ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ১৬ শেষ
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতটা যেমন কষ্টে কাটলো, সকালটা তার চেয়েও বেশি চমক এনে দিলো।
ফাইজার আজ হাউমাউ করেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কখনো ভাবেনি, এমন সারপ্রাইজও অপেক্ষা করছে তার পরবর্তী জীবনে! সকালে রাইসা এসেছে তাদের দেখতে। শুধু রাইসাই নয়, সাথে এসেছে তার প্রাণ প্রিয় মা! যার মুখটা দেখে না আজ প্রায় সাত বছর হতে চলেছে! সেই মা নাকি বাচ্চাদের নিয়ে ফাইজার একাকিত্বের খবর পেয়ে ছুটে চলে এসেছে! হৃদয়টা ভীষণ রকমের কাঁপছে ফাইজার। চোখ ভিজতে বিন্দুমাত্র সময় নেয়নি। মায়ের চেহারাই দেখতে পারছে না এই অশ্রুপাতের যন্ত্রণায়! একটা মুহুর্ত কাটলো মা মেয়ের জড়াজড়ি কান্নায়! নওরিন হা করে তাকিয়েছিলো শুধু। খালামনিকে সে চিনে, ভিডিও কলে কথা হয়েছে। কিন্তু নানুকে চিনে না। নানু কাকে বলে, নানুর সাথে তার সম্পর্ক কেমন হবে কিছুই জানে না। নানা-নানু, দাদা-দাদুর আদর কখনো পাবে না মেয়ে, তাই এই শব্দগুলোর সাথে সেভাবে পরিচয় হতে দেয়নি তারা। ফলশ্রুতিতে সবটা অজানাতেই রয়ে গেছে। নোমান তো সামনেই আসেনি তাদের দেখে! তারা আসার সময় কেবিনের এক কোণে ছিলো, পরে বাইরে বেরিয়ে গেছে। তবে দূরে যায়নি। কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক রাশ লজ্জা ও অপরাধবোধ নিয়ে। তাদের মেয়ে নিয়ে পালিয়ে এসেছিলো যে সে! এদিকে রাইসা নবজাতকদের দেখে, নওরিনের নাক টেনে বললো,
“এই, চোরের পাকা মেয়ে! বাবাই পালিয়ে গেলো কেন আমাদের দেখে?”
“আমার বাবাই চোর না!”
নওরিনের যেন মানে লেগে গেলো কথা। তাই ক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে ফেললো সাথে সাথেই। রাইসা হেসে, তার পাশে হাটু ভেঙে বসে দুহাতে গাল চেপে ধরলো নওরিনের। কপালে চুম্বন করে বললো,
“ইশ! বাবাইয়ের রাজকন্যা। চোর না হলে চুরি করলো কেন তোমার আম্মুকে?”
“আম্মু, বাবাই তোমাকে চুরি করেছে?”
ফাইজা মুখে আনন্দের হাসি রেখে চোখ মুছে ঘাড় কাত করে রাইসার দিকে তাকালো। তাকানোর ভঙ্গিমাতেই যেন বলছে, কেন অযথা মেয়েকে ক্ষেপাচ্ছে! তারপর মেয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“না, খালামনি দুষ্টুমি করছে।”
নওরিন নাক কুচকে রাইসাকে বললো,
“তুমি একটা পঁচা!”
রাইসা মুখ এগিয়ে বললো,
“তবে একটা উম্মা দাও, ভালো হয়ে যাবো।”
নওরিন তার মুখ ধরে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো,
“আর কখনো আমার বাবাইকে চোর বলবে না। জানো, এগুলো বলা ভালো না।”
“আচ্ছা বাবা, বলবো না।”
নাকে নাক ঘঁষে উঠে দাঁড়ালো রাইসা। তার পাকামো দেখে নানু এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলো। দুই গালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। নওরিনের চোখেমুখে বিস্ময়ের খেলা দেখে ফাইজা বললো,
“নওরিন, নানু হয় তোমার। তুমি যেমন আমার এক মা, ইনি আমার আরেক মা। আমি যেমন তোমাকে খায়িয়ে দেই, পড়াই। তোমার মতো ছোট থাকতে আমার মা-ও আমাকে খায়িয়ে দিয়েছে, পড়িয়েছে।”
“স্কুলে নিয়ে যায়নি?”
