#জেদ,#পার্ট১০,১১
(A Conditional LoveStory)
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
পার্ট১০
.
হঠাত করে আরদ্ধকে দেখে চমকে উঠলাম আমি।আমার হাত থেকে কখন শাড়িটা পড়ে গেছে টেরও পাইনি। আরদ্ধ নেশাতুর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আর এক পা এক পা করে আগাচ্ছে আমার দিকে।আরদ্ধকে সামনে আগাতে দেখে আমি ভয়ে পিছাতে লাগলাম।কিন্তু কতদূরই বা যেতে পারব!এক পর্যায়ে পিঠ ঠেকে গেল দেওয়ালে।আমি দু হাতে নিজেকে ঢেকে চোখ বন্ধ করে নিলাম।
বেশ কয়েক সেকেন্ড যাবত ও ভাবেই আছি আমি।চোখ খুলতে যাব ঠিক তখনি আরদ্ধ আমার কোমড় পেচিয়ে ধরে ঠোটে ঠোট ডুবিয়ে দিল।
আমি চোখ বড় বড় করে আরদ্ধকে দেখছি।
আরদ্ধ একরাশ মাদকতা নিয়ে আমার ঠোট চুষছে।যেন খুব মিষ্টি কিছুর সন্ধান পেয়েছে সে।
আমার ঠোট ছেড়ে দিয়ে আরদ্ধ কুচিটা কোমড়ে গুজে দিল।আমি অবাক হয়ে দেখছি।কখন করল সে এসব!আমি কিছু জিজ্ঞেস করব তার আগেই বুকের মধ্যে আচলটা ঠিক করে দিয়ে বলল
-Now You’re looking like my queen.Stay here নড়বে না।
আমাকে দাড় করিয়ে রেখে আরদ্ধ আমাকে জুয়েলারি পড়াতে লাগল।আরদ্ধ একটা একটা করে জুয়েলারি চেক করছে আর বিরক্ত হচ্ছে।ওকে দেখে বেশ কনফিউজড লাগছে।
-কি হলো?সমস্যা কোন?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
আরদ্ধ মাথা না ঘুরিয়ে উত্তর দিল
-এই একটা সমস্যা।তোমাকে হেভি কোন জুয়েলারিতে মানায় না।আমি প্রতিবার তোমার জন্য জুয়েলারি কিনতে গিয়ে ঝামেলায় পরি।
-এই জন্যেই মেহরিন বলেছিল তোমার পার্টনারের ফ্যাশন সেন্স কম।
কথাটা বলেই আমি আচল ঠিক করতে মনযোগ দিলাম।আমি জানি আরদ্ধ আমার উপর রেগে যাবে এখন। মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। রাগলে ওকে খুব কিউট লাগে।ফর্সা গালগুলো আপেলের মত লাল হয়ে ওঠে।তখন ওর রাগ ভাংগাতে আমার বেশ লাগে।
কথাগুলো ভেবে আমি আনমনেই হেসে দিলাম।আচল ঠিক করে মাথা তুলে তাকাতেই কেপে উঠলাম আমি। আরদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে ফুসছে।ওর মুখের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ও রাগ দমানোর চেস্টা করছে।
আরদ্ধকে এই মুহুর্তে প্রচন্ড ভয় লাগছে আমার।আমি কাপা কাপা পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি।
-আরদ্ধ আমি…..
আরদ্ধ আচমকা আমাকে জাপটে ধরে ডান হাত দিয়ে আমার চোয়াল চেপে ধরে বলল
-তোমাকে না কতবার বলেছি আমাদের মাঝখানে অন্যকাউকে আনবা না!কে কি বলল কে কি ভাবল সেটা গোনার টাইম আমার নেই।I damnly don’t give a shit to them.একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো আমার পাশে শুধু তোমাকেই মানায়।আল্লাহ ইনায়াতকে শুধু আরদ্ধর জন্যেই বানিয়েছেন।You’re meant to be mine.Only mine.
আরদ্ধ আমাকে ছেড়ে দিয়ে রাগে গজরাতে গজরাতে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আমি হা হয়ে বসে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।বাব্বাহ কি এমনটা বললাম যে ছেলেটা এত রেগে গেল আমার উপর!আরদ্ধের চোখের এই রাগটাই আমি দেখেছিলাম যেদিন আমাকে প্রথমবার বলেছিল “ভালোবাসি”.
