ছেঁড়া বাঁধন পর্ব- ১৫

ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
ফাইজা দুচোখে ইতিবাচক পলক ফেললো। নোমানকে ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি রেখে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখা গেলো। সে হসপিটালের নার্সকে এক্সট্রা চার্জ দিয়ে ঠিক করে রেখেছে ফাইজা ও বাচ্চাদের বিশেষ যত্ন নেওয়ার জন্য। কেবিনে প্রবেশের সময় তার সাথে সেই নার্সও এসেছে বাচ্চাদের নিয়ে। দোলনায় সুন্দরভাবে শুয়িয়ে দিচ্ছে, যা দেখার জন্য নওরিন উৎফুল্লতার সাথে পাশে দাঁড়িয়েছে। আর নোমান এসে বসেছে ফাইজার পাশে। ফাইজা স্থীর অভিমানে চোখ সরিয়ে নিয়েছে অন্যদিকে। শুধু অভিমান কি, তার তো তখনও রাগ হয়েছিলো তার মাত্রাতিরিক্ত স্বাভাবিকতা দেখে। সেই রাগের উপর ভিত্তি করে এখনো রাগ হচ্ছে তার মুখের লেপ্টে থাকা চাপা হাসিটা দেখে। নোমান তার তিন বাচ্চার দিকেই তাকিয়ে আবার তাকালো ফাইজার মুখে। মুখে কেমন একটা বিরক্তি এনে সে-ও তাকিয়ে আছে বাচ্চাদের দিকেই। নোমান তার মুক্ত হাতটা তুলে নিলো নিজ হাতে। ফাইজা টেনে নিতে চাইলেও পারলো না। বিপরীত টানে শক্ত করে ধরে রেখেছে নোমান। চেপে রেখেছে দুহাতের মাঝে। যেন নার্সের যাওয়ার অপেক্ষাটাই করছিলো। একেবারেই যে যাচ্ছে, তা না। অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো ময়লার বালতিতে ফেলে তা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি যেতেই নোমান বললো,
“স্যরি।”
ফাইজা চোখ ফেরালো না। নোমান মুচকি হেসে তার হাতটা তুলে হাতের পিঠ নিজের গালে চেপে ধরেছে। ফাইজার প্রকাশ্য অবিশ্বাসের মনোভাবটা মুছে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে সে বললো,
“সত্যি বলছি, আমি অফিস থেকে ট্যুরে গিয়েছিলাম সবার সাথে। রাগারাগি চলছিলো, মনমানসিকতা ভালো ছিলো না তাই বলে যাইনি যাওয়ার আগে। তুমি যেমনটা ভেবে নিয়েছো, তেমনটা নয়। ওই মেয়ের সাথে আমি একদিন বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম, আর যেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছো সেদিন সন্ধ্যায় দেখা করেছিলাম। এছাড়া বাইরে আর কোথাও দেখা হয়নি। ফোনে টুকটাক কথা হয়েছিলো কিছুদিন, তা-ও আমি বন্ধ করে দিয়েছি ট্যুর থেকে ফিরে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ভুল হয়েছে। তাই শুধরে গেছি, ফাইজা।”
ফাইজা নিশ্চুপ। তার নিরব মুখে প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশায় তাকিয়ে থেকে আবার বললো,
“আল্লাহর কসম, আমি ট্যুরে গিয়েছিলাম। তার সাথে আর দেখাসাক্ষাৎও হয়নি। হবেও না আর কখনো। প্রমিজ।”
ফাইজার চোখ ভিজে উঠেছে। তবুও সে চোখ ফেরালো না। চোখের পানি মোছার জন্য এই হাতটা প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু নোমান ছাড়লো না। গালে চেপে রাখা হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দিতেই ফাইজা আবারও টানলো। তবুও সম্ভব হলো না। পরপর তিনবার ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে হাত নিজের অধিনে রেখেই নিচে নামিয়ে নোমান বললো,
“আমাদের তিনটা বাচ্চা।”
তারপর সামান্য ঝুঁকে ফাইজার চোখ মুছে দিতে দিতে ফিসফিস করে বললো,
“ভালোবাসা তো এখন তিনগুন বাড়বে। আদর তিনগুণ পড়বে। এতোদিন অসুস্থ ছিলে, কিছু বলিনি। এখন অসুখ সেরে গেছে। এখনও যদি মুখ বন্ধ রাখো, বেশি ভালো তো হবেই না। বরং খবর ঘটিয়ে এবং রটিয়ে দিবো, ফাইজা চতুর্থ সন্তানের মা হতে চলেছে।”
এতোক্ষণের কথা সব অনুভূতিতে মিশলেও এখন সাথে সাথেই ফাইজা ক্ষিপ্ত চোখ জোড়া নিক্ষেপ করলো তার দিকে। নোমান নিঃশব্দে শরীর কাপিয়ে হেসে সোজা হয়ে বসলো। নওরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে তার হাত নেড়ে নবজাতকদের সাড়া ফেরানোর চেষ্টা করছে। এর মধ্যে একজন ঘুমাচ্ছে, আরেকজন থেমে থেমে একটু আধটু কাঁদছে। নোমান জিজ্ঞেস করলো,
“ভাইয়াদের নাম কি রাখবে, নওরিন?”