তার কথায় উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো। তার নানুই জবাব দিলো,
“আগের দিনের বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে হয়নি। একা একাই যেতে পেরেছে।”
“এখন পারে না কেন?”
“এখন যে বাচ্চারা বেশি পাকামো করে, সেজন্য।”
বাইরে দাঁড়িয়ে সবই শুনতে পাচ্ছে নোমান। রাইসা বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে বললো,
“এখানে দাঁড়িয়ে কেন, ভাইয়া? ভেতরে আসুন।”
“না, ঠিক আছে। নাস্তা করেছো? কি খাবে, বলো। নিয়ে আসি।”
“আরে, খাওয়াদাওয়া পরে। আসুন, কথা হোক আগে।”
রাইসার সাধাসাধিতে আবার ভেতরে এলো নোমান। শ্বাশুড়িকে সালাম দিলো। তিনি সালামের জবাব দিয়ে স্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক আচরণই করলেন। নওরিনকে কোল থেকে নামিয়ে বাচ্চাদের কোলে নিলেন। বাচ্চাদের নিয়ে মেয়ের এমন পরিস্থিতিতে পড়ার খবর পেয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেননি সুরাইয়া। তিন বাচ্চা নিয়ে একা একা কিভাবে কি করছে ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন গতকাল থেকেই। তাই ফাইজার বাবা ও ভাইয়া না এলেও তিনি রাগ, অভিমান ছুড়ে ফেলে ছুটে এসেছেন ছোট মেয়ের সাথে। নওরিন একবার নানুকে বলছে তার ভাইয়াদের নাম, আবার খালামনিকে বলছে। কিছুক্ষণ পর রাইসা চলে গেলেও তিনি থেকে গেলেন এখানে। নানুর সাথে গল্পে গল্পে ভালো ভাব জমিয়ে নিয়েছে নওরিন। বিকেলে রাইসা আবার এসে নওরিনকে সাথে নিয়ে গেছে। সে যেতে চাইছিলো না, তবুও নানান বুঝ দিয়ে ফাইজা ও নোমান পাঠিয়েছে তাকে। এখানে ঘুমাতে যে বেশ কষ্ট। তবে পরেরদিন সকালে মুখে গম্ভীরতা নিয়ে ফিরেছে এখানে। বাবামায়ের সাথে সে কি অভিমান! রাইসা জানালো রাতে কান্না করেছে ঘুমানোর আগে। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘুম পাড়াতে ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে। বাড়ির সবাই-ই যত্ন করতে চাইলো কিন্তু বাবামাকে ছাড়া সেই যত্নও সাদরে গ্রহণ করলো না সে। অবশেষে এখন নোমান তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরে অভিমান ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছে। আজ বিকেলেই হসপিটাল ছেড়ে বাড়ি ফিরে এসেছে তারা। দুদিন তাদের বাড়িতে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছে সুরাইয়া। বাচ্চাদের আকিকা দিবে তাই আরও দুদিন থেকে যেতে বলেছে নোমান ও ফাইজা। বাসায় কাজের লোকও রাখতে চাইছিলো নোমান। কিন্তু কাজের লোকের বড্ড অভাব! দুদিন ঘুরে না পেয়ে থামিয়ে দিয়েছে খোঁজাখুঁজি। ফাইজাও যেন মত দিচ্ছিলো না তাকে কাজের লোক রাখতে। অবশেষে চারটা খাসি কিনে সপ্তম দিনেই আকিকা দিলো। মিষ্টি এবং মাংস নিয়ে আজ বহুদিন পর নিজ বাড়িতে গেছে নোমান। শেষ গিয়েছিলো নওরিনের জন্মের পর। সেদিনও মিষ্টি এবং মাংস দিয়ে এসেছে। নানুকে পেয়ে কি খুশি হয়েছে নওরিন, তা দেখে আজ দাদুর সাথে