টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০৪,০৫

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২),০৪,০৫
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৪

অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটা রিহানকে জাগাতে পারলো না। শেষে সে রিহানকে একটা স্ট্রেচারে তুলে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। এভাবে চোখের সামনে একটা ভালো লোককে পাগল বানিয়ে দেবে, কখনও হতে দেবে না সে। ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে গেল মেয়েটা স্ট্রেচারটা টানতে টানতে। এতকিছু ঘটে যাচ্ছে, রিহান কিছুই টের পেল না।

খানিক পর ডাক্তার শহিদ এসে রিহানকে খুঁজে না পেয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠল। সামনে যা পাচ্ছে রাগে এদিক ওদিক ছুড়তে লাগলো সে। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘কে নিয়ে গেল ওকে?’

একজন নার্স দৌড়ে এলো। ভয়ে ভয়ে বললো, ‘শান্তা ম্যাম নিয়ে গেছে একটু আগে।’

‘শান্তা? কোথায় নিয়ে গেছে?’ শান্তার উপর রাগ দ্বিগুণ বেড়ে গেল শহিদের। শান্তা তার সহকারী ডাক্তার। রিহানকে যে ইনজেকশনটা দেয়ার কথা, ওটা হয়তো শান্তার চোখে পড়েছে। শহিদকে আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। শান্তা যে এমনটা করবে সেটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিল।

‘কোথায় নিয়ে গেছে জানি না স্যার। স্ট্রেচারে করে বের করে নিয়ে যেতে দেখেছি।’

‘স্ট্রেচারে করে?’ ভ্রু কুঁচকালো শহিদ।

‘জি স্যার।’

‘তারমানে এখনও বেশিদূর এগোতে পারেনি ওরা।’ বিড়বিড় করলো শহিদ। তারপর ইনজেকশনটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল সে।

শান্তা স্ট্রেচারটা দ্রুতপায়ে টানতে টানতে সমানতালে ডাকতে লাগলো রিহানকে। রিহান একটু একটু করে চোখ খুলছে। তখন কারও পায়ের শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেল শান্তা। ডাক্তার শহিদ নিশ্চয়ই পিছু নিয়েছে। শান্তা স্ট্রেচারটা সাইড করে রেখে কয়েকটা গাড়ি থামানোর জন্য সিগন্যাল দিলো। কিন্তু কোনো গাড়ি থামলো না। ডাক্তার শহিদকে দেখা গেল কিছুটা দূরে, রাগান্বিত হয়ে ছুটে আসছে সে। রিহান স্ট্রেচারে উঠে বসলো। তাকে বসতে দেখে খুশি হলো শান্তা। দৌড়ে গেল তার কাছে। রিহান স্ট্রেচার থেকে নামলো, কিন্তু ঠিকভাবে দাঁড়াতে পারলো না। টলতে লাগলো, যেন ঘুমের নেশা এখনও কাটেনি। শান্তা তার গা ঝাঁকিয়ে বললো, ‘স্যার, আপনি ঠিক আছেন?’

‘হ্যাঁ…এ… আমি… আমি ঠিক আছি।’ টলতে টলতে বললো রিহান।

শান্তা বুঝলো, ঠিক নেই রিহান। এই অবস্থায় সে নিজেকে প্রতিরক্ষা করতে পারবে না। শান্তা আবারও গাড়ি সিগন্যাল দিলো। ততক্ষণে শহিদ কাছে চলে এসেছে। ইনজেকশনটা হাতে নিয়ে রিহানের দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর ইনজেকশনটা সিরিঞ্জে নিলো। রিহানের গায়ে পুশ করার আগেই শান্তা এসে তাকে ধাক্কা দিলো। পড়ে গেল শহিদ। শান্তা চিৎকার করে ওঠল, ‘এমন কেন করছেন স্যার? একটা নিরীহ লোকের এতবড়ো ক্ষতি কেন করছেন?’

