জীবন_সায়াহ্নে,পর্ব_২

জীবন_সায়াহ্নে,পর্ব_২
মারজানা হোসেন রোজী

হঠাৎ পুরোদেশ অস্থির হয়ে উঠে। দলে দলে লোকজন শহর ছেড়ে ছুটে পালিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে অস্থিরতা ছড়িয়ে গেলো গ্রামের পর গ্রাম। শহর পুড়ছে, মানুষ মরছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পুরো দেশে তখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম পাক বাহিনী! মতিহারদের বাড়ীর কারো মনে শান্তি নেই। মতিহারের বড় ভাই তার চার মাসের পোয়াতি স্ত্রী আর সুন্দরী ছোট বোনকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। যদিও তাদের গ্রামে বা আশেপাশের কোনো গ্রামে পাক বাহিনী প্রবেশ করেনি। কিন্তু আসতে আর কত সময়।
দেশের অবস্থা দিন দিন চরম খারাপের দিকে যাচ্ছে। মতিহারের বড় ভাই আর মেজ ভাই ইণ্ডিয়া ট্রেইনিং এ যেতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের সাথে নুরুন্নবী, আলিমসহ গ্রামের আরো জোয়ান ছেলেরা যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত। দেশ মাকে শত্রুসেনার হাত থেকে যে কোনো মূল্যে মুক্ত করতে তাদের জোয়ান রক্ত টগবগ করছে।

মতিহারের মা ছেলেদের চিন্তাতে খাওয়া নাওয়া বন্ধ প্রায়। সিদ্ধান্ত হলো মতিহারের ছোট ভাই সুলতান বাড়িতে থাকবে। সে মতিহারের থেকে বছর তিনের বড় হবে। বুদ্ধিতে কিছুটা খাটো। সরল সোজা ধরণের!

নুরুন্নবী যাবার আগে মতিহারের হাত ধরে বলল, “আমার জন্য অপেক্ষা কইরো! দেশরে মুক্ত কইরা একটা লাল সবুজ পতাকা তোমার হাতে তুইলা দিবো! সেইটাই তোমার বিয়ার উপহার! স্বাধীন দেশে দম খুইলা তুমি আর আমি নিঃশ্বাস নিবো। আমাগোর সন্তান নিঃশ্বাস নিবো। দেশ আমাগোর আলো দেয়, বাতাস দেয়! খাওয়াই পরাই বাঁচায় রাখে ,অনেক দিছে আমাগোরে! এইবার আমগোর দায়িত্ব দেশের জন্য কিছু করার! দেশ মায়ের সেবা করার এমন সুযোগ কই পাব, বলো। তুমি আমার জন্য অপেক্ষায় থাইকো। আমি ফিরবোই, ইনশাআল্লাহ! ”

মতিহার আর তার মা ভেজা চোখে হাসি মুখে বিদায় দেয় তার দুই ভাই, নুরুন্নবী, আলিমসহ গ্রামের আরো কয়েকজন যুবক ছেলেদের।

এরপরে মাস দুয়েক বেশ ভালোই চলছিল। মতিহারদের গ্রামে পাকবাহিনীর আনাগোনা তখনও শুরু হয়নি।

হঠাৎ একদিন সকালবেলা খবর পেল গ্রামে পাক বাহিনী ক্যাম্প করেছে। সবার চোখের ঘুম উধাও! সবচাইতে বেশি চিন্তা যাদের পরিবারের জোয়ান ছেলেমেয়ে আছে! জোয়ান ছেলেদের পেলেই ধরে নিয়ে যাচ্ছে তারা। আর মেয়েদের পেলেতো কথাই নেই। ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন আটকে রেখে শারিরীক, পাশবিক অত্যাচার চলতে থাকে। মতিহারের মায়ের দিন রাত কিভাবে যাচ্ছে সে টেরই পাচ্ছে না। একদিকে দুই ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। তারা বেঁচে আছে নাকি নেই সেই খবর পর্যন্ত জানে না। তার উপর ঘরে আরেক জোয়ান ছেলে। তবে সবচাইতে বেশি চিন্তা মতিহার আর তার ছেলে বউকে নিয়ে। অনেক চিন্তা করে সে মতিহারের ভাবীকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় । মতিহারের ভাবীদের গ্রামে তখনো পাকবাহিনীর ঘাঁটি হয়নি। তাছাড়া মতিহারের ভাবীর বাবা বেঁচে আছেন।
দুই গ্রাম বাদেই মতিহারের ভাবীর বাপের বাড়ি। সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরে মতিহারের ছোট ভাই সুলতান তার ভাবীকে নিয়ে তাদের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

