কে_তুমি,পর্ব:৪,৫
Tahmina_Akther
পর্ব:৪
কেউ গুনগুনিয়ে কাঁদছে, যে কান্না করছে তার গলার স্বর আমার পরিচিত।চোখ মেলে যে তাকাবো সেই শক্তি টুকু নেই মনে হচ্ছে। কারন, আমি ভীষণ রকমের ক্লান্ত।
তবু্ও, বহুকষ্টে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আম্মু কাঁদছে আর আব্বু আম্মুকে স্বান্তনা দিচ্ছেন।
সিঁড়িঘরের সেই অদৃশ্য কন্ঠের কথা মনে আছে আমার। এরপর আমার আর কিছুই মনে নেই।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ১২ টা বাজে, দুপুর নাকি রাত ১২টা বুঝতে পারছি না।
তাই আম্মুকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করব এখন কি রাত নাকি দিন?
কিন্তু আমার গলা থেকে শত চেষ্টা করার পরও আওয়াজ বের হচ্ছে না।
আমার গোঙানির শব্দে আব্বু – আম্মু দুজনেই আমার কাছে এসে বসে।
আম্মু আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে খুশিতে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন এবং আমার সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন।
আব্বু আমার ডানহাত ধরে বলছেন,
– মা,আমার তুমি কেন বিকেলে ছাদে যেতে গেলে? তোমাকে আমি তোমার আম্মু বহুবার না করেছিলাম ছাদে যেতে, বিশেষ করে একা আর বিকেলে ও সন্ধ্যায়।
কেন গিয়েছিলে মা?
বলেই কেদে ফেললেন কায়নাতের বাবা শাহিন।
– তুই যখন আমার ডাক শুনে আসিস নি তখন ছাদে আমি যাচ্ছিলাম তোকে ডাকতে।
কিন্তু, তোকে আমি পাই ছাদে যাওয়ার মধ্যেভাগ সিঁড়িতে।
তোর সারা শরীর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল। যেন মনে হচ্ছিল তোর ভেতরে আগুন ধরে গেছে।
তোর এই অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করে তোর বাবাকে ডাকতেই, তোর বাবা এসে তোকে নিয়ে আসে এইখানে আমাদের রুমে।
তুই, চিন্তা করিস না। তোকে ডাক্তার দেখিয়েছি।
তুই যে হঠাৎ করে কেন অজ্ঞান হয় পরলি তা আমরা কেউই বুঝতে পারছি না?
কিছু জটিলতার জন্য তুই দু-একদিন কথা বলতে পারবি না, পরে ঠিক হয়ে যাবি।
বলেই কায়নাতের চোখের কোণায় জমে থাকা চোখের পানিটুকু মুছে দিলেন কায়নাতের মা শাহানা।
কায়নাত মনে মনে ভাবছে, তাহলে কি অদৃশ্য কিছু আমার ক্ষতি করতে চাইছে, আর আমার কানেই তো বলল, আমার উপর থেকে নাকি তার নজর সরবে না।
হে আল্লাহ, আপনি আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করুন।
কায়নাতের বাবা উঠে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন।
আর তখন কায়নাত দেখতে পেল দুপুরের ঝলমলে কড়া রশ্মি।
তারমানে সে গতকাল বিকেলের পরে জ্ঞান হারিয়ে আজ দুপুর ১২ টায় জ্ঞান ফিরে পেয়েছে।
এত দীর্ঘ সময় সে সেন্সলেস থাকায় তার বাবা মা এত দুশ্চিন্তায় ছিল।
সে আবার কথা বলতে পারলে,তার আব্দুল আঙ্কেল এবং বাবাকে বলবে সিঁড়ি ঘরের ঘটনা।
মেয়েকে সুস্থ দেখেই কায়নাতের বাবা খুশি হলেন ঠিকই কিন্তু উনার স্ত্রীর মেয়ের সঙ্গে মিথ্যে কেন বললেন বুঝতে পারছেন না?
কায়নাতের বাবা ভেবে রেখেছেন,তিনি এক ফাঁকে শাহানাকে জিজ্ঞেস করবেন কেন তিনি কায়নাত কে সত্য বলে নি?
চলবে
#কে_তুমি
#পর্ব:৫
#Tahmina_Akther
-শাহানা, তুমি কেন সত্যি বললে না কায়নাতকে?
ওকে ওর নিজস্ব সমস্যা জানালে ওর জন্যই ভালো। আর কিভাবে বললে তুমি বুঝবে বলো?
প্রশ্নের উত্তর দাও?
শেষের কথাটুকু উচ্চস্বরে বললেন কায়নাতের বাবা।
-আমার এত সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটা হঠাৎ করেই এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে কে জানে বলো?
