#কৃষ্ণকলির গল্প-06 last
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম
শক্ত করে হাতের মুঠো, চোখে সপ্নের রংতুলি
পরনিন্দা করে না পরোয়া,অদম্য নারী কৃষ্ণকলি!
নাজির হোসেনের বাড়িতে দুপুর থেকে হৈচৈ চলছে। বুক ভরা প্রশান্তি নিয়ে উচ্ছাসে জনে জনে মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন তিনি। সকলের কাছে মিনতির সুরে মেয়ের জন্য দোয়া চাইছেন বাবা নাজির হোসেন। বারান্দায় পাতা চেয়ারটায় বসে বাবার কর্মকাণ্ড দেখে হেসে হুটোপুটি খাচ্ছে প্রিয়তা। নিজের মাঝেও আনন্দের ছড়াছড়ি। এমন সুখের মুহুর্তের জন্যই যেনো সে এতোদিন উৎ পেতে অপেক্ষা করছিলো।
‘সেদিন শুভ্র যখন রক্তাক্ত প্রিয়তাকে হসপিটালের বেডে রেখে চোরের মতো পালিয়ে আসে তখন কোনোমতে আমতা আমতা করে বাবার নাম্বার টা ডক্টর কে বলতে পেরেছিলো সে। ডক্টর তখন প্রিয়তার বাবাকে ফোন করে হসপিটালে আসতে বলে। গ্রাম থেকে শহর বেশ খানিকের মতো। নাজির হোসেন ফোন পাওয়ার সাথে সাথে রওনা দিলেও হসপিটাল পৌছতে পৌঁছতে পরদিন ভোর হয়ে যায়। প্রিয়তাকে তখনও অটিতে নেওয়া হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই বেডে ফেলে রাখা হয়েছে। টাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় হসপিটালের গাইনি ডক্টরের সাহায্যে প্রিয়তার মৃত বাচ্চার এবরশন করানো হয়। যার দরুন প্রিয়তার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে।
‘নাজির হোসেন হসপিটালে পৌছানোর পর প্রিয়তা বাবাকে অনুরোধ করে বলে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। হসপিটাল তার কাছে মৃত্যু সমতুল্য মনে হচ্ছে। মৃত্যু হলে তার বাড়িতেই হোক। এখানে দম বন্ধ লাগছে।
নাজির হোসেন এ অবস্থায় প্রিয়তাকে বাড়ি নিতে না চাইলেও প্রিয়তার জোরাজোরির কাছে তিনি হার মানেন। বাড়ি নিয়ে যেতে বাধ্য হন। হসপিটাল থেকে আসার সময় প্রিয়তা ডক্টরের কাছে দু হাত জোর করে বলে আসে,
‘কেউ যদি তার খোঁজ নিতে আসে কোনোদিন, তখন বলবেন সেদিন ই প্রিয়তার মৃত্যু হয়েছে। যেদিন তাকে হসপিটালে অবহেলায় ফেলে যাওয়া হয়েছিল।
চলে আসে হসপিটাল থেকে। অসুস্থ দুটি চোখে প্রিয়তা সেদিন সপ্ন একেছিলো যদি কখনও নিজের পায়ে দাড়াতে হয়, তবে নতুন করে ডক্টরের পেশায় নিজেকে জন্ম দিবো। এই প্রিয়তার মতো অন্য কোনো প্রিয়তা যেনো স্বামীর অত্যাচারে দগ্ধ হয়ে হসপিটালের বেডে চিকিৎসার অভাবে আর না কতরায়।
‘সেই থেকে ডাক্তার হওয়ার সপ্ন প্রিয়তার বুকে একটু একটু করে লালিত হতে থাকে। গায়ের রং একটু ময়লা হওয়ায় সহপাঠী থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশীর কাছে প্রতিনিয়ত হেয় হেয়েছে সে। কথায় আহত হয়ে ঘর বন্দী হয়ে কেঁদেছে। হাজার বার ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। কিন্তু থেমে থাকেনি। নিজের ভাঙা সত্তাকে পুনরায় জোড়া লাগিয়ে নিজের সপ্নের পথে হেঁটেছে। দিন রাত এক করে পড়াশোনায় নিজকে ব্যস্ত রেখেছে। কে কি বললো না বললো সেসব কথায় কান দেওয়ার সময় বোধ হয় সচেতন মেয়েদের থাকেনা। সকলের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সে। মাসেক দুয়েক পরে রেজাল্ট প্রকাশ হয়। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে প্রিয়তা। সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে আনন্দ নগর,তার নিজ জেলায় প্রথম হয়।