ডাক্তার শহীদ তার কাচের চশমাটা ঠিকঠাক বসালো চোখে। তারপর উঠে দাঁড়ালো। শান্তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে বললো, ‘আমার ক্লিনিকে চাকরি করিস, আমার দেয়া বেতনে চলিস, আর আমারই কাজে বাধা দিস?’ এগিয়ে গিয়ে জোরে চড় মারলো শহিদ শান্তার গালে। জোরে চিৎকার করে পড়ে যেতে যেতে শান্তা নিজেকে সামলে নিলো। রিহান টলতে টলতে শহিদের সামনে এসে অস্পষ্ট গলায় বললো, ‘স্যার, মেয়েটাকে মারছেন কেন?’

‘মারতে তো চাইছি তোকে, মেয়েটা বাধা দিচ্ছে।’ বলেই সিরিঞ্জটা তুলে আবারও রিহানের গায়ে পুশ করতে চাইলো শহিদ। শান্তা দৌড়ে এসে তার হাত শক্ত করে ধরলো, যাতে শহিদ ব্যর্থ হয়। দুজনের মাঝে কিছুক্ষণ হাতাহাতি চললো। হঠাৎ সিরিঞ্জটা শক্ত করে ধরে পুশ করে দিলো শহিদ শান্তার গায়ে। চিৎকার করে ওঠল শান্তা। মুখটা হা করে থাকলো সে অনেকক্ষণ। শহিদ যে তার গায়ে ইনজেকশনটা পুশ করে দিবে ভাবতে পারেনি সে। সেই মুহূর্তে কোথা থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে রিহানকে তুলে নিয়ে গেল নিমিষেই। শহিদ রাগে হাত-পা ছুঁড়তে লাগলো। শান্তাকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো। তারপর পুলিশ অফিসার সঞ্জুর দেয়া কার্ডটা বের করে কার্ডের নাম্বারে ফোন দিলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই সে নিজেকে কন্ট্রোল করে শান্ত কণ্ঠে বললো, ‘স্যার, ডাক্তার শহিদ বলছি।’

‘জি বলুন…’ সঞ্জুর কণ্ঠ শোনা গেল।

‘দুঃখিত স্যার আপনাকে মিথ্যে ইনফরমেশন দেয়ার জন্য। রিহান নামের যাকে আপনারা খুঁজতে আসছিলেন সে পাগল নয়, সে পুরোপুরি সুস্থ। সে একটু আগে আমাদের ক্লিনিক থেকে পালিয়ে গেছে।’

‘মিস্টার শহিদ, মিথ্যা তথ্য দেয়ার জন্য আপনার শাস্তি হতে পারে জানেন?’

‘দুঃখিত স্যার।’

‘ঠিক আছে, রাখুন।’ ফোন কেটে গেল। শহিদ কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। পাশে বেহুশ হয়ে পড়ে আছে শান্তা। তাকে কোলে তুলে নিয়ে ক্লিনিকের দিকে হাঁটতে লাগলো সে।

রিহানের ঘোর কাটতে আরও অনেকক্ষণ কেটে গেল। পুরোপুরি যখন সে স্বাভাবিক হলো, দেখলো সে নিজঘরে শুয়ে আছে। পাশে তার মা-বাবা, আর ছোটোবোন। তাকে স্বাভাবিক হতে দেখে ওরা হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিয়ে তাকালো। রিহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আমি এখানে কী করে এলাম?’

রহমান সাহেব জবাব দিলেন, একটা মাইক্রোবাস থেকে কেউ একজন তোকে নামিয়ে দিয়ে গেছে।’

‘কিন্তু আমার তো ক্লিনিকে থাকার কথা এখন।’ কথাটা বলেই রিহান কী যেন ভাবলো। আবছা আবছা কী যেন মনে পড়তে লাগলো তার। একটা মেয়ে, চেহারাটা অস্পষ্ট। মেয়েটা তাকে স্যার স্যার বলে ডাকছিল। আর কী যেন বলছিল? তাকে ইনজেকশন দিয়ে পুরোপুরি পাগল করে দিবে। শেষে মেয়েটা তাকে নিয়ে পালাতে গিয়ে পালাতে পারেনি। ডাক্তার শহিদের সাথে মেয়েটার হাতাহাতি হয়, এরপর ডাক্তার ইনজেকশনটা পুশ করে দেয় মেয়েটার গায়ে। সবকিছু ধীরে ধীরে মনে পড়তেই ভয়ে চমকে ওঠে রিহান। না, একটা মেয়ে নিজেকে তার জন্য বিপদে ফেললো, রিহান মেয়েটাকে একা ছাড়তে পারে না। কিন্তু ডাক্তার শহিদ? তার সাথে তো রিহানের কোনো শত্রুতা ছিল না। তবে সে কেন তাকে ইনজেকশন দিয়ে পুরোপুরি পাগল করতে চাইলো?