মতিহারের মা কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুলতান ফিরলেই মতিহার আর তাকে নিয়ে সেও তার ভাইয়ের বাড়িতে চলে যাবে। তার ভাইদের ওখানে কিছুটা নিরাপদ মতিহারকে নিয়ে। অত গ্রামের ভেতরে পাকসেনারা নাও যেতে পারে ।এটুকুই ভরসা।

এদিকে নুরুন্নবীদের পরিবারেও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। পাকবাহিনী একবার যদি জানতে পারে এই পরিবারের কেউ মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তাহলে তাদের রক্ষে নেই।

যদিও নুরুন্নবীর বড় ভাইরা তাদের বউদেরকে আগেভাগেই এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে। নিজেরাও খুব সাবধানে চলাফেরা করছে। নুরুন্নবীকে কেন যুদ্ধে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছে এ নিয়ে সারাক্ষণই গালমন্দ করতে থাকে নুরুন্নবীর মা-বাবাকে তারা। সে যুদ্ধে না গেলে তাদেরকে এতটা টেনশন এ থাকতে হতো না। কোনরকম পাকবাহিনীর হাত-পা ধরে জীবনটা বাঁচানো যেত।
তার উপর নূরুন্নবীর বড় বোনের মেয়ে ফুল তাদের বাড়িতে থাকে। ছোটবেলায় তার মা মারা গিয়েছে বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে। নানা নানীর কাছেই তার আশ্রয়। বয়স কত হবে এই এগারো কি বারো ! বিয়ের কথাবার্তাও চলছে! মেয়েটা কথা বলতে পারেনা। কিন্তু দেশের এমন পরিস্থিতিতে বিয়ে-শাদী তো এখন দেওয়া দূরের কথা বেঁচে থাকাটাই যেন দায়! মতিহার আর তার মা প্রায়ই যায় তাদের খোঁজ খবর নিতে! নুরুন্নবীর মা খুব কান্নাকাটি করে ওদের পেলেই !

বিকেলের দিকে মতিহার তাদের বাড়ির সামনের লাউ শাকের মাঁচা থেকে শাক তুলছে। হঠাৎ পাশের বাড়ির হায়াত চাচা দৌড়ে এসে তাকে খবর জানাল সে বাজার থেকে আসার সময় খবর পেয়েছে পাকবাহিনী গ্রাম থেকে বেশকিছু লোকজনকে তুলে নিয়ে গেছে তাদের ক্যাম্পে। এর মধ্যে মতিহারের ছোট ভাই সুলতান আর তার বড় ভাবীও রয়েছে।

নিরাপত্তার জন্য মতিহারের ছোট ভাই ভাবীকে নিয়ে নৌপথে যাচ্ছিল। কিন্তু সেখানেও রেহাই মেলেনি। শকুনগুলি ঠিকই টের পেয়েছে।