.
.
আরদ্ধর মুখ থেকে ভালোবাসি শোনাটা যতটা মোহনীয় ছিল তার চেয়েও বেশি কঠিন ছিল তাকে ভালোবাসা অনুভব করানোটা।প্রয়োজন আর প্রিয়জনের মধ্যকার পার্থক্য জানা ছিল না তার।তার যান্ত্রিকতায় ভরা জীবনে ভালোবাসার ছোয়া লাগানো যেন পাথরে ফুল ফোটানোর মতই কঠিন ছিল।শুরুতে এই পাহাড় কঠিন কাজটা নিজের অজান্তেই করে যাচ্ছিলাম আমি কিন্তু এত সহজে আরদ্ধের ভালোবাসা পাওয়া আমার সাধ্যে ছিল না।
আরদ্ধকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম তখন থেকেই ওর সবকিছুতেই যান্ত্রিকতার ছোয়া পেয়েছিলাম।কাজ করা থেকে শুরু করে কথা বলার ধরন পর্যন্ত যান্ত্রিক ছিল।আরদ্ধর আরেকটা ব্যাপার খুব অবাক লাগতো।সহজে রাগ করত না সে।কারও কোন ফাইলে কোন ভুল ত্রুটি হলে বা কোন মেইল সাবমিশনে লেট হলে আরদ্ধকে কখনোই রাগারাগী করতে দেখিনি আমি।শুধু হীমশীতল চোখে কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক তাকিয়ে থাকত সামনের ব্যক্তির দিকে।তাতেই যেন সেই বান্দার অন্তরাত্মা কেপে উঠত।শুরু থেকেই আরদ্ধকে আমার ব্যতিক্রম মনে হলেও আমি তার প্রতি কোন সফট কর্নার রাখিনি মনে।কাউকে ভালোবেসে না পাওয়ার কষ্ট টা আমার কাছে চরম অসহ্যনীয়।এই ব্যাথা আমি কখনো সহ্য করতে পারব কি না কে জানে! আরদ্ধ বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে।শুধু বড়লোক বললেও ভুল হবে যেন।সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছে সে।তবে বাবার পরিচয় দিয়ে খুব একটা পছন্দ করে না সে।যোগ্যতা আর দক্ষতায় তার বাবার চেয়েও কয়েকধাপ এগিয়ে সে।ফ্লোরিডা থেকে পিএইচ ডি শেষে দেশে ফিরে আসার পর তার বাবা চেয়েছিল আরদ্ধ যেন তার কোম্পানি দেখা শোনা করে।কিন্তু আরদ্ধের জেদ ছিল নিজের কিছু করার।নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধেই তার কোম্পানিকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে এসেছে সে।রুপ,গুন,যোগ্যতা দক্ষতায় আরদ্ধএর মত আর একটা পার্ফেক্ট ছেলে আমি আমার সারাজীবনেও খুজলে পাব বলে মনে হয় না আমার।
অপর দিকে মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে জন্ম নেওয়া সাধারন একটা মেয়ে আমি।বাবা মায়ের এক মাত্র মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা আদরের ছিলাম না।ছোট থেকেই বেশ কড়া শাসনে বড় হয়েছি আমি।মেয়ে হওয়ায় বাধ্যবাধকতা যেন একটূ বেশিই ছিল।বাবা মায়ের দায়িত্ব কমাতে একটা পাবলিক ভার্সিটী থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে জব করছি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে।আমার মত হাজারো মেয়ের ড্রিম বয় আরদ্ধ ।হাত বাড়ালেই যেকোন বড়লোক বাবার হাই কোয়ালিফাইড সুব্দর মেয়ের সাথে ঘর বাধতে পারত সে।কিন্তু এত সব মোহ ফেলে আমার নেশায় মগ্ন হওয়া ব্যাপারটা আজীবন আমার কাছে এক অমিমাংসিত রহস্য।
.
.
