ছেঁড়া বাঁধন
পর্ব- ১৩,১৪
(নূর নাফিসা)
১৩
.
মেয়েকে পড়ানো শেষ করে উঠে চলে এলো নোমান। নামাজ পড়ে আসার পরই ক্ষুধা লেগে গিয়েছিলো। নওরিনের পড়া হয়নি বিধায় তখন একটা চমচম খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করে নিয়েছিলো। এখন পড়া শেষ করেই রিমোর্ট হাতে নিয়ে নিলো নওরিন। দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে বাবা কর্তৃক আজ এনে দেওয়া চকলেট কেকও নিয়ে এসেছে খাওয়ার জন্য। নোমান একটুখানি মুখে তুলে চলে এসেছে পাশের রুমে। ফাইজা ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। নোমানও তার চেহারায় তাকিয়ে আন্দাজ করতে পারছে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্ত চোখেমুখেও অন্যরকম সৌন্দর্য ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই সৌন্দর্যের টানে টানেই সে মুখে ম্লান হাসি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসেছে। বসেছে মুখের সম্মুখে। সৌন্দর্য তো চেহারায় সবসময়ই ভাসে। তবে সবসময় দেখার চেষ্টা করে না বলেই সেই সৌন্দর্য মনে ধরে না। এখন দেখছে বলেই রোগাটে মুখেও সৌন্দর্যের দেখা পাচ্ছে। এইতো, ভালো লাগছে। সেদিনও ভালো লেগেছিলো, আজও ভালো লাগছে। তবে মধ্যখানে হঠাৎ ওই সাবিহার সৌন্দর্যে লোভ জন্মেছিলো কেন! তার স্ত্রীর সৌন্দর্য তো তার দৃষ্টিকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট। এইতো মুগ্ধ হচ্ছে। সেদিনও মুগ্ধ হয়েছিলো বলেই সংসার বেঁধেছে। ছয়টা বছর অতিক্রম করেছে। ওই সাবিহাটাই কেমন, বউ বাচ্চা আছে জেনেও তার দিকে নজর দিয়েছে! ভালো মেয়ে হলে তো তাকেও পাত্তা দিতো না, নিজেও এগিয়ে আসতো না। ধ্যাৎ! ওসব নিয়ে আর ভাববেই না নোমান। যেখানে নিজের দোষ স্পষ্ট, সেখানে অন্যের দোষ দেখা হাস্যকর। যে যেমনই হোক। নিজেকে শুধরে নেওয়াটাই এখন উত্তম। তার স্ত্রী আছে, সন্তান আছে, ভাবনা জুড়ে এই প্রাপ্তিগুলোই থাকুক সারাক্ষণ।
স্পর্শ সম্পর্কিত হুমকি এবং সেদিনের আচরণ মাথায় রেখেও নোমান হাত বাড়ালো ফাইজাকে আলতো ছুঁয়ে দিতে। সে তো ঘুমাচ্ছে, এখন তেমন রিয়েক্ট আসবে না তার মাঝে, সেই নিশ্চয়তা নিয়ে চোখের পাশ থেকে আলতোভাবে পুরো গালে আঙুল বুলালো একবার। তারপর হাতের পিঠের স্পর্শ পড়লো গাল থেকে কান পর্যন্ত। তার হাতের ধাক্কায় কানের ভেতর চুলের খোঁচা লেগে যাওয়ায় সুড়সুড়ি অনুভব করে ফাইজা ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠেছে। তারপর হাতের স্পর্শ অনুভব করতে পারায় তার ঘুম পুরোই ভেঙে গেছে। চোখ খুলে তাকাতেই হাত সরিয়ে তার ওপাশে বিছানায় ভর দিয়েছে নোমান। মুখে বিদ্যমান হাসির ছোঁয়া। ফাইজার সদ্য ঘুম ভাঙা চোখের ভ্রু সামান্য কুচকে গেলেও, নোমানের মাঝে বিরাজ করছে বড্ড স্বাভাবিকতা। সে একইভাবে ঝুঁকে থেকে বললো,
“ভাত খাবো কখন?”