খবরটা শুনে মতিহারের হাত-পা কাঁপছে। বুকের ভিতর লন্ডভন্ড ঝড় শুরু হয়ে যায়। কী করবে, কী না করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মা আসরের নামাজের জন্য মাত্র দাঁড়িয়েছে। নামাজে বসলে সে সহজে উঠে না। সিজদায় পড়ে বড় দুই ছেলের জন্য কান্নাকাটি করতেই থাকে। মতিহার তার মাকে কিছু না বলেই ছুটতে শুরু করলো ক্যাম্পের দিকে। সেখানে গেলে তার জন্য যে বিপদ ওৎ পেতে আছে এ নিয়ে তার কোনো চিন্তাই যেন নেই। তার দুই ভাইকে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিয়ে । আদৌ বেঁচে ফিরে আসবে কিনা তারা কেউই জানেনা। এখন যদি ছোট ভাই আর বড় ভাইয়ের সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর কিছু হয় তাহলে মতিহার আর তার মায়ের বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বনই অবশিষ্ট থাকবে না।
ক্যাম্প গ্রামের একদম ও মাথাতে হওয়াতে মতিহারের সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় এশার ওয়াক্ত হয়ে গেল। তার সাথে কেউই নেই। সে জানে জেনেশুনে কেউই এই মৃত্যুমুখে পা বাড়াবে না। তাই কারো কাছে হাত জোড়ও করতে যায়নি সে।
ক্যাম্পে ঢোকার মুখেই মতিহারের সাথে দেখা হলো তাদের গ্রামের ছেলে মিন্টুর সাথে। মিন্টুর সাথে কথাবার্তা বলে যা বোঝা গেল তা হচ্ছে মিন্টুর সাথে পাকবাহিনীর লোকজনের খুব ভাব। অর্থাৎ মিন্টু রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে ক’দিন হলো। মিন্টুর কাছে জানতে পারল তার ভাই আর ভাবীর সম্পর্কে। মতিহারের ভাবীকে এখানকার মেজর সরফরাজ পাঠান তার খাস কামড়াতে নিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে! আর তার ভাই সুলতানকে হাত পা বেধে ফেলে রাখা হয়েছে টর্চার সেলে। মতিহার কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার হাত পা কাঁপছে। সে ধপ করে মিন্টুর পায়ের কাছে বসে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিন্টুকে অনেক অনুনয় বিনয় করার পরে সে বুদ্ধি দিলো মেজর সাহেবের হাত থেকে এখন একমাত্র মতিহারই পারে তার পোয়াতি ভাবী আর ভাই সুলতানকে বাঁচাতে। মিন্টুর কথামতো মতিহার রাজি হয়ে গেল। ভালো-মন্দ চিন্তা করার সময় এখন না! তার ভাবীর জীবনের চাইতে তার জীবনের মূল্য এখন খুবই তুচ্ছ!

সরফরাজ পাঠান। ক্যাম্পের মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। টগবগে জোয়ান পুরূষ। মতিহারের মন চাইল একদলা থুথু ছিটিয়ে দেয় মুখের উপর। কতবড় অমানুষ হলে এমন নির্দয় হয়!
“একটা পোয়াতি মাইয়া মানুষের প্রতিও তোর দরদ হয় না? ছিঃ!”

মিন্টু কিছুটা আড়ালে গিয়ে কি কি বলল। সরফরাজ পাঠান দূর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মতিহারকে আগাগোড়া ভালো করে দেখে নিলো। মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই সে গিলে ফেলছে মতিহারকে। কিছুক্ষণ পরে তার নির্দেশে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় সুলতানকে হাজির করা হলো। সুলতানের বাঁধন খুলে দিয়ে তার কাছে তার বড় ভাবীকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। মতিহার তাদের থেকে কিছুটা আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। সুলতান কিছুই বুঝে ওঠে না! এতটা দরদ তাদের প্রতি হঠাৎ করে কেন হলো এই অমানুষগুলোর ! তার বড় দুই ভাই মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে! মূলত পাকবাহিনীরা এই খবরটি জানতে পেরেই তাদেরকে ধরে এনেছিল!
মিন্টু তাদেরকে সাথে করে নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। সুলতান আর তার বড় ভাবী ভয়ে কোন কথাই বলে না। ইজ্জত আর জীবন দুটোই ভিক্ষে পেয়েছে এর থেকে বড় আর কি চাই! কোন কারণ জানতে আর ইচ্ছে হয় না তাদের!

