নিজেই বলেন অনেক সাজাতে।
আরাফ ওর কানের দুল খুলে বলল, যেখানে যেমন থাকা উচিত সে অনুযায়ী আপনাকে সাজাই। আপনি কি এতে বিরক্ত?
রেবা ওর গলা জড়িয়ে বললো, নাহ। আপনার স্ত্রীকে আপনি যেমন খুশি তেমন সাজান। এতে আমার আপত্তি থাকবে কেন?
গুড গার্ল! বসুন আমি আপনাকে হেল্প করছি,,
আরাফ খুব যত্ন করে ওর গয়না হাতের চুড়ি চুলে সেট করা পিন খুলে দিলো। ওর ধৈর্য দেখে রেবা বলল, আপনি মাশাআল্লাহ অনেক ধৈর্যশীল! এতো ক্লিপ খুললেন অথচ একটুও ব্যাথা পাই নি।
তাই বুঝি?
হুম। আমি হলে এতোক্ষণে কত চুল যে ছিঁড়তো!
বিয়ের রাতে মনে নেই? কত ভেজালে পড়েছিলাম। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো আপনি সেদিন আমায় একটুও হেল্প করেননি কেন?
আরাফ রেবাকে পেছনের দিকে টেনে বুকে নিয়ে দু হাতে জড়িয়ে বললো, সেদিন যদি হেল্প করতাম ভাবতেন আপনাকে ইম্প্রেস করতে চাইছি কিংবা স্পর্শ করার বাহানা খুঁজছি। আরেকটা বড় কারণ হলো, আমার আপনার অধৈর্য মুখ দেখতে অনেক ভালো লাগছিল।
আপনি অনেক ইনটেলিজেন্ট!
তাই?
হুম
রেবা শুনুন, আপনি নিজেকে এমনভাবে রাখতে শিখুন যাতে আমার অন্যকোথাও নজর না যায়। আপনি এমনিতেই আমার আকর্ষণের মূল কেন্দ্র তবুও বলছি এটা। আপনি মাঝেমধ্যে আমার অফিসে যাবেন, আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। বা আপনি গিয়ে দেখবেন আমি কি করছি।
এসব করার কারণ?
আছে,, আমি চাই এটা। আপনাকে আমি অকারণে কিছু বলিনা এটা তো মানেন?
জ্বি
তবে যাবেন কেমন?
আচ্ছা।
রেবা!
জ্বি?
আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি জানেন?
হুম
আপনি কষ্ট পাবেন এমন কিছু আমি কখনোই করতে চাইনা।
জানি
চারপাশটা ভীষণ খারাপ। আপনি সচেতন থাকুন কেমন?
কিছু কি হয়েছে?
নাহ।
তাহলে?
আমার মাঝেমধ্যে ভয় হয়, কেউ যদি আপনাকে ভুল বোঝাতে চায়। আর আপনি যেমন নরম। আগপিছ না ভেবেই দূরে সরে যান যদি!
আমি আপনাকে ভরসা করি আরাফ। এতো চিন্তা করবেন না তো। আমি আপনার প্রতি সচেতন থাকবো। আপনিও থাকবেন। ব্যস!
আরাফ রেবার মাথায় কপাল ঠেকিয়ে বলল, আমরা যেন এভাবেই সর্বদা একে অপরকে বিশ্বাস করতে, সম্মান করতে, আর ভালোবাসতে পারি।
ইনশাআল্লাহ!
চলবে,,,