ফাইজা তার উপর দিয়ে ওপাশে নিয়ে যাওয়া হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে বসলো। চোখেমুখে বিরক্তি নিয়েই নেমে গেলো। তাতে বিন্দুমাত্র আঁচ পড়লো না নোমানের ভাবভঙ্গিতে। যেন ভীষণ রকমের রোমান্টিকতার হাওয়ায় ভাসছে সে। এই হাওয়া গায়ে মেখেই ফাইজার পিছু পিছু বেরিয়ে নওরিনকেও ডেকেছে খেতে আসার জন্য। ফাইজাকে একটু বিরক্ত করতে পারলে বোধহয় এখন আরও ভালো লাগতো। কিন্তু এই অবস্থায় বিরক্ত করবে না। ফাইজা সুস্থ থাকলে ঠিকই করতো। যেমনটা সবসময়ই করে এসেছে। ফাইজাও তখন কম যায়নি। সময়ে সুযোগ নিয়ে সে-ও নোমানকে কম বিরক্ত করেনি। দুজনেরই খুনসুটিতে বেশ চলতো তাদের সংসার।
পরবর্তী দিন স্কুলে নোমান দিয়ে এলেও একটু ভালো অনুভব করছে বিধায় ফাইজা ই গেলো নিয়ে আসার জন্য। কথা তো বলে না, তাই যাওয়ার আগে ইনবক্সে টেক্সট করে জানালো সে আনতে যাচ্ছে নওরিনকে। প্রত্যুত্তরে “ওকে” লিখলো এবং হাসলো নোমান। কথা বললো না কিভাবে? মুখে উচ্চারণ না করলেই কি, লিখে তো বললোই। এ-ও তো কথা বলারই একটা মাধ্যম!
কিন্তু এদিকে স্কুল ছুটি হওয়ার পরই ফাইজার মুখে হাসি ফোটার আগে বুকে ছুরি বিঁধলো। নওরিন ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুহাতে চোখ কচলে এদিকে ওদিক তাকাতে তাকাতে বেরিয়ে আসছে। বারবারই চোখ মুছে, বারবারই এপাশ ওপাশ তাকিয়ে মাকে খোঁজে। দিতির আম্মু ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করছিলো,
“কি হয়েছে নওরিন? কাঁদছো কেন?”
সে জবাব না দিয়ে গেইটের দিকে এগোচ্ছে মায়ের খোঁজে। মাকেও পাচ্ছে না, বাবাকেও পাচ্ছে না। ফাইজা গেইটের এদিকে ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো ওদিকে কড়া রোদ পড়ায়। নওরিন তাকে না দেখলেও সে শুরু থেকেই দেখছে, নওরিন কাঁদতে কাঁদতে এদিকে আসছে। ফাইজা ছাউনি ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলো। কান্নার সাথে বারবার চোখমুখ কচলানোর কারণে মেয়ের পুরো চেহারা লাল হয়ে আছে। অনেক্ক্ষণ যাবত কাঁদছে, বুঝাই যাচ্ছে। ফাইজাকে দেখতেই দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে কান্না বাড়িয়ে দিলো। ফাইজা বিস্মিত হয়ে বারবারই জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে তার। নওরিন বলছে না। ফাইজা তাকে কড়া রোদ থেকে একপাশে ছায়ায় নিয়ে গেলো। চোখ মুছে, মুখে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
“কাঁদছো কেন মা? কি হয়েছে তোমার?”