মতিহারকে সরফরাজের খুব মনে ধরল। মরা লাশের সাথে সম্পর্ক করার চাইতে এমন একটা মেয়েকে হেলায় হাতছাড়া করার মত বোকা সরফরাজ না। প্রতিদিন ক্যাম্পে নানা জায়গা থেকে মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে এসে তাদের উপর নির্যাতন করা হয়। আধমরা মেয়েগুলির উপর পৌরুষত্ব দেখাতে গিয়ে শারীরিক সুখ কিছুটা পাওয়া গেলেও মানসিক সুখ আর মেটে না। মাত্র কিছুদিন আগে বিয়ে করেছে সে। দেশের প্রয়োজনেই নতুন বউকে ঘরে রেখেই ছুটে এসেছে এই দূর দেশে!

মতিহারকে সে যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। এমন একটা সুন্দরী মেয়ে স্বেচ্ছায় তার কাছে এসে ধরা দিয়েছে এটা সে ভাবতেই পারছে না। আর মতিহারের ব্যবহারে মনেই হচ্ছে না যে মতিহারের সাথে তার পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের। মেয়েটা শিক্ষিতা। অন্য মেয়েদের মত মূর্খ না। স্মার্ট আর সুন্দরী। টুকটাক ইংলিশও জানে। খুব মনে ধরল সরফরাজের। মনে মনে নিজের ক্ষমতার একচোট প্রশংসা না করে পারল না। মতিহারের কাছে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীও কিছুই না।
দিন কয়েকের মধ্যেই মতিহারকে যেন সে তার প্রেয়সীর স্থান দিয়ে দিয়েছে খুব সামান্য সময়ের পরিচয়েই। খুবই উচ্ছল আর চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। তার প্রাণোচ্ছল হাসিতে পাঠান সাহেবের মন শীতল হয় এক নিমিষেই। বাশির সুরের মত কণ্ঠ মতিহারের। ক্যাম্পের বাকি সবাইও যে আড় চোখে মতিহারকে দেখে সেটা পাঠান সাহেব নিশ্চিত। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তার বলিষ্ঠ পৌরুষত্ব আর ক্ষমতার জোরে এমন খাঁটি জিনিস তার দখলে! ভাবতেই শিহরণ জাগে পাঠান সাহেবের। টানা এতদিন ধরে মতিহার তার সাথে আছে। একবারও বাড়িতে যাওয়ার কথা পর্যন্ত বলেনি। মতিহারের চলাফেরা দেখে বোঝার উপায় নেই যে পাশে পাঠান সাহেবের স্ত্রী নাকি রক্ষিতা! সরফরাজ পাঠানের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-আশাক, সেবাযত্ন সব দিকেই সমান খেয়াল তার!

তার কাছে ধীরে ধীরে অনেক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে গেল মতিহার। মাঝে একদিন কথাচ্ছলে সে ক্যাম্প থেকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি চাইল সরফরাজের কাছে! পাঠান সাহেব চুপচাপ কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে রাজি হয়ে গেল তাকে বাইরে যেতে দিতে।
বন্দি পাখির মতো ছটফট করতে দেখতে চায় না সে মতিহারকে। একরকম বলা চলে মতিহারের আচার-ব্যবহার, রূপ-যৌবন সবকিছুই সরফরাজকে মুগ্ধ করেছে। সে প্রেমে পড়েছে মতিহারের। তার মনে মনে ইচ্ছা মতিহার যদি তার সাথে পাকিস্তান যেতে চায় সে তাকে সেখানেও নিয়ে যাবে। প্রয়োজনে তাকে বিয়ে করবে। মতিহার সেদিন আর ক্যাম্প থেকে বেরুলো না। আরো বেশ কিছুদিন পরে সেখান থেকে বেরুলো মায়ের সাথে দেখা করতে যাবার জন্য । পাঠান সাহেবের জন্য খুব দরদ মতিহারের তাই সে তাকে ছেড়ে সহজে যেতে চাচ্ছে না এমন একটা ভাব যেন! মতিহারের ব্যবহারে যারপরনাই খুশি পাঠান সাহেব।