‘সেদিনও সে হেসেছিলো। তবে আজকের মতো না। আজ তার এডমিশন টেষ্টের রেজাল্ট প্রকাশ হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। তার খুশী আর দেখে কে। সমস্ত বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে আজ সে তার সপ্নের পথে এসে দাড়িয়েছে। এবার পাকাপোক্ত ভাবে সপ্ন পূরনের পালা।
‘ঘড়ির কাটায় কাটায় কেটে গেলো দীর্ঘ পাঁচ পাঁচ টা বছর। প্রিয়তা এখন শহরের বুকে নাম করা এমবিবিএস ডক্টর। আর এই পাঁচ বছরে আমার হাড্ডিসার অবস্থা। দৈহিক সৌন্দর্য্য বলতে আমার আর কিছু নেই। থেরাপি নিতে নিতে শরীর ভেঙেচুরে বিধ্বস্ত অবস্থা। আজ আমার কিছুই নেই। আমি মৃত্যু পথযাত্রী। গত এক বছর যাবত আমি হসপিটালে ভর্তি। বাবা মা মাঝে মাঝে এসে দেখে যায় আমাকে। এই পাঁচ বছরে আমি অনেক খুঁজেছি প্রিয়তাকে। কোথাও পাইনি। অথচ এতো বছর পর আজ প্রিয়তা আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। আমার নিষ্ঠুর নিয়তি এই বিধ্বস্ত শুভ্র কে টেনে হিচড়ে প্রিয়তার সামনে এনে দাড় করিয়েছে।
‘প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো এই শুভ্র কে চিনতে তার কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু প্রিয়তার চোখে মুখে আমার জন্য বিন্দু মাত্র অনুশোচনা আমি দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ হসপিটালের এই রুমটা ফাঁকা হয়ে গেলো। প্রিয়তার পাশে যে দুজন নার্স ছিলো তারা নিজেদের কাজে চলে গেলো। রুমে প্রিয়তা আর আমি একা। প্রিয়তা তখনও অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার চাহনি আমাকে লজ্জা দিচ্ছে। কাজলহীন নিরব চোখের চাউনিটা যেনো আমার দিকে চেয়ে বিদ্রুপ করছে। মনে হচ্ছে প্রিয়তা এখনি মুখ ফুটে বলে উঠবে,
‘নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, তাই না শুভ্র? যে বেডে শুয়ে আমি একদিন গলা কাটা মুরগির মতো কাতরাচ্ছিলাম আজ সে বেডেই আপনি শুয়ে আছেন মৃত্যু পথযাত্রী হয়ে। আল্লাহ ছেড়ে দিলেও ছাড় দেন না কাউ কে।
কিন্তু নাহ। প্রিয়তা তেমন কিছুই বললো না। আমি একটু নড়েচড়ে উঠলাম। প্রিয়তা চোখের পলক ফেললো। মিইয়ে যাওয়া গলায় খুব কষ্টে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেমন আছো প্রিয়তা?
‘প্রিয়তা কথা বলছে না। খেয়াল করলাম প্রিয়তার চোখের পানিতে ঝাপসা হয়ে উঠেছে চশমার স্বচ্ছ কাচ। প্রিয়তা সেই চোখের পানি লুকানোর কসরত করে যাচ্ছে। প্রিয়তাকে চুপ থাকতে দেখে আমি আবার বললাম,
‘আমার দম ফুরিয়ে এসেছে প্রিয়। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?