“মিস আমাকে মেরেছে।”
কথার সাথে চলছে হেচকি তুলে কান্না। বলার পরপরই হালকা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাম হাতের বাহু দেখালো নওরিন। মুহুর্তেই বুক কেঁপে উঠলো ফাইজার। সে তার মেয়েকে যেখানে ফুলের টোকা দেয় না, সেখানে এই কচি হাতে বেতের ঘা বসে ফোলে লালচে দাগ হয়ে আছে। চামড়া ফেটে রক্তও বেরিয়েছে সামান্য। যদিও সেই রক্ত গড়িয়ে পড়েনি, কিন্তু ফাইজার বুকে রক্তক্ষরণ ঠিকই হয়েছে। রাগে গায়ের লোমকূপে আগুনও জ্বলছে! তার মেয়ে তো দুষ্টু প্রকৃতিরও না, ঝগড়ুটেও না। তাহলে এভাবে মারবে কেন? মূলত ব্যাথাটা তার এখানেই। সে মা হয়েই তাকে কখনো মারেনি, কারণ সে দুষ্টু বাচ্চাদের মতো নয়। খুবই শান্ত এবং অভিমানী। তাছাড়া, শিক্ষকরা এইটুকু বাচ্চার উপর এভাবে আঘাত করেই কি করে যে, শরীর ফোলে যায়, চামড়া ফেটে যায়!
ফাইজা ফোলে যাওয়া অংশে আলতোভাবে কাঁপা হাত বুলালো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“কোন মিস মেরেছে তোমাকে?”
“সাবিহা মিস।”
সাবিহার নাম শুনতেই ফাইজা বিস্মিত এবং ক্ষিপ্ত হলো। সেদিনও কি একটা জিজ্ঞেস করে মেয়েকে মারলো। যেটা সম্পর্কে মেয়ে বলতেই পারেনি যে, কি জিজ্ঞেস করেছে। আজ আবারও এমন জঘন্যরকম ভাবে মারলো। সে এমন কেন করলো? প্রতিশোধ নিচ্ছে নাকি তার মেয়েকে মেরে মেরে? ফাইজা নওরিনের হাত ধরে ভবনের দিকে পা বাড়িয়ে বললো,
“চলো আমার সাথে।”
নওরিন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে গেলো তার সাথে। ফাইজা সরাসরি নিয়ে এলো হেড টিচারের রুমে। এখানে হেড টিচারও মহিলা। তিনি মনযোগ দিয়ে কিছু পড়ছেন। ফাইজা বাইরে থেকেই সালাম দিয়ে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। তারপর নালিশ জারি করলো সাবিহার নামে। মেয়ের হাতের ক্ষতও দেখালো। বাচ্চারা পড়া না পারলে, দুষ্টুমি করলে এভাবে শাস্তি দিতে হয় নাকি তার জবাবদিহিতা চাইলো। তিনিও যেন থমকে গেছেন নওরিনের হাত দেখে। বড়দের জন্য হয়তো এতোটুকু ক্ষত সামান্য হতো। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য অনেক। তিনি সাবিহাকে কল করে অফিস রুমে ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করতেই সাবিহা বললো, নওরিন খুব বেশি দুষ্টুমি করছিলো, কথা শুনছিলো না তাই মেরেছে। নওরিন তার মায়ের মুখে তাকিয়ে সাথে সাথেই বললো,
“আম্মু, আমি দুষ্টুমি করিনি।”
ফাইজাও হেড টিচারের কাছে বললো তার মেয়ে খুবই শান্ত প্রকৃতির। একটু ধমক দিলেই অভিমান করে বসে। মাইর দেওয়ার কোনোই প্রয়োজন হয় না। তারপরও যদি টিচারদের সাথে বেয়াদবি করেই থাকে, অবশ্যই টিচারদের অধিকার আছে বাচ্চাদের শাসন করার। তাই বলে এভাবে শাসন করা কতটা যৌক্তিক তা জানতে চাইলো হেড টিচারের কাছে। হেড টিচার সাবিহার উপর কিছুটা রাগান্বিত হলো। বাচ্চাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হয়, তার