দিন গড়াচ্ছিল আমার প্রতি আরদ্ধের রুক্ষ্মতার মাত্রা বাড়ছিল।অফিসে বাইরে,ক্যান্টিনে যেখানেই সুযোগ পেত দু চারটে কড়া কথা শুনিয়ে যেত।তখন ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও এখন বেশ বুঝতে পেরেছি।আমাকে অফিসের কোন মেল কলিগের সাথে কথা বলতে দেখলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত সে।তার সাথে ছাড়া অন্য কারও সাথে এক মুহুর্ত সময় কাটাই ব্যাপারটা যেন সহ্য হত না তার।উহু না তখনো সে আমাকে ভালোবাসে নি ।ভালোবাসা ,আবেগ,অনুভূতি এই শব্দগুলার সাথে দূর দূরান্তের সম্পর্ক ছিল না তার ।তবে আমাকে পাওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছা জেগেছিল তার মনে।আমাকে নিজের করে রাখার জেদ চেপে বসেছিল তার মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে।অফিসে আমার কাজের সাথে বাড়ছিল তার জেদের মাত্রাও।আরদ্ধ রেওয়াত কোন কিছু চেয়েছে আর তা পাবেনা সেটা কি করে হয়!সুযোগ বুঝে আমাকে একদিন সাইট ওয়ার্কের নাম করে নিয়ে গেল আমার সবচেয়ে উইক পয়েন্টে।নদীতে…….
চলবে
#জেদ(A Conditional LoveStory)
#পার্ট১১
#আফরিন_ইনায়াত_কায়া
.
.
ভয় আর আতংক দুই মিলে এক অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করে আমার মধ্যে জলরাশির বিশালতা দেখলে।আরদ্ধ ব্যাপারটা খুব ভালো করেই বুঝেছিল “ফ্রাঞ্চাইরিজ কোম্পানির” লাঞ্চ মিটিং এ।
চায়না থেকে আগত বিজনেসম্যানেরা দুইদিনের জন্যে একটা রিসোর্ট বুক করেন।অফিসের গোলযোগের বাইরে একটা ক্লান্তিহীন পরিবেশে কাজ সম্পন্ন করার জন্যে রেওয়াত গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজকে ইনভাইট করা হয় তাদের সেই রিসোর্টে।বেশ সুন্দর করে সাজানো ছিল রিসোর্টটা।রিসোর্টের চারদিক দিয়ে বয়ে গেছে একটা কৃত্রিম খাল।সেই খাল পার করেই যেতে হবে রিসোর্টের মেইন ফটকে।খালের উপর বানানো ছোট্ট একটা কাঠের ব্রীজটাই রিসোর্টে যাওয়ার উপায়।কিন্তু মেরামত কাজের অবহেলা আর ভারী বস্তু বহনের কারনে দুই দিন আগে ধ্বসে পরেছে সাকোটি।গাড়ি কেন মানুষ চলাচলেরও অযোগ্য হয়ে পরেছে সেটি।তাই উপায়ান্তর না থাকায় নৌকা বিলাস করেই যেতে হবে ওপারে।নৌকাতে প্রথম বার পা রাখতেই যেন গা শিউরে উঠল আমার।নিজেকে সংযত রেখে বসে পরলাম ঠিক মাঝ বরাবর।পানি ভীতির কারনেই নৌকা ভ্রমন তো দূরে থাক কখনো পুকুর বা নদীর ধারে কাছেও যেতাম না আমি।অথচ সেই আমাকেই কিনা অজানা অচেনা একটা মানুষের সংগে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পাড়ি দিতে হচ্ছে।ভাগ্য যেন আমার সাথে ছিল।খাল পেরিয়ে মিটীংটা বেশ সুন্দর করে মিটীয়ে ফিরছিলাম আমরা।মনে মনে শুধু জপছি কখন নৌকা ওপারে পৌছাবে।কিন্তু কথায় বলে না!-“যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।“নৌকা পাড়ে পৌছাতে না পৌছাতেই তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি।
কাদামাটিতে পা পড়ায় পিছলে গিয়ে পানিতে পড়েছিলাম।ভাগ্য ভালো শুধু হাটু অব্দি ডুবেছিল।কিন্তু তাতেই আমার আত্মারাম খাচাছাড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম।চিতকার করে আর কেদেকেটে একেবারে একাকার অবস্থা আমার।আরদ্ধ আমাকে দেখে যতটা না বিরক্ত হয়েছিল তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছিল।আমাকে পাড়ে টেনে তুলার পরেও পাগলের মত আচরন করতে দেখে পুরোই বোকা বনে গিয়েছিল সে।অবশেষে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল এত চেচানোর কি আছে? হাটু জলে পরেছিলে।খালের মাঝখানে পরলেও তো ডুবতে না।এম্নিতেই ছোট এরিয়া তার উপর শুকনো মৌসুম চলে।
আরদ্ধর কথার জবাবে হালকা কাপুনি ছাড়া আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি। তবে গাড়ি থেকে নামার সময় বলেছিলাম
-হয়তো পানিতে ডুবে মরতাম না কিন্তু আমার পানি ভয় তার আগেই আমাকে মারর ফেলত।I am afraid of water.
