গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ০৫

গল্পের নাম:প্রেম পায়রা,পর্ব ০৫
লেখনীতে: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)

—‘হা করুন!’

চরম বিরক্তি নিয়ে কথাটি বললো তিথি।সম্পদ ল্যাপটপের স্ক্রিণ থেকে চোখ না সরিয়ে সামান্য হাঁ করলো।তিথির কপাল কুঁচকে গেল।বাচ্চাদের মতো এত ছোট্ট হা করলে খাওয়াবে কি করে!সে দু বার না ভেবে বাম হাতের প্লেটটা বিছানায় রাখলো।এক হাতে সম্পদের গাল চেপে বড় করে হাঁ করে পরোটার ছেঁড়া টুকরো ঢুকিয়ে দিল।মনে মনে বললো,

—‘খা বজ্জাত।ভালো করে খা!’

তার এহেন কর্মকান্ডে সম্পদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে।মুখের খাবার চিবানো বাদ রেখে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।তিথি সেসব পাত্তা দিল না।দ্বিতীয় বার বড়োসড়ো আরেক টুকরো হাতে নিয়ে সম্পদের গাল চেপে ধরতে সম্পদ তার হাত ধরে ফেলল।মুখের খাবারটুকু কোনো রকমে গিলে অবাক হয়ে বললো,

—‘হোয়াট’স রঙ উইথ ইউ তিথি?এমন বিহেভ করছো কেন?মানুষের মতো খাওয়াও!ছোট্ট ছোট্ট করে টুকরো করে, ভালোবাসা মিশিয়ে খাওয়াতে হয়।’

বলে সে অপেক্ষা করলো না।তিথিকে বোঝানোর ভঙ্গি করে নিজেই পরোটার একটা অংশ ছিঁড়লো।তাতে একটু সবজি মিশিয়ে তিথির মুখের সামনে ধরে বললো,

—‘এবার অল্প করে হাঁ করো তো!’

তিথির মুখ এমনিতে বিস্ময়ে সামান্য হাঁ হয়ে রয়েছে।সম্পদ খাবারের টুকরো এগিয়ে নিয়ে জোরপূর্বক মুখে দিতে সে কিঞ্চিৎ হাঁ করলো।সম্পদ গম্ভীর কন্ঠে বললো,

—‘বুঝতে পেরেছ?এখন সুশীল ভাবে আমাকে খাইয়ে দাও!আর হ্যাঁ!কাল থেকে তোমার বাতাসী খালার সাথে খাবে না।আমি যখন বাসায় থাকবো,একসাথে খাব আমরা।’

তিথি চুপচাপ সম্পদের মুখে খাবার তুলে দিল।আবার মন খারাপ হয়ে গেছে তার!তিন তিনটা দিন হয়ে গেল!অথচ তার হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ গুলোর সাথে এক পলকের জন্যও দেখা হলো না।তার বড় বাবা আসতে চেয়েছিল।সে কড়া ভাবে নিষেধ করেছে।এতে যে তার মন আরো দূর্বল হয়ে যাবে।তাকে দূর্বল হওয়া যাবে না।অনেক সাধনার এ জীবন যে তার!দূর্বল হলেই যে সে বিলীন হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।পৃথিবী দূর্বলদের জন্য নয়।প্রকৃতির অখন্ড নিয়মের মধ্যে একটি নিয়ম হলো,এই পৃথিবীতে দূর্বলদের কোনো জায়গা নেই।

—‘ভার্সিটি যাবে কবে থেকে?’