সম্পর্কে উঁচু গলায় জ্ঞান দিলো। অবশেষে সাবিহা মাথা নত করে জানালো, সে বুঝতে পারেনি এতোটা জোরে লেগে যাবে। মাথা ঠিক ছিলো না, তাই জোরে লেগে গেছে। হেড টিচারও জানালো, মাথা ঠিক না থাকলে যেন বাচ্চাদের সংস্পর্শেও না যায়। বাচ্চাদের সামনে গেলে বড়দেরকেও আচরণে বাচ্চা হতে হয়। ফাইজার সামনেই তাকে শাসিয়ে ফাইজাকে আন্তরিকতার সাথে জানালো, ভবিষ্যতে আর যেন এমন না হয় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবেন তারা। নওরিনের মাথায়ও হাত বুলিয়ে দিলেন।
তাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ডিসপেনসারি থেকে অয়েন্টমেন্ট নিয়ে এসেছে ফাইজা। ঘরে এসে স্যাভলন পানি দিয়ে ওয়াশ করে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিয়েছে। সারাটাদিনই শরীর কটমট করেছে সাবিহার উপর রাগান্বিত হয়ে। সেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়াতেই নিশ্চয়ই তার মেয়ের উপর এমন অত্যাচার করছে। আরেকদিন যদি ওই সাবিহা তার মেয়েকে টাচ করবে, তবে ওই সাবিহার শরীরে কোনো একটা বিস্ফোরণ ঠিক ঘটিয়ে দিয়ে আসবে। এরপর যা হওয়ার হবে। কিন্তু সে মা হয়ে মেয়ের উপর অত্যাচার সহ্য করবে না বারবার।
বিকেলে ঘুম থেকে উঠার পরই লক্ষ্য করেছে নওরিনের শরীর গরম। সারাদিন মেয়েটার মুখে আর হাসি ফুটেনি। সন্ধ্যায় আবার তাপমাত্রা পরিমাপ করে নিশ্চিত হলো, জ্বর হয়েছে তার মেয়ের। রাগ যেন আরও গর্জে উঠলো! ইচ্ছে করছে, এই মুহুর্তে সাবিহার চুলগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে দিয়ে আসতে!
ফাইজা শরীরে হাত দেওয়ার পরই নওরিন মায়ের কাছে ঘেঁষে বললো,
“আম্মু, আমার পড়তে ভালো লাগছে না আজ।”
“ঠিক আছে, মা। পড়তে হবে না তোমার। হাতে কি খুব ব্যাথা পাও?”
“উহুম। ধরলে ব্যাথা পাই।”
“আচ্ছা, ধরো না। শুয়ে থাকো একটু। একটা মিষ্টি খাবে তুমি?”
“দাও।”
“বসো, আমি নিয়ে আসছি।”
“আম্মু, আমি এখন টিভি দেখতে পারি কি?”
“দেখো।”
ফাইজা একটা চমচম এনে দিলে নওরিন অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা তাকে দিয়ে দিলো। ফাইজা পাশে বসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ভাবতে লাগলো অনেক রকম কিছুই। তবে খুব বেশি ভেবেছে নোমানকে নিয়ে, নোমানের বর্তমান আচরণ নিয়ে। সে দুর্ব্যবহার করে এখন আবার লেজের মতো পিছু ঘুরে কোন মতলবে? এমন আচরণ করে সে কি করতে চাইছে? বিশ্বাস করাতে চাইছে, সে আবার বদলে গেছে? আবার আগের মতো হয়ে গেছে? নাকি তাদের হাত করতে চাইছে, সাবিহার সাথে সম্পর্কটা চোখের সামনে স্বাভাবিক করে তোলার? কোন মতলবে সে দুতিনদিন যাবত এতো দায়িত্ববোধের মুখোশ পরিধান করেছে? নাকি সেদিন সাবিহার কাছে গিয়ে কোনো ঝামেলা বাঁধিয়ে এসেছে, যার জন্য আজ তাদের এতো নিকটে এসে হঠাৎ অবস্থান করেছে! এতো যত্নবান হয়ে উঠেছে! উদ্দেশ্যটা কি তার?