‘বাবা আমি আসছি। আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছি। আমাকে একটু এখনই বের হতে হবে।’ উত্তরের প্রত্যাশা না করেই রিহান দ্রুত বেরিয়ে গেল।

যে জায়গাটায় মেয়েটাকে ইনজেকশন পুশ করে, ওখানে আসে রিহান। মেয়েটাকে না পেয়ে সে ভেবে নেয়, তাকে হয়তো ডাক্তার শহিদ নিয়ে গেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ক্লিনিকে যাওয়াটা তার জন্য বোকামি হবে। তাই সুযোগ বুঝে ডাক্তারকে বাগে আনতে হবে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিহান হাঁটতে লাগলো। হঠাৎ আবারও নজরে পড়লো সেই লোকটা, চট্টগ্রামে যে হামলা করেছিল। ওইদিন পালিয়ে বেঁচেছিল সে। আজ আর কোনোভাবে পালাতে দেবে না। লোকটাকে ধরতে প্রাণপণ দৌড়ায় সে। লোকটা তাকে দেখতে পেয়ে আবারও পালাতে চায়। অনেকগুলো দেয়াল আর বিল্ডিং টপকে পালাতে চেয়েও ব্যর্থ হলো এবার লোকটা। রিহান যেন সংকল্প করেছে লোকটাকে আজ ধরবেই৷ শেষে ধরেই ফেললো। তারপর কয়েকটা ঘুষি চালালো মুখে। ঠোঁট কেটে রক্ত বের হলো লোকটার। লোকটা প্রতিরক্ষার চেষ্টা করতে করতে বললো, ‘থামুন। এভাবে মারছেন কেন আমাকে?’

‘কেন মারছি জানিস না? তবে পালাচ্ছিলি কেন?’

‘আমার দিকে এভাবে তেড়ে এলেন, তাই ভয়ে পালাচ্ছিলাম।’

‘এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলি? ভেবেছিস তোর চেহারাটা আমার মনে নেই? চট্টগ্রামে আমার উপর তিনবার হামলা করেছিলি দলবল, পিস্তল নিয়ে। কেন বল? কে পাঠিয়েছিল তোদের?’

‘কী বলছেন এসব? আমি কখন চট্টগ্রাম গেলাম?’

‘মিথ্যে বলছিস তুই।’

‘মিথ্যে বলছি না। আমি কখনও চট্টগ্রাম যাইনি।’

‘চট্টগ্রাম যাসনি? বল যাসনি?’ আবারও কয়েক দফা ঘুষি চালালো রিহান লোকটার মুখে। লোকটা এবার আর সহ্য করতে না পেরে বলে ফেললো, ‘গেছি, হ্যাঁ গেছি। হামলাও করেছিলাম আপনার উপর।’

রিহান নিজেকে কন্ট্রোল করলো। লোকটা হাঁপাতে লাগলো কিছুক্ষণ। তারপর দম নিয়ে বললো, ‘আমরা হলাম ভাড়াটে গুণ্ডা। ছোটোখাটো মাস্তান। টাকার বিনিময়ে এসব করি।’

‘কে পাঠিয়েছিল তোদের?’

‘যে পাঠিয়েছিল তার নামটা শুনলে আপনি বিশ্বাস করবেন তো? আপনার একজন শ্রদ্ধার মানুষ।’

‘বল…’ রিহান আবারও ঘুষি মারতে উদ্ধত হলে লোকটা দ্রুত বলে ফেললো নামটা, ‘ইউসুফ সাহেব… ইউসুফ সাহেবই আমাদের ভাড়া করেছিল আপনাদের মারার জন্য।’

‘ইউসুফ সাহেব? মানে আমার অফিসের ইউসুফ স্যার?’