হঠাৎ রাতে একটা মেয়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মতিহার এগিয়ে গেল। মেয়েটিকে দেখেই চিনতে পারল। তাদের গ্রামের আমির চাচার ছোট ছেলের বউ। সাত মাসের পোয়াতি। তার কান্না শুনে কলিজা ফেটে যাচ্ছে মতিহারের। সে দৌড়ে ছুটে গেল পাঠান সাহেবের কাছে। যদিও পাঠান সাহেব মতিহার ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে আর অ্যালাউ করে না তার কক্ষে। কিন্তু অন্যান্য জানোয়ারগুলোর মনোরঞ্জনের জন্যই প্রতিদিনই গ্রাম থেকে কোনো না কোনো মেয়েদেরকে ধরে নিয়ে আসা হয়। মতিহার পাঠান সাহেবের পা জড়িয়ে ধরে আমির চাচার ছেলে বউয়ের জীবন ভিক্ষা চাইল। সে পাঠান সাহেবের কাছে বলল, একজন গর্ভবতী মায়ের সাথে এতটা অমানবিক অত্যাচার সেই মায়ের জন্য কতটা কষ্টকর! সে তাকে পাঠান সাহেবের মায়ের কথা মনে করিয়ে দিলো! এতদিনে মতিহারের আচার ব্যবহার ও সেবা যত্নে অমানুষটার মনে কিছুটা হলেও মনুষত্ব জেগে উঠেছে। সে দ্রুত পায়ে ক্যাম্পের সকলকে এক জায়গায় ডেকে জানিয়ে দিলো এখন থেকে যেন আর কোনো পোয়াতি মেয়েকে ক্যাম্পে নিয়ে আসা না হয়। এবং এখনই ক্যাম্পে যেসব পোয়াতি মেয়েরা আছে তাদেরকে সসম্মানে তাদের বাড়ীতে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে আদেশ দিলো। ক্যাম্পের অমানুষগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে এর পিছনে মতিহারেরই হাত। মাথা নিচু করে তারা মেজর সাহেবের অর্ডার ফলো করল।

প্রায় মাসখানেক পরে মতিহার তার নিজ গ্রামে ফিরে গেল। তবে পাঠান সাহেবকে কথা দিয়ে এসেছে সন্ধ্যার আগেই সে ফিরে যাবে ক্যাম্পে। পাঠান সাহেব তাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করেছে। বিশ্বাস না করলেও কোন সমস্যা নেই। সে যদি স্বেচ্ছায় ফিরে নাও আসে কিভাবে আনতে হয় সে পদ্ধতিও জানা আছে পাঠান সাহেবের। সে চায় মতিহারের মনে তার জন্য ভালোবাসা সৃষ্টি হোক, সম্মান তৈরি হোক। কোন আতঙ্ক বা ভয় নয়। এই সুযোগে মতিহারকে পরীক্ষা করারও ভালো একটা চান্স মিলে গেল তার।

মতিহার গ্রামে ফিরে এসেছে। পুরো গ্রামে মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামের সবাই তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছে। সে এটার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তবে তার সব চাইতে ভয় হচ্ছে তার মায়ের সামনে কি করে দাঁড়াবে! মিন্টুর কাছে খবর পেয়েছে তার মা তার চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছে। তার ভাবীও আর বাপের বাড়িতে যায়নি। অসুস্থ শাশুড়িকে রেখে কিভাবে যায়! যা হবার হবে! যমের মুখ থেকে তো একবার ফিরে এসেছে! তার উপরে তার প্রিয় ননদ মতিহার এই এক মাস ধরে নিখোঁজ! নিখোঁজ বললে অবশ্য ভুল হবে। তারা খবর ইতিমধ্যে পেয়ে গিয়েছে! তবে তাদের কাছে খুব অবাক লাগে মেয়েটা এমন কাজ কেন করল!