“ছেঁড়া বাঁধন”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
আজ ফিরেছে নোমান ইশার নামাজের পর, একেবারে মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে। এইটুকু পথেও লম্বা জ্যাম তাকে আটকে দিয়েছে। কলিং বেল বাজলে ফাইজা দরজা খুলে দিয়ে চলে এসেছে মেয়ের কাছে। নোমান দরজা লক করতে করতেই মেয়ের উদ্দেশ্যে গলা ছেড়েছে,
“নওরিন, ঘুমিয়ে গেছো?”
নওরিন শুয়ে থেকেই জবাব দিলো,
“না, বাবাই।”
“কি করছো?”
“টিভি দেখছি।”
“পড়া শেষ তোমার?”
“না, আজ পড়তে বসিনি।”
“কেন?”
“এমনি, ভালো লাগছে না।”
নোমান আর এদিকে আসেনি। রুমের বাইরে থেকেই কথা বলতে বলতে পাশের রুমে চলে গেছে। ফাইজা শরীরে চাপা জেদ নিয়েই মেয়েকে উঠিয়ে দিলো,
“যাও, বাবাকে দেখিয়ে এসো সাবিহা মিস যে তোমাকে মেরেছে। সাবিহা মিসের নামও বলবে।”
মায়ের কথায় নওরিন উঠে চলে গেলো। অন্য কোনো ব্যাপার হলে হয়তো এভাবে জানানোর জন্য পাঠাতো না ফাইজা। সাবিহার ব্যাপার বলেই পাঠালো তার রিয়াকশন দেখার জন্য। তার প্রিয়তমা তার মেয়েকে এভাবে মেরেছে, সেটা তারও তো জানা উচিত। সে-ও দেখতে চায়, নোমানের মেয়ের প্রতি টানটা বেশি নাকি প্রিয়তমার প্রতি! নাকি এই ব্যাপারেও ফোনে আগেই জানিয়েছে প্রাণ প্রিয়তমা? নিজের দোষ আগ বাড়িয়ে জানাবে বলে তো মনে হয় না। অবশ্য এটা জানাতে পারে যে, ফাইজা হেড টিচারের কাছে নালিশ করে তাকে বকা খায়িয়েছে। সাবিহা ও নোমানের সম্পর্ক চলমান ভেবে এমনটাই ধারণা হচ্ছে ফাইজার।
এদিকে নওরিন এসেছে বাবার কাছে। নোমান শার্ট খুলে বাথরুমে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো। নওরিন সামনে দাঁড়িয়ে বাহু দেখিয়ে বললো,
“বাবাই, দেখো। সাবিহা মিস আমাকে অযথা মেরে কেটে ফেলেছে।”
কথা শুনে নোমান ভ্রু কুচকে ফেলেছে। হাটু ভেঙে বসে কাছ থেকে দেখলো হাতের অনেকটা নীলচে ফোলা এবং ফোলা জায়গায় কাটা দাগ হয়ে আছে। সে ভ্রু কুচকানো রেখেই বললো,
“সাবিহা মিস মেরেছে? কেন?”