‘হ্যাঁ।’

লোকটার কথা যেন বিশ্বাস করতে পারলো না রিহান। আবার বিশ্বাস না করারও উপায় নেই। লোকটার মুখে ইউসুফ স্যারের নামটা শোনার পর থেকে রিহানের হাত-পা কেমন যেন অবশ হতে শুরু করলো। ইউসুফ স্যারকে সে কত আপন মনে করতো, আর তিনিই কি-না তাকে খুন করতে লোক ভাড়া করলো? যদি খুন-ই করার ইচ্ছে থাকে তবে রিহানকে অফিসের এতবড়ো দায়িত্ব দিলো কেন? ঝিমঝিম করতে লাগলো রিহানের মাথা। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। একদিকে ডাক্তার শহিদ, আরেকদিকে ইউসুফ স্যার। না জানি তার অজান্তে আরও কত শত্রু তৈরি হয়ে আছে। সুযোগ খুঁজছে তারা যেকোনো মুহূর্তে ছোবল মারতে। হঠাৎ মাথায় প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করলো রিহান। পেছন থেকে কেউ শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করেছে তাকে। কে এই নতুন শত্রু? ভাবতে ভাবতেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল রিহান।

যখন জ্ঞান ফিরলো রিহান নিজেকে একটা অন্ধকার কক্ষে আবিষ্কার করলো। হাত-পা শক্তভাবে বেঁধে, কারা যেন তাকে অন্ধকার কক্ষে বন্দী করে রেখেছে। অতীতের সেই বন্দীজীবনের কথা মনে পড়লো রিহানের। ব্রিটিশরা তাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছিল। এখন আবার কোন নতুন ব্রিটিশ পয়দা হলো তার সামনে? জোরে চিৎকার করে উঠল রিহান, ‘কে আছেন? আমাকে এভাবে বন্দী করা হয়েছে কেন?’

কয়েকমুহূর্ত পর দরজা খুলে গেল, লাইট জ্বলে ওঠল। একটা স্যুট-টাই পরা লোক এগিয়ে এলো হাসিমুখে। রিহান লোকটাকে চিনে বলে মনে হলো না। কখনও দেখেনি সে। রিহানের সামনে এসে লোকটা নিজের পরিচয় দিলো, ‘আমি রাহাত খান। দুঃখিত এভাবে আমাদের সাক্ষাৎ হওয়ার জন্য।’

‘কে আপনি? আমাকে এভাবে বন্দী করার মানে কী?’

‘একটা গল্প বলি শুনুন…’ গলা ঝেড়ে নিলো রাহাত। ‘একদা এক লোক ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যায় কোনো একটা কাজে। লোকটা যথারীতি তার কাজ সেরে ফিরে আসতে চাইছিল, কিন্তু ফিরতে পারেনি। সে চলে চলে যায় অনেক অনেক অনেক দূরে। কতদূরে জানেন?’

রিহান জবাব না দিয়ে হা করে চেয়ে থাকে। রাহাত আবারও বলতে থাকে, ‘লোকটা চলে যায় একেবারে ১৯৪২ সালে। সেখানে একটা স্কুল শিক্ষকের মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়, মেয়েটার সাথে সখ্য গড়ে ওঠে তার। একদিন ছেলেটা ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ে, পরে মেয়েটাও ধরা পড়ে ব্রিটিশদের হাতে। কিন্তু একদিন ওরা ব্রিটিশদের মেরে পালিয়ে যায়, পালানোর রাতে একটা মসজিদে আশ্রয় নেয় ওরা, ওখানে তারা বিয়ে করে।’

রাহাতের কথা শুনতে শুনতে রিহান চমকে ওঠছে বারবার। এ তো তারই গল্প বর্ণনা করে যাচ্ছে লোকটা। তার আর সুফিয়ার গল্প। কিন্তু লোকটা এতকিছু জানলো কীভাবে? কে এই লোক? রিহানকে ভাবতে দেখে রাহাত জিজ্ঞেস করে, ‘কী রিহান সাহেব, গল্পটা পরিচিত মনে হচ্ছে?’