সম্পদের প্রশ্নে তিথি চমকে উঠলো।সে যে স্টুডেন্ট সেটা বেমালুম ভুলে গেছিল।তার পড়াশোনার পাঠ এখনো চুকেনি।তাকে তো স্টাডি কমপ্লিট করতে হবে।একটা সময় পড়াশোনা নিয়ে তার কত স্বপ্ন ছিল।নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে ভাবতে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়ে দিয়েছে।কখনো কল্পনায় ডাক্তার সেজে রোগীর চিকিৎসা করতো!কখনো বা বুয়েটের ইন্জিনিয়ারিং হয়ে বিদেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতো।মাঝে মাঝে মোটা ফ্রেমের চশমা সেঁটে গম্ভীর গলায় ক্লাস নিতে থাকা টিচিং প্রফেশনকে কল্পনা করতো।অথচ সব এখন কেমন মুখ থুবড়ে পড়েছে।এখন কিছুই হতে ইচ্ছে করে না।নিজেকে সবসময় খোলসের মধ্যে রাখতে ইচ্ছে করে।লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে ইচ্ছে করে।

স্বপ্ন দেখতে কোনো বয়স লাগে না।সময় লাগে না।এটা হয়তো তার জন্য ভুল!প্রতিটা জিনিসের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় যেমন বরাদ্দ থাকে,তেমনি স্বপ্ন দেখারও বোধ হয় একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে।সে সময় তার পেরিয়ে গেছে।এখন আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে না,কল্পনার শহর সাজাতে মন চায় না।এখন স্থবির হতে ইচ্ছে করে।উদ্ভিদের মতো কোথাও খুঁটি গেড়ে থাকতে ইচ্ছে করে।আর খরগোশের মতো শশব্যস্ত জীবন ভালো লাগে না।

সম্পদ তিথির দিকে চেয়ে বললো,

—‘কি হলো?ভার্সিটি যাবে কবে থেকে? ‘

—‘জানি না!’

সম্পদের খাওয়া শেষ।পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে তিথির দিকে তাকালো।তাকে অন্য মনস্ক দেখে মনে কষ্ট পেল।মেয়েটাকে সে উচ্ছ্বসিত দেখতে চায়।ভালোবাসা আর আদরে মুড়িয়ে দিতে চায়। তাকে হাসিখুশি রাখতে চায়।কিন্তু কোথায় যেন বাঁধা।সব ঠিক হয়েও কি যেন বেঠিক!সে মনে মনে বললো,

—‘তিলবতী!সময় দাও আমাকে।তোমার উলোটপালোট পৃথিবী ঠিক করে দেওয়ার দায়িত্ব আমার এবং একান্ত আমার।’

ল্যাপটপ শাট ডাউন করতে নিয়ে করলো না সম্পদ।একটা ড্রেস কোড বের করে তিথির দিকে এগিয়ে বললো,

—‘তিথি দেখো তো!মডেলটা কেমন?এটা উলের সোয়েটার।সামনের শীতের জন্য বাজারে আসবে।একই মডেল তবে উল আর লেদারের তৈরি হবে।’

তিথি এক নজর চেয়ে বললো,

—‘সুন্দর!’

—‘তুমি অামাদের গার্মেন্টসে যাবে?আমার অফিসও দেখে আসলে।’

তিথির মন খারাপ তীব্র হলো।মানুষটার আগ্রহ ভরা কন্ঠ সে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,

—‘আমি অন্য দিন যাব।আজ নয়!’

—‘আমি উঠি তাহলে।’

সম্পদ দ্রুত উঠে পড়লো।ল্যাপটপ রেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে আরেক বার দাঁড়াল।পরিপাটি চুলগুলোতে পুনরায় ব্রাশ করলো।হালকা করে পারফিউম স্প্রে করলো।ফাঁকে ফাঁকে আয়নায় ভেসে উঠা তিথির মুখ পানে চেয়ে রইলো।তার অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না।মন চাইছে তিথিকে মুখোমুখি বসিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিক!

প্যান্টের পকেটে একটা কলম গুঁজে আয়নার সামনে থেকে সরে আসলো সম্পদ।শার্টের হাতা একটু টেনেটুনে তিথির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

—‘আমি আসছি তাহলে।সাবধানে থাকবে।রান্নাঘরে যাবে না।প্রয়োজনে বাবার সাথে গল্প করো।স্নেহা বোধ হয় ভার্সিটিতে চলে গেছে।তাড়াতাড়ি তুমিও মানসিক ভাবে প্রিপেয়ার্ড হও।কাল অথবা পরশু থেকে ভার্সিটি যাবে।’

তিথি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।সম্পদ আলমারি থেকে স্যুটটা হাতে নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে দরজার দিকে গিয়ে আবার বললো,

—‘আমার নাম্বার তোমার ফোনে সেইভ করে রেখেছি।কিছু বলার থাকলে মেসেজ কোরো।’

—‘হুঁ!’