নওরিন পিছু ফিরে বললো,
“কি নাম বাবাই?”
“তুমি বলো।”
“আমি তো বলতে পারি না। তুমি বলো।”
“আমি বলবো? ওকে…”
নোমান ভাবতে গিয়েও হঠাৎ থেমে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভেবে রেখেছো কিছু?”
ফাইজা স্বভাবিক মনোভাবে তার সরাসরি জবাব দিলো মাথা নেড়ে। এইতো, অভিমান চলে গেছে মেয়ে ও ছেলেদের মায়ের। নোমান আবার ভাবতে বসলো। নওরিন বেশ উৎফুল্লতার সাথে বাবার মুখে তাকিয়ে আছে, বাবা কি নাম বলে তা শোনার জন্য। নোমান ভেবে বললো,
“একজনের নাম নওশাদ, আরেকজন রওনাফ। তোমার সাথে মিলে গেছে ভাইয়াদের নাম।”
“কিন্তু কোনটা নওশাদ, আর কোনটা রওনাফ? আমি চিনবো কি করে!”
মেয়ের প্রশ্নে নাম নিশ্চিত করতে ফাইজার হাত ছেড়ে বাচ্চাদের আবার দেখতে উঠে গেলো নোমান। কাছ থেকে চেহারার পার্থক্য চিহ্নিত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু এতো ছোট বাচ্চাদের মধ্যে মনে রাখার মতো তেমন কোনো পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছে না। দেখতে দুজনেই একরকম। তাই কনফিউজড হয়ে মেয়েকে বললো,
“আমিই তো বুঝতে পারছি না কার নাম কোনটা রাখবো! তুমি বুঝবে কি করে!”
“তাহলে দুজনের নামই একটা রেখে দাও।”
মেয়ের বুদ্ধিতে নিজের বুদ্ধি সমঝোতায় নিয়ে আসতে নোমানও মস্করা জুড়ে দিলো,
“তবে ভাইয়াদের নামও নওরিন রেখে দেই। যখন ডাকবো, তিনজনই ছুটে চলে আসবে।”
বাবার কথায় খিলখিল করে হাসলো নওরিন। তাদের মনে রাখার কাজ সহজ করে দিতে ফাইজা বললো,
“একজনের মাথার চুলে এক পাক আছে, আরেকজনের দুই পাক।”
নোমান বিস্ময়ের সাথে তা পর্যবেক্ষণ করে দেখলো সত্যিই! তাই বিস্মিত চোখে ফাইজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তুমি জানো কিভাবে?”
ফাইজা ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে জবাব দিলো,
“ডক্টর জানিয়েছে। যার মাথায় এক পাক, সে বড়। সে আগে পৃথিবী দেখেছে। যার মাথায় দুই পাক, সে দুই মিনিটের ছোট।”
বেশ উৎফুল্লতা নিয়ে ইন্টারেস্টিং কথাগুলো মগজে সংরক্ষণ করে নিলো নোমান। সাথে সাথেই নওরিনের মাথাটাও টেনে দেখে নতুন করে নিশ্চিত হলো তার মাথায় এক পাক নাকি দুই পাক। নাহ, নওরিনের মাথায় এক পাক জানতো। এক পাকই আছে। মেয়ের মাথা দেখতে দেখে ফাইজা বিড়বিড় করলো,
“নিজের মাথা দেখুক না আগে।”
“আমার মাথায় দুইটা। তাই ভালোভাবে দেখে নিলাম সবারটা।”
নিজের মাথায় দুই পাক, সেটা আগে থেকেই জানে নোমান। তারপর সে নওরিনকে নিশ্চিত করলো, এক পাক যার মাথায়, তার নাম নওশাদ। দুই পাক যার মাথায়, তার নাম রওনাফ। বাবার কথা মাথায় গণ্ডগোল সৃষ্টি করায় নওরিন প্রশ্ন করলো,
“পাক কি, বাবাই?”