‘কে আপনি? এই গল্প আপনি জানেন কী করে?’ উত্তেজিত হয়ে রাহাতের দিকে তাকায় রিহান। ‘হা হা হা’ করে জোরে হেসে ওঠে তখন রাহাত।

[[চলবে…]]

#টুয়েন্টি_মিনিটস (চ্যাপ্টার-০২)
লেখা: ShoheL Rana
পর্ব:-০৫

‘বলুন… এই গল্প আপনি কী করে জানেন?’ চিৎকার করে প্রশ্ন করে রিহান। হাতের বাঁধন খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।

‘কেউ বর্তমান থেকে অতীতে যেতে পারলে। অতীত থেকে কেউ বর্তমানে আসতে পারবে না?’ ভ্রু কুঁচকে তাকালো রাহাত রিহানের দিকে। কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিয়ে বললো, ‘গল্পটা এখনও শেষ হয়নি মি. রিহান। ওইসময় মসজিদে দুজনের বিয়ে হয়, ওখানেই ওরা রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মধ্য রাতে একটা গাড়ির শব্দে ঘুম ভাঙে দুজনের। ওটা ছিল ব্রিটিশ সেনাদের একটা গাড়ি। ব্রিটিশদের আগমন টের পেয়ে তখন লোকটা তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে মসজিদে রেখে বের হয়ে পড়ে। তারপর কৌশলে সব ব্রিটিশদের হত্যা করে। আহ্, কী সাহসী লোক! বর্তমান থেকে অতীতে গিয়ে একাই এতগুলো ব্রিটিশকে হত্যা করলো। আই স্যালুট হিম। রিয়েলি, আই স্যালুট হিম।’ বলেই স্যালুটের ভঙ্গি করলো রাহাত। রিহান তখন সেদিনের ঘটনা পুরোটা মনে করলো। সেদিন রাতে মসজিদে ওরা বিয়ে করে সবে ঘুমিয়েছিল। তখন একটা ব্রিটিশদের গাড়ি এসে থামে রাস্তায়। ওদের ঘুম ভেঙে যায়। সুফিয়া ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রিহানকে। রিহান সুফিয়ার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে, ‘ভয় পেয়ো না। আমি দেখছি।’

সুফিয়া রিহানের বুকে আড়ষ্ট হয়ে বললো, ‘ব্রিটিশরা হয়তো আমাদেরকেই খুঁজতে আসছে। ওরা হয়তো সব জায়গায় খুঁজে খুঁজে আসছে। মসজিদেও খুঁজবে।’

‘একদম ভয় পেয়ো না তুমি। শান্ত হয়ে শুয়ে থাকো। আজ একজনকেও জীবিত ফিরতে দেবো না।’ বলেই উঠে দাঁড়ালো রিহান। সুফিয়া তার হাতটা টেনে ধরে চাপাকণ্ঠে বলে, ‘কোথায় যাচ্ছো তুমি? না, না, ওদের সামনে যেয়ো না প্লিজ…’ রিহান সুফিয়ার দুহাত আলতো করে ধরে ফিসফিস করে বলে, ‘আমার উপর ভরসা রাখো।’

