গল্প:রঙহীন জীবনের রঙ,পর্ব ১

গল্প:রঙহীন জীবনের রঙ,পর্ব ১
লেখনীতে:স্বর্ণা সাহা (রাত)

যে মেয়ে একটা বাচ্চা দিতে পারেনা,, তার সাথে আমি সংসার করবো না মা, কখনোই না, তাই আমি ঠিক করেছি আমি দিশানী কে ডিভোর্স দেবো

নিজের বর নির্ঝর এর মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠলো দিশানী,, ও নির্ঝর এর কাছে গিয়ে বললো,,
—কি বলছো এসব তুমি নির্ঝর ?

দিশানীর শাশুড়ি অর্থাৎ নির্ঝরের মা দিশানীর কথার উত্তরে বললো,,
—আমার ছেলে তো ভুল কিছু বলেনি বৌমা,, বিয়ের চার বছর পরেও তুমি আমার ছেলেকে বাবা ডাক শোনার সুযোগ দাওনি,,চার বছরেও আমরা দাদু ঠাকুমা ডাক শুনতে পেলাম না,,কম টাকা তো খরচা করা হয়নি তোমার পিছনে,, কত ডাক্তার দেখানো হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই কিন্তু তুমি আমাদের বংশে একটা সন্তানও দিতে পারোনি,, তাই আমি ঠিক করেছি,, আমি আমার ছেলের আবার বিয়ে দেবো।

দিশানী ওর শাশুড়িকে বললো,,
—এমন কথা বলবেন না মা ,, আর সবসময় যে বাচ্চা না হওয়ার পেছনে একটা মেয়েরই দোষ থাকবে এটার তো কোনো যুক্তি নেই একটা ছেলেরও তো দোষ থাকতে পারে তাহলে আ..

পুরো কথা শেষ না হতেই দিশানীর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়তেই দিশানী আহঃ করে উঠলো,, দিশানী তাকিয়ে দেখে ওর বর নির্ঝর ওর গালে চড় মেরেছে,, দিশানী কিছু বলতে যাবে তার আগেই নির্ঝর বলতে শুরু করলো,,

—চুপ আর একটাও কথা বলবি না তুই,, অনেক বলে ফেলেছিস, তোর খুব বার বেড়েছে না, আমার খাবি আমার পড়বি আর আমাকেই দোষারোপ করবি??

নির্ঝর এর মা সুজাতা নির্ঝর কে বললেন,,
—দেখেছিস কি পরিমাণ বেয়াদব মেয়ে,বলে কিনা ওর বাচ্চা হয়না তাতে নাকি তোর দোষ?

নির্ঝর দিশানী কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো। ধাক্কা দেওয়ার কারণে দিশানীর ডান হাত টেবিলের সাথে লেগে হালকা কেটে যায়,, দিশানী নিচে বসে কাঁদতে থাকে। দিশানী কে কাঁদতে দেখে ওর শাশুড়ি বললো,,
—একদম আমার সামনে নেকা কান্না কাঁদবে না,, টেবিলে বাসনগুলো পড়ে আছে যাও বাসনগুলো মেজে গুছিয়ে রাখো

দিশানী হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো,, ওর শাশুড়ি সুজাতা ওখান থেকে চলে গেলে দিশানী দেখে ওর হাত দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে,, এসব কে উপেক্ষা করে ও নিচ থেকে উঠে টেবিল থেকে থালাবাসন নিয়ে ধুতে চলে যায়