দেখা করাতে নিয়ে গেলো। এতোদিন পর বাড়ি এসে কেমন পরিবর্তন লাগছে সব! হ্যাঁ, পরিবর্তন ঠিকই হয়েছে। ঘর দুইটা ভাগ হয়ে গেছে। ঠিক ঘর নয়, ঘরের মানুষগুলো! সংসার আলাদা করে যার যার মতো গুছিয়ে নিয়েছে দুই ভাই। মাঝখানে আগাছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা মা। বাবা ভীষণ অসুস্থ, কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছে আরও বছর দুয়েক আগে৷ এখন ঘরেই তার বসবাস। মাঝে মাঝে একটু বাড়ির বাইরের দিকটায় হাটাহাটি করেন। মা-ও বাবার যত্ন নিতে নিতে বার্ধক্যে নেমে যাচ্ছে। অথচ তার মা কত পাকাপোক্ত একজন নারী ছিলেন! এই আগাছারা এখন এক সপ্তাহ বড় ছেলের ঘরে খায়, এক সপ্তাহ খায় মেজো ছেলের ঘরে। তা-ও একাধারে নানান দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে দুই ভাইয়ের মাঝে কিংবা বাবামায়ের সাথেই। কত খোটাও দিয়ে ফেলে বাবামায়ের মুখে তুলে দেওয়া দুই মুঠো ভাতের! তবুও নির্লজ্জের মতো বেঁচে থাকার প্রত্যাশায় ডালভাত গিলে যায় এই বাবামা। খোটা দিবেই না কেন! সবারই বউ বাচ্চা আছে। নেই পর্যাপ্ত আয়। যে আয় হয়, তাতে বউ বাচ্চাদেরই টান পড়ে যায়। আবার বাবামায়ের ভার কে নিতে চায়! বয়স বাড়লে তো মানুষ বোজা হয়ে ঘাড়ে দাঁড়ায়!
কিন্তু এসব শুনতেই যেন নোমানের রক্তমাংস উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। এতোদিন বাবার খেয়ে এখন বাবাকে খাওয়াতে বোজা মনে হয়? যখন বাবার খেয়েছে, তখন কি বাবার ঘাড়ে বোজা হয়েছিলো না তারা? তবুও কিছু বললো না ভাইদের। কি আর বলবে, সে-ও তো করছে না। মূলত সে সুযোগই পায়নি করার। তবে করবে কি করে বাবামাকে? হয়তো বাড়ি-গাড়ি নেই, কিন্তু আল্লাহর রহমতে তার আয় আছে যথেষ্ট। আয়ের দিক থেকে সে ভাইদের উপরে।
বউ বাচ্চার প্রয়োজন মিটিয়েও দিব্যি চলে যায়। রহমতের বর্ষণ চলমান থাকলে ভবিষ্যতে বাড়ি গাড়িও হবে, সেই প্রচেষ্টা চলছে নোমানের৷ সে এক্ষুনি বাবামাকে রাগ দেখিয়ে বললো তার সাথে চলতে। কারো ভাগাভাগির অংশীদার হবে না সে। এককভাবেই দায়িত্ব নিবে বাবামায়ের। সে বউ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে পারলে, বাবামায়ের দায়িত্বও নির্দ্বিধায় নিতে পারবে। আকিকার মাংস ও মিষ্টি দু ঘরেই বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। হাসিমুখে কথাও বলেছে সবার সাথে৷ রাগ শুধু বাবামায়ের ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বাবা তো একটা শব্দও করলো না অভিমানে। মা দুঃখের কথা বলে বলে চোখ ঝরালো শুধু। ভাইদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার পর মেজো ভাই তো খোঁচা মেরে বলেও ফেলেছে, এতোদিন পর বাড়ির দখলদারি নিতে এসেছে কি না। নোমানও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। সে জবাব দিয়েছে,
“আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট দিয়েছে, তা নিয়ে আমি সন্তুষ্ট আছি ভাইয়া। জমি দখলদারির মানসিকতা আমার নেই। বাবা আমাকে কিছু না দিলেও আমার কোনোরকম আফসোস থাকবে না। আফসোস নিয়ে তো আর বাড়ি ছাড়িনি। কিন্তু বাবা যদি আমার নামে এক টুকরো মাটিও লিখে দেয়, আমি তার হাক ছাড়বো না। যেকোনো ভাবে সেই এক টুকরো মাটির দখলদারিও আমি নিয়ে ছাড়বো।”
কথার প্রথমদিকে উদারতা, আর শেষে এসে যেন ঝাঝের উত্তপ্ততা প্রকাশ! মনে মনে ভীষণ রকমের ক্ষিপ্ত হয়েছেন প্রিয় ভাই। আসলে শুধু জেদিই না, চালাকচতুরেও কোনোদিকে কম যায় না নোমান। শুধু একটা মুহুর্তের জন্য বিকৃতরুচি এসে গিয়েছিলো ভালোবাসার মাঝে। এখন সেই রুচিকে ঘৃণার তরে ফেলার প্রচেষ্টা। বাবা মা তো আজই এলেন না সাথে, তবে আসার সময় মা তার কানে একটু বাজিয়ে দিয়েছেন কথা,
“তোর নামে সমান সম্পত্তি বন্টন করে দিছে তোর বাবা। এ বছরের শুরুতেই বন্টননামা হয়ে গেছে। নিজের অংশ ঠিকঠাক বুঝে নে বাপ।”
প্রত্যুত্তরে নোমান ধীর নিশ্বাস ফেলে মাকে আশ্বাস দিয়ে এসেছে,
“নিবো। নাতনিকে তো দেখলে। তোমার নাতিদের দেখতে এসো মন টানলে। আমার ওখানে তোমাদের থাকার জায়গার অভাব হবে না। প্রয়োজনে আরেকটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিবো। বাবা তো সারাজীবনই আমার পছন্দের বিপরীতে মুখ ফিরিয়ে রাখলো। আমিও বাবার ছেলে৷ সারাজীবনই জেদ নিয়ে বেঁচে আছি। একদম নড়চড় নেই কারো।”
.
বাবা যখন ইচ্ছাকৃত দিচ্ছে, বাবার সম্পদের হাক ছাড়বে না নোমান। তারও বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের ভবিষ্যৎ আছে। জমিজমা প্রয়োজন, নিজ বসবাসের জন্য আবাসস্থল নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শুধু ভালো খেয়ে বাঁচলেই তো চলবে না, ছাদের নিচে নিশ্চিন্তে মাথা রেখে ঘুমানোরও প্রয়োজন আছে। শীঘ্রই বন্দোবস্ত করে বুঝে নিবে নিজ অংশীদারীত্ব। বাড়ি ফিরে এই সন্ধ্যায় শ্বাশুড়িকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছে নোমান। বাড়িতে প্রবেশের ইচ্ছাবোধ করলো না সে। সুরাইয়াও জোর করেননি কোনো এক বাঁধার কারণে। মনের ইচ্ছে মনে চাপা দিয়ে একবার শুধু মুখের সাধা সেধেছিলেন। এতোদিন তো তিনিও অপছন্দ করতেন নোমানকে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে যতটুকু দেখেছে ও চিনেছে, তাতে খুবই পছন্দ করে বসেছেন মেয়ের জামাইকে। মনে খুব শান্তি অনুভব করেছেন, মেয়ে বেশ সুখে আছে ভেবে। অসুখে থাকার কোনো কারণ তো দেখেননি তিনি। ভালো খাওয়া, পরায় দিনকাল ভালোই কাটছে। কি যত্নবান নোমান। নিজ চোখেই দেখলেন তো, স্ত্রীর প্রয়োজন অপ্রয়োজন জানতে কেমন নজরদারি করছে পাশে থেকে থেকে। মেয়েকে গোসল করাচ্ছে, ঘরের ময়লা পরিষ্কার করছে, বিছানাপত্র ঠিকঠাক রাখছে, নিজের খাবারের প্লেটটা পর্যন্ত ধুয়ে খাচ্ছে, আবার ধুয়ে রাখছে। নিজ দায়িত্বে মেয়েকে ডেকে ডেকে খায়িয়ে দিচ্ছে। যেন হাতের এই কাজকর্ম গুলো নিয়েও ফাইজাকে ভাবতে না হয়, যতদিন সে অসুস্থ আছে, ততদিন। একজন ভালো জীবনসঙ্গী হলে আর কি চাই তার মেয়ের সুখী হতে? শীঘ্রই মেয়ের জামাইকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে ঘরে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন তিনি।