ওকে আমি বারংবার ছাদে যেতে মানা করেছি কিন্তু, ও আমার কোনো কথাই শুনেনি।
কাল যখন ওকে তুমি সিঁড়িঘর থেকে রুমে নিয়ে আসার পর নানা কায়দায় তাকে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করতে লাগলে।
বহু চেষ্টার পর যখন কায়নাতের জ্ঞান ফিরে এলো, তখন স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেললাম।
কিন্তু, আসলেই, আমার মেয়ের জ্ঞান আসেনি। এসে ছিল আমার মেয়ের উপর নজর দেওয়া সেই অদৃশ্য জ্বীন। কিন্তু,
এতটুকু বলেই থেমে গেলেন শাহানা। শাহানাকে থামতে দেখেই শাহীন মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো কায়নাতকে।
যে কীনা দরজার পাশে দাড়িয়ে অশ্রুজল আখিদ্বয় দিয়ে তাকিয়ে আছে তার মা বাবার পানে।
কায়নাত কয়েক কদম ফেলে তার মায়ের পাশে বসে কথা বলার চেষ্টা করছিল।
মনে মনে কায়নাত বলছে,
– আল্লাহ, তুমি চাইলে আমি কথা বলতে পারব? একটু দয়া করো তোমার বান্দার উপর।
খানিকবাদে শুধু কায়নাতের কন্ঠে কয়েকটি শব্দ উচ্চারিত হলো,
– মা, কি হয়েছিল আমার সেদিন?দয়া করে বলো।
বহুকষ্টে কথাগুলো বলল কায়নাত।
মেয়েকে কথা বলতে দেখে শাহীন এসে মেয়ের হাত ধরে বললেন,
– মা,তুই এখন আর কোনো কথা বলিস না। তোর কষ্ট হবে। আমি বলছি কি হয়েছিল? শুধু একটা কথা মাথায় রাখিস তোর বাবা মা তোর সঙ্গে আছে, তোকে সবসময় আগলে রাখবে সবরকম মুসিবত থেকে।
তোর জ্ঞান আসার পর তোর মা এবং আমি, তোর আব্দুল আঙ্কেল অনেকটা চিন্তামুক্ত হই।
কিন্তু, সামনে আমাদের জন্য কতটুকু ভয়াবহ ছিলো তা ভাবতেও পারিনি।
তুই উঠে আগেই ওয়াশরুমেই চলে গেলি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন তুই আসছিস না, তখন তোর মা’কে বললাম তোকে ডেকে আনতে।
তোর মা তোকে ওয়াসরুমের সামনে যেয়ে অনেকবার ডাক দেয় কিন্তু, তুই কোনো সাড়া দিচ্ছিস না দেখে দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে যায়, আর ভিতরে তাকাতেই তোর মা ভয়ে চিৎকার যে করবে তার সেই শক্তিটুকু ছিল না।
শুধু তোর মা আমার নাম ধরে একটা ডাক দিয়েছিল, আমি শুনতে পেয়ে সেখানে গেলাম।
গিয়ে দেখি তোর মা ওয়াশরুমের বাইরে দাড়িয়ে ভিতরের দিকে ভয় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি তোর মার দৃষ্টি অনুসরণ করলাম এবং যা দেখলাম, তোকে বললে মা তুই বিশ্বাস করবি কি না জানি না, তারপরও বলি,
তুই ওয়াসরুমের ফ্লোরে শুয়ে আছিস, আর তোর আশেপাশে অসংখ্য সাপ যাদের গায়ের রং ছিল নীল।
আমি ভয় পাচ্ছিলাম, কিন্তু তোর মা’কে বুঝতে না দিয়ে তোকে ডাক দিলাম।
তুই প্রথমে আমার ডাকে সাড়া দিসনি, দ্বিতীয়বার তোকে আবারও ডাকলাম।এবার তুই উঠে আমার দিকে তাকালি কিন্তু মা তোর দু’টো চোখ যেন তোর ছিল না, কারণ দু’টো চোখের মাঝে কোনো মনি ছিল না একবারেই সাদা ছিল ।
তোর মা তোর চোখদুটো দেখে ভয়ে চিৎকার শুরু করলো।
তোর মায়ের চিৎকার শুনে আব্দুল ভাই আর রাক্বী উনারা দুজনেই চলে আসে ওয়াসরুমের সামনে। এসেই তোকে এই অবস্থায় দেখে তারাও ভড়কে যায়।
রাক্বী এবার তোর মা’কে বলল একটু পানি নিয়ে আসতে। তোর মা চটজলদি পানি এনে রাক্বীর কাছে এনে দিল।
পানিতে কিছু সূরা পড়ে সেই পানি ছিটা দিলো তোর উপর এবং জোড়ে জোড়ে কুরআনের কিছু আয়াত পড়তে শুরু করেছেন, এতেই তুই যেন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলি।
তুই কান চেপে চিৎকার শুরু করলি আর বলতে থাকলি কিছু অজানা ভাষা, যা আমাদের কারোর বোধগম্য হচ্ছিল না।
রাক্বী তোর গায়ে পানি টুকু ছিটিয়ে দিলেই তোর সাড়া গায়ে যেন কেমন কাপন দিয়ে উঠতো।
অনেকক্ষণ ধরেই এভাবে চলতে থাকলো, তোর মা তোর এরকম অবস্থা সইতে পারছিলো না।
তুই এবার এমন কিছু বললি যা আমরা উপস্থিত সবাই বুঝতে পারলাম, তোর কন্ঠ হয়ে পরেছে পুরুষ কন্ঠের ন্যায়। তুই বলছিস,
– এই শয়তান, তোর এই কি সব যেন পরছিস এগুলো বন্ধ কর? নয়তো এর পরিমাণ ভালো হবে না বলছি!