সাবধানে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে রিহান। কিছুটা দূরে হেডলাইট জ্বালানো ব্রিটিশদের গাড়িটাকে দেখা গেল। সেই আলোতো কয়েকজন ব্রিটিশকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। রিহান ওদের নজরে পড়েনি কারণ এদিকটা অন্ধকারে গ্রাস করে নিছে। মসজিদের বাতিও নেভানো। রিহান দেখলো ব্রিটিশদের সংখ্যা বেশি না, পাঁচজন। এদেরকে সহজে শেষ করা যাবে। মসজিদের উঠান হাতড়ে একটা ঢিল খুঁজে নিলো সে। তারপর সেই ঢিলটা ছুঁড়ে মারলো ব্রিটিশদের গাড়িটা লক্ষ করে। ঢিলটা যখন গাড়িতে শব্দ করে আঘাত করে, ব্রিটিশরা আবার পেছনে দৌড়ে যায়। রিহানও ক্ষিপ্র বেগে দৌড়ে যায় পেছন পেছন। একদম পেছনের জনকে সে নিজের নাগালে নিয়ে আসে। পেছন থেকে হাঁটুর জয়েন্টে লাথি দিলে পড়ে যায় ব্রিটিশটা। তারপর তার মাথাটা শক্ত করে ধরে ঘাড়টা মটকে দেয় এবং তার বন্দুকটা হাতে তুলে নেয়। সামনের ব্রিটিশরা ঘুরে তাকায় এবার। রিহান বন্দুকের বাট দিয়ে আরেকজনের মুখে জোরে আঘাত করে। জোরে চিৎকার করে পড়ে যায় সে। বাকি তিনজন তখন বন্দুক তুলে গুলি করতে উদ্যত হয়। গুলি করতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে ওদের। সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে রিহান গাড়ির উলটোদিকে অন্ধকারে মিশে যায় মুহূর্তে। ব্রিটিশ তিনজন পেছন পেছন ছুটে যায়। কিন্তু অন্ধকারে খুঁজে পাই না রিহানকে। তখন একজন ব্রিটিশ সেনা পুনরায় গাড়ির দিকে ছুটে যায়। গাড়িটা ঘুরিয়ে নিলে হেডলাইটের আলোতে খোঁজা যাবে তাকে। তাই গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়িটা ঘুরানোর চেষ্টা করে সেনাটা। পরপর দুবার গুলির শব্দ হয় সেই সময়। ব্রিটিশ সেনাটা গাড়ি পুরোপুরি ঘুরিয়ে নিলে সামনে দেখতে পায় তার বাকি দুই সেনার লাশ রাস্তায় পড়ে আছে। আর শত্রু তাদের লাশের উপর পা তুলে নির্বাক দাঁড়িয়ে বন্দুক তাক করে আছে সোজা তার দিকে। লাশের উপর পা তুলে রিহান হাসে। অবশিষ্ট ব্রিটিশ সেনাটাকে ইশারায় গাড়ি থেকে নামতে বলে। দুহাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নামে সেই ব্রিটিশটা। ভয়ে ভয়ে এগোয় রিহানের দিকে। বিড়বিড় করতে থাকে সে, ‘ডোন্ট শ্যুট, ডোন্ট শ্যুট।’

ব্রিটিশটা নাগালে চলে এলে রিহান বন্দুকের বাট দিয়ে তার পায়ে আঘাত করে। পড়ে যায় সে রাস্তায়। রাগে গজগজ করতে করতে সে চিৎকার করে, ‘বাস্টার্ড, ডু ইউ নো হু আই অ্যাম?’

রিহান পুনরায় বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে তার মুখে। ঠোঁট কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় তার। মুখের রক্তাক্ত থুথু ফেলে সে হাতে ঠেস দিয়ে উঠার চেষ্টা করলে রিহান বন্দুক তাক করে তার দিকে। এবার আরও বেশি ভয় ফুটে ওঠে তার চেহারায়। হাতের ইশারায় রিহানকে থামতে বলে ইংরেজিতে বলে উঠে, ‘হেই, আমাকে মারলে এই ভূখণ্ড একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। জানিস আমি কে?’

‘জন…সন… জনসন।’ ব্রিটিশ সেনাটার ড্রেস থেকে নামটা পড়ে নিলো রিহান। জনসন তখন বললো, ‘হ্যাঁ, জনসন। কিন্তু আমার নামের পদবিটা কী জানিস?’

ভ্রু কুঁচকে তাকালো রিহান। চোখে তার প্রশ্ন। জনসন নিজেই উত্তর দিলো, ‘আমার নামের পদবিটা হলো চার্চিল। চার্চিল পদবিটা কার নাম থেকে নেয়া জানিস তো? ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর।’

রিহান হাসে। ‘তারমানে তুই বলতে চাস তুই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আপন কেউ?’

‘শুধু আপন না। আমি তাঁর আপন ছেলে। যেটা কেউ জানে না।’

‘হোয়াট!’

‘কী? ভয় পাচ্ছিস তো?’ হেসে ওঠে জনসন। ‘হ্যাঁ, আমি জনসন চার্চিল। উইন্সটন চার্চিলের আপন ছেলে। কিন্তু, আমার পরিচয়টা পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তুই জানতে পারলি প্রথম।’

‘আর কেউ জানে না?’