তিনি চলে যাওয়ার পর আজ বাড়িতে শুধু তারা একক পরিবার, বাবা-মা ও তিন বাচ্চা। হ্যাঁ, শুধু সুরাইয়ার দেখা অংশটুকু নয়, নোমান সত্যিই দায়িত্ববান একজন। নওরিনের সময় কত কাজ করেছে সে, সেসব ভুলেনি ফাইজা। তবে ফাইজা সুস্থ থাকলে মোটেও কোনো ঘরোয়া কাজে হাত দেয় না। খাবারের প্লেটটা পর্যন্ত ধুয়ে নেয় না। এমনকি তরকারিটা পর্যন্ত ফাইজাকে দিয়ে প্লেটে তুলে! তাতে ফাইজার মোটেও আপত্তি নেই। এতে ভালোবাসা উপলব্ধি হয় তার। সে চায়ও না নোমান ঘরোয়া কাজে লেপ্টে থাকুক। চায় শুধু আজীবন তার হয়ে পাশে থাকুক। পৃথিবীতে একজন নারীর এই চাওয়াটাই স্বামীর কাছে প্রধান চাওয়া। তারপর যত প্রয়োজন, অপ্রয়োজনের কথা।
এতোদিন নওরিনের নানু থাকায় তারা বাবা-মেয়ে নওরিনের রুমে ঘুমিয়েছে। ফাইজা ও বাচ্চারা ঘুমিয়েছে নানুর সাথে। আজ নওরিনের রুমের বিছানার আসবাব সব এই রুমে নিয়ে এসেছে নোমান। বিছিয়ে নিয়েছে মেঝেতে। তারা বাবা-মেয়ে নিচে ঘুমাবে, মা ও ছেলেরা ঘুমাবে উপরে। সুরাইয়া আজকের রান্নাবান্না সব করেই দিয়ে গেছেন। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে রেখে বহুদিন পর ফাইজা, নোমান ও নওরিন একত্রে খেতে বসেছে টেবিলে। এতোদিন রুমেই খাওয়া হতো ফাইজার। মা প্লেটে খাবার নিয়ে তাকে সেখানে দিয়ে আসতো আরামে বসে খেতে। আজও নোমান চাইছিলো তাকে সেখানে খাবার দিয়ে আসতে। কিন্তু ফাইজা উঠে চলে এলো একসাথে খেতে। একে তো সে অচল নয়, আগামীকাল থেকে রান্নাবান্নাও সে-ই সামলাবে। অন্যথায় বাচ্চারা জেগে কেঁদে উঠলেও এখান থেকে শোনা যাবে। তাই ইচ্ছে হতেই চলে এলো এবং নিজেই খাবার প্লেটে তুললো সবার। টেবিল পর্যন্ত খাবার নিয়ে আসতে নোমানও সহযোগিতা করেছে।
তারপর ঘুমাতে এসে মাত্রই চোখে ঘুম নেমেছিলো, এরই মধ্যে স্পর্শ পেয়ে ঘুমটা ভেঙে গেলো ফাইজার। চোখ খুলে ঘাড় ঘুরানোর চেষ্টা করতেই বুঝতে পারলো নোমান তার পেছনে। ফাইজার বালিশে কনুই ভর করে মাথা রেখেছে হাতে। ফাইজা তার দিকে তাকাতেই সে মৃদু হেসে বললো,
“ঘুমাও, তাকিয়েছো কেন আবার?”
“এখানে কেন? মেয়ে উঠে পড়বে পাশে কাউকে না পেলে।”
“চলে যাবো।”
ফাইজা আবার আগের ন্যায় বাচ্চাদের মুখী হয়ে চোখ বুজলো। ঘাড়ের চুলগুলো এক আঙুলে একে একে সরিয়ে দিচ্ছে নোমান। আঙুলের স্পর্শে কেঁপে উঠেছে ফাইজা। তার ঘুমে বিরক্ত করছে তাই চোখ বাকিয়ে আবার তাকালো তার দিকে। এবার নোমানের হাসি আরও প্রশস্ত হলো। দুষ্টুমি বাদ দিয়ে হাত বাহুতে রেখে বললো,
“ওকে, ঘুমাও। ফাইজা, বাবামাকে নিয়ে আসবো এখানে।”
“কবে?”
“বলে এসেছি। দেখি, আবার যাবো দুয়েক দিনের মধ্যেই।”
“আসবে?”
“আসতে হবে। আরও কিছু ভাবছি।”
“কি?”
“বাবা আমার নামে জমি দিয়েছে। ওটা ঠিকঠাক করে বিক্রি করে দিবো।”
“বিক্রি করবে কেন?”