কথাটা বলে এক সেকেন্ডের জন্যে আরদ্ধের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।আরদ্ধের যন্ত্রসচল চোখে সেদিন প্রানের অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম আমি।আরদ্ধকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমি সেদিন বাসায় চলে এসেছিলাম।
আরদ্ধ সেই সুযোগটাকেই ভালো করে কাজে লাগিয়েছিল।
.
.
অফিসের কাজ শেষ করে ডেস্ক গুছাচ্ছি আরদ্ধ আমাকে কল করে তার কেবিনে ডাকল।রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই এক গাদা ফাইল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
-মিস ইনা আপনার যদি সমস্যা না থাকে এই ফাইলগুলোর কাজ শেষ করে তারপর বাসায় যান।ফাইলগুলো আজকেই লাগবে আমার।
-বাট স্যার….
-প্লিজ….
আরদ্ধ অনুরোধ করলেও তার সুরে যে আদেশের একটা প্রগাঢ়তা ছিল সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলাম আমি।তাই কোন কথা না বলে ফাইল নিয়ে ফিরে আসলাম নিজের কেবিনে।
কাজ শেষ হল সন্ধ্যা নামার ঘন্টা খানেক আগে৷ফাইল জমা দিয়ে অফিস থেকে বের হব দেখি আরদ্ধ কেবিনে নেই।হয়তো চলে গেছে।আরদ্ধের টেবিলে ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখে বের হয়ে আসলাম আমি।অফিসের বাইরে পা ফেলতেই আরদ্ধের গাড়ি এসে রাস্তা আটকে দাড়াল আমার।জানালার কাচ নামিয়ে বলল
-এভাবে যেতে থাকলে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।Better আপনি আসুন আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।
ফোন থেকে মাথা না তুলেই বলল আরদ্ধ।আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করলেও আরদ্ধের কথার যৌক্তিকতা বুঝতে পেরে গাড়িতে উঠে পড়লাম।প্রায় ঘন্টাখানেক পথ চলার পরেও যখন বাসায় পৌছাচ্ছিলাম না।আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আরদ্ধের দিকে তাকাতেই সে বলল
-একজন ক্লাইন্ট টেক্সট করেছেন।একটা ইম্পরট্যান্ট কাজে যেতে হবে।Don’t worry.We’ll be back in half an hour.
মিনিট পাচেক পরে গাড়ি থামল একটা বড় লেকের পারে।ঢাকা শহরে এসব পানির আধারের অভাব নেই।কিন্তু এই লেকটা যেন অন্যরকম সুন্দর।প্রসস্থতে কোন ছোট খাটো নদীর সমান। গাঢ় সবুজ কচুরীপানার মধ্যে বেগুনী ফুল লেকের শোভা বাড়াচ্ছে।ভরা মৌসুমের কারনে দুকুল কানায় কানায় ভরা। ।কাছে যেতেই দেখতে পেলাম লাল গোলাপে সাজানো ছোট একটা নৌকা ভাসছে।আরদ্ধ পাড়ে গিয়ে দাড়াতেই মাঝি নৌকা নিয়ে এগিয়ে এল।আরদ্ধ এগিয়ে গিলে নৌকায় উঠল।আমি পাড়ে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে কাপছি। আরদ্ধ আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল
-ওখানে দাড়িয়ে আছ কেন? Get in.