‘না। কারণ, উইন্সটন চার্চিলের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে পৃথিবীর আর কেউ জানে না। আর তিনিও সেটা আজীবন গোপন রাখতে চান। কিন্তু, আমি তার খুবই প্রিয় সন্তান। আমার কিছু হলে এই ভূখণ্ড তিনি আর রাখবেন না।’

জনসনের কথা শুনে হেসে ওঠে রিহান। ‘শুন চার্চিলের বাচ্চা, আজ থেকে ৭০-৭৫ বছর পরের ঘটনাও আমি জানি। আর তুই আমাকে বাপের ভয় দেখাস? তুই যখন বাপের এতই প্রিয় সন্তান, তবে তোর আজ এমন হাল করবো, যেন লাশসুদ্ধ খুঁজে না পায় তোর বাপ।’ বলেই অবিরাম গুলি চালাতে লাগলো রিহান জনসনের বুকে। পরে জনসন যখন নিস্তেজ হয়ে যায়, তার লাশটা টেনে একটা খোলা মাঠে নিয়ে আসে। ওখানে মাটি খুঁড়ে সে কয়েক হাত গভীরে পুঁতে ফেলে জনসনকে, যার একমাত্র সাক্ষী রিহান নিজে। জনসনকে মাটির গভীরে পুঁতে যখন রিহান ফিরে আসছিল, পথে দেখতে পায় সুফিয়াকে। রিহানের দেরি দেখে সে বের হয়েছিল। রিহান তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘ভয় নেই, সব কুকুরের দলকে শেষ করেছি। তাদের মধ্যে একজন কে জানো?’

‘কে?

‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের ছেলে জনসন চার্চিল। তাকে ওই মাঠে পুঁতে এসেছি।’

‘আমিও একটাকে মেরেছি, জানো? ওখানে একজন মাটিতে পড়ে একটু একটু নড়ছিল। তার পেটে আমি বন্দুকের নলটা পুরো ঢুকিয়ে দিয়েছি।’ হাসলো সুফিয়া।

‘বাহ্, আমার সাহসী বউ। ওকে আমি বন্দুকের বাট দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছিলাম।’ সুফিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকে রিহান। ব্রিটিশদের ভয়াবহতা নেই বুঝতে পেরে তখন মসজিদ থেকে হুজুর এবং বাকিরাও বের হয়ে আসে।

পুরো ঘটনাটা মনে পড়তেই কিছুক্ষণ থমকে বসে থাকে রিহান। তারপর রাহাতের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। ‘এসব কাহিনি তো আপনার জানার কথা না, বলুন কী করে জানেন আপনি?’

‘ওই যে বললাম, আমি অতীত থেকে এসেছি। তাই সব জানি। কিন্তু আমি আজ অনেকদিন ধরে একটা জিনিস খুঁজছি। কী জানেন?’

‘কী?’

‘জনসন চার্চিলের লাশটা। আপনি তাকে কোথায় পুঁতে রেখেছিলেন?’

‘হা হা হা’ করে রিহান হেসে ওঠে। ‘কেন? আপনি তো অতীত থেকে এসেছেন, সবই জানেন৷ তবে লাশটা কোথায় পুঁতে রেখেছি জানেন না কেন? আপনি যে অতীত থেকে আসেননি তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি এবার।

‘বাহ্, বুদ্ধিমান লোক। বুঝে গেছেন আমি অতীত থেকে আসিনি।’

‘কিন্তু আপনি কে? আমার ঘটনাগুলো কীভাবে জানেন? সুফিয়া ছাড়া তো লাশটার ব্যাপারে কেউ জানতো না। আপনি কি সুফিয়ার কেউ? প্লিজ, বলুন আমাকে?’ চিৎকার করে ওঠে রিহান।

‘আস্তে মি. রিহান আস্তে। আপনার আওয়াজ বাইরের কেউ শুনতে পাবে না। সাউন্ড প্রুফ কক্ষ, আর জনস্থান থেকেও অনেকটা দূরে।’