—‘আমার আসতে আসতে সন্ধ্যা হবে হয়তো।’

—‘হুঁ!’

সম্পদ আর দাঁড়াল না।দরজা ভিড়িয়ে চলে যেতে তিথি বড় করে শ্বাস নিল।অবশেষে রুমটাতে একটু একা একা থাকা যাবে।এরকম একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সাথে এক রুমে থাকা যে কতটা ডিফিকাল্ট সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।

এক লাফে উঠে সে ওয়াশরুমে ঢুকলো।বেসিনে প্লেট রেখে হাত ধুয়ে বের হয়েই চমকে গেল।সম্পদ রুমের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে কৈফিয়তের সুরে বললো,

—‘গাড়ির চাবি খুঁজে পাচ্ছি না।’

টেবিল ঘাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।তিথি এগিয়ে এসে নিজেও খোঁজা শুরু করলো।সে চাচ্ছে মানুষটা দ্রুত বাসার বাইরে যাক।দুই-তিন মিনিট খুঁজে চাবির হদিস পাওয়া গেল না।তিথি অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,

—‘কোথায় রেখেছিলেন?পাচ্ছি না তো।’

সম্পদ সোজা হয়ে ম্লান হাসলো।মাথার চুল গুলোতে ঘন ঘন আঙুল চালিয়ে বললো,

—‘খুঁজতে হবে না।মনে পড়েছে তিথি।চাবি তো ড্রাইভার চাচার কাছে।আমি আসছি।’

বলে সে বড় বড় পা ফেলে রুম থেকে বের হয়ে গেল।তিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।খোঁপা করে রাখতে মাথা ব্যথা হয়ে গেছে।সে এক টানে মাথার খোঁপা খুলে ফেলল।চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে বিছানায় বসতে নিতে সম্পদ আবার হুড়মুড় করে রুমে ঢুকলো।তিথি চমকে বলে উঠলো,

—‘আবার কি হলো?’

সম্পদ অগোছালো ভাবে বললো,

—‘ল্যাপটপ!ল্যাপটপ রেখে গেছি।’

সে দ্রুত বিছানার কাছে গিয়ে ল্যাপটপ টা হাতে উঠিয়ে চলে গেল।তিথির ভ্রু কুঁচকে গেল।মনে ক্ষীণ সন্দেহের দানা।সম্পদ নামক বদের হাড্ডি কি ইচ্ছাকৃত ভাবে বার বার রুমে আসছে?এটা ওটা নেয়ার অজুহাতে!সে হাঁসফাঁস করলো।কি শয়তান!কি নিখুঁত অভিনেতা।সে সিউর আবার আসবে।

তিথি এবার প্রস্তুতি নিয়ে রইলো।আসলে কড়া কিছু কথা বলবে।সে শাড়ির আঁচল ঠিক করে রুমে পায়চারি শুরু করলো।দু বার বেলকনিতে গেল।কিন্তু মিনিট পাঁচেক অতিক্রান্ত হওয়ার পরো যখন সম্পদ আসলো না তখন সে সত্যি সত্যি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।নিশ্চিত হলো যে অফিসে চলে গেছে।

নিশ্চিন্ত মনে বিছানার দিকে এগিয়ে গেল।বহুদিন হলো তার ভালো ঘুম হয় না।মেডিসিন না খেলে ঘুমেরা ধরা দেয় না।এখন চোখ দুটো কেমন লেগে আসছে।একটু শান্তি মতো ঘুমাবে সে।সম্পদ থাকাকালীন সারাক্ষণ মনের ভেতর কেমন কেমন করে।ঘুমের মধ্যেও সতর্ক থাকতে হয় যেন কাপড় এলোমেলো না হয়ে যায়।সবসময় মনে ভয় থাকে।আজ সারাদিন সে ভয় নেই।