প্রিয়তা একবার তাকালো আমার দিকে। চোখ থেকে চশমা খুলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
‘ক্ষমা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর একটি শব্দ। সেই সুন্দর শব্দ টি সব জায়গায় ব্যবহার করাটাও অপরাধ। আজন্ম পাপ।
‘তবে কি আমি ক্ষমার অযোগ্য? মাফ পাবো না?
‘আমি না হয় মাফ করলাম আপনাকে। কিন্তু আমার নিষ্পাপ বাচ্চা টা কি মাফ করবে আপনাকে? সে তো কত যন্ত্রণা নিয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে এ পৃথিবীতে থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। তার কাছে কিভাবে মাফ চাইবেন?
প্রিয়তার এই কথাটা শুনে বুক টা ধুক করে উঠলো। মনে হতে লাগলো,’ আসলেই কত নিকৃষ্ট মানুষ আমি! শুনেছি সব মানুষ খারাপ হলেও বাবারা নাকি কখনো খারাপ হয় না। অথচ সেই থিওরিতেই আমি জঘন্য একজন মানুষ। একজন খুনী বাবা।
হঠাৎ বুকের ব্যথাটা বাড়তে লাগলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস উঠছে। শরীর টা অবশ অবশ লাগছে। বন্ধ হয়ে আসছে চোখ। প্রিয়তার কি হলো কে জানে। সে আমার পাশে এসে বসলো। অসুস্থতায় কুকড়ে যাওয়া হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ভেজা গলায় বলে উঠলো,
‘পৃথিবীতে রুপ টায় যদি সব কিছু হতো তবে পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত রুপের হাট বসে যেতো। আপনার জীবনটাও আজ অন্য রকম হতো। আপনি চাইলেই হয়তো আমি আপনার থেকে যেতাম। আমরা এক সাথে বাচতাম। কোনো এক জ্যোৎস্না রাতে দুজনে চাঁদের বৃষ্টিতে ভিজতাম। অথচ আপনি আমার কালো রং টাকে ঘিরে ধরে আমাকে অন্ধকারে ঠেলে দিলেন। আমিও নিকষ কালো অন্ধকারে তলিয়ে গেলাম। কিন্তু হারিয়ে যাইনি। নতুন করে বাঁচতে শিখছি। নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে টিকে রয়েছি। এই নির্মম নিষ্ঠুর পৃথিবী কে জানিয়ে দিয়েছি,বুঝিয়ে দিয়েছি,
‘পৃথিবীটা শুধু সাদা চামড়ার মানুষের জন্য নয়। আমরা কালো চামড়ার মেয়েরাও পৃথিবী কে বদলে দিতে পারি। ভালো কিছু করতে পারি। স্বামী, সংসার আমরাও সামলাতে পারি। শুধু পার্থক্য একটু আপনার মতো মানুষের মস্তিষ্কে। আপনারা যেখানে আমাদের সম্বোধন করেন কালি পুজো বলে সেখানে বাবা আমাদের আদর করে ডাকে কৃষ্ণকলি। এ ডাক-ই আমাদের শক্তি। আমাদের এগিয়ে চলার মুল চাবিকাঠি। কৃষ্ণকলিদের জীবন উপন্যাসের সেরা উক্তি। দিন শেষে আমাদের গল্পে বাবাদের কৃষ্ণকলিরাই সেরা। আমরাও সব পারি। আমরা তুচ্ছ নই।
একদমে কথা গুলো বলে লম্বা একটা শ্বাস নিলো প্রিয়তা। হাতের মুঠো নরম হলো। হাত দুটো ছেড়ে উঠে দাড়ালো । চোখের চশমা টা ঠিক করে পড়তে পড়তে স্ব দম্ভে এগিয়ে চললো নিজের গন্তব্যে।
‘আমি নির্বাক। নির্লিপ্ত চোখে দেখলাম প্রিয়তার চলে যাওয়ার পথ কতটা সুন্দর! কতটা প্রশস্ত! অসহায় দুটি চোখ বুজে যাওয়ার আগে আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম
‘প্রিয়তার চাল চলনে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে সেই অপ্রিয় সত্যের সেই নির্মম শব্দ গুচ্ছ,
‘আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না কাউকে!
________সমাপ্ত __________