মতিহারকে দেখে মতিহারের মায়ের যেন প্রাণ জুড়াল! মেয়ে একদম ভালো আছে! বুকে জড়িয়ে নিল মতিহারকে! হঠাৎ করে কি মনে করে এক ধাক্কায় মেয়েকে বুক থেকে ছাড়িয়ে একদলা থুথু ছিটিয়ে দিল তার মুখে! মতিহার পরম যত্নে তার ওড়নার আঁচলে মায়ের দেওয়া উপহারটুকু মুছে নিল। মেয়েকে নানান ধরনের অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি শুরু করল এবং বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললো ।
মতিহারের চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ধারা বইছে। কি বলবে সে তার মাকে? কেন সে স্বেচ্ছায় এই জীবন বেছে নিয়েছে?
তার ভাই সুলতান দূর থেকে শুধু তাকে দেখছে। কাছে এসে একটু কথা বলার রুচি হচ্ছে না আদরের ছোট বোনের সাথে।
মতিহারের ভাবী এগিয়ে এসে মতিহারকে টেনে নিয়ে গেল আড়ালে। মতিহারের ভাবীর অনেক জোরাজুরি করার পরে মতিহার তার বান্ধবীর মতো ভাবীর কাছে আর মিথ্যে বলতে পারল না। সবকিছু খুলে বলল তাকে! মতিহারের আত্মোৎসর্গের কাহিনী শুনে তার ভাবীর কৃতজ্ঞতায় রক্ত হিম হয়ে এলো। চোখ থেকে ছল ছল করে অশ্রুবান যেন ঝর্ণাধারায় বইতে লাগল।

পেট ভরে ভাত খেলো বহুদিন পরে আজ মতিহার। অনেকদিন পরে তাদের বাড়িঘরে ভালো মন্দ রান্না হল আজ। গাছের লাউ দিয়ে মুরগীর ঝোল মতিহারের খুব পছন্দ। তার ভাবী প্লেটে তুলে খাওয়াচ্ছে।
মতিহারের মায়েরও ভুল ভাঙলো। মেয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখ ভিজে উঠল। কিন্তু সে এই নরকে আবার ফিরে যেতে দেবে না তার মেয়েকে কিছুতেই। মতিহার তার মাকে বোঝাল। তার বড় দুই ভাই যুদ্ধে গিয়েছে। এটাই তাদের বড় অপরাধ। আর এই অপরাধে তার ছোট ভাই আর ভাবীকে বাঁচানোর এর চাইতে ভালো কোন উপায় আর তার জানা নেই। তবে সে তার মাকে কথা দিলো এখন থেকে প্রায় দিনই চেষ্টা করবে একবারের জন্য হলেও বাড়িতে ফেরার। ক্যাম্পের খাবার মতিহার ভালো খেতে পারেনা এজন্য একটা পোঁটলায় করে মেয়ের জন্য রাতের খাবার দিয়ে দিলো মতিহারের মা। বিকেল হতেই রওনা হয়ে গেল মতিহার।

মতিহার ফিরে এসেছে দেখে পাঠান সাহেব মহা খুশি। সে তার নিজের জন্য নিয়ে আসা খাবার দাবার পাঠান সাহেবকে নিজ হাতে খাইয়ে দিলো। পাঠান সাহেবের প্রতি এত দরদ দেখে সে মতিহারকে প্রয়োজনের থেকেও বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করল। ধীরে ধীরে মতিহার তাকে বোঝাতে সক্ষম হলো যে সেও এদেশের স্বাধীনতা চায় না। তার বড় দুই ভাইয়ের বোকামির জন্য সে খুবই দুঃখিত।

মতিহার এখন প্রায় দিনই বাড়িতে যায় এবং আসার পথে পাঠান সাহেবের জন্য কিছু না কিছু অবশ্যই নিয়ে আসে।
হঠাৎ মতিহার একদিন বাড়ি ফিরে তার ভাই সুলতানের কাছে খবর পেলো আলিম রাতের আধারে বাড়ি ফিরেছে। সে গোপণে আলিমের সাথে দেখা করলো। সে তার ভাইদের আর নুরুন্নবীর খোঁজখবর নিলো। তার ক্যাম্পের বন্দী জীবন সম্পর্কে আলিমকে সবকিছু খুলে বলে। আলিম ব্যাপারটা বুঝতে পারে । আপাতত তার ভাইরা বা নুরুন্নবী কাউকে না জানানোর প্রতিশ্রুতিও করলো আলিম। মতিহার জানে নুরুন্নবী কোনোদিনই তাকে ক্ষমা করবে না। বিয়েতো দূরের কথা!