– আমি এইসব পড়া বন্ধ করে দেব, আগে তুই বল তুই কে? কেন এসেছিস এই মেয়ের কাছে?
– এই, ইনসানের বাচ্চা এই মেয়ে তুই কাকে বলছিস, ও হচ্ছে আমার হুমায়রা।
আমি হচ্ছি আয়রাব বিন মেহতাব। আমি ইফ্রিত বংশের ক্ষমতাসীন জ্বীন।
– আসসালামু আলাইকুম, আপনি অনেক শক্তিশালী ও আল্লাহর সৃষ্টির আশরাফুল মাখলুকাতের কাছে অতি নগন্য।
কিন্তু, আপনি কায়নাতের সাথে থেকে কেন ওকে বিরক্ত করছেন বলবেন একটু?
– বলব, তবে ওয়াদা করতে হবে। আমাকে আমার হুমায়রার থেকে আলাদা করার কথা ভুলেও চিন্তা করতে পারবি না।
বলেই অট্টহাসিতে মেতে পড়লো কায়নাতের শরীরে আশ্রয় নেয়া জ্বীন আয়রাব।
হাসি থামিয়ে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো কাচের ডাইনিং টেবিলের উপর যা মূহুর্তের মাঝে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
থেমে গেলেন শাহিন, আর কায়নাত সে তো ভয়ে কাপছে, এ কোন বিপদে পরলো সে।
এই অদৃশ্য সত্তা তার পিছু নিয়েছে বা কেন?
তার শরীর মাঝে কেউ প্রবেশ করে এত অঘটন ঘটালো আর ও কিছুটি টের পেল না।
কায়নাতের বাবা এক গ্লাস পানি খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো।
– আমি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে বেড়াই,
এবার এলাম আপনাদের এলাকায় সামনের পাহাড়টিতে। সেখানে কয়েকদিন ধরেই আমার যাতায়াত।
হঠাৎ, একদিন বৃষ্টি পরার আভাস দেখা গিয়েছিল প্রকৃতির মাঝে তাই বৃষ্টি থেকে বাচতে আমি দ্রুত উড়ে পাহাড়ের গর্তে পৌঁছাতে চাচ্ছিলাম।তবে পথে মধ্যে এক ছাদের মাঝে আমার নজর আটকে যায় এক মেয়ের উপর। সেই ছিল কায়নাত ওরফে আমার হুমায়রা।
এরপর থেকে তাকে দেখতে আমি এই বাড়ির ছাদে বসে থাকতাম। কখন আমার হুমায়রা আসবে কখন আমি তাকে দুচোখ ভরে দেখব?
আস্তে আস্তে তাকে দেখার পরিমাণ টুকু বেড়ে গেল।
তাই প্রতিরাতে তার শোবার ঘরে চলে যেতাম। সারারাত তাকে দেখতাম, ফজরের আযানের সময় হলেই ফিরে যেতাম পাহাড়ে।
কিন্তু, কিভাবে যেন উনারা বুঝে যায় তাদের মেয়ের উপর নজর পড়েছে?
তাই এই বুড়োর(অর্থাৎ,আব্দুল আঙ্কেল) কাছে যেয়ে পানি পড়া নিয়ে আসে যার দরুন আমি আমার হুমায়রার কাছে যেতে পারছিলাম না।
কিন্তু, আমার ভাগ্য আমার উপর সহায় ছিল আজ হুমায়রার শরীর মেয়েলী সমস্যায় আক্রান্ত হয়।এবং সে ছাদে আসে তখনই আমি তার শরীরের ভিতর আশ্রয় নেই।
তাই এখন শত চেষ্টা করলেও আমাকে আমার হুমায়রা থেকে আলাদা করতে পারবি না।
বলেই অট্টহাসিতে মেতে উঠলো আয়রাব যে এখন কায়নাতের দেহে অবস্থান করছে।
-জানিস না মা তার এই হাসিতে আমরা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম কি ভাবে তোকে রক্ষা করব এই শয়তান জ্বীন থেকে?
কিন্তু, কথায় আছে না প্রত্যেক সমস্যার সমাধান আছে। ঠিক ভাবে আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তোর আব্দুল আঙ্কেলের উসিলায় তুই এখন আমাদের মাঝে আছিস।
আব্বুর কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পরলাম।
তাহলে কি আব্দুল আঙ্কেলের কোনো ক্ষতি
করেছে সেই অদৃশ্য সত্তা?
চলবে