বিছানার মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে এ কয়েক রাত তারা ঘুমিয়েছে।তিথি মাঝের কোলবালিশটা লাথি দিয়ে ফেলে দিল।সম্পূর্ণ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো।একটুপর ভেড়ানো দরজার দিকে এক পলক চেয়ে বুকের আঁচল গুটিয়ে নিল।মাথার চুল গুলো বালিশে ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।

কয়েক সেকেন্ড নিরবে নিস্তব্ধে কাটলো।পরমুহূর্তে নিস্তব্ধতার সুর কেটে বুট পায়ে রুমে কারো প্রবশের আওয়াজ কানে আসলো তিথির।মস্তিষ্ক সচল হয়ে গেল তার।এক লাফে শোয়া থেকে উঠে পড়লো।দরজার দিকে তাকিয়ে সম্পদের ক্লান্তিমাখা অবয়ব দেখে বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে পড়লো।শাড়ির আঁচল ঠিক করে ভয়ার্ত গলায় বললো,

—‘ফি-ফিরে আসলেন যে!’

সম্পদের বিধ্বস্ত চেহারা।এ কয়েক মিনিটে যেন ঝড় বয়ে গেছে তার উপর দিয়ে।চুল গুলো এলোমেলো।শার্টের ইন ঠিক নেই।টাই অবিন্যস্ত।চোখে মুখে কেমন বিষণ্ণতা লেগে অাছে।তিথির বুকের ভেতর ভয় ঢুকে গেল।তাকে আরেক ধাপ অবাক করে সম্পদ এলোমেলো পায়ে এগিয়ে এসে ধপ করে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো।

তিথি মুখে হাত চেপে বিস্ফারিত কন্ঠে বললো,

—‘কি হয়েছে আপনার?এমন করছেন কেন?’

সম্পদ কিছু বললো না।তবে আস্তে আস্তে তার বলিষ্ঠ হাত দুটো তিথির কোমড় জড়িয়ে নিল।পেটে মুখ গুঁজে সম্পদ চোখ বন্ধ করলো।

তিথি জমে পাথর হয়ে গেছে।ডান হাতটা এখনো তার মুখে।চোখে মুখে অস্থিরতা।আশপাশে কি হচ্ছে ঠাওর করার চেষ্টা করছে।সে মাথা নিচু করে বিস্ফারিত নয়নে সম্পদের দিকে তাকালো।সম্পদ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো টেনে টেনে বললো,

—‘তিথি!আমি ক্রমেই পাগল হয়ে যাচ্ছি।এতদিন ভেবেছি তোমার থেকে দূরে আছি বলে এই উদ্ভ্রান্ত ভাব।তোমাকে পাশে পেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু হলো তার উল্টো।তোমাকে পাশে পেয়ে আরো পাগল হয়ে গেছি।এখন সারাক্ষণ তোমায় চোখের সামনে চাই।আমার কাছাকাছি চাই।২৪/৭ তোমার মুখ দেখতে চাই,আমার আশপাশে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করতে চাই।’

সম্পদের হাতের বাঁধন শক্ত হয়ে এলো।আরো গভীর ভাবে নিজের মুখটা তিথির শাড়িতে আবৃত পেটে গুঁজে দিল।

তিথির ছটফটানি শুরু হলো।শরীর ভেঙে আসছে।চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়তে সে কোনোরকমে বলল,

—‘আপনি পাগল হয়ে গেছেন।আমায় ছাড়ুন!’