“অযথা মেরেছে। আমি কোনো দুষ্টুমিই করিনি। তারপরও সবার কাছে শুধু বলে, আমি নাকি দুষ্টুমি করেছি। তাই আমাকে এতো জোরে মেরেছে। ব্যাথা পেয়ে আমি কান্না করে দিলে আমাকে ধমকও দিয়েছে। দেখো, আমার জ্বর এসে গেছে।”
নোমানের যেন মাথা দিয়ে আগুন বের হচ্ছে। সাবিহা এমনটাও করতে পারে, তার ধারণার বাইরে ছিলো। সে কি নোমান কর্তৃক সম্পর্ক নিষিদ্ধকরণে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিলো তার মেয়ের উপর? কোথায়, আগে তো ধমকও দেয়নি। এখানে পড়াতে আসলে কি আদুরে আদুরে কথা বলতো তার মেয়ের সাথে। এমনকি তার সাথে কথা হলেও নওরিনের ব্যাপারে বেশ প্রশংসনীয় কথা তুলে ধরতো। এমন আচরণের কারণ তো তার কাছে এখন অতি স্পষ্ট। সে নওরিনের কপালে, গালে স্পর্শ করে দেখলো সত্যিই জ্বর! মুখে রাগের ছাপ রেখেও সে স্বাভাবিকভাবে নওরিনকে জিজ্ঞেস করলো,
“কখন মেরেছে? ক্লাসে?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার আম্মু দেখে কিছু বলেনি?”
“হ্যাঁ, আম্মু হেড মিসের কাছে বিচার দিয়েছে।”
তাহলে তো ডোজ একটা পড়েছেই, ভেবে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলো নোমান। পরপর আবার জিজ্ঞাসা করলো,
“কি বলেছে হেড মিস?”
“হেড মিস বকেছে সাবিহা মিসকে। আবার আমাকে আদর করেছে।”
নোমান আবারও হাতের ফোলা দেখলো। তারপর গলায় হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলো। তাকে কোলে তুলে পাশের রুমে এসে ফাইজাকে বললো,
“নওরিনের দেখি জ্বর, মেডিসিন খায়িয়েছো কিছু?”
ফাইজা এক পলক তাকিয়ে নোমানের মুখভঙ্গি দেখে নিলো। তার মুখে চিন্তার ছাপ পড়েছে। তার সাথে কথা বলার ইচ্ছে তো নেই, কিন্তু মেয়ের অসুস্থতার ব্যাপারে চুপ থেকে বোকামি করেনি ফাইজা। সে অন্যত্র চোখ রেখে তার জবাব দিয়েছে,
“না। সন্ধ্যায় জ্বর বেড়েছে।”
“রেডি করে দাও। ডাক্তার দেখিয়ে, জ্বর মেপে মেডিসিন নিয়ে আসি। ইডিয়টের বাচ্চা এভাবে বেতের আঘাত করলো কি করে!”
নওরিনকে কোল থেকে নামিয়ে শেষ বাক্য দাতে চেপে বলে বেরিয়ে গেছে আবার শার্ট পরতে। এবারও ফাইজা তার মুখে তাকিয়েছে এবং রাগ দেখতে পেয়েছে চেহারায়। নোমানের শতভাগ রাগটা তার মেয়ের হাতে কেটে যাওয়ার জন্য নয়। মূলত সাবিহার প্রতিশোধমূলক কার্যক্রমের জন্য। এইটুকু ব্যাথা তো তার মেয়ে পড়ে গিয়েও পেতে পারতো, কিংবা অন্য কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েও আরও বেশিও কেটে যেতে পারতো। তখন কাকে বকা দিতো আর কার উপর রাগ দেখাতো? কারো উপরই নয়। তবে এখন সাবিহাকে বকা দিতে হলো, কারণ সাবিহা প্রতিশোধমূলক আচরণ করেছে। ইচ্ছাকৃত অহেতুক শাস্তি দিয়েছে তার বাচ্চাকে। রাগে তার প্রতি অকথ্য গালিও উঠে আসছে মন থেকে কিন্তু মুখ খারাপ করছে না নোমান। তার দিকে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা যে চরম একটা ক্ষতিকর ভুল করেছে, তা বেশ বুঝতে পারছে। মূলত সম্পর্ক ছিলো না সেটা, ছিলো দৃষ্টির আকর্ষণ। আবর্জনাটাকে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে পারলে বোধহয় তার রাগটা একটু কমে আসতো এখন।
নিকটস্থ ডিসপেনসারির ডাক্তার দেখিয়ে তখনই মেডিসিন নিয়ে এসেছে নোমান। পরবর্তী দুদিন অসুস্থতার জন্য স্কুলে পাঠায়নি নওরিনকে। শুরুতেই মেডিসিন প্রয়োগে জ্বর বাড়তে না দেওয়ায় আল্লাহর রহমতে দুদিনেই সুস্থ হয়ে গেছে নওরিন। তবে তৃতীয়দিনও স্কুলে যাওয়া হয়নি। তারা সপরিবারে চলে এসেছে হসপিটাল। ডাক্তার নোমানকে জিজ্ঞেস করেছিলো,
“রোগির সাথে আর কে এসেছে?”