————
হাতের কাটা জায়গায় সাবানগুঁড়ো আর থালা বাসনে লেগে থাকা ঝালমশলা লেগে জ্বলে যাচ্ছে তবুও চোখে জল নিয়ে হাতের অসম্ভব জ্বলুনি সহ্য করে দিশানী একে ধ্যানে একের পর এক বাসন মেজে যাচ্ছে আর ভাবছে পৃথিবীতে কত নির্মম লোক বাস করে,, যাদের অন্যদের জন্য নিম্নতম মায়াও হয়না,, বাসনগুলো মেজে ধোয়ার সময় জলগুলো যেনো আরো বেশি করে কাটা স্থানের জ্বলুনির কথা জানান দিচ্ছে।
কোনো রকমে থালাবাসন মেজে টেবিলে সাজিয়ে রেখে ওখান থেকে একটা থালা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো দিশানী,,প্রতিদিন বাড়ির সবাই খেয়ে নিলে তারপর দিশানী খাবার খায়, কিন্তু আজ এতো ঝামেলার মধ্যে আর খাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর, খিদের চোটে পেটে যেনো ছুঁচো দৌঁড়াতে শুরু করেছে,, গত এক বছর ধরে এই রকম অবহেলা সহ্য করছে মেয়েটা শুধু এই পরিবারে একটা বংশধর না দিতে পারার কারণে,,দিশানী শুধু ভেবে গেছে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু ও কখনো ভাবতেই পারেনি নির্ঝর ওকে ডিভোর্স দিতে চাইবে।একটা মানুষ ৩বছরের মধ্যে কি করে পাল্টে যেতে পারে, নির্ঝর তো দিশানীর প্রতি খুব কেয়ারিং ছিলো কিন্তু ১ বছরের মধ্যে সব বদলে গেছে। আগের নির্ঝর আর এখনকার নির্ঝরের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ, যে নির্ঝর আগে সবসময় দিশানীর খোঁজ-খবর নিতো সে এখন দিশানীর দিকে ঠিক করে চেয়েও দেখেনা।

রান্নাঘরে গিয়ে রাইস কুকারের ঢাকনা খুলে দেখে অল্প কিছু ভাত সেখানে অবশিষ্ট আছে কিন্তু দিশানীর স্পষ্ট মনে আছে সবাইকে খেতে দেওয়ার পরে রাইস কুকারে যথেষ্ট পরিমানে ভাত ছিলো যা দিশানী খেলেও সামান্যটুকু ভাত রয়ে যাবে।এসব ভাবতে ভাবতেই দিশানী দেখলো ওর ননদ নিরা একটা প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে আসছে,,নিরা রান্নাঘরে ঢুকে প্লেট রাখতেই দিশানী নিরাকে জিজ্ঞাসা করলো,,
—নিরা এটা কিসের প্লেট রাখলে তুমি আর রাইস কুকারে যে ভাতগুলো ছিলো সেই ভাতগুলো কোথায় তুমি কি তা জানো??

নিরা বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,,
—বাড়ির সামনে একটা কুকুর এসে ঘেউ ঘেউ করছিলো আমি ভাবলাম খাবারের জন্য হয়তো ঘেউ ঘেউ করছে তাই ওকে কিছু খাবার দেবো বলে রান্নাঘরে এসে দেখি রাইস কুকারে অনেক ভাত আছে তাই আমি ভাতগুলো ওই কুকুরটাকে খেতে দিয়েছি

দিশানী একটু নিচু গলায় বললো,,
—ওহ,, আসলে আমি দুপুরে ভাত খাইনি তো তাই ওই ভাতগুলো রাইস কুকারে রাখা ছিলো,ভেবেছিলাম বাসনগুলো মেজে এসে তারপর খাবো।

—তোমার যে কথা বৌদি,, এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল,,আমি কি করে বুঝবো যে তুমি এখনো খাওনি যত্তসব ,, আমি ভেবেছি সবার খাওয়া হয়ে গেছে তাই আমি ভাতগুলো কুকুরটাকে খেতে দিয়েছি

সুজাতা রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে দিশানীকে বললো,,
—ওকে খাওয়ানোর থেকে তো কুকুরবিড়াল কে খাওয়ানো অনেক ভালো,, ওকে খাইয়ে শুধু আমাদের অন্ন-ই ধ্বংস হচ্ছে,, তাছাড়া তো কোনো উপকার হচ্ছে না
সুজাতা এবার নিরার দিকে তাকিয়ে বললো,,
—এই তোর সাথে আমার দরকারি কথা আছে,, আমার ঘরে আয় তো
কথাটা বলেই সুজাতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

নিরা হাত ধুয়ে বাইরে যাওয়ার সময় দিশানী কে বলে গেলো,,
—এরকম দম ধরে দাঁড়িয়ে থেকো না,, কিছু কাম-কাজ করো,, বসে বসে শুধু গিললে তো আর হবেনা,, আর শোনো একদিন না খেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না
নিরা এসব বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো

দিশানীর চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করলো।দিশানীর যে এ বাড়িতে কোনো মূল্য নেই সেটা দিশানী খুব ভালো করেই জানতো কিন্তু তাই বলে আজ এই বাড়ির সকলের কাছে দিশানী কুকুর-বিড়ালের থেকেও নিম্নতম প্রাণী তা ও স্বপ্নেও ভাবেনি,, এই বাড়ির লোকজনের কাছে কুকুর-বিড়ালের জন্য যে মায়া আছে,,দিশানীর জন্য সেই মায়ার এক কণাও নেই।