‘আমাকে প্লিজ বলুন, সুফিয়াকে আপনি চিনেন কি না।’ শান্ত কণ্ঠে বললো রিহান।

‘আরে মিয়া, কী সুফিয়া সুফিয়া করে যাচ্ছেন তখন থেকে। আমি এরচেয়েও দামি কথা বলতে চাচ্ছি, আপনি কোনো গুরুত্বই দিচ্ছেন না।’ রেগে ওঠল রাহাত। রিহান তার চেহারার দিকে অসহায়ভাবে তাকালো। রাহাত নিজেকে সামলিয়ে পুনরায় বললো, ‘লাশটা আপনি কোথায় পুঁতেছিলেন সেটা আমি জানি, কিন্তু ঠিক কোন জায়গায় পুঁতেছিলেন সেটা আমি জানতাম না বলে পুরো ছয় একর জমি কিনে নিই। তারপর ওখানে শুরু করি আমার নতুন প্রজেক্ট। এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাকে বলে। আমার প্রজেক্টটাও হবে আবার লাশটাও খোঁজা হবে। পুরো জায়গাটা আমি দেয়াল আর কাঁটাতারে ঘিরে দিই। একইসাথে আমার প্রজেক্টের কাজও চলতে থাকে, তারচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই লাশটা খোঁজার কাজে। কেন আমি একটা লাশ খুঁজতে এত মরিয়া হয়ে ওঠি জানেন? কী আছে ওই লাশে? আপনিও হয়তো ইতোমধ্যে জেনে গেছেন প্রশ্নটার উত্তর। তাই না মি. রিহান?’ ভ্রু কুঁচকে তাকায় রাহাত রিহানের দিকে। রিহান জবাব দেয় না। চুপ হয়ে চেয়ে থাকে রাহাতের দিকে। তারপর রাহাত নিজেই বলে ওঠে, ‘আপনি জেনে গেছেন লাশটার দাম। তাই তো সেদিন ঝুঁকি নিয়েই দেয়াল আর কাঁটাতার টপকে লাশটা নিয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু আপনি দেখতে কেমন? কোথায় থাকেন কিছুই জানতাম না আমি। তবে আপনি যে রিহান সেটা আমি জানতাম। আপনার বাকি পরিচয়টাও বের করতে আপনার পেছনে আমি পুলিশ লেলিয়ে দিই। এজন্য শুধু শুধু একটা নিরীহ ছেলেকে প্রাণ হারাতে হলো। আমার গেইট কিপার, আমি নিজ হাতেই ওকে খুন করি, জানেন? আর দোষটা আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দিই। যাতে পুলিশ আপনাকে খুঁজে বের করে।’

‘পুলিশ আমাকে খুঁজছে? আমার পেছনে পুলিশ?’ অবাক হয় রিহান।

‘কেন? আপনি জানেন না আপনার পেছনে পুলিশ তাড়া করছে? আপনি ভাগ্যবান তাই পুলিশের হাতে না পড়ে আমার হাতেই পড়েছেন। প্রথমে ইচ্ছে হয়েছিল আপনাকে নিজ হাতে খুন করে কলিজাটা বের করে নেবো। কিন্তু আপনাকে এক শর্তে বাঁচাতে পারি…’ দম নিলো রাহাত। তারপর বললো, ‘লাশটা আমাকে দিয়ে দিন। এতদিনে হয়তো ওটা আর লাশ নেই, কঙ্কাল হয়ে গেছে, কঙ্কালটাই আমাকে ফেরত দিন।’

‘আপনার পরিচয় দিন। তবেই কঙ্কালটা পাবেন। কে আপনি?’

‘কী মশাই, আপনি দেখি আমার পরিচয়ের পেছনেই পড়ে আছেন? কে আমি জানতে না চেয়ে কঙ্কালটা আমাকে ফেরত দিন।’

‘ওটা আপনি কখনোই পাবেন না।’

রাহাত মুখটা রিহানের কানের কাছে নিয়ে গেল। তারপর নিচু কণ্ঠে বললো, ‘কেন? ওটার প্রতি কি আপনারও লোভ আছে? অবশ্য লোভ থাকারই কথা, একটা কঙ্কালের দাম যদি হয় বিশ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং, যা আমাদের দেশের দুইশো কোটি টাকার চেয়েও বেশি।’ হেসে ওঠল রাহাত। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, ‘কঙ্কালটা ফেরত দিন, নয়তো এই কক্ষ থেকেই আপনার কঙ্কাল বের হবে।’ বলেই বেরিয়ে যেতে লাগলো রাহাত। রিহান চিৎকার করে ওঠল, ‘আপনার পরিচয় দিয়ে যান।’

ফিরে তাকালো না আর রাহাত৷ বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল বাহির থেকে। কক্ষটা আবারও অন্ধকার হয়ে গেল।

[[চলবে…]]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here