“আমি এসেছি।”
নোমানের কথা যেন হাস্যকর লাগলো। তাই তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনাকে তো দেখতেই পাচ্ছি। আর কে এসেছে?”
নোমানও বুঝতে পারলো তার জবাব ডাক্তার মশকরা সমতুল্য নিয়েছে। তাই হাতের আঙুল ধরে পাশে দাঁড়ানো নওরিনকে একটু সামনে টেনে বললো,
“আর আমার মেয়ে এসছে।”
ডাক্তার হেসে উঠেছেন এবার। বুঝতে পারলেন নোমান প্রথম উত্তরই সিরিয়াসভাবে দিয়েছে। তিনি মূলত স্ত্রী লোকের সন্ধ্যানে এমন প্রশ্ন করেছিলেন। এখন তারা কেন নিয়ে এলো না, তা তো তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু মনে মনে বুঝলেন লোকটা বেশ সাহসী। তা না হলেই কি কোনো স্ত্রীলোক ব্যাতিত একাই বউ নিয়ে চলে আসে! তবে একজন হলেও স্ত্রীলোকের প্রয়োজন পড়ে এসময়ে রোগীর পাশে। কারণ স্ত্রী লোকের কাজ তো পুরুষ লোকের দ্বারা সম্ভব হয় না। কোনো কোনো রোগীকে তো দলগোষ্ঠী নিয়ে হাজির হতে দেখা যায়। বাধ্য হয়ে রাগারাগি করে তাদের দলগোষ্ঠী বের করে দিতে হয় হসপিটালের পরিবেশের সুশৃঙ্খলা বজায় রাখতে।
মাকে থিয়েটারে যেতে দেখে নওরিন ভয়ে কেঁদে উঠেছিলো। থিয়েটার কি জিনিস, তার জানা নেই। তবে হসপিটাল শব্দটাকে ভয়ংকর হিসেবেই ধারণা করে সে। সে জানে, এখানে ছুরি, কাচি থাকে। মানুষকে কেটে ফেলা হয়। তাই তার ভয় হচ্ছে। তারা আম্মুকে নিয়ে যাচ্ছে, আম্মুকে মেরে ফেলবে। এই ভেবেই ভয় হচ্ছে তার। ফাইজা তাকে আদর করে রেখে গেছে। এই ছোট বাচ্চার ভয় দেখে যেন তারও মনে ভয় জন্মেছে। শুধু নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে নোমান। সে নওরিনকে ভয়মুক্ত করতে ব্যস্ত হয়ে ছিলো। বাইরে প্রদর্শিত চেহারা একদমই স্বাভাবিক। তার চেহারা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, সে একটুও ভয় পাচ্ছে না, একটুও মন খারাপ করছে না। শুধু চোখটা তুলে অতি স্বাভাবিক, নির্ভয় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছে, যখন ফাইজা তার চেহারায় তাকিয়েছিলো। তার এই স্টুপিড মার্কা স্বাভাবিকতা দেখে এই মুহূর্তে রাগ হলো ফাইজার। মনের অভিমান, তাকে নিয়ে মন খারাপ করবে কেন? ভয় করবে কেন? তার মনে তো আর এখন সে নেই। সেখানে অন্য নারীর বসবাস! সে মরে গেলে তো এই লোক আরও হাফ ছেড়ে বেঁচে যায়।