আমি কাপা কাপা গলায় বললাম
-আমি না গেলে হয় না?
-যদি হতো তাহলে তোমাকে নিয়ে আসতাম না।এখন কথা না বাড়িয়ে চলে আসো।
কথাটা বলে আরদ্ধ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।আমি আরদ্ধের হাত ধরে নৌকায় উঠলাম।নৌকার একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছি আমি।ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এসে নৌকা থেমে গেল।আমি এক রাশ ভয় নিয়ে চোখ তুলে সামনে তাকালাম।আরদ্ধ দুহাত পকেটে গুজে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে।আমি কাপা কাপা গলায় বললাম
– কি হলো?নৌকা থেমে গেল কেন!
কিছু বলার আগেই মাঝি এক ঝাপ দিয়ে নৌকা থেকে পানিতে নেমে পড়ল। চোখের পলকেই সাতরে তীরে উঠে চলে গেল।এক পলকের জন্যেও ফিরে তাকাল না। আমার আত্মা যেন এবার খাচা ছাড়ার উপক্রম।তীব্র ভয় এসে গ্রাস করল আমাকে।চারদিকে রাগে ভয়ে কাপতে কাপতে বললাম
-মাঝি কোথায় গেল?আপনি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?কি চান আপনি?
-তোমাকে?
শান্ত শীতল কন্ঠে আরদ্ধ জবাব দিল।আরদ্ধের কথা শুনে আমি হতবম্ব হয়ে গেলাম।
-দেখ ইনায়াত আমার ঘুরায় পেচায় কথা বলার অভ্যেস নেই।আমি যা বলার সোজাসুজি বলতে পছন্দ করি।তোমাকে আমি পছন্দ করি।তোমাকে আমার চাই। I want you.
.
.
আরদ্ধের কথা শুনে অবাক হয়ে আছি আমি।ছেলেটার কি মাথা খারাপ হল নাকি! অথৈ জলে এনে আমাকে এসব কি বলছে সে!
না এখন মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হবে।উলটা পাল্টা কিছু বলা যাবে না।আমি নিজেকে সামলে বললাম
-দেখেন কাউকে ভালোলাগা আর ভালোবাসা এক জিনিস না।ভালোলাগা অস্থায়ী।আজ আছে কাল উবে যাবে৷ তখন আমাকে আর আপনার ভালো লাগবে না।
-তোমার কথায় ভুল নেই।কিন্তু এটাও তুমি অস্বীকার করতে পারবে না যে ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার শুরু হয়। আমার ভালোলাগা আমার জেদের মতোই দৃঢ়।আর আমি যখন কোন কিছুর জন্যে জেদ করি সেটা শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত টিকিয়ে রাখি।
– মি.আরদ্ধ এটা জরুরি না যে আপনি যাকে পছন্দ করেন তাকেও আপনাকে ভালোবাসতে হবে। I don’t love you.আপনার জেদের জন্য আপনি আমাকে বলির পাঠা বানাতে পারেন না।I cannot be with you.
আমার কথায় আরদ্ধ বেশ রেগে গেল।আমার কাছে তেড়ে এসে আমার দুই বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলল
– কতটুক জানো আমাকে?কতটুক চিনেছ তুমি আমাকে?একটা মানুষকে না জেনেই কিভাবে বলতে পারো যে তাকে তোমার পছন্দ না? কি জানো কি তুমি আমার ব্যাপারে?