দিশানী মনে মনে ভাবতে লাগলো,,বাচ্চা না হওয়ার পেছনে কি সবসময় একটা মেয়েরই দোষ থাকে,, ছেলেদের কি কোনো দোষ থাকতে পারেনা? তবুও এই নিষ্ঠুর সমাজ একটা মেয়েকেই সবসময় দোষী বানায়,,তিল তিল করে মেয়েটার মনটাকে মেরে ফেলে,একটা জিন্দা লাশ বানিয়ে ফেলে,তার জীবনে সুখ-শান্তি নামের কোনো বস্তু থাকেনা,বরং মেয়েটার জীবনটা দুঃখের সাগরে ভেসে যায়।
দিশানীর এর আগের বারের ডাক্তারের কথা মনে হলো সে বলেছিলো, নির্ঝরের একটা টেস্ট করিয়ে নিতে,, শুধু এর আগের বারের ডাক্তার কেনো আজ অবধি যতগুলো ডাক্তার দেখানো হয়েছে সবাই একই কথা বলেছেন।ডাক্তাররা যখনি এই কথা বলে নির্ঝর তখনি ডাক্তার পাল্টায়,,নিজে সবসময় নিজের জায়গায় ঠিক থাকতে চায়,, নিজের দোষ, নিজের অক্ষমতাগুলোকে আড়াল করতে যায়,,কারণ নির্ঝর মনে করে একজন পুরুষমানুষের কোনো দোষ হয়না সব দোষ শুধু নারীর,, কিছু কিছু পুরুষ আছে যারা সবসময় নিজেকে উপরে রাখতে চায়,,নারীকে সবসময় ছোটো করতে চায়,নির্ঝরও হয়তো সেই পুরুষগুলোর মধ্যেই পড়ে।

দিশানী এসব ভাবনা-চিন্তা বাদ দিয়ে খালি পেটেই নিজের অন্য কাজ শুরু করলো।সবার কথা শুনেই পেট ভরে গেছে,, খাওয়ার জন্য পেটে এখন আর এক চুল পরিমাণও জায়গা নেই।

দিশানী অনেক বার এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছে কিন্তু ও কি করবে এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে গেলেও ওর তো কোনো ভবিষ্যৎ থাকবেনা কার কাছে যাবে দিশানী? ওর বাবার বাড়িতে? সেখানে কি ওর জায়গা হবে, মেয়েদের আসলে নিজের বাড়ি হয়না,বাপের বাড়ি শশুর বাড়ি করতেই জীবন শেষ হয়ে যায়।দিশানীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই ওর বাবা মারা যায়,, পরীক্ষা কোনো মতে দিলেও এর পরের পড়াশোনা চালাতে চাইলে ওর বড় ভাই ওর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে তারপর দিশানীর বিয়ে দিয়ে দেয়, এতেই দিশানীর বড় ভাইয়ের তার বোনের প্রতি সকল দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে.আর এখন তো ওর ভাইয়ের বউও আছে, দিশানীর বৌদিও দিশানী কে খুব একটা পছন্দ করে না, তাহলে দিশানী কার কাছে গিয়ে উঠবে?সেজন্যই তো ডিভোর্সে ভয় পায় দিশানী।

একটা ছেলে ছিলো যে দিশানী কে পাগলের মতো ভালোবাসতো, ছেলেটা দিশানীর ২বছরের সিনিয়র ছিলো,ক্লাস ৯ থেকে দিশানীর পেছনে প্রচুর ঘুরেছে, অনেক বার প্রপোস করেছে কিন্তু দিশানী কখনো কোনো উত্তর দেয়নি,কিন্তু দিশানীর ছেলেটার প্রতি মায়া জন্মে গেছিলো ও ভেবেছিলো ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করবে কিন্তু তার আগেই এতকিছু ঘটে গেলো।দিশানী একজনের থেকে শুনেছে ছেলেটা নাকি এখন একজন ডাক্তার,প্রতিষ্ঠিত একটা মানুষ। এখন হয়তো দিশানীর কথা আর ছেলেটার মনে পড়েনা আর নয়তো আজও ছেলেটা দিশানীকে নীরবে ভালোবেসে যায়।

কাজ করতে করতেই নিরা দিশানী কে ডাক দেয়,

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here