অপারেশনের আগে দুই ব্যাগ রক্ত রেডি রাখতে হয়েছে। রক্ত সংগ্রহে মোটেও কষ্ট করতে হয়নি। তার পরিচিত লোক আর বন্ধুবান্ধবদের অভাব নেই। খুব সহজেই যেন রক্ত যোগাড় করে নিতে পেরেছে। যাদের রক্ত দেওয়ার কথা, তারা এসে রক্ত দিয়ে চলেও গেছে। বাবা মেয়ের শুধু অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার অপেক্ষা। আসর লগ্নে অতঃপর এক মুখোরিত মেঘাচ্ছন্ন বিকেলে অপেক্ষার অবসান ঘটলো বাবা মেয়ের। মানুষের আকারে বর্ণিত পিচ্চি পিচ্চি দুইটা নবজাতকের দিকে এক রাশ মুগ্ধতার চোখে তাকিয়ে ছিলো নওরিন। বাবাই বলেছে এরা নাকি তার দুইটা ভাই। সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছিলো, ভাইয়েরা দেখতে এমন কেন? বাচ্চারা বুঝি এতো ছোট হয়? বাচ্চারা তো আরেকটু বেশি বড় হয়। হাসতে পারে, ডাকলে শোনে, কথা বলতে পারে না তবে আই, আউ, ওউ করতে পারে। হাত পা নেড়ে খেলতে পারে, কাছে গেলে থাপ্পড় কিংবা লাথি দিতে পারে। খিলখিল করে হাসতে পারে। দিতির ছোট আপুটা তার চুলে ধরে টান দিয়ে বসেছিলো না একদিন! কিন্তু তার ভাইয়েরা তো হাসেই না। উল্টো, অযথা কান্না করছে! এতো ছোট হবে কেন!
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে এসবই ভাবছে মনে মনে। ভাবনার কারণ, সে এই প্রথমবারের মতো নবজাতক দেখলো। এর আগে ছোট বাচ্চা দেখলেও নবজাতকের সম্মুখে যাওয়া হয়নি তার। তাই সে জানে না, নবজাতক কেমন থাকে। কেন তারা অযথা কান্না করে। এতো ছোট কেন তার ভাইয়েরা, তার কারণ বাবাইকে জিজ্ঞেস করলে বাবাই জানিয়েছে, বাচ্চারা ছোটই থাকে। সে-ও একসময় এমন ছোটই ছিলো। নওরিনের যেন বিশ্বাস হলো না বাবাইয়ের কথা! এমনকি ফোনে তার ছোটকালের ছবি দেখলেও বিশ্বাস হয় না যে সে এতো ছোট ছিলো কখনো। বরং সবসময়ই মনে করে, এখন যেমন আছে তখনও তেমনই ছিলো! তবে এতো ভাবনার পরেও এখন আনন্দ হচ্ছে তার। কারণ সে জানে এই ছোট ছোট ভাই দুটোকে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। মায়ের কাছে এসে তো আনন্দে চিৎকার করেও উঠেছে,
“আম্মু! আমি দুইটা ভাইয়াকে দেখেছি!”
তার আনন্দের বিপরীতে ফাইজার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠেছে, সাথে চোখের ধার বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু! নওরিন তৎক্ষনাৎ আনন্দ থামিয়ে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রুবিন্দু হাতে মুছে নিয়ে বললো,
“তুমি কাঁদছো কেন, আম্মু!”
ফাইজা হাত বাড়িয়ে নওরিনের একটা হাত টেনে নিয়েছে৷ হাতের পিঠে চুমু দিয়ে বললো,
“কাঁদছি না আম্মু। এই যে, হাসছি তোমাকে দেখে।”
“তুমি ভাইয়াদের দেখেছো?”
ফাইজা দুচোখে ইতিবাচক পলক ফেললো। নোমানকে ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি রেখে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখা গেলো।