“ওই বাড়িতে থাকা সম্ভব না। তারা দুজনই লেগে যায়। আমি গেলে আরও লাগালাগি হবে। আমার এসব পছন্দ না।”
“তাই বলে বিক্রি করে দিবে? তোমার ভবিষ্যৎ আছে, সন্তানের ভবিষ্যৎ আছে। তা নিয়েও তো ভাবতে হবে।”
“ওদিকে বিক্রি করে এদিকে কিনে নিবো। সমস্যা নেই তো। শুধু, সেখানে থাকবো না। একা আছি, ভালো আছি।”
“যা ভালো মনে করো।”
নোমান ফাইজার মাথার দিকে তাকালো৷ চুলের পাকে চোখ পড়লো, হাত বুলিয়ে চুলে এদিক সেদিক নেড়ে বললো,
“নওরিনের মাথা তোমার মতো, নওশাদের মাথাও তোমার মতো। রওনাফ তার বাবার মতো।”
“ঘুমাবো নাকি! এরা জেগে গেলেই আবার উঠে যেতে হবে।”
“ওকে, ঘুমাও। আমি ঘুম পাড়িয়ে দেই।”
“তোমার ঘুম পাড়াতে হবে না। ঘুম এমনিতেই আমার চোখে দৌড়াচ্ছে।”
“চুপ! ঘুমাও! এই দৌড়াদৌড়িই তো আমি থামিয়ে দিবো।”
নোমান জড়িয়ে রেখেই নিজেও মাথার সাথে মাথা রেখে চোখ বুজে রইলো। ফাইজাও শান্ত মনে চোখ বুজে নিয়েছে। খারাপ লাগছে না তার প্রিয় মানুষের সংস্পর্শে থাকতে। ঘুম যেন আরও দ্রুত নেমে আসছে চোখে। কাঁচা ঘুমে থেকে একটু পরেই তার দুরত্ব অনুভব করতে পেরেছে ফাইজা। নোমান উঠে নিচে চলে গেছে। তারও ঘুম এসে যাচ্ছে চোখে।
মেয়েটাও তার বড্ড কাজের হয়ে উঠেছে আজকাল। তাইতো সকালে উঠে মায়ের কাজ এগিয়ে দিতে ঘর ঝাড়ু দিলো। পিচ্চি ভাইয়াদের চিৎকারে তাদের বাবা মেয়ের ঘুমও সকাল সকাল ভেঙে গেছে। ফাইজা রান্নাবান্না সারলো, আবারও একত্রে নাস্তা করা হলো। মেয়ে চলে গেলো বাবার সাথে। তাকে স্কুলে দিয়েই অফিস যাবে নোমান। আবার দুপুরে নওরিনের ছুটির সময় অফিস থেকে ফিরে তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এসে লাঞ্চও করে যায়। দুদিন যাবত এভাবেই চলছে তাদের স্কুল এবং অফিস। আজ দুপুরে এসেই নোমান জানালো আগামীকাল থেকে পরীক্ষা তাদের। সে ফি দিয়ে এসেছে এবং রুটিন সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছে। ফাইজার যেন বিস্ময়ের শেষ রইলো না! মেয়ের পড়াও তো হলো না তেমন! রুটিন-ই বা কবে দিলো! মেয়ে তো কতদিন স্কুলেই যায়নি, জানবেই কি করে! সবমিলে একটা হযবরল পরিস্থিতি! দিনের বাকিটুকু সময়ে যতটুকু সম্ভব নওরিনের পড়ায় সময় দিয়েছে। শেষ সময়ে একটু তাড়াহুড়ো চললেও পরীক্ষা ভালোই দিয়েছে নওরিন। সারাবছর পড়েছে তো, রিভিশনটা চলেছে তাড়াহুড়োতে৷ পরীক্ষা শেষে ফলাফলে ঘটলো সাবিহার আরেক কাণ্ড! সেদিনের পর আর তো মারেনি, কিন্তু খাতায় বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। সব নম্বরই ভালো হলো, বাংলাতেই জঘন্য রকমের খারাপ! একদম ফেইল করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর সেটা যে ইচ্ছাকৃত হয়েছে, তা বুঝতেই পারছে ফাইজা। কেননা প্রতিটি শব্দে অতিরিক্ত কারচিহ্ন বসিয়ে বানান ভুল দেখানো হয়েছে। ফাইজার ভীষণ রাগ হলো খাতা দেখে। সে নোমানকেও দেখালো,
“তোমার কি মনে হয় নওরিন এমন ভুল করে? প্রত্যেকটা লেখায় এই কারচিহ্ন ইচ্ছাকৃত বসানো হয়েছে না?”