নোমান বাচ্চাদের মাথায় ইঙ্গিত করে তাকে বুঝিয়ে দিলো মাথার পাকের ব্যাপার। এরপর থেকে একটু পরপরই মাথায় উঁকি দিয়ে বলে,
“এই ভাইয়ার নাম নওশাদ, এই ভাইয়ার নাম রওনাফ।”
স্কুলের হোমওয়ার্কের চেয়েও বেশি শক্তিশালীভাবে নাম মুখুস্ত করতে শুরু করেছে নওরিন। পিছনের সব কষ্ট ও ব্যাথাদের ভুলে এই মুহুর্তে এতো সুখ অনুভব করছে ফাইজা, যা শুধুমাত্র অনুভবের ভাষায় প্রকাশ করাই সম্ভব। বাবা, মা, বাচ্চারা কি সুন্দর একটা পরিবার উপস্থিত এই চার দেয়ালের ভেতরে। মুখে হাসি, মনে আনন্দ। বুক ভরে নিচ্ছে সুখের নিশ্বাস। যেন সুখের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে বাতাসে।
কিছুক্ষণ পর নোমানের কাছ থেকে নিজের ফোন নিয়ে ছোট বোন, রাইসাকে জানালো বাচ্চাদের খবর। রাইসা জেনে খুশি হয়েছে, আবার নোমানের ব্যাপারে জেনে মলিন মুখে জিজ্ঞাসাও করে বসেছে,
“আপু, ভাইয়া কি এখনো ওরকম?”
একটু নিরবতা ধারণ করে ফাইজা নিজের মনের খবরটা জানার চেষ্টা করলো। গতদিনগুলোতে চোখের সামনে নোমানের আত্মশুদ্ধির প্রচেষ্টাগুলো স্মরণ করলো। মন বললো, নোমান আত্মশুদ্ধি করেছে। তাইতো বারবার জানাতে আসে, বিশ্বাস করাতে আসে। তবে তার রাগ সবসময়ই বেশি, ওসব হজম করার অভ্যাস আছে ফাইজার। শুধু ভালোবাসার পথভ্রষ্টের সময়টুকুই মেনে নিতে পারেনি। কখনো পারবেও না। তার সবকিছু একান্তই তার। অন্য কারো সাথে ভাগাভাগি করতে চায় না তার প্রিয়জনদের। তাই রাইসাকেও জবাব দিয়েছে,
“উহুম। সে আমার। শুধুই আমার।”
এদিকে হসপিটালে রাতে থাকাটা ভারি মুশকিল হয়ে গেছে বাবা মেয়ের জন্য। ছোট কেবিন, একটাই বেড। যেটাতে ফাইজা অবস্থান করেছে। পাশে বাচ্চাদের রাখার দোলনা। এখানে বসার মতোও কিছু ছিলো না আর। নার্স একটা টুল এনে দিয়েছিলো নোমানকে বসতে। ফাইজা মুখের কথা বলেছিলো, তাকে বাসায় চলে যেতে। নোমান এইটুকু পাগলও হয়নি বিশ্রাম নেওয়ার। সে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসতেও রাজি না তাদের একা ফেলে, আবার বাসায়! সাথে পরিবারের কেউ থাকলে এক কথা ছিলো। এখানে তো সে-ই একমাত্র পরিবার। রাত ঘন হয়ে এলে নওরিন ঘুমিয়ে গেছে নোমানের কোলে৷ টুল নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে এভাবেই রাত কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে নোমান। ফাইজা এবার তাদের কষ্ট দেখে সিরিয়াস হয়েই বলেছিলো নওরিনকে তার একপাশে শুয়িয়ে দিতে। কিন্তু তাতেও রাজি হলো না নোমান। মেয়ে তার এমনিতেই খাট গড়াগড়ি দেয়, এই অবস্থায় ফাইজার পাশে তাকে ঘুমাতে রাখার কথা মাথায়ও আনবে না সে। তার কোলেই ঘুমাক। বসেই তো আছে। কষ্ট হবে না তেমন। ঠিক এভাবেই রাত পাড় হলো তাদের। নোমানের যেমন ঘুম হয়নি, ফাইজারও ঘুম হয়নি। শারীরিক যন্ত্রণা, আবার বাচ্চাদের দিকে লক্ষ্য রাখা, নোমান ও নওরিনের দিকে লক্ষ্য রাখা তার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। নোমানের তো চোখ লেগে আসার মতো জায়গারই অভাব, তারউপর সবদিকে সজাগ দৃষ্টি বিদ্যমান রাখার দায়িত্ব। ঘুম আবার আসে কিভাবে এই চোখে! অবশেষে রাতটা যেমন কষ্টে কাটলো, সকালটা তার চেয়েও বেশি চমক এনে দিলো।

(গেস করুন দেখি, কি চমক এসেছে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here