আরদ্ধের ওরকম বিহেব দেখে আমি আরও ভয়ে কুকড়ে গেলাম।আমাকে ভয় পেতে দেখে আরদ্ধ আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাড়াল।
-ইনা ছোট থেকেই আমি যেটা জেদ করি যেটা পূরন করি।তোমাকে পাওয়া আমার লাইফের সবচেয়ে বড় জেদ। আর সেটা যদি পূরন না হয় তবে আমার থাকার কোন মানে হয় না।
কথাটা বলতে না বলতেই আরদ্ধ একটা লোহার রড দিয় নৌকাটাতে ফুটো করে দিল।পরপর বেশ কয়েকটা ছিদ্র করতে লাগল সে।ছিদ্র ছাপিয়ে ঘোলা জল চুয়ে উঠছে নৌকায়। এভাবে চললে ১০ মিনিট ও লাগবে না তলিয়ে যেতে। আরদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখি সে নর্বিকার ভাবে শীতল চোখে তাকিয়ে আছে।আরদ্ধর ফর্সা ধবধবে চেহারাটায় বিষন্নতার গাঢ় ছায়া ভর করে আছে।ভয় এর তীব্রতা আমাকে এতোটাই গ্রাস করে ফেলেছিল যে হিতাহিত ভুলে আমি চেচিয়ে উঠলাম
-Ok আপনি যা বলছেন তাই হবে। বাট আমার কিছু সময় লাগবে।আর সেটা তখনি সম্ভব হবে যখন আমি এখান থেকে বেচে ফিরব। So for God’s sake আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করুন।
আমার কথা শুনে আরদ্ধ ধীর পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এল।আমার কাছে বসে বলল
-সত্যি বলছ?
এবার যেন মেজাজ বিগড়ে গেল আমার।চট করে উঠে দাঁড়িয়ে চেচিয়ে বললাম
-আমার জানের উপর উঠে এসেছে আর আপনার মনে হচ্ছে এই রকম একটা মুহুর্তে আমি মিথ্যা কথা বলব!
আমার কথায় আরদ্ধ হাল্কা হেসে পকেট থেকে একটা ছোট বাক্স বের করল।আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে আমার ডান হাতটা টেনে নিল।অনামিকা আংগুলে একটা ডায়মন্ডের রিং পরিয়ে বলল
-ইনা আজ থেকে তুমি আমার। তোমার হাসি কান্না সুখ দুখ সব কিছুতেই আমি তোমার সাথে সমান ভাবে থাকব।আমি জানি এক না একদিন তুমি ঠিকই আমাকে মেনে নিবে। কারন জোর করে কারও অনুভুতি নিজের করে নেওয়া যায় না।তবুও যদি কখনও মনে হয় তুমি আমার সাথে থাকতে পারবে না তাহলে আংটিটা আমাকে খুলে দিও।আমি কোন প্রশ্ন ছাড়াই তোমাকে মুক্ত করে দিব।
আরদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে আমার কপালে একটা চুমু খেল।সেই প্রথম বার আরদ্ধ আমাকে স্পর্শ করল।ওরকম একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও আরদ্ধের অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ যেন আমার মনকে নাড়া দিয়ে গেল।এক মুহুর্তের জন্যে যেন ভুলে গেলাম আমি কোথায় আছি!কার সাথে আছি।আরদ্ধের যান্তিকতাকে ছাপিয়ে সেদিন প্রথম বারের মত তার মধ্যে একজন আবেগী মানুষের অস্তিত্ব খুজে পেয়েছিলাম আমি।
আরদ্ধ সরে দাড়াতেই আমি চোখ খুললাম।পাশে আরেকটা নৌকা এসে দাড়িয়েছে।আরদ্ধ আমাকে হাত ধরে টানছে সেটাতে যাবার জন্যে। কিন্তু আমি যেন জমে গেছি।নড়বার শক্তি টুকু পাচ্ছি না।এদিকে নৌকা প্রায় ডুবুডুবু অবস্থা।অর্ধেক নৌকা পানিতে তলিয়ে গেছে।আরদ্ধ উপায় না দেখে আমাকে পাজাকোলা করে তুলে নিল।
ভয়ের তীব্রতা হয়তো ফোবিয়া রোগীদের থেকে ভালো কেউ জানে না। গাড়িতে ফেরার পরেও যেন ভয় আমাকে ছাড়ল না।হাত পা কাপছে আমার ।আমার অবস্থা দেখে আরদ্ধ আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
-ইনায়াত আমি চাইলেও তোমাকে বলতে পারব না আমি তোমাকে ভালোবাসি।কারন ভালোবাসা শব্দটার সাথে আমি পরিচিত না।কীভাবে ভালোবাসতে হয় আমি জানি না।আমি চাই তুমি আমার লাইফে ভালোবাসার নতুন রঙ হয়ে আসো।আমাকে শব্দটার সাথে পরিচিত কর যাতে আমি সবটুকু দিয়ে তোমাকে ভালোবাসতে পারি।…….
চলবে