এসব দেখে নোমানেরও রাগ হলো। সেদিন মেয়ের হাতে আঘাত দেখেও রাগ হয়েছিলো, কিন্তু ফাইজা বিচার দিয়ে এসেছে তাই কিছু বলতে যায়নি। আজও এমন কীর্তি দেখে আর চুপ করে বসে থাকতে পারবে না সে। ফাইজা একটু থেমেই আবার বললো,
“পরপর দুইবার আমার মেয়েকে মারলো, আর আজ খাতায় ফেইল করালো। এমন হলে আমি মেয়েকে স্কুলে পাঠাবো কি করে!”
“রাখো, কাল যাবো নওরিনকে নিয়ে স্কুলে।”
“স্কুলে যেতে হবে না তোমার। আমি নওরিনকে ওই স্কুলে রাখবোই না।”
“আমি সাবিহার কাছে যাচ্ছি না। হেড টিচারের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।”
নোমান ঠিকই স্কুলে গিয়ে হেড টিচারের কাছে নালিশ করলো। আগের খাতা দেখালো, অন্য খাতায় লেখা দেখিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করলো নওরিন এমন ভুল করেনি। হেড টিচার নিজেও লিখতে দিয়ে যাচাই করলেন ওভাবে কারচিহ্ন ব্যবহার করেনা নওরিন। তিনি সাবিহাকে আবার ডাকলেন। সাবিহা অস্বীকার করলো সে এমন করেনি। নওরিন যেমন পরীক্ষা দিয়েছে, সে তেমন নম্বর দিয়েছে। কিন্তু যথাযথ প্রমাণে হেড টিচার এবার চাকরি বাদ করার হুমকি দিলেন। কড়া একটা ডোজ পড়েছে এবার সাবিহার উপর! নোমান সেদিকে সন্তুষ্ট কিংবা অসন্তুষ্টের প্রতিক্রিয়া রাখেনি। ব্যাপারটা প্রাতিষ্ঠানিক না হলে এই সাবিহাকে শূন্য থেকে আছড়ে ফেলার ব্যবস্থা করতো সে। স্কুল থেকে নওরিনের টিসি নিয়ে চলে এসেছে নোমান। এতো হুমকির মুখে রেখে মেয়েকে শিক্ষা দিতে প্রস্তুত নয় সে। আজ বেতের ঘা, কাল খাতায় কাটা, পরশু দেখা যাবে প্রাণই নিয়ে নিয়েছে তার মেয়ের! পড়াশুনার জন্য মেয়ে হারাবে না সে। আশেপাশে স্কুলের অভাব নেই। নতুন বছর নতুন স্কুলে পদার্পণ করবে নওরিন। বাবা মা সচেতন থাকবে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সাবিহার মতো শিক্ষদের এড়িয়ে সন্তানদের সুন্দর সুশিক্ষার এক পৃথিবী নিশ্চিত করা প্রতিটি বাবামায়ের অন্যতম দনায়িত্ব। নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে সেই দায়িত্বই বহন করতে প্রস্তুত হয়েছে নোমান। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সংসার সাজানোর এক সুন্দর দিনের প্রত্যাশা এখন নোমানের আগামীর লক্ষ্য। প্রকৃত ভালোবাসাগুলোতে আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয় প্রতিনিয়ত। এই ভালোবাসার বাঁধনগুলো মজবুত হয়ে থাকে। চাইলেই ছিঁড়ে এবং ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় না সহজে৷ বরং আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারলে, জীবন সহজ হয়ে যায় সুখশান্তিতে।
(সমাপ্ত)
[এই পৃথিবীতে অনেক নোমান আছে, অনেক ফাইজা আছে। কিন্তু সব নোমানের হেদায়াত হয় না, সব নোমান ফিরে আসে না। কিছু নোমান হারিয়ে যায় চিরতরে, ডুবে যায় পাপিষ্ঠতায়! সব ফাইজারাও সংসার আঁকড়ে ধরে বাঁচে না। কিছু ফাইজা চলে যায় সংসার ফেলে, কিছু ফাইজা থেকে যায় অনন্তকাল জ্বলেপুড়ে!]