তিথির কান্না মিশ্রিত কন্ঠে সম্পদ নিজের হুঁশে ফেরে।সে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।তার চোখে মুখে লজ্জার আভা।যেন নিজের কাজে ভীষণ লজ্জিত।সে তোতলানো স্বরে বললো,

—‘ডোন্ট ক্রাই!আমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।তুমি প্লিজ কান্না করো না তিথি।আমি আসছি।’

কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে সে দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।সিঁড়িতে ধুপধাপ পায়ের শব্দ হতে তিথির পা ভেঙে এলো।ফ্লোরে বসে বুক উজাড় করে সে কান্না শুরু করলো।

এতোদিন কল্পনার সংসার সাজাল একজনকে নিয়ে।অথচ পাশে পেল অন্যজনকে।এখন না পারছে পুরাতন মায়া ভুলে এই মানুষটাকে কাছে টানতে, না পারছে ছেড়ে যেতে!জীবন এত বিচিত্র কেন?সে কি করে সম্পদকে বলবে, আমি অন্য একজনকে ভীষণ ভালবাসতাম!অন্য কারো সাথে পায়ে পা ফেলে,আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে বার্ধ্যের শহর দেখার স্বপ্ন দেখাতাম!কিভাবে বলবে সে!

১০.

নিশান রুমে ঢুকতে ড্রেসিং টেবিলের দিকে নজর গেল।তুলি পরম আয়েশে চেয়ারে বসে মাথার চুল আঁচড়াচ্ছে।তার চোখে মুখে কেমন সুখী সুখী ভাব।মাথার চুল আঁচড়ানোর স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে সে পরম সুখে আছে।হঠাৎ করে নিশানের কানে অস্পষ্ট গানের লাইন ভেসে আসল।সঙ্গে সঙ্গে তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল।তুলি কি গুনগুন করে গানও গাইছে?

অথচ নিশান জানে তুলির এখন গান গাওয়ার সময় নয়।চোখে মুখে খুশি উপচে পড়ার কথা নয়।কারণ তদের বিয়েটা যে স্বাভাবিক ভাবে হয়নি।সে তো নিশানকে নিয়ে স্বপ্ন সাজায়নি।তার কল্পনার সংসারে তো নিশানের পরিবার ছিল না।না নিশান তুলির মনের মানুষ, আর না তুলি তার মনের মানুষ!তুলি তো ভালোবাসতো অন্য একজনকে।নিশানের বন্ধু মিরাজকে!

নিশান সামান্য গলা খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি বোঝাল।কয়েক পা এগিয়ে বিছানায় বসলো।তুলি ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার তাকে দেখে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিল।এখনো সে গুনগুন করছে।তবে গানের লাইন স্পষ্ট না।তুলির এহেন আচরণ দেখে নিশান ভড়কে গেল।তুলি এত স্বাভাবিক কেন?কিভাবে সম্ভব?

সে বিছানায় আধ শোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করলো।সঙ্গে সঙ্গে তার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল।

মিরাজ নিশানের ছোটবেলার বন্ধু।সে যখন মোহাম্মদ পুরের স্কুলে ভর্তি হয় তখন মিরাজের সাথে তার পরিচয়।ক্লাস এইটে অবশ্য মিরাজ স্কুল চেঞ্জ করার জন্য বেশকিছু বছর তাদের মধ্যে তেমন যোগাযোগ ছিল না।হঠাৎ হঠাৎ কথা হতো।কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তির পর সে কাকতালীয় ভাবে মিরাজকে পেয়ে গেল।দুজনের একই ডিপার্টমেন্ট।সেই সুবাদে পুরনো বন্ধুত্ব তরতাজা হয়ে গেল।নতুন প্রাণ পেল।এরপর কয়েক বছর হৈ হুল্লোড়ে কেটে গেল।ভার্সিটিতে শেষ হলো।

মাস ছয়েক আগে মিরাজ তাকে বললো সে তুলি নামের একটা মেয়েকে ভালোবাসে।মেয়েটা গরিব ঘরের।আপন মা নেই,সৎ মায়ের সংসারে ভীষণ অবহেলিত।সে মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছে।