আলিমরা এই গ্রামের পাকসেনাদের উপর আক্রমণের প্লান করছে। মতিহারকে গুরুদায়িত্ব দেয়া হলো ক্যাম্পের খোঁজখবর জানানোর। মতিহারও এতদিনে মনের মত একটা কাজ পেয়ে চাঙ্গা হলো যেনো। আলিম জানালো,
আগামীকাল তাদের বড় একটা গ্রুপ আসছে। যে করে হোক পাক বাহিনীর কানে খবরটা পৌছাতে হবে। পাক বাহিনীরা গ্রামে ঢোকার ব্রীজে ওঠা মাত্রই ব্রীজ উড়িয়ে দেয়া হবে! আমরা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবো!
সরফরাজের কাছে মতিহারের বিশ্বস্ততা অর্জন করতেই মূলত এই পন্থা! এক ঢিলে দুই পাখি মারার আইডিয়া!

ওইদিনই হাঁপাতে হাঁপাতে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে মতিহার ক্যাম্পে পৌছালো! পাঠান সাহেবের কাছে খুব টেনশনে আছে এমন ভাব দেখিয়ে গালাগালি করে মুক্তিবাহিনীর চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে বলল,” গ্রামে আর শান্তি রইল না। আগামী কাল নাকি ক্যাম্পে হামলা করতে সন্ধ্যা টাইমে দুই গাড়ি মুক্তিবাহিনী ঢুকবে!” গোপণে কথা বলেছিলো তার মা আর ভাবী। বলার সময় তার মা আর ভাবীর কথাপোকথন শুনে ফেলছে মতিহার! বড় ব্রীজের ওপারে মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি।

মতিহারের কথা শুনে সজাগ হল সরফরাজ পাঠান। দ্রুত ক্যাম্পে মিটিং বসল! রাতে সরফরাজ অনেক দেরী করে কক্ষে আসলো। মতিহার টেনশনে আছে এমন ভাব নিয়ে সরফরাজকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ” কালকে আপনি কিন্তু যাইতে পারবেন না! আপনার কিছু হইলে আমি বাঁচব না! ”
সরফরাজ যে কালকের অপারেশনে নিজে যাবে না সেটা মতিহার ভালো করেই জানতো! সরফরাজ তাকে অভয় দান করে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

মতিহার তাকে জানাল, সে সরফরাজের সাথে পাকিস্তান যাবে। প্রয়োজনে সরফরাজ এর বউয়ের দাসী হয়ে থাকবে তাও সরফরাজকে ছাড়া থাকতে পারবে না। সরফরাজও তাকে আশ্বস্ত করল সেও মতিহারকে ছাড়া বাঁচবে না। দেশে ফিরেই সে মতিহারকে বিয়ে করবে!

পরেরদিন রাতে ক্যাম্পে হঠাৎ থমথমে অবস্থা! মতিহারের সন্দেহই সত্যি। গ্রামে মুক্তিবাহিনী ঢুকছে। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত হামলায় দুই জিপ পাকসেনাকে গ্রামে ঢোকার সাঁকোর উপরে হত্যা করা হয়েছে।
সরফরাজ পাঠান সারারাত পায়চারী করেই কাটাল। সকালে জরুরী মিটিংয়ে যোগ দিতে তিনদিনের জন্য ঢাকায় গেল সে। মতিহারও তার বাড়িতে ফিরে গেলো। এ কয়টা দিন থাকবে মায়ের বুকে।

এতবড় সফলতায় মতিহারের মনে যেন ফাগুনের ফুরফুরে হাওয়া বইছে।
এদিকে পাকবাহিনী তাদের পরাজয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে হিংস্র পশুর মত পুরো গ্রামে, আশেপাশে মুক্তিবাহিনীর খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছে। যাকে পারছে মারছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে!

সন্ধ্যার দিকে মতিহাররা মাগরিবের নামাজ শেষ। করে দোয়া দুরুদ পড়ছে হঠাৎ মতিহারদের উঠানে এসে গগনবিদারি চিৎকার দিয়ে উঠল নুরুন্নবীর মা আমেনা বেগম।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here