নিশান তাকে উৎসাহ দিল।মেয়েটাকে আগলে রাখতে বললো।একদিন মিরাজ তাকে জোর করে সাথে নিয়ে তুলির সাথে দেখা করতে গেল।তুলির বাড়ি টঙ্গী পাড়ার বসতি এলাকায়।রাস্তাঘাট আর বস্তির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে নিশানের মন খারাপ হয়ে গেল।কিন্তু সেই মন খারাপ ভাব বেশিক্ষণ রইলো না।তুলির মতো ফুটফুটে মেয়েকে দেখে সব মন খারাপ ভাব উবে গেল।মিরাজের পছন্দের প্রশংসা করলো এবং তাকে উৎসাহিত করলো যেন অতিদ্রুত মেয়েটিকে বিয়ে করে ঘরে তোলে।

এরপর তাদের মধ্যে তুলির ব্যাপারে আর কথা হয়নি।নিশান তার জব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।একদিন গভীর রাতে মিরাজ তাকে ফোন দিয়ে বলে যে তুলি তাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছে।তার সৎ মা নাকি বউ মরা বয়স্ক এক ট্রাক ড্রাইভারের সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে।তিনদিন পর শুক্রবার বিকেল চারটায় সে তুলিকে কাজী অফিসে বিয়ে করবে।লুকিয়ে বিয়ে করবে কারণ মিরাজের পরিবার তুলিকে বৌ মা বানাতে রাজি নয়।

নিশান সব বুঝতে পারলো এবং মিরাজের কথামতো বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে থাকতে রাজি হলো।এরপরের তিনদিন আর মিরাজের সাথে তার যোগাযোগ হলো না।শুক্রবার সকাল থেকে মিরাজকে ফোনে পেল না সে।তবুও আগের কথামতো বিকেলবেলা নির্দিষ্ট কাজী অফিসে গেল।তার যেতে যেতে একটু দেরি হয়েছিল।গিয়ে দেখলো আরো দুজন ছেলে এসেছে এবং তুলি নামের কিশোরী মেয়েটা বোরখা পড়ে জবুথবু হয়ে বসে আছে।কোথাও মিরাজের চিহ্ন নেই।তাকে দেখে তুলির ভয় কিঞ্চিৎ কমে গেল।সে হড়বড় করে বললো,

—‘আপনার বন্ধু এখনো আসছে না কেন?চারটার সময় আসার কথা।এখন ছয়টা বাজতে চলল।’

নিশান চট করে কোনো উত্তর দিতে পারলো না।তুলিকে শান্ত হতে বললো।বার বার মিরাজের ফোনে ফোন দিল।কিন্তু নট রিচেবেল দেখাল।তুলির কাছে শুনলো গতকাল রাত থেকে মিরাজকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।আগের কথা অনুযায়ী সে চলে এসেছে।কারণ আজ সন্ধ্যার পর তার বিয়ে।বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে।

নিশান পড়ে গেল গভীর চিন্তায়।না চাইতেও ঝামেলার মধ্যে ফেঁসে গেল।তুলি আর অপরিচিত বন্ধু দুটোকে নিয়ে রাত নয়টা পর্যন্ত একই জায়গা অপেক্ষা করলো।কিন্তু মিরাজের ছায়াটুকু দেখা দিল না।এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে তুলি নাঁকি সুরে কান্না শুরু করলো।নিশান তাকে বুঝিয়ে বাড়ি পাঠাতে চাইলো।কিন্তু তুলি নারাজ।বাড়ি কিছুতেই ফিরবে না।ফিরলে তার সৎ মা মেরে ফেলবে।অবস্থার অবনতি দেখে মিরাজের বন্ধু দুটো সুযোগ বুঝে সটকে পড়লো।

নিশান পড়লো অথৈ সমুদ্রে।রাত বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় থাকা বিপদজনক।সে একটু চিন্তা করে তুলিকে তার সাথে নিয়ে যা-ওয়ার কথা বললো।তুলি প্রথম দিকে রাজি হতে চাইলো না।কিন্তু আর কোনো উপায় না দেখে রাজি হলো।তুলি তখনো কান্না করছে।নিশান রিকশা খুঁজতে নিতে একদল ছেলের হাতে পড়লো।তুলির কান্না দেখে তারা ভেবেছে মেয়েটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সটকে পড়ছে।সেই ভেবে তাকে ঘিরে ধরলো চারপাশ থেকে।অনেক বুঝিয়েও কূল কিনারা পেল না।কারো কথা শুনলো না।এক প্রকার জোর করে টেনে কাজী অফিসে নিয়ে তার আর তুলির বিয়ে দিয়ে দিল।

নিশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।তুলি আর তার বিয়েটা একটা দূর্ঘটনা।অথচ এই দূর্ঘটনা তার জীবনটা কোথা থেকে কোথায় এনে দাঁড় করাল।সে হারাল তার ভালোবাসার মানুষ, তার এক সময়ের পুতুল বউকে!

—‘আপনি আজ অফিস যাবেন না নিশান ভাই?’

খচ করে ‘নিশান ভাই’ শব্দটা নিশানের বুকে গিয়ে বিঁধলো।তিথি তাকে কথায় কথায় নিশান ভাই, নিশান ভাই বলে ডাকতো।সে দ্রুত চোখ খুলে সামনে তুলিকে দেখে মিইয়ে গেল।তুলির চুল বাঁধা শেষ।মোটা করে একটা বিনুনি করে সামনে এনে রেখেছে।মাথায় আঁচলে নেই।

নিশানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তুলিই কি তার আজকের এই জীবনের জন্য দায়ী?তার আজকের এই জীবনের জন্য কি তুলি দায়ী?সে কি তুলিকে বকা দিবে?

পরমুহূর্তে তার আরেক মন বিদ্রোহ করে উঠলো।তুলিও তো তারই মতো পরিস্থিতির স্বীকার।সেও তো বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে।

—‘কি হলো? কথা বলছেন না কেন?অফিস যাবেন না নিশান ভাই?’

নিশান ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—‘আমাকে নিশান ভাই বলে ডাকবে না তুলি।’

—‘তাহলে কি বলে ডাকবো?’

—‘জাহান্নাম বলে ডাকো!তবুও নিশান ভাই বলে ডাকবে না।’

—‘ঠিক আছে নিশান ভাই!’

নিশান বিরক্ত হলো।চরম বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করলো।পরক্ষণে বললো,

—‘চোখের সামনে থেকে দূর হও!’

তুলি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে বললো,

—‘ঠিক আছে নিশান ভাই।’

১১.

অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল সম্পদের।ড্রয়িং রুমে কাউকে চোখে পড়লো না। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি মাড়িয়ে বাবার রুমে আগে গেল।তার এক হাতে মেডিসিন আর আরেক হাতে দুটো বই।তার বাবা দুদিন আগে জুলভার্নের কিছু রচনাবলি আনতে বলেছিল।সেটাই আজ ফিরতি পথে নিয়ে এসেছে।

বাবাকে মেডিসিনের সময়াবলি বুঝিয়ে সে স্নেহার রুমে ঢুকলো।স্নেহা ফোনে কিছু একটা করছিল।সম্পদকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে এসে বললো,

—‘ভাইয়া!’

সম্পদ তার হাতে ছোট্ট একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো,

—‘রাতের খাবার খেয়েছিস তো?’

—‘হুঁ!ভাবীও খেয়েছে।তুমি আজকেও এত দেরিতে ফিরলে?’

—‘তিনদিন পর অফিসে গেছি।অনেক কাজ পেন্ডিং এ ছিল।’

—‘ফ্রেশ হও গিয়ে।’

—‘রাত জাগবি না কিন্তু।তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পর।’

স্নেহা মাথা নাড়তে সম্পদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়াল।

দরজা ভেড়ানো ছিল।তার সামনে দাঁড়াতে সম্পদের বুকের ভেতর অজানা সুখের ঢেউ বয়ে গেল।সাবধানে দরজা খুলে দেখলো রুম অন্ধকার।ক্ষীণ স্বরে সে ডাকলো,

—‘তিথি